الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَلَمِينَ
সর্বাবস্থায় প্রশংসা হয় সুন্দরের, অসুন্দরের কোন প্রশংসা হয় না। কদর্য, কুৎসিত এবং বিভৎসতার কোন প্রশংসা হয় না। যা দৃষ্টিনন্দন, মনোমুগ্ধকর, হৃদয়গ্রাহী, চিত্তাকর্ষক প্রশংসা তারই হয়। সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতেই বলা হয়েছে, সমস্ত প্রশংসা কেবল মাত্র আল্লাহর। অন্য কোন শক্তির প্রশংসা হতে পারে না। কারণ, পৃথিবীতে মানুষ যেসব বস্তু দেখে এবং যাদেরকে শক্তির উৎস বলে মনে করে, এসব বস্তু ও শক্তির কোন প্রশংসা হতে পারে না। কেননা, বস্তু স্বয়ং দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যের পসরা ও মনোমুগ্ধকর, কল্যাণকর গুণাবলীসহ সৃষ্টি হয়নি। এর পেছনে একজন স্রষ্টা রয়েছেন। তিনিই বস্তুর ভেতরে সৌন্দর্য দান করেছেন, তার ভেতরে কল্যাণকর গুণাবলী দান করেছেন। আবার মানুষ যাদেরকে বিরাট ক্ষমতাশালী ও শক্তিধর বলে মনে করে তার প্রশংসা করে, আল্লাহর শক্তির মোকাবেলায় এসব নশ্বর শক্তির কোন তুলনা হয় না। মানুষের কল্পিত এসব শক্তিকে আল্লাহ তা'য়ালা মুহূর্তে অস্তিত্বহীন করে দিতে পারেন। সুতরাং, মানুষের সামনে পরিদৃশ্যমান পৃথিবীর কোন শক্তিই প্রশংসা লাভের অধিকারী হতে পারে না এবং তাদের সে যোগ্যতাও নেই। আল্লাহ বলেন-
لِلَّهِ مَا فِي السَّمَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ غَنِيًّا حَمِيدًا -
আকাশ ও পৃথিবীর সমস্ত জিনিসের মালিক হচ্ছেন আল্লাহ এবং তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন, উপরন্তু যাবতীয় প্রশংসার তিনিই একমাত্র যোগ্য অধিকারী। (সূরা আন নিসা-১৩১)
প্রশংসা যারই করা হোক না কেন, দুটো কারণ সামনে রেখে তা করা হয়। প্রথমতঃ যার প্রশংসা করা হবে, তার ভেতরে নিজস্ব অনুপম গুণ-বৈশিষ্ট্য এবং অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য বিদ্যমান থাকতে হবে। তাকে স্বয়ং সৌন্দর্যের স্রষ্টা হতে হবে। তার অনুপম গুণাবলী ও সৌন্দর্যের প্রভাব বিস্তার লাভ করবে এবং তা চূড়ান্তভাবে পরিবেশের ওপরে প্রতিফলিত হবে। দ্বিতীয় যে কারণে প্রশংসা করা হয় তাহলো, যার প্রশংসা করা হবে, তার অসীম অনুগ্রহ দৃষ্টির সামনে পরিদৃশ্যমান থাকবে। যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করা হবে, সেদিকেই প্রশংসা লাভের অধিকারী যিনি-তার অপার অনুগ্রহ দেখা যাবে। এ দুটো গুণাবলীর অধিকারী যিনি, তিনিই সমস্ত প্রশংসা লাভের অধিকারী। এ দুটো গুণ কোন সৃষ্টির মধ্যে যে বিদ্যমান নেই, তা অনুধাবন করার জন্য গভীর তত্ত্ব জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। স্কুল দৃষ্টিতেই উপলব্ধি করা যায়, এ দুটো গুণের অধিকারী একমাত্র আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। সুতরাং, প্রশংসা লাভের একমাত্র অধিকারী হলেন আল্লাহ তা'য়ালা।
সূরা ফাতিহায় এ কথা বলা হয়নি যে, 'প্রশংসা আল্লাহর জন্য' বরং বলা হয়েছে, 'সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর জন্য'। তাওহীদের মূল ধ্বনিই সূরা ফাতিহার এই আয়াতে অত্যন্ত দৃঢ়তা ও বলিষ্ঠভাবে উচ্চারিত হয়েছে। দাসত্ব করতে হবে একমাত্র আল্লাহর-এ কথারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে 'সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর' এ কথাটি বলে। কারণ তাওহীদের ধারণার বিপরীত জ্ঞান মানুষকে সৃষ্টির দাসত্ব করায়। যিনি একটি শক্তি সৃষ্টি করলেন, সেই শক্তির প্রকাশ দেখেই কেউ যদি শক্তির স্রষ্টার প্রশংসা না করে তার সৃজিত শক্তির পূজা