জিহ্বার ক্ষতির ও নীরবতার ফজিলত

 

জিহ্বা আল্লাহ পাকের এক বিরাট নেয়ামত

        জিহ্বা আকারে একটি ক্ষুদ্র মাংশপিণ্ড হইলেও ইহা আল্লাহ পাকের এক বিরাট নেয়মত এবং তাঁহার সূক্ষ্ম কারিগরিসমূহের অন্যতম নিদর্শন। মোমেনের ঈমানরূপ শ্রেষ্ঠ নেয়মত এই জিহ্বার মাধ্যমেই প্রকাশ পায় এবং মানুষের চূড়ান্ত বিনাশ ও বরবাদী তথা কুফরীর মত সর্বনাশা পরিণতিও এই জিহ্বার মাধ্যমেই প্রকাশ পায়। অর্থাৎ ঈমান-এবাদত, আনুগত্য ও এতায়াতের ক্ষেত্রে এই জিহ্বার ভূমিকা যেমন ব্যাপক, তদ্রূপ অনাচার-অনাসৃষ্টি ও পাপাচারের ক্ষেত্রেও এই জিহ্বার ভূমিকা সর্বাধিক।

        মোটকথা, ভাল-মন্দ ও কল্যাণ-অকল্যাণ, জ্ঞাত-অজ্ঞাত এবং সৃষ্টি হউক বা স্রষ্টা, বাহ্যিক হউক বা পর্দার অন্তরালে ইত্যাদি প্রতিটি বস্তুই এই জিহ্বায় আসিয়া উচ্চারিত হয়। উদাহরণতঃ মানুষের এলেম ও জ্ঞানের পরিধিতে যাহাকিছু বিদ্যমান, অর্থাৎ- মানুষ যাহাকিছু দেখে, শোনে ও উপলব্ধি করে- চাই তাহা সত্য হউক বা মিথ্যা উহার সকল কিছুই এই জিহ্বার মাধ্যমে উচ্চারিত ও বর্ণিত হয়। জিহ্বার বৈশিষ্ট্য এখানেই। অর্থাৎ- মানব দেহের অপরাপর অঙ্গসমূহ হয়ত বিশেষ কোন অবস্থা ও বস্তুবিশেষকেই উপলব্ধি করিতে পারে; কিন্তু জিহ্বা মানবের উপলব্ধির সকল কিছুই প্রকাশ করিতে পারে। যেমন- চক্ষু কেবল বস্তুসমূহের রং ও আকৃতিকেই উপলব্ধি করিতে পারে, উহার অতিরিক্ত তাহার করিবার কিছুই নাই। কান কেবল আওয়াজ ও শব্দ শুনিতে পায়। হাতের শক্তি কেবল স্পর্শ করা। কিন্তু জিহ্বার শক্তি আরো ব্যাপক ও বিস্তৃত। কল্যাণ ও পুন্যের ক্ষেত্রে ইহা যেমন মানুষকে অন্তহীন সৌভাগ্যের অধিকারী করিতে পারে; তদ্রূপ পাপ-অকল্যাণ ও বরবাদীর ক্ষেত্রেও ইহা মানুষকে চরম পরিণতি ও ধ্বংসের অতল গহবরে নিক্ষেপ করিতে পারে। এই কারণেই জিহ্বার উপর পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আবশ্যক। যেই ব্যক্তি জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখিতে পারিবে না, শয়তান তাহার মুখ দিয়া কত কি বলাইয়া তাহাকে জাহান্নামের কোথায় নিয়া নিক্ষেপ করিবে উহার কোন ঠিকঠিকানা নাই। হাদীসে পাকে এরশাদ হইয়াছে-

وَ لَا يَكُبُّ النَّاسَ فِي النَّارِ عَلَى مَنَاخِرِهِمْ إِلَّا حَصَائِدُ الْسِنَتِهِمْ

     অর্থ: "জিহ্বার ফসলই মানুষকে উপুড় করিয়া দোজখে নিক্ষেপ করে।"

        জিহ্বার ক্ষতি হইতে কেবল তাহারাই বাঁচিয়া থাকিতে পারিবে যাহারা উহাকে শরীয়তের লাগাম ও সুন্নতের শিকলে আবদ্ধ করিয়া রাখিবে এবং যেই সময় উহা দ্বীন-দুনিয়ার ভালাই ও কল্যাণের কথা বলিবে কেবল তখনই উহাকে মুক্তি দিবে।

