আল্লাহর অসীম ক্ষমতা বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি করেছেন

        আল্লাহর অসীম ক্ষমতা ও সৃষ্টির নৈপূর্ণতা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, পৃথিবীর প্রাণী জগতের দিকেই তোমরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখো আমার সৃষ্টির বিচিত্র রূপ। আমি মানুষ সৃষ্টি করেছি, শৈশবে এই মানুষ অপরের সাহায্য ব্যতিত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে গমন করতে পারে না। আমি আল্লাহ তাকে হাঁটার কৌশল শিখিয়েছি। মানুষ দু'পায়ের ওপর ভর করে হাঁটে। আবার পশু জগতের মধ্যে এমন কিছু পশু সৃষ্টি করেছি, যারা কিছু সময়ের জন্য দু'পায়ের ওপর ভর করে চলতে পারে। আবার এমন পশুও আমি সৃষ্টি করেছি যারা চার পায়ের ওপর ভর করে এই পৃথিবীতে চলে। এমন প্রাণী আমি সৃষ্টি করেছি, যার কোন পা নেই, পা বিহীন প্রাণী আমি সৃষ্টি করেছি। আমি সর্পকে পা দিইনি, তারা পা ছাড়াই বুকের ওপর ভর করে এই পৃথিবীতে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলতে পারে। সাগরের এমন অনেক প্রাণী রয়েছে যারা পা ছাড়াই জলে ও স্থলে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে চলাফেরা করে। আমি বিচ্ছু জাতীয় প্রাণী সৃষ্টি করেছি, যাদেরকে আমি অসংখ্য পা দান করেছি। তারা অসংখ্য পা দিয়ে পৃথিবীতে চলা ফেরা করে।

        এমন অসংখ্য পাখি আমি সৃষ্টি করেছি, যারা দু'পা দিয়ে হাঁটতেও পারে আবার ঐ দূর আকাশেও ডানা মেলে উড়তে পারে। এসব পাখি উড়তে উড়তে কখনও ডানা দুটো গুটিয়ে নিয়েও মহাশূন্যে অবস্থান করে-নিচে পতিত হয় না। আল্লাহ বলেন-

وَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ فَوْقَهُمْ صَاقَت وَيَقْبِضْنَ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا الرَّحْمَنُ إِنَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ بَصِيرٌ -

        এসব লোকজন কি নিজেদের ওপরে উড়ন্ত পাখিগুলোকে ডানা বিস্তার করতে ও গুটিয়ে নিতে দেখে না? একমাত্র রহমান ব্যতিত তাদেরকে অন্য কেউ ধরে রাখে না। তিনি সমস্ত জিনিসের সংরক্ষক। (সূরা মূলক-১৯)

        আল্লাহ বলেন, তোমাদের জীবন ধারনের জন্য যা প্রয়োজন তা সবই আমি করেছি। যাবতীয় ব্যবস্থাপনা আমার হাতে, আমিই সব কিছু সম্পাদন করছি। তোমরা ক্ষেত্রে বীজ বপন করে নিশ্চিন্ত থাকো, সেই বীজ থেকে ফসল ফলানোর ক্ষমতা তোমাদের নেই। আমিই সেই বীজ থেকে ফসল উৎপাদন করে থাকি। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

إِنَّ اللَّهَ فَالِقُ الْحَبِّ وَالنَّوَاى - يُخْرِجُ الْحَيِّ مِنَ الْمَيِّتِ وَمُخْرِجُ الْمَيِّتِ مِنَ الْحَقِّ ذَالِكُمُ اللَّهُ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ

        দানা ও বীজ দীর্ণকারী হচ্ছেন আল্লাহ। তিনিই জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং মৃতকে বের করেন জীবিত থেকে। এসব কাজের প্রকৃত কর্তা হচ্ছেন আল্লাহ; তাহলে তোমরা কোথায় বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছো? (সূরা আনআ'ম-৯৫)

        তোমরা তোমাদের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছো যে, আল্লাহই সমস্ত কিছু করছেন, তাহলে আমার আইন-বিধান ত্যাগ করে মানুষের রচনা করা বিধান তোমরা কেন অনুসরণ করছো? তোমরা কি দেখনা? একটি কুকুর আরেকটি কুকুরের আইন মানে না, একটি শুকুর আরেকটি শুকুরের আইন মানে না। তোমরা কি এসব প্রাণী থেকেও নিকৃষ্ট হয়ে গেলে যে, একজন মানুষ একটি মতাদর্শের জন্ম দিল আর ওমনি তোমরা তা অনুসরণ করতে শুরু করলে? তোমরা লক্ষ্য করে দেখো তো? আমি আল্লাহ তোমাদের জন্য কি করছি-

