মহিলাদের রসুলের প্রতি ভালবাসা কেমন ছিল

 কে শহীদ হয়েছে জানতে চাইনা

        হযরত মুসআব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দেখতে ছিলেন অনেকটা বিশ্বনবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত। ওহুদের ময়দানে পাপিষ্ঠ ইবনে কামিয়াহ আল্লাহর নবীর এই সাহাবীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ভেবেছিল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করেছি। এ কারণে সে চিৎকার করে বলেছিল, 'আমি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যা করেছি।'

        মদীনা শহরে যখন সংবাদ পৌছেছিল, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবিত নেই তখন মদীনার আবাল বৃদ্ধ বনিতাগণ দলে দলে মাতম করতে করতে ওহুদের ময়দানের দিকে ছুটে এসেছিল। বনী দিনার গোত্রের একজন মহিলা ওষুদের দিকে ছুটে আসছিল। এই মহিলার স্বামী, পিতা ও ভাই ওহুদের যুদ্ধে এসেছিল। মহিলা যখন পাগলিনীর ন্যায় ছুটে আসছিল, তখন একজন তাঁকে জিজ্ঞাসা করলো, 'ওহে মহিলা! তুমি কোথায় যাচ্ছো? মহিলা বলেছিল, 'আমি ওহুদের ময়দানে যাচ্ছি।'

        লোকটি তাঁকে বলেছিল, 'ওহুদের ময়দানে যেয়ে আর কি হবে, তোমার স্বামী যুদ্ধে এসেছিল, সে শাহাদাত বরণ করেছে।' স্বামীর শাহাদাতের সংবাদ শুনে মহিলা ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন উচ্চারণ করে বলেছিল, 'কে শহীদ হয়েছে জানতে চাই না, বলো আল্লাহর হাবিব কেমন আছে?'

        মহিলা এ কথা বলেই পুনরায় ছুটছিল ওহুদের দিকে। এভাবে পরপর তাঁকে তাঁর স্বামী, ভাই ও পিতার শাহাদাতের সংবাদ শোনানো হলে প্রতিবারই সে ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন উচ্চারণ করে বলেছিল, 'কে শহীদ হয়েছে জানতে চাই না, বলো আল্লাহর হাবিব কেমন আছে?'

        মহিলা ওহুদের ময়দানে উপস্থিত হয়ে সাহাবায়ে কেরামের কাছে জানতে চাইলো, 'বলো আল্লাহর হাবিব কেমন আছে?' সাহাবায়ে কেরাম তাঁকে বললেন, 'আল্লাহর রাসূল ভালো আছেন, তুমি যেমন কামনা করো আল্লাহর নবী তেমনি আছেন।' মহিলা যেন কথাটি অন্তর দিয়ে গ্রহণ করতে পারলো না, বললো, 'আমি আল্লাহর নবীকে একবার দেখতে চাই, তাঁকে একটু দেখাও।'

        মহিলাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো, যেখানে সাহাবায়ে কেরাম কর্তৃক পরিবেষ্টিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বসেছিলেন। আল্লাহর রাসূলকে দেখেই মহিলা বলে উঠলো, 'হে আল্লাহর রাসূল! স্বামী, ভাই ও শিতা চলে গেছে কোন আফসোস নেই, আপনি জীবিত আছেন, এটাই জীবনের সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা।'

ওহুদের প্রান্তরে মহিলা সাহাবী

        ওহুদের প্রান্তরে মুসলিম বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকজন নারীও ছিল। তাঁরা সৈন্যদেরকে পানি পান করাতেন এবং আহতদেরকে সেবা-যত্ন করতেন। হযরত আয়েশা, হযরত আনাসের আম্মা হযরত উম্মে সুলাইম, হযরত উম্মে আম্মারা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুমা আজমাঈন প্রমুখ নারীগণ মুসলিম বাহিনীর সাথে ছিলেন। তাঁরা মশক ভর্তি করে পানি এনে সৈন্যদেরকে পান করাতেন এবং পানি শেষ হয়ে গেলে পুনরায় মশক ভর্তি করে আনতেন। সৈন্যদের ক্ষতস্থানে তাঁরা ব্যান্ডেজ বেঁধে দিতেন।