        কোন্ কথাটি ভাল এবং কোল্টিন্ট মন্দ, কোন্ ক্ষেত্রে জিহ্বাকে কথা বলার অনুমতি দেওয়া যাইবে এবং কোন্ ক্ষেত্রেই বা উহাকে নিয়ন্ত্রণে রাখিতে হইবে, এই সকল বিষয় সঠিকভাবে চিহ্নিত করা নিতান্তই দুরূহ বটে। তদুপরি এই সকল বিষয়ে অবগতি লাভের পরও উহার উপর আমল করা আরো কঠিন।

        মানবের অঙ্গসমূহের মধ্যে জিহ্বাই সর্বাপেক্ষা অবাধ্যতা ও নাফরমানী করিয়া থাকে। কেননা, এই জিহ্বা অতি সহজেই সঞ্চালন করা যায় এবং ইহাতে কিছুমাত্র কষ্ট করিতে হয় না। মানুষ এই জিহ্বার ক্ষতিকে মামুলী মনে করিয়া ইহা হইতে বাঁচিয়া থাকার ব্যাপারে বড় অবহেলা করিয়া থাকে। অথচ এই জিহ্বার মাধ্যমেই শয়তান মানুষকে বিপথগামী করিয়া থাকে। বক্ষমান বিবরণে আমরা পর্যায়ক্রমে জিহ্বার ক্ষতি, উহার উপকরণ, অনিষ্টের পরিমাণ এবং উহা হইতে আত্মরক্ষার উপায়-উপকরণ ইত্যাদি বিষয়ের উপর বিস্তারিত আলোচনা করিব।

জিহ্বার ক্ষতি ও নীরবতার ফজিলত

        জিহ্বার ক্ষতির পরিধি ব্যাপক-বিস্তৃত এবং উহার পরিণতিও বড় ভয়াবহ। ইহা হইতে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় হইল নীরব থাকা। এই কারণেই শরীয়তে নীরব থাকার প্রশংসা করিয়া উহার প্রতি উৎসাহিত করা হইয়াছে। রাসূলে আকরাম ছাল্লাল্লা আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন-

مَنْ صَمَتَ نَجا
    "যে নীরব থাকে সে মুক্তি পায়।” (তিরমিযী) 

        অন্য রেওয়ায়েতে আছে-

الصِّمْتُ حِكْمَةٌ وَقَلِيلٌ فَاعِلٌ

    অর্থাৎ- "নীরব থাকা হইল হেকমত ও প্রজ্ঞা। (কিন্তু) কম লোকই উহার উপর আমল করে।"

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সুফিয়ানের পিতা বর্ণনা করেন, একবার আমি রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করিলাম, ইসলাম সম্পর্কে আমাকে এমন কোন কথা বলিয়া দিন যেন আপনার পরে আর কাহারো নিকট কিছু জিজ্ঞাসা করার প্রয়োজন না হয়। আমার এই নিবেদনের জবাবে তিনি এরশাদ করিলেন-

قُلْ أَمَنْتُ بِاللَّهِ ثُمَّ اسْتَقِمْ

    অর্থাৎ- "বল, আল্লাহর উপর ঈমান আনিলাম। অতঃপর এই ঈমানের উপর কায়েম থাক।"

        আমি আরজ করিলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কোন্ বিষয় হইতে বাঁচিয়া থাকিব? জবাবে তিনি জিহ্বার দিকে ইশারা করিয়া বলিলেন, ইহা হইতে বাঁচিয়া থাক। 
 (তিরমিজী, নাসাঈ, ইবনে মাজা, মুসলিম)

        হযরত ওকবা বিন আমের (রাঃ) বলেন, একবার আমি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করিলাম, নাজাতের উপায় কি? তিনি এরশাদ করিলেন,

امسك لِسَانَكَ وَ يَسْعَكَ بَيْتُكَ وَابْكَ عَلَى خَطِيئَتِكَ

        অর্থঃ "জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণে রাখ, তোমার ঘর যেন তোমার জন্য যথেষ্ট হয় (অর্থাৎ ঘর হইতে বাহির হইও না) এবং নিজের গোনাহের জন্য (অনুশোচনার) অশ্রু বর্ষণ কর।”         (তিরমিজী)