অর্চনা করতে থাকে, তাহলে তো মূল স্রষ্টার দাসত্ব করা হলো না। পৃথিবীতে যেখানে যে অবস্থায় যে বস্তু বিদ্যমান, এসব বস্তু কোন না কোন দিক দিয়ে অবশ্যই গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। চাঁদকে সৃষ্টি করা হয়েছে এক ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্য দিয়ে। সূর্যকে সৃষ্টি করা হয়েছে চাঁদের বিপরীত ভিন্ন গুণ-বৈশিষ্ট্য দিয়ে। এভাবে বাতাসের মধ্যে নানা গুণ-বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে, পানির ভেতরে অসংখ্য গুণাবলী দান করা হয়েছে। পাহাড়-পর্বত, উদ্ভিদরাজির ভেতরে অসংখ্য গুণাবলী বিদ্যমান। আগুনের মধ্যে গুণ-বৈশিষ্ট্য দেয়া হয়েছে। সমস্ত প্রাণী জগতের মধ্যে নানা ধরনের গুণাবলী দান করা হয়েছে।
কিন্তু মানুষকে এটা অনুভব করতে হবে যে, এসব গুণ ও বৈশিষ্ট্য কে দান করেছেন? বস্তুর ভেতরে একটি আশ্চর্য ধরনের গুণাবলী দেখে অবাক বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে স্বয়ং সম্পূর্ণ ভেবে তার সামনে দাসত্বের মস্তক অবনত করে দেয়া হয়, তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় ধরনের আহম্মকি আর কিছুই হতে পারে না। কারণ বিস্ময়কর গুণাবলীর দর্শককে তো সর্বপ্রথমে এটা অনুসন্ধান করে দেখতে হবে, এই গুণ-বৈশিষ্ট্য কে দান করলেন? যিনি দান করলেন তাঁকে চিনতে হবে এবং তাঁর সামনেই তো দাসত্বের মাথানত করে দিতে হবে। সমস্ত প্রশংসা করতে হবে একমাত্র তাঁরই।
বিষয়টি অনুভব করার পরে কোন ব্যক্তি যদি আল্লাহর প্রশংসা না করে কোন সৃষ্টির প্রশংসা করে, তাহলে তা হবে শিরক। এই শির্ক থেকে মানুষকে মুক্ত রাখার লক্ষ্যেই আল্লাহ তা'য়ালা সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে মানুষকে শিক্ষা দিয়েছেন, আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং প্রশংসাও করতে হবে একমাত্র তাঁরই। কারণ সৃষ্টির সমস্ত কিছুই একমাত্র তাঁরই প্রশংসা করছে, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা শোনার মতো শ্রবণশক্তি অর্জন করতে পারে না। কেউ যদি তা পারে তাহলে শুনতে সক্ষম হবে কিভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অনু-পরমাণু আল্লাহর মহিমা কীর্তন করছে। মহান আল্লাহ বলেন-
تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَوتِ السَّبْعُ وَالْأَرْضُ وَمَنْ فِيهِنَّ وَإِنْ مِنْ شَيْءٍ إِلَّا يُسَبِّحُ بِحَمْدِهِ وَلَكِنْ لَا تَفْقَهُونَ تَسْبِيحَهُمْ
এমন কোন জিনিস নেই যা তাঁর প্রশংসা সহকারে তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছে না, কিন্তু তোমরা তাদের পবিত্রতা ও মহিমা কীর্তন বুঝতে পারো না। (সূরা বনী ইসরাঈল-৪৪)
প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণার অর্থ হচ্ছে, প্রতিটি জিনিস শুধুমাত্র নিজের রব্ব-এর দোষ-ত্রুটি ও দুর্বলতা মুক্ত থাকার স্বীকৃতিই দিচ্ছে না, সেই সাথে তাঁর যাবতীয় গুণে গুণান্বিত ও যাবতীয় প্রশংসার অধিকারী হবার কথাও বলিষ্ঠভাবে বর্ণনা করছে। প্রতিটি জিনিস তার পরিপূর্ণ অস্তিত্বের মাধ্যমে এ কথা উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করছে যে, তার স্রষ্টা ও ব্যবস্থাপক এমন এক সত্তা, যিনি সমস্ত মহৎ গুণাবলীর সর্বোচ্চ ও পূর্ণতম অবস্থার অধিকারী এবং প্রশংসা যদি কারো করতেই হয়, তাহলে যাবতীয় প্রশংসার অধিকারী হলেন আল্লাহ তা'য়ালা। সূরা বনী ইসরাঈলের ১১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, একমাত্র তাঁরই শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করো। কেন তাঁর প্রশংসা করতে হবে, এ প্রশ্নের উত্তরও মহান আল্লাহই দিয়েছেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْزَلَ عَلَى عَبْدِهِ الْكِتَابَ وَلَمْ يَجْعَلْ لَهُ عِوَجًا -