        তিনি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেন এবং তার সাহায্যে সব ধরনের উদ্ভিদ উৎপাদন করেন এবং তা থেকে শস্য-শ্যামল ক্ষেত-খামার ও বৃক্ষ তরু-লতার সৃষ্টি করেছেন। তারপর তা থেকে বিভিন্ন কোষসম্পন্ন দানা বের করেছেন, খেজুরের মোচা থেকে ফলের থোকা থোকা বানিয়েছেন, যা বোঝার ভারে নুয়ে পড়ে। আর সজ্জিত করেছেন আঙ্গুর, যয়তুন ও ডালিমের বাগান সাজিয়ে দিয়েছেন, সেখানে ফলসমূহ পরস্পর স্বদৃশ, অথচ প্রত্যেকটির বৈশিষ্ট্য আবার ভিন্ন ভিন্ন। এই গাছগুলো যখন ফল ধারণ করে, তখন তাদের ফল বের হওয়া ও তার পেকে যাওয়ার অবস্থাটা একটু সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখো। (সূরা আনআ'ম-৯৯)

        জীবের জন্য পানি অপরিহার্য-এ কথা নতুন কিছু নয়। আল্লাহ তা'য়ালা বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জবান মোবারকের মাধ্যমে চৌদ্দ শত বছর পূর্বেই বিশ্ববাসীকে পানির অপরিহার্যতার কথা শুনিয়েছেন। তিনি মানুষের জন্য নানা ধরনের ফল-মূল ও দানা সৃষ্টি করেছেন। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কোন একটি ফল এবং দানাও খোসা বিহীন নয়। মানুষ এসব আহার করবে এ কারণে আল্লাহ সমস্ত ফল ও দানার ওপরে আবরণ সৃষ্টি করেছেন। বায়ু প্রাণী জগতের জন্য অপরিহার্য।

        বিজ্ঞানীদের ধারনা অনুসারে পৃথিবীর মূল আবহাওয়ামন্ডলের বিস্তৃতি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ৫০ মাইল বা ৮০ কিলোমিটার পর্যন্ত উঁচু। পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের ৯৯ শতাংশই এর মধ্যে পড়েছে। তবে ১ হাজার মাইল বা ১ হাজার ৬ শত কিলোমিটার উঁচু পর্যন্ত পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলের গ্যাসের হাল্কা অস্তিত্ব বিরাজমান। পৃথিবীর এই বায়ুমন্ডলের ৭৮ ভাগই নাইট্রোজেন, ২১ ভাগ অক্সিজেন, ১ ভাগ আর্গন। এছাড়া রয়েছে কার্বনডাই-অক্সাইড, অন্যান্য গ্যাস ও জলীয় বাষ্প। বায়ুমন্ডলের এসব উপাদানসমূহ উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের টিকে থাকার জন্য একান্ত অপরিহার্য। মানুষের জীবন ধারনের জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানব শরীরে অক্সিজেন গ্রহণ করা হয় এবং তা মানবদেহের বিভিন্ন কাজে ব্যবহৃত হয়। মানুষের জীবন ধারনের জন্য একান্ত প্রয়োজন হলো আগুন। অক্সিজেন ব্যতিত আগুন প্রজ্জলিত হয় না। কয়লা, তেল বা অন্য কোন দহনের জন্য অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। বায়ুমন্ডলে থাকা নাইট্রোজেন গ্যাস যে কোন ধরনের দহন কার্য নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। উদ্ভিদ-বৃক্ষ-তরু-লতার জন্য নাইট্রোজেন অপরিহার্য। বায়ুমন্ডলে অবস্থিত কার্বনডাই অক্সাইড গ্যাস উদ্ভিতের জন্য প্রাণস্বরূপ। পানি এবং কার্বনডাই অক্সাইড থেকে সূর্যের আলোতে বৃক্ষ-তরু-লতার সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় শ্বেতসার খাদ্য ও অক্সিজেন গ্যাস প্রস্তুত হয় এবং অনাবশ্যকীয় অক্সিজেন বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়।