        আল্লাহর হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যেই ব্যক্তি আমাকে উভয় কানের মধ্যখানের বস্তু অর্থাৎ জিহ্বা এবং দুই রানের মধ্যস্থানের বস্তু অর্থাৎ লজ্জাস্থানের নিশ্চয়তা দিবে, আমি তাহাকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিব।         (বোখারী)

        অন্য হাদীসে আছে, "যেই ব্যক্তি নিজের উদর, লজ্জাস্থান ও জিহ্বার ক্ষতি হইতে বাঁচিয়া থাকে, সেই ব্যক্তি সর্বাধিক অনিষ্ট হইতে নিরাপদ থাকে।"

        কেননা, মানুষ ব্যাপকভাবে এই তিনটি অঙ্গের খাহেশের কারণেই বিপথগামী হইয়া থাকে।

        একবার নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা কর। হইল, কোন্ বিষয়ের কারণে মানুষ অধিক পরিমাণে জান্নাতে যাইবে? জবাবে তিনি এরশাদ করিলেন- تقوى الله وحسن الخلق অর্থাৎ "আল্লাহর ভয় ও সচ্চরিত্রতার কারণে।” পুনরায় আরজ করা হইল, সেই বিষয়টিও বলিয়া দিন যার কারণে মানুষ জাহান্নামে যাইবে। এরশাদ হইল-

الْأَجُوفَانِ الفَمِ وَ الْفَرْجُ 

        অর্থাৎ- "দুইটি খালি বস্তুর কারণে- মুখ ও লজ্জাস্থান।"

(তিরমিজী, ইবনে মাজা)

        এখানে মুখের অর্থ জিহ্বাও হইতে পারে। কেননা, মুখ হইল জিহ্বার আবাস। তাছাড়া মুখের অর্থ পেটও হইতে পারে। কারণ মুখের মাধ্যমে বা মুখের পথ দিয়াই পেট ভরা হয়।

        একদা হযরত আব্দুল্লাহ ছাকাফী (রাঃ) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কোন বিষয় বলিয়া দিন যেন সারা জীবন উহার উপর আমল করিতে পারি। তিনি বলিলেন,

قُلْ رَبِّي اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقِيمُ

        অর্থঃ "তুমি বল, আল্লাহ আমার প্রতিপালক। অতঃপর উহার উপর কায়েম থাক।"

        ছাহাবী আরজ করিলেন, আপনি আমার সম্পর্কে কোন্ বিষয়টির অধিক আশংকা করিতেছেন? জবাবে তিনি স্বীয় জিহ্বা মোবারক স্পর্শ করিয়া বলিলেনঃ ইহা সম্পর্কে। (নাসাঈ)

        হযরত মোয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সর্বোত্তম আমল কোনটি? জবাবে তিনি নিজের জিহ্বা মোবারক বাহির করিয়া উহার উপর আঙ্গুল স্থাপন করিলেন, অর্থাৎ নীরব থাকা সর্বোত্তম আমল। (তাবরানী, ইবনে আবিদ্দুনয়া)

        হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেনঃ বান্দার ঈমান ততক্ষণ পর্যন্ত ঠিক হয় না, যতক্ষণ তাহার কূলর ঠিক না হয়। বান্দার কূলব ততক্ষণ ঠিক হয় না, যতক্ষণ তাহার জিহ্বা ঠিক না হয়। আর সেই ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করিতে পারিবে না, যার ক্ষতি হইতে তাহার প্রতিবেশী নিরাপদ নহে।

(ইবনে আবিদ্দুনয়া)

এক হাদীছে আছে-

من سره أن يسلم فليلزم الصمت

        "যেই ব্যক্তি শান্তি পছন্দ করে, সে যেন নীরবতা অবলম্বন করে।"

(বায়হাকী, ইবনে আবিদ্দুনয়া)

        হযরত সাঈদ ইবনে জোবায়ের (রাঃ) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এরশাদ নকল করেনঃ যখন সকাল হয় তখন মানুষের সকল অঙ্গ জিহ্বাকে বলে, আমাদের বিষয়ে তুমি আল্লাহকে ভয় কর; তুমি ঠিক থাকিলে আমরাও ঠিক থাকিব। আর তুমি বক্র হইলে আমাদের অবস্থাও অনুরূপ হইবে।