প্রশংসা আল্লাহর যিনি তাঁর বান্দার প্রতি এ কিতাব অবতীর্ণ করেছেন এবং এর মধ্যে কোন বক্রতা রাখেননি। (সূরা আর কাহ্ফ-১)
মানুষ ছিল পথহারা, এ কিতাব অবতীর্ণ করে তিনি পথহারা মানুষকে পথের সন্ধান দিয়েছেন। এমন কিতাব তিনি অবতীর্ণ করেছেন, যে কিতাবের মধ্যে কোন ধরনের অস্পষ্টতা নেই। এই নিয়ামত লাভের কারণে তাঁরই প্রশংসা করতে হবে। আল্লাহ অনুগ্রহ করে মানুষের মধ্যে থেকে নবী নির্বাচিত করে মানুষকে নির্ভুল নেতৃত্ব দান করেছেন। এ জন্যও প্রশংসা একমাত্র ঐ আল্লাহর-ই প্রাপ্য। আল্লাহ বলেন-
قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ وَسَلِّمٌ عَلَى عِبَادِهِ الَّذِينَ اصْطَفَى
(হে রাসূল!) বলে দিন, প্রশংসা আল্লাহর জন্য এবং সালাম তাঁর এমন বান্দাদের প্রতি যাদেরকে তিনি নির্বাচিত করেছেন। (সূরা আন নামল-৫৯)
পৃথিবীর বস্তু নিচয় অবলোকন করে, তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যারা এই সৌন্দর্যের স্রষ্টা সেই নিপুণ শিল্পী আল্লাহর কথা ভুলে যায় এবং বস্তুর সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে থাকে। আল্লাহর সৃষ্টির গুণাবলী দেখে সৃষ্টির সামনে মাথানত করে দেয় এবং তার গুণ-কীর্তন করতে থাকে। তাদেরকে সাবধান করে দিয়ে বলা হয়েছে-
قلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ سَيُرِيْكُمْ أَيَتِهِ فَتَعْرِفُوْ نَهَا وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ
তাদেরকে বলো, প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, অত্যন্ত দ্রুত তিনি তোমাদেরকে তাঁর নিদর্শনাবলী দেখিয়ে দেবেন এবং তোমরা তা চিনে নেবে। আর তোমরা যেসব কাজ করো সে সম্পর্কে তোমাদের রব্ব অমনোযোগী নন। (সূরা আন নামল-৯৩)
পৃথিবীর কোন বৈজ্ঞানিকের কোন ক্ষমতা নেই তারা নিজের শক্তি প্রয়োগে আল্লাহ সৃষ্ট বস্তুর সহযোগিতা ব্যতীত ভিন্ন কিছু সৃষ্টি করে প্রশংসা লাভের অধিকারী হতে পারে। তারা যা কিছুই করতে অগ্রসর হবেন, প্রতি মুহূর্তে-প্রতি পদক্ষেপে তাকে মহান আল্লাহর মুখাপেক্ষী হতে হবেই। এ জন্য আল্লাহ ব্যতীত যেমন দাসত্ব লাভের অধিকারী আর কেউ নেই, তেমনি তাঁর প্রশংসা ব্যতীত আর কারো প্রশংসা করা যেতে পারে না। সূরা কাসাসে মহান আল্লাহ বলেন-
وَهُوَ اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْحَمْدُ فِي الْأُولَى وَالْآخِرَةِ وَلَهُ الْحُكْمُ وَالَيْهِ تُرْجَعُونَ
তিনিই এক আল্লাহ যিনি ব্যতীত দাসত্ব লাভের অধিকারী আর কেউ নন। তাঁরই জন্য প্রশংসা পৃথিবীতেও এবং আখিরাতেও। শাসন কর্তৃত্ব তাঁরই এবং তাঁরই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।
একশ্রেণীর লোক রয়েছে যারা নিজেদেরকে প্রকৃতি প্রেমিক বলে পরিচয় দিয়ে থাকে। এরা বিশ্বপ্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যরাশি অবলোকন করে মুগ্ধ হয়ে তার গুণ বর্ণনা করে থাকে। রাতের নির্জনতায় কৌমুদী স্নাত পুষ্প উদ্যানে সুধাকরের স্নিগ্ধ সৌরভে মন-প্রাণ আমোদিত হয়ে ওঠে, সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষ আবেগে উদ্বেলিত হয়ে সৌন্দর্যের স্রষ্টা আল্লাহর প্রশংসার পরিবর্তে চাঁদকেই সমস্ত সৌন্দর্যের আধার মনে করে তার গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে থাকে। প্রখর সূর্য কিরণে পথ-প্রান্তর যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, উদ্ভিদরাজি শ্যামলিমা হারিয়ে হরিদ্রাভা ধারণ করে, নির্জীব ভূমি ফসল উৎপাদন ক্ষমতা হারিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যায়, প্রচন্ড দাবদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে, তখন হঠাৎ করেই আকাশ থেকে এক পশলা বৃষ্টি যদি নেমে আসে তখন অজ্ঞ মানুষ আল্লাহর প্রশংসা 'মা করে বৃষ্টির প্রশংসা করতে থাকে। মায়াবী চাঁদের আলো নিয়ে প্রশংসামূলক অসংখ্য পংক্তি মালা রচনা করে। মেঘমালা আর প্রশান্তিদায়ক বৃষ্টির প্রশংসায় কবিতা রচনা করে থাকে। কিন্তু এদেরকে যদি প্রশ্ন করা হয়, এই চাঁদের আলোর স্রষ্টা কে? এই বৃষ্টি কে বর্ষালেন? এরা তখন বলতে বাধ্য হয়, এসবের পেছনে একজন মহাশক্তিধর স্রষ্টা আছেন। এ সমস্ত তথাকথিত প্রকৃতি প্রেমিকদের লক্ষ্য করেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مِّنْ نَزِّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ
আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য কিন্তু অধিকাংশ লোক বোঝে না। (সূরা আল 'আনকাবুত-৬৩) আল্লাহর সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য রাশি ও সৃষ্টির নিপুণতা দেখে, তাঁর অসংখ্য নিয়ামত ভোগ করে শুধু মুখে মুখে আল্লাহর প্রশংসামূলক বাণী উচ্চারিত করলেই হবে না, তাঁর সামনে দাসত্বের মস্তক অবনত করতে হবে। আল্লাহর প্রশংসা করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হলো নামাজ আদায় করা। সূরা রূমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِيْنَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُوْنَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمواتِ وَالْأَرْضِ وَعَشِيًّا وَ حِينَ تُظْهِرُونَ
সুতরাং, আল্লাহর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় এবং যখন তোমাদের প্রভাত হয়। আকাশসমূহে ও পৃথিবীতে তাঁর জন্যই প্রশংসা এবং (তাঁর মহিমা ও পবিত্রতা ঘোষণা করো) তৃতীয় প্রহরে এবং যখন তোমাদের কাছে এসে যায় যোহরের সময়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই বিশ্ব-জাহান ও এর সমস্ত জিনিসের মালিক, এ বিশ্ব প্রকৃতিতে সৌন্দর্য, পূর্ণতা, জ্ঞান, শক্তি, শিল্পকারিতা ও কারিগরির যে নিপুণতা দৃষ্টি আকর্ষণ করে, এসবের জন্য একমাত্র মহান আল্লাহ-ই প্রশংসার অধিকারী। এ পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীজগৎ যে কোন বস্তু থেকে উপকারিতা লাভ করছে, লাভবান হচ্ছে, আনন্দ ও স্বাদ উপভোগ করছে সে জন্য অন্যান্য প্রাণীসমূহ যেমন আল্লাহর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে, মানুষকেও আল্লাহর প্রশংসা ও তাঁর দাসত্ব করতে হবে। যাবতীয় সৌন্দর্যের পেছনে এক আল্লাহ ব্যতীত যখন অন্য কারো কোন ভূমিকা নেই, তখন প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা লাভ করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহ বলেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي لَهُ مَا فِي السَّمَواتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي الْآخِرَةِ
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের মালিক এবং আখেরাতেও প্রশংসা তাঁরই জন্য। (সূরা সাবা-১)
মহান আল্লাহর সৃষ্টিতে কারো কোন অংশ নেই, সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে এ কথাটিই অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সমস্ত কিছু সৃষ্টির ব্যাপারে একক কৃতিত্ব একমাত্র তাঁর। তিনিই আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। এ জন্য সমস্ত প্রশংসাও তাঁরই প্রাপ্য। আল্লাহ বলেন-