        এভাবে মানুষ এবং অন্যান্য জীব-জন্তু শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে বায়ুমন্ডল থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করে এবং কার্বনডাই অক্সাইড ছেড়ে দেয়। পক্ষান্তরে বৃক্ষ, তরু-লতা বায়ুমন্ডল থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ছেড়ে দিয়ে এদের সমতা রক্ষা করে।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর উষ্ণতা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বায়ুমন্ডলকে আদেশ দান করেছেন, যেন বায়ুমন্ডল গোটা পৃথিবীকে আবৃত করে রাখে। ফলে দিন ও রাত, গ্রীষ্ম এবং শীতকালের উষ্ণতার পার্থক্য বেশী হতে না দিয়ে জীব-জন্তু ও উদ্ভিদ জগৎ টিকে থাকার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। মহান আল্লাহ বায়ুমন্ডলে নানা ধরনের স্তর সৃষ্টি করেছেন। এসব স্তরের ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এর একটি স্তরের নাম হলো ওজোন স্তর। এই ওজোন স্তর সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর রশ্মি (Harmful ray) শোষণ করে জীব জগৎ ও উদ্ভিদ জগতকে হেফাজত করে। বায়ুমন্ডলের আরেকটি স্তরের নাম হলো অমড্রযদণরণ। এই স্তর থাকার কারণে মানুষ যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সমর্থ হয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা বায়ুমন্ডলে জলীয় বাষ্প সৃষ্টি করেছেন। ভূ-পৃষ্ঠের সাগর, মহাসাগর, নদী-নালা, খাল-বিল, হাওড় ইত্যাদি থেকে সূর্যের তাপে পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে আল্লাহর আদেশে বায়ুমন্ডলে প্রবেশ করে। এই জলীয় বাষ্প ওপরে ওঠার পর ক্রমে তা শীতল হতে থাকে এবং পানির বিন্দু সৃষ্টি হয়। এরপর তা ঘনীভূত হয়ে আল্লাহর আদেশে মেঘমালায় পরিণত হয়। মহান আল্লাহ বায়ুমন্ডলে উষ্ণতা ও চাপের পার্থক্য সৃষ্টি করেছেন। ফলে মেঘ দূর-দূরান্তে চলে যায়। তারপর আল্লাহর আদেশে বৃষ্টি বর্ষিত হয়ে ভূ-পৃষ্ঠ সিক্ত করে। এভাবে আল্লাহ মৃত যমীনকে জীবিত করেন। মহান আল্লাহ সূরা ফাতিরের ৯ নং আয়াতে বলেন- 

وَاللهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَسُقْنَاهُ إِلَى بَلَدٍ مِّيِّتِ فَأَحْيَيْنَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا -

        তিনিই আল্লাহ যিনি বায়ু প্রেরণ করে এবং বায়ু দ্বারা মেঘমালা সঞ্চালিত করেন। তারপর তিনি তা নির্জীব ভূ-খন্ডের দিকে পরিচালিত করেন এবং মৃত যমীনকে জীবন্ত করে তোলেন।

        পৃথিবীর যেখানে বৃষ্টি প্রয়োজন আল্লাহ তা'য়ালা বায়ুকে আদেশ করেন সেখানে মেঘমালা সঞ্চালিত করার জন্য। মুহূর্তের মধ্যে বায়ু সে আদেশ পালন করে। কি পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং বৃষ্টির ফোটার আকার কি হবে সেটাও আল্লাহ তা'য়ালা নির্ধারণ করে দেন। এভাবে বৃষ্টির মাধ্যমে আল্লাহ পৃথিবীকে সিক্ত করেন। আল্লাহ বলেন-

وَهُوَ الَّذِي يُرْسِلُ الرِّيحَ بُشْرًا بَيْنَ يَدَى رَحْمَتِهِ حَتَّى إِذَا أَقَلَّتْ سَحَابًا ثِقَالاً سُقْنَاهُ لِبَلَد مِّيِّت فَأَنْزَلْنَا بِهِ الْمَاءَ فَأَخْرَجْنَا بِهِ مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ

        তিনি নিজের অনুগ্রহের (বৃষ্টি বর্ষণের) প্রথমে বাতাসকে সুসংবাদবাহী হিসেবে প্রেরণ করেন। তারপর যখন সে বাতাস পানি ভারাক্রান্ত মেঘমালা উত্থিত করে, তখন সে বাতাসকে কোন মৃত (শুষ্ক) যমীনের দিকে প্রেরণ করেন, পরে তা থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। তারপর যমীন থেকে নানা ধরনের ফলমূল উৎপদন করেন। (সূরা আ'রাফ-৫৭)

Post a Comment

0 Comments