(তিরমিজী)

        একদা হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ)-কে নিজের জিহ্বা টানিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, হে রাসূলের খলীফা! আপনি ইহা কি করিতেছেন? জবাবে হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) বলিলেন, এই জিহ্বাই আমাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছাইয়া দিয়াছে।

        আল্লাহর রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিয়াছেনঃ দেহের প্রতিটি অঙ্গই আল্লাহ পাকের নিকট জিহ্বার ক্ষিপ্রতা প্রসঙ্গে অভিযোগ করে।

        হযরত ইবনে মাসউদ (রাঃ) হইতে বর্ণিত যে, তিনি সাফা পাহাড়ে আরোহণ করিয়া তালবিয়া পাঠ করিতেছিলেন এবং নিজের জিহ্বাকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছিলেন-

        অর্থঃ "হে জিহ্বা! ভাল কথা বল, লাভবান হইবে এবং অনিষ্ট হইতে নীরব থাক, বিপদমুক্ত থাকিবে।"

        লোকেরা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি যাহা বলিতেছেন, ইহাকি আপনার নিজের কথা, না অপর কাহারো নিকটু শুনিয়াছেন? তিনি বলিলেন, আমি নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিহ্বা সম্পর্কে বলিতে শুনিয়াছি-

        "বনী আদমের অধিকাংশ গোনাহ হইল তাহার জিহ্বার মধ্যে।"

(তাবরানী, বায়হাকী)

        হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) নিম্নের হাদীসটি বর্ণনা করেন- 

مَنْ كَفَّ لِسَانَهُ سَتَرَ اللهُ عَوْرَتَهُ وَ مَنْ مَلَكَ وَقَاهُ اللَّهَ عَذَابَهُ وَ مَنِ اعْتَذَرَ إِلَى اللَّهِ قَبِلَ اللَّهُ عُذْرَهُ

        অর্থঃ "যেই ব্যক্তি নিজের জিহ্বা সংযত রাখে, আল্লাহ পাক তাহার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখেন। যেই ব্যক্তি ক্রোধ দমন করে, আল্লাহ পাক তাহাকে আজাব হইতে রক্ষা করেন। যেই ব্যক্তি আল্লাহ পাকের নিকট ওজর করে, আল্লাহ পাক তাহার ওজর কবুল করেন।"

        একদা হযরত মোয়াজ ইবনে জাবাল (রাঃ) নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে আরজ করিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে কিছু ওসীয়ত করুন। হযরত মোয়াজের নিবেদনের জবাবে আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেনঃ তুমি এমনভাবে আল্লাহ পাকের এবাদত কর যেন আল্লাহকে দেখিতেছ। নিজের নক্সকে মৃতদের মধ্যে গণ্য কর। তুমি যদি চাও, তবে আমি তোমাকে এমন বিষয় বলিব যাহা এই সমুদয় বিষয় অপেক্ষা উত্তম; অতঃপর তিনি হাত দ্বারা নিজের জিহ্বার দিকে ইশারা করিলেন। (ইবনে আবিদ্দুনয়া, তাবরানী)

        হযরত সাফওয়ান বিন সলীম (রাঃ) হইতে বর্ণিত, একদা রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেনঃ আমি কি তোমাদিগকে এমন এবাদতের কথা বলিব না, যাহা খুবই আছান এবং শরীরের জন্যও অত্যন্ত সহজ? (সেই এবাদত হইল) চুপ থাকা এবং উত্তম স্বভাব। (ইবনে আবিদ্দুনয়া)

        হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত, রাসূলে আকরাম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন-

مَنْ كَانَ يُؤْمِنُ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَلْيَقُلْ خَيْرًا أَوْ يَسُكُتْ

        অর্থঃ "যেই ব্যক্তি আল্লাহকে এবং পরকালকে বিশ্বাস করে, সে যেন ভাল' কথা বলে অথবা নীরব থাকে।"

        হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, আমার নিকট নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই বানী নকল করা হইয়াছে যে, আল্লাহ পাক সেই ব্যক্তির উপর রহম করুন যে কথা বলিলে উপকারী কথা বলে এবং নীরবতা দ্বারা নিরাপত্তা লাভ করে। (বায়হাকী)

