বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কায় যে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন, দীর্ঘ তের বছরে সে আন্দোলন একটি বিশেষ পর্যায়ে উন্নিত হলেও মক্কায় এ আন্দোলন সফল হবার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কারণ যে কোন আদর্শ ভিত্তিক আন্দোলন সফল করতে হলে দুটো জিনিসের একান্তই প্রয়োজন হয়। একটি হলো যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালিত হচ্ছে, সে আদর্শের ভিত্তিতে একদল লোক প্রস্তুত করা। যেন সাধারণ মানুষ সে লোকগুলোর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখে আদর্শ সম্পর্কে বাস্তব ধারণা লাভ করতে পারে এবং আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে।
এ ছাড়া আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা যতটা কঠিন, তার চেয়ে অধিক কঠিন হলো আদর্শ টিকিয়ে রাখা। আদর্শ ভিত্তিক লোক প্রস্তুত করা না হলে আদর্শ টিকিয়ে রাখা যায় না। দ্বিতীয় যে বিষয়টির প্রয়োজন হয় তাহলো আদর্শ ভিত্তিক সে আন্দোলনের প্রতি জনসমর্থন। দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ জনতার সে আন্দোলন ও আদর্শের প্রতি যদি সমর্থন না থাকে, তাহলে তা দেশের বুকে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়না।
আল্লাহর রাসূল মক্কার জীবনে প্রথমটিতে সফলতা অর্জন করেছিলেন। দ্বিতীয়টি মক্কায় ছিল না। মক্কায় আদর্শ ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তি প্রস্তুত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ রাসূলের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেনি এবং ইসলামী আদর্শ গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। এ জন্য হযরত মুসয়াব ইবনে উমায়ের রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে আল্লাহর রাসূল মদীনায় প্রেরণ করে মদীনার জনগণকে ইসলামের পক্ষে সংগঠিত করার কাজে নিয়োগ করেছিলেন। তিনিই ছিলেন ইসলামের প্রথম মুবাল্লিগ-ইসলামের প্রথম দূত।
এছাড়া মদীনা থেকে হজ্জ উপলক্ষ্যে যেসব লোকজন মক্কায় আগমন করতো, আল্লাহর নবী তাদের কাছে ইসলামী আদর্শ তুলে ধরতেন। এভাবে মদীনার কিছু সংখ্যক লোকজনের ইসলামের সাথে পরিচিতি ঘটে এবং পরপর দু'বছর মদীনা থেকে আগত লোকজন রাসূলের কাছে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা রাসূলকে যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে মদীনায় বরণ করে নেয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন। এভাবেই মদীনায় ইসলামের পক্ষে একটা সাধারণ জনমত গড়ে উঠেছিল।
মক্কায় ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী মুসলমানদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। এ কারণে কিছু সংখ্যক মুসলমান রাসূলের অনুমোদনক্রমে হাবশা-বর্তমানে যে দেশটির নাম আবিসিনিয়া সেখানে হিজরাত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীতে মক্কার মুসলমানগণও একে একে মদীনায় হিজরাত করেন। তারপর মক্কার ইসলাম বিরোধী গোষ্ঠী স্বয়ং আল্লাহর রাসূলকেই পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়ার এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র করেছিল। ঠিক সে সময়ে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁকে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় হিজরাত করার অনুমতি দিলেন।
রাসূল মদীনায় গমন করলেন, সেখানের সাধারণ জনগণ তাঁকে হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল। যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করার জন্য রাসূলের এই আন্দোলন, তা বাস্তবে পরিণত করার সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। তিনি ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন করলেন। এবার রাষ্ট্রশক্তির মাধ্যমে ইসলাম চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলো। এ পর্যন্ত ইসলামী আন্দোলনের কর্মী-সমর্থক যেখানে যে অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা সবাই একই কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত হবার সুযোগ লাভ করলেন।
মদীনায় হিজরাত করার পরে আল্লাহর রাসূলের ওপরে কোরআনের যেসব আয়াত বা সূরা অবতীর্ণ হয়, সেগুলো মাদানী সূরা নামে পরিচিতি লাভ করেছে। এসব সূরার বৈশিষ্ট্য মক্কী সূরা থেকে ভিন্ন। একটি রাষ্ট্রশক্তি মুসলমানদের হস্তগত হবার পর থেকে ইসলাম বিরোধী শক্তির সাথে মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করলো। মদীনায় ইহুদীদের একটি বিরাট শক্তি বর্তমান ছিল। এই ইহুদী জাতি-গোষ্ঠীগতভাবে অত্যন্ত কুটিল স্বভাবের। ইসলাম এবং মুসলমান এদের কাছে অসহনীয়।
এছাড়া রাসূল মদীনায় হিজরাত করার পূর্বে উবাই নামক এক প্রভাবশালী ব্যক্তির নেতৃত্বের আসনে আসীন হবার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহর রাসূল মদীনায় পদার্পণ করার সাথে সাথে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরে গেল; জনতা নেতৃত্বের আসনে আসীন করলো স্বয়ং আল্লাহর রাসূলকে।
নেতৃত্ব হারিয়ে লোকটি উন্মদের ন্যায় হয়ে পড়েছিল। সে তার সমর্থক গোষ্ঠী নিয়ে ইসলাম ও মুসলমানদের ক্ষতি করার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল। সংখ্যা গরিষ্ঠ জনশক্তি ইসলামের দিকে থাকার কারণে সে প্রকাশ্যে বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করতে না পেরে মদীনার ইহুদী এবং মদীনার বাইরের ইসলামের শত্রুদের সাথে আঁতাত করে ইসলামী রাষ্ট্র উৎখাত করার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছিলো। এই পরিস্থিতিতে মুসলমানদেরকে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হচ্ছিলো। মুসলমানদের জনবল নেই, অর্থবল নেই, অস্ত্রশক্তিও নেই-তবুও তাঁদেরকে একটার পরে আরেকটা যুদ্ধের মোকাবেলা করতে হলো। এভাবে এক চরম সংঘাত-মুখর পরিস্থিতি অতিক্রম করে দীর্ঘ দশ বছর পরে বিজয়ের সোনালী সূর্য উদিত হলো। এই দীর্ঘ দশটি বছর অতিবাহিত করতে গিয়ে যেসব পরিস্থিতি ও পরিবেশের মোকাবেলা করতে হয়েছে, তার আলোকে কোরআনের যে সূরা বা আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, একটি নতুন পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা ও জাতি গঠন এবং তা বিশ্বের মানচিত্রে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যেসব উপাদান- উপকরণের প্রয়োজন, তা মাদানী সূরাসমূহে পরিপূর্ণ করে দেয়া হয়েছে।
0 Comments