বহুমাত্রিক জগতের ধারণা ও পৃথিবীর সুরক্ষিত ছাদ

        পবিত্র কোরআনে আকাশ সম্পর্কে বহু তথ্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কিভাবে আকাশ সৃষ্টি করা হয়েছে এবং কেমন করে তার সাংগাঠনিক শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এবং কোন পদ্ধতিতে আকাশকে কোন ধরনের স্তম্ভ ব্যতিত যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত রাখা হয়েছে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে পবিত্র কোরআন মানুষকে ধারণা দান করেছে। আকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণ এখন পর্যন্ত কোন স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সক্ষম হননি। তারা প্রকৃত অর্থে আকাশের কোন সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। বিষয়টি এখনো গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। মানুষ সসীম জ্ঞানের অধিকারী। কোন কিছু সম্পর্কে এরা সঠিক জ্ঞানার্জন করতে ব্যর্থ হলেই তার অস্তিত্ব অস্বীকার করা এদের স্বভাব। আকাশের ঠিকানা আবিষ্কারে ব্যর্থ কেউ কেউ আকাশের অস্তিত্ব অস্বীকার করে বলেছে, আকাশ বলতে কিছুই নেই। পৃথিবীর ধূলিকণা মহাশূন্যে বায়বিয় স্তরে পুঞ্জিভূত হয় এবং তার ওপরে সূর্যের আলো পতিত হবার ফলে তা নীল দেখায়। প্রকৃত অর্থে আকাশের কোন অস্তিত্ব নেই। অথচ এই আকাশের যিনি স্রষ্টা তিনি বলছেন-

إِنَّا زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِزِينَةِ الْكَوَاكِبِ

        এই দুনিয়ার আকাশখানিকে তারকা প্রদীপ দিয়া সাজায়ে রেখেছি মনের মতন দেখো তুমি তাকাইয়া। (সূরা আস্ সা-ফফা-ত-৬)

        উল্লেখিত আয়াতে পৃথিবীর আকাশ বলতে সেই আকাশকেই বুঝানো হয়েছে, যা আমাদের এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটবর্তী। যে আকাশকে আমরা কোন কিছুর সাহায্য ব্যতিতই খালি চোখে দেখে থাকি। এই আকাশ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে বিজ্ঞানীগণ যে বিশ্বকে দেখে থাকেন এবং তাদের পর্যবেক্ষণ যন্ত্রপাতির মাধ্যমে যেসব বিশ্ব এখন পর্যন্ত মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়নি সেগুলো সবই দূরবর্তী আকাশ। কোরআনে আকাশ সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে 'সাব'আ' শব্দের ব্যবহার করা হয়েছে। যার সরল অনুবাদ করা হয়েছে 'সাত আকাশ'। আল্লাহর কোরআনের বক্তব্য মানুষের বোধগম্য ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। যে শব্দ ব্যবহার করলে মানুষ সহজে বুঝতে সক্ষম হবে, সেই শব্দই ব্যবহার করা হয়েছে। কোরআনে কোন জটিলতা রাখা হয়নি। আরবী পরিভাষায় 'আলিফ' বলতে অগণিত কিছু বোঝায়। এখন কেউ যদি এই আলিফ বলতে শুধুমাত্র একহাজার বুঝে, তাহলে সে তার জ্ঞান অনুযায়ী তা বুঝতে পারে। কিন্তু এই আলিফ দিয়ে আল্লাহর কোরআন অসংখ্য অগণিত বুঝিয়েছে।

        যেমন সূরা কদরে লাইলাতুল কাদরি মিন আলফি শাহরে বলতে বুঝানো হয়েছে অসংখ্য অগণিত মাসের থেকেও উত্তম হলো কদরের রাত। আবার কিয়ামত সংঘটিত হবার প্রসঙ্গ উপস্থাপন করতে গিয়ে কোরআন 'সুর' শব্দ ব্যবহার করেছে। এই 'সুর' শব্দের অর্থ হলো শিঙ্গা। হযরত ইসরাফিল আলাইহিস্ সালাম শিঙ্গায় ফুঁ দিবেন, কিয়ামত শুরু হয়ে যাবে। সেই প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্তও কোন গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ প্রচারের জন্য ঢেড়া পিটিয়ে বা শিঙ্গা বাজিয়ে মানুষকে একত্রিত করা হয়। এখানো সৈন্যবাহিনীকে একত্রিত করার জন্য বিউগল বাজানো হয়। অর্থাৎ মানুষ এই শিঙ্গা শব্দটির সাথে পরিচিত, এ কারণে কোরআন শিঙ্গা শব্দই ব্যবহার করেছে। এদেশেও কথার মাঝে মানুষ সীমাহীন দূরত্ব বুঝাতে 'সাত সমুদ্দুর তের নদী-সাত তবক আসমান' ইত্যাদি বাক্য ব্যবহার করে থাকে। অমূল্য কোনকিছু বুঝাতে 'সাত রাজার ধন' বাক্যটি ব্যবহার করে। এ জন্য আল্লাহর কোরআন অসংখ্য আকাশকে বুঝাতে 'সাব'আ' বা সাত আকাশ শব্দ ব্যবহার করেছে, যেন মানুষ সহজে বুঝতে পারে। আল্লাহ বলেন-