        এক ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ)-এর খেদমতে আরজ করিল; আমাকে এমন কোন আমল বলিয়া দিন, যাহা দ্বারা আমি বেহেশত লাভ করিতে পারিব। তিনি বলিলেন, তুমি কখনো কথা বলিও না। লোকটি আরজ করিল, ইহা তো সম্ভব নহে। তিনি বলিলেন, তুমি ভাল কথা ব্যতীত অন্য কিছু বলিও না।

        হযরত সুলাইমান (আঃ) বলেন, (মনে কর) কথা বলা যদি রূপা হয়, তবে চুপ থাকা যেন স্বর্ণ। এক বেদুঈন নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে হাজির হইয়া আরজ করিল, আমাকে এমন কোন আমল বলিয়া দিন যাহা দ্বারা আমি জান্নাত লাভ করিতে পারিব। আল্লাহর নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করিলেনঃ অভুক্তকে আহার করাও, পিপাসার্তকে পানি পান করাও, সৎকাজের আদেশ কর এবং অসৎ কাজ হইতে নিষেধ কর। তুমি যদি এইরূপ করিতে না পার, তবে ভাল কথা ব্যতীত অন্য কোন কথা বলিও না।

(ইবনে আবিদুনয়া)

        এক হাদীসে আছে- নিজের জিহ্বাকে কল্যাণকর কথা ব্যতীত অন্য সকল কথা হইতে বিরত রাখ, ফলে তুমি শয়তানের উপর প্রবল থাকিবে।

(তাবরানী, ইবনে হিব্বান)

        রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ আল্লাহ তায়ালা সকল বক্তার সঙ্গে আছেন। সুতরাং সকলেরই নিজের কথার ব‍্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা উচিত। এক রেওয়ায়েতে আছে, নবী করীম ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ মানুষ তিন প্রকার-

    ১. গনীমত আহরণকারী- যে আল্লাহকে স্মরণ করে।

    ২. বিপদাপদ হইতে নিরাপদ- যে চুপ থাকে।

    ৩. ধ্বংসপ্রাপ্ত- যে বাতিলের মধ্যে লিপ্ত।

(তাবরানী, আবু য়া'লা)

        মোমেনের জিহ্বা অন্তরের পিছনে। সে কথা বলার পূর্বে চিন্তা করিয়া তবে কথা বলে। পক্ষান্তরে মোনাফেক্টের জিহ্বা অন্তরের আগে থাকে। সে চিন্তা-ভাবনা করিয়া কথা বলে না। যাহা মনে আসে তাহাই বলে।

        হযরত ঈসা (আঃ) বলেনঃ এবাদতের দশটি অংশের মধ্যে নয়টি নীরব থাকার সহিত সংশ্লিষ্ট এবং একটি মানুষের সঙ্গ হইতে পৃথক থাকার সহিত।

        আল্লাহর হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ যেই ব্যক্তির কথা বেশী, তাহার অপরাধ বেশী। যেই ব্যক্তির অপরাধ বেশী, তাহার গোনাহ বেশী। আর যেই ব্যক্তির গোনাহ বেশী, সেই ব্যক্তি আজাবের অধিক উপযুক্ত।
(আবু নোয়াইম, আবু হাতিম, বায়হাকী)

        হযরত আবু বকর ছিদ্দিক (রাঃ) কথা বলা হইতে বিরত থাকার উদ্দেশ্যে মুখের ভিতর কংকর পুরিয়া রাখিতেন। তিনি নিজের জিহ্বার দিকে ইশারা করিয়া বলিতেন, ইহা আমার অনেক ক্ষতি করিয়াছে।

        হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, ঐ পবিত্র জাতের কসম, যিনি ব্যতীত কোন মা'বুদ নাই; মানুষের জিহ্বাই সর্বাপেক্ষা দীর্ঘ সময় কয়েদ রাখার বস্তু।

        হযরত তাউস (রহঃ) বলেন, আমার জিহ্বা হইল হিংস্র জন্তু। উহাকে মুক্ত অবস্থায় ছাড়িয়া দিলে সে আমাকে খাইয়া ফেলিবে।

        হযরত হাসান (রহঃ) বলেন, যেই ব্যক্তি নিজের জিহ্বাকে হেফাজত করে না, তাহার দ্বীনের সমঝ পরিপক্ক নহে।