        তবে ওহুদের যুদ্ধে যত নারীই অংশগ্রহণ করে থাক না কেন, হযরত উম্মে আম্মারা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার ভূমিকার কারণে তাঁর নাম ঐতিহাসিকগণ সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করেছেন। তীরান্দাজ বাহিনীর নেতৃ আদেশ অবহেলার কারণে মুসলিম বাহিনী যখন হঠাৎ শত্রুবাহিনীর আক্রমনের শিকার হয়ে পর্যদুস্ত হয়ে পড়েছিল, তখন হযরত উম্মে আম্মারা আহত সৈন্যদের সেবা করায় ব্যস্ত ছিলেন। তিনি যখন শুনলেন শত্রু বাহিনী চিৎকার করে বলছে, 'কোথায় মুহাম্মাদ! তাঁর সন্ধান করতে থাকো, সে জীবিত থাকলে আমরা কেউ বিপদ মুক্ত নই। তাঁকে হত্যা করতেই হবে।'

        এ কথা শোনার সাথে সাথে হযরত উম্মে আম্মারা দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। তিনি দেখলেন আল্লাহর নবী যেখানে অবস্থান করছেন, সেদিকে শত্রু বাহিনী ছুটে যাচ্ছে। তিনি একজন নারী, তবুও নিজেকে স্থির রাখতে পারলেন না। তিনি পানির পাত্র সজোরে নিক্ষেপ করলেন। যৎ সামান্য যে অস্ত্র হাতের কাছে পেলেন তাই উঠিয়ে নিয়ে দ্রুত গতিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সামনে এসে উপস্থিত হলেন। একটি ঢাল যোগাড় করে তিনি শত্রুর আক্রমন প্রতিরোধ করতে লাগলেন। শত্রুর আক্রমন এতটা তীব্র ছিল যে, অনেক বিখ্যাত মুসলিম বীরও ময়দানে টিকে থাকতে পারেননি। অথচ এ ধরণের মারাত্মক এবং নাজুক পরিস্থিতিতে হযরত উম্মে আম্মারা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা অতুলনীয় বিক্রমে শত্রু বাহিনীকে প্রতিরোধ করছিলেন।

        তিনি তীর বেগে ছুটে একবার ডানে এবং আরেকবার বামে যাচ্ছিলেন, যেন শত্রু বাহিনীর কোন সদস্য আল্লাহর নবীর কাছে যেতে না পারে। হযরত উম্মে আম্মারার দুটো সন্তানও ওহুদের ময়দানে যুদ্ধ করছিলেন। শত্রু বাহিনী যখন দেখলো, এই নারীর কারণে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে পৌঁছা যাচ্ছে না, তখন তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো, এই নারীকে আগে হত্যা করে তারপর মুহাম্মাদের কাছে অগ্রসর হতে হবে। তখন শত্রু বাহিনী তাঁকেই আক্রমন করলো।

        একজন সৈন্য তাঁর দিকে অগ্রসর হয়ে তাঁর ওপরে তরবারীর আঘাত করলো। হযরত উম্মে আম্মারা সে আঘাত ঢাল দিয়ে প্রতিহত করলেন। তারপর তিনি তরবারীর আঘাত করে শত্রু সৈন্যর ঘোড়ার পা কেটে ফেললেন। ঘোড়া মাটিতে পড়ে যাওয়ার সাথে সাথে শত্রু সৈন্যও মাটিতে পড়ে গেল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দৃশ্য দেখে হযরত উম্মে আম্মারার দুই সন্তানকে তাঁদের মায়ের সাহায্যে প্রেরণ করলেন। তাঁরা অগ্রসর হয়ে শত্রুকে জাহান্নামে প্রেরণ করেছিল। এক পর্যায়ে তাঁর সন্তান আহত হলেন। তিনি সন্তানের ক্ষতস্থানে ব্যন্ডেজ করে দিয়ে আদেশ দিলেন, 'দ্রুত ময়দানে গিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ো।' 

        নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত উম্মে আম্মারার সাহসিকতা এবং নিষ্ঠা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। যুদ্ধের ময়দানেই তিনি বারবার মহান আল্লাহর কাছে তাঁর এই মহিলার জন্য দোয়া করছিলেন। তিনি অন্যান্য সাহাবায়ে কেরামকে শুনিয়ে হযরত উম্মে আম্মারার প্রসঙ্গে বলছিলেন, 'তাঁর মত সাহাস আর কার আছে!' লড়াই চলতে থাকলো, হযরত উম্মে আম্মারার সামনে এলো ঐ ব্যক্তি, যে তাঁর সন্তানকে আঘাত করেছিল। তিনি প্রতিশোধ গ্রহণ করার লক্ষ্যে শত্রুর দিকে এগিয়ে গেলেন। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে সতর্ক করে বললেন, 'হে উম্মে আম্মারা! সতর্ক হও! এই জালিম তোমার সন্তান আব্দুল্লাহকে আহত করেছে।' আল্লাহর নবীর কথা শুনে হযরত উম্মে আম্মারার শরীরে যেন সিংহের শক্তি এসে জমা হলো। তিনি তরবারী দিয়ে পুত্রের ওপর আঘাতকারীর ওপরে এমন শক্তিতে আঘাত হানলেন যে, তাঁর আঘাতে শত্রু সৈন্য দ্বিখন্ডিত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। আল্লাহর নবী এই দৃশ্য দেখলেন। একজন মহিলার বীরত্ব দেখে আনন্দে হেসে উঠে বললেন, 'ওহে উম্মে আম্মারা! তুমি তোমার সন্তানের ওপর আঘাত করার কারণে উত্তম প্রতিশোধ গ্রহণ করেছো।' মক্কার কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত বীর জাহান্নামী আব্দুল্লাহ ইবনে কামিয়ার সাথেও হযরত উম্মে আম্মারা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা ভয়ঙ্কর মুহূর্তে যুদ্ধ করেছিলেন। ইবনে কামিয়াহ বারবার রাসূলকে হত্যা করার জন্য আক্রমন করছিল। এই জালিমও রাসূলের পবিত্র দেহে আঘাত করেছিল। রাসূলের জীবনের এই কঠিন মুহূর্তে হযরত উম্মে আম্মারার মত একজন নারী নিজের জীবন বিপন্ন করে ইবনে কামিয়াকে প্রতিরোধ করছিলেন।

        আক্রমনকারী জামিলের দেহ ছিল লৌহ বর্মে আবৃত। হযরত উম্মে আম্মারা জালিমকে হত্যা করার জন্য তরবারীর আঘাত করেন। কিন্তু জালিমের দেহে বর্ম থাকার কারণে তাঁর তরবারী ভেঙ্গে গেল। জালিম এবার সুযোগ পেয়ে উম্মে আম্মারার ওপর আক্রমন করলো। হযরত উম্মে আম্মারা ঢাল দিয়ে সে আঘাত প্রতিহত করতে গিয়েও তাঁর কাঁধ মারাত্মকভাবে আহত হলো। আহত দেহেই তিনি আল্লাহর দুশমনের সাথে লড়াই অব্যাহত রাখলেন। তাঁর মোকাবেলায় টিকতে না পেরে জালিম আব্দুল্লাহ ইবনে কামিয়াহ পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বয়ং তাঁর এই মহিলার ক্ষতস্থানে ব্যন্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন আর বলেছিলেন, 'আল্লাহর শপথ! আজ উম্মে আম্মারা অনেকের চেয়ে অধিক বীরত্ব প্রদর্শন করেছে।'

        ওহুদের প্রসঙ্গ উঠলেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, 'ওহুদের দিনে আমি আমার ডানে বামে যেদিকেই তাকিয়েছি, সেদিকেই উম্মে আম্মারাকে যুদ্ধ করতে দেখেছি।'

Post a Comment

0 Comments