وَلَقَدْ خَلَقْنَا فَوْقَكُمْ سَبْعَ طَرَائِقَ - وَمَا كُنَّا عَنِ الْخَلْقِ غَافِلِينَ - وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً بِقَدَرٍ فَاسْكَنَهُ فِي الْأَرْضِ وَإِنَّا عَلَى ذَهَابَ بِهِ لَقَادِرُونَ

        নিশ্চয়ই আমি তোমাদের ওপরে অসংখ্য স্তর সৃষ্টি করেছি। আমি আমার সৃষ্টি সম্পর্কে মোটেও অমনোযোগী নই। আর আকাশ থেকে আমি ঠিক হিসাব মতো একটি বিশেষ পরিমাণ অনুযায়ী পানি বর্ষণ করেছি এবং তাকে ভূমিতে সংরক্ষণ করেছি। আমি তাকে যেভাবে ইচ্ছা অদৃশ্য করে দিতে সক্ষম। (সূরা আল মু'মিনূন-১৭-১৮)

        মহান আল্লাহ হলেন রাব্বুল আলামীন। তিনি অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং এসব সৃষ্টি করেই তিনি অবসর গ্রহণ করেননি। তিনি তাঁর প্রতিটি সৃষ্টি সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন রয়েছেন। কোনটি কিভাবে পরিচালিত হবে, কোন সৃষ্টির কি প্রয়োজন, এ সম্পর্কে তিনি মোটেও অমনোযোগী নন। তাঁর সৃষ্টি অসংখ্য জগৎ যেন যথা নিয়মে পরিচালিত হয়, এ ব্যবস্থাও তিনি করেছেন। কোন কোন বিজ্ঞানী বলেন, সৃষ্টির সূচনাতেই আল্লাহ তা'য়ালা একই সঙ্গে এমন পরিমিত পরিমাণ পানি পৃথিবীতে বর্ষণ করেছিলেন যা পৃথিবী নামক এই গ্রহটির ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে। এই পানি পৃথিবীর নিম্ন ভূমিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এভাবে পানিকে সংরক্ষণ করার কারণেই নদী, সাগর-মহাসাগর ও জলাধারের সৃষ্টি হয়েছে, ভূগর্ভেও বিপুল পরিমাণ পানি রিজার্ভ রয়েছে। এই পানিই চক্রাকারে উষ্ণতা, শৈত্য ও বাতাসের মাধ্যমে বর্ষিত হতে থাকে। মেঘমালা, বরফাচ্ছাদিত-পাহাড়, সাগর, নদী-নালা ঝরণা ও কুয়া, ডিপ টিউবওয়েল এই পানিই পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে দিয়ে থাকে।

        অসংখ্য জিনিসের সৃষ্টি ও উৎপাদনে পানির ভূমিকা অপরিসীম। তারপর এ পানি বায়ুর সাথে মিশে গিয়ে আবার তার মূল ভান্ডারের দিকে ফিরে যায়। সৃষ্টির শুরু থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পানির এ মওজুদ ভান্ডারের বিন্দুমাত্রও হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটেনি। তিনি কে-যিনি একই সময় এ বিপুল পরিমাণ হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন মিশ্রিত করে পানির বিশাল ভান্ডার পৃথিবীর অধিবাসীদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করে দিয়েছেন? কোন সে প্রতিপালক-যিনি এখন আর দুটো গ্যাসকে সে বিশেষ অনুপাতে মিশতে দেন না যার ফলে পানি উৎপন্ন হতে পারে? অথচ এ দুটো পৃথিবীতে মওজুদ রয়েছে। আর পানি যখন বাষ্পাকারে বাতাসে মিশে যায় তখন অক্সিজেন ও হাড্রোজেন কেন পৃথক হয়ে যায় না? যিনি এসব নিয়ন্ত্রণ করছেন তিনিই হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। পানির জগতকেও তিনিই নিয়ন্ত্রণ করছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ رُكَامًا فتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلْلِهِ

        তুমি কি দেখো না, আল্লাহ মেঘমালাকে ধীর গতিতে সঞ্চালন করেন, এরপর তার খন্ডগুলোকে পরস্পর সংযুক্ত করেন, তারপর তাকে একত্র করে একটি ঘন মেঘে পরিণত করেন, তারপর তুমি দেখতে পাও তার খোল থেকে বৃষ্টি বিন্দু অবিরাম ঝরে পড়ছে। (সূরা আন্ নূর-৪৩)

        পৃথিবী যে অজস্র ধরনের বিচিত্র সৃষ্টির আবাসস্থল ও অবস্থান স্থল হয়েছে, এটা কোন সহজ বিষয় নয়। যে বৈজ্ঞানিক সমতা ও সামঞ্জস্যশীলতার মাধ্যমে পৃথিবী নামক এই গ্রহটিকে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে এ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। যারা এ সম্পর্কে চিন্তা-গবেষণা করেন তারা অনুভব করতে থাকেন যে, এমন ভারসাম্য ও সাম স্যশীলতা একজন জ্ঞানী, সর্বজ্ঞ ও পূর্ণশক্তি সম্পন্ন সত্তার ব্যবস্থাপনা ব্যতিত প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে না। পৃথিবী নামক এই ভূ-গোলকটি মহাশূন্যে ঝুলন্তাবস্থায় বিদ্যমান। এটি কোন জিনিসের ওপর ভর করে অবস্থান করছে না। কিন্তু এরপরও এর মধ্যে কোন কম্পন ও অস্থিরতা নেই। পৃথিবীর কোন অঞ্চলে মাঝে মধ্যে সীমিত পর্যায়ে ভূমিকম্প হলে তার যে ভয়াবহ চিত্র আমাদের সামনে প্রকাশিত হয়, তাতে গোটা পৃথিবী যদি কোন কম্পন বা দোদুল্যমানতার শিকার হতো, তাহলে এখানে মানুষ বসবাস করতে সক্ষম হতো না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

امِّنْ جَعَلَ الْأَرْضَ قَرَارًا جَعَلَ خِلُلَهَا أَنْهُرَا وَجَعَلَ لَهَا رَوَاسِيَ وَجَعَلَ بَيْنَ الْبَحْرَيْنِ حَاجَزا -

        আর তিনি কে, যিনি পৃথিবীকে করেছেন বসবাসের উপযোগী এবং তার মধ্যে প্রবাহিত করেছেন নদ-নদী এবং তার মধ্যে গেড়ে দিয়েছেন (পর্বতমালার) পেরেক, আর পানির দুটো ভান্ডারের মাঝখানে অন্তরাল সৃষ্টি করে দিয়েছেন। (সূরা আন নামল-৬১)

        পৃথিবী নামক এই গ্রহটি নিয়মিতভাবে সূর্যের সম্মুখ ভাগে একবার আসে এবং আবার পিছনের দিকে সরে যায়। এরই ফলে দিন ও রাতের পার্থক্য সৃষ্টি হয়। যদি পৃথিবীর একটি দিক সব সময় সূর্যের দিকে অবস্থান করতো এবং অন্য দিকটি সময় সময় সূর্যের আড়ালে অবস্থান করতো, তাহলে এই পৃথিবীতে কোন প্রাণী বসবাস করতে সক্ষম হতো না। কারণ একদিকের সার্বক্ষণিক শৈত্য ও আলোকহীনতা উদ্ভিদ ও প্রাণীর জন্মলাভের উপযোগী হতো না এবং অন্যদিকের ভয়াবহ দাবদাহ প্রচন্ত উত্তাপ পৃথিবীর সূর্যের দিকে একইভাবে অবস্থানরত অংশকে পানিহীন, উদ্ভিদহীন ও প্রাণহীন করে দিতো।

        উল্কা পতনের ভয়াবহ প্রভাব থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করার লক্ষ্যে এই ভূ-মন্ডলের প্রায় আটশত কিলোমিটার ওপর পর্যন্ত বাতাসের একটি ঘনস্তর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যদি এ ব্যবস্থা না করতেন, তাহলে প্রতিদিন কোটি কোটি বিশালাকারের উল্কাপিন্ড প্রতি সেকেন্ডে আট চল্লিশ কিলোমিটারেরও অধিক গতিতে এসে পৃথিবী পৃষ্ঠে আঘাত হানতো। এর ফলে পৃথিবীতে যে ধ্বংস লীলা সাধন হতো তাতে করে মানুষ, পশু-প্রাণী, বৃক্ষতরু-লতা কোন কিছুর অস্তিত্ব থাকতো না। সমস্ত কিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে চর্বিত তৃণের ন্যায় ধারণ করতো।

        এই পৃথিবীতেই