        হযরত আওজায়ী (রহঃ) বলেন, একবার হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজীজ (রহঃ) পত্রযোগে আমাকে লিখিলেন- যেই ব্যক্তি মৃত্যুর কথা বেশী বেশী স্মরণ করে, সে দুনিয়ার অল্প ছামান দ্বারা তুষ্ট হয়। যেই ব্যক্তি কথাকেও আমলের মধ্যে গণ্য করে, সে অর্থহীন কথা বলে না। জনৈক বুজুর্গ ব্যক্তি বলেন, চুপ্ত থাকার মাধ্যমে মানুষের দুইটি উপকার হয়। প্রথমতঃ তাহার দ্বীন নিরাপদ থাকে, দ্বিতীয়তঃ অপরের কথা সে ভালভাবে উপলব্ধি করিতে পারে।

        একবার মোহাম্মদ বিন ওয়াসে' প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত মালেক বিন দীনারকে বলিলেন, হে আবু ইয়াহ্ইয়া! জিহ্বার হেফাজত টাকা-পয়সার হেফাজত অপেক্ষা উত্তম।

        হযরত ইউনুস বিন ওবায়েদ (রহঃ) বলেন, যেই ব্যক্তির জিহ্বা সংযত থাকে, তাহার সকল কাজ ঠিক থাকে।

        হযরত হাসান বসরী (রহঃ) বলেন, একলার কয়েক ব্যক্তি হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ)-এর দরবারে বসিয়া পরস্পর কথা বলিতেছিল। কিন্তু হযরত আহনাফ বিন কায়েস সেখানে বসিয়া তাহাদের কথা শুনিতেছিলেন। হযরত মোয়াবিয়া (রাঃ) তাহাকে বলিলেন, হে আবুল বাহার! আপনি কিছু বলিতেছেন না কেন? জবাবে তিনি বলিলেন, যদি মিথ্যা বলি, তবে অন্তরে আল্লাহর ভয় আসে। আর সত্য বলিলে তোমার ভয়ে ভীত হই।

        হযরত আবু বকর বিন আয়াস বলেন, একবার পারস্য, রোম, হিন্দুস্তান ও চীন এই চারি দেশের বাদশাহগণ এক বৈঠকে মিলিত হইলেন। এই সময় কথা প্রসঙ্গে এক বাদশাহ বলিলেন, আমি কথা বলিলে লজ্জিত হই, আর কথা না বলিলে আমাকে লজ্জিত হইতে হয় না। দ্বিতীয় জন বলিলেন, আমি যখন কোন কথা বলিয়া ফেলি, তখন সেই কথার নিয়ন্ত্রণে চলিয়া যাই এবং উহা আর আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আর যতক্ষণ সেই কথাটি না বলি, ততক্ষণ উহা আমার নিয়ন্ত্রণে থাকে। তৃতীয় জন বলিলেন, আমি এমন বক্তার কথায় বিস্মিত হই যে, সেই কথাটি যদি তাহার প্রতি ফিরাইয়াও দেওয়া হয় তবুও সে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে, আর ফিরাইয়া না দিলেও সে উহা দ্বারা লাভবান হইবে না। চতুর্থ জন বলিলেন, যেই কথাটি এখনো বলা হয় নাই, উহা প্রত্যাহার করিতে আমি সক্ষম, কিন্তু একবার মুখ হইতে বাহির হইয়া গেলে উহা আর প্রত্যাহার করা যায় না।

        মনসুর ইবনুল মো'তার দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত এশার নামাজের পর হইতে সকাল পর্যন্ত কোন কথা বলেন নাই। হযরত রবী' বিন খায়সাম দীর্ঘ বিশ বৎসর পর্যন্ত কোন রূপ পার্থিব কথা বলেন নাই। সকালে উঠিয়াই তিনি হাতের কাছে কাগজ কলম রাখিয়া দিতেন এবং কোন কথা বলিলে সঙ্গে সঙ্গে তাহা লিখিয়া রাখিতেন। সকল কাজ-কর্ম শেষে রাতে হিসাব লইয়া দেখিতেন- কোন কথাটি কি কাজে বলা হইয়াছে।

Post a Comment

0 Comments