الْحَمْدُ لِلهِ فاطر السمواتِ وَالْأَرْضِ
প্রশংসা আল্লাহরই জন্য, যিনি আকাশসমূহ ও পৃথিবীর নির্মাতা। (সূরা ফাতির-১)
একশ্রেণীর মানুষ বোঝে না, না বুঝে আল্লাহর সৃষ্টি কাজে অন্যের অংশ আছে বলে বিশ্বাস করে। তারা ধারণা করে, সৃষ্টি কাজে আল্লাহকে সহযোগিতা করার জন্য স্বয়ং আল্লাহই অনেককে নিয়োগ করেছেন। তারাও স্ব-স্ব ক্ষেত্রে অসীম ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী। এ জন্য তাদেরও পূজা-অর্চনা করতে হবে। এভাবে অজ্ঞ মূর্খ মানুষ কল্পিত শক্তির মূর্তি নির্মাণ করে তার সামনে মাথানত করে দেয়। মাটির নিষ্প্রাণ মূর্তির প্রশংসায় মুখরিত হয়ে ওঠে। এদেরকে ভ্রান্তিমুক্ত করার জন্য সূরা সাফাতের ১৮০-১৮২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُونَ وَسَلِّمٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
তারা যেসব কথা তৈরী করছে তা থেকে পাক-পবিত্র তোমার রব্ব, তিনি মর্যাদার অধিকারী। আর সালাম প্রেরিতদের প্রতি এবং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর রাব্বুল আলামীনের জন্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, তোমরা নিজের হাতে যেসব মূর্তি নির্মাণ করো, তাদের যে কোন ক্ষমতা নেই, তা তোমরা নিজেরাই অনুধাবন করতে পারো। তাদের দেহে মাছি বসলে তারা সে মাছিকেও তাড়াতে অক্ষম তা তোমরা দেখছো। তোমরা যেসব জিনিসকে শক্তির উৎস বলে তার পূজা-অর্চনা করছো, তা ধ্বংসশীল, তারা কিভাবে ধ্বংস হয় সে দৃশ্য তোমরা নিজেদের চোখে দেখে থাকো। এসব দেখেও কি তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো না? সুতরাং, দাসত্ব ও প্রশংসা করো ঐ আল্লাহর-যিনি অমর অক্ষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
هو الحَيُّ لَا إِلَهَ إِلا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
তিনি চিরঞ্জীব। তিনি ছাড়া কোন ইলাহ নেই। তোমাদের দ্বীন তাঁর জন্য নিবেদিত করে তাঁকেই ডাকো। গোটা সৃষ্টি জগতের রব্ব আল্লাহর জন্যই সমস্ত প্রশংসা। (মু'মিন-৬৫)
প্রশংসা করো একমাত্র আমার এবং দাসত্ব করো শুধু আমারই। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অনুসরণীয় নিয়ম-পদ্ধতি আমার বিধানের অনুগত করে দাও। আমার একনিষ্ঠ গোলাম হয়ে যাও। আমার গোলামীর সাথে অন্য কারো গোলামীর মিশ্রণ ঘটিয়ো না। এ আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছুই তোমরা দেখছো, এসবের মালিক আমি-আমিই এসবের রব্ব। যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আমারই হাতে নিবদ্ধ। পবিত্র কোরআন ঘোষণা করছে-
فَلِلَّهِ الْحَمْدُ رَبِّ السَّمَوَاتِ وَرَبِّ الْأَرْضِ رَبِّ الْعَالَمِينَ
সুতরাং সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি যমীন ও আসমানের মালিক এবং গোটা বিশ্বজাহানের সবার রব্ব। (সূরা আল জাসিয়া-৩৬)
এ পৃথিবীতে অসংখ্য বস্তু এমন রয়েছে, যাদেরকে জড়পদার্থ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এসব বস্তুর ভেতরে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই। এসব প্রাণহীন বস্তুও মহান আল্লাহর প্রশংসা করে। আকাশের মেঘমালাও আল্লাহর প্রশংসা করে। ঈশান কোণে কালবৈশাখীর নিকষকালো মেঘ রুদ্র ভয়াল রূপ ধারণ করে ক্রমশঃ গোটা আকাশ ছেয়ে ফেলে। ভয়ঙ্কর গর্জন করতে থাকে। আল্লাহ বলেন-
وَيُسَبِّحُ الرَّعْدُ بِحَمْدِهِ
মেঘের গর্জন তাঁরই প্রশংসা সহকারে পবিত্রতা বর্ণনা করে।
(সূরা আর-রা'দ-১৩)
0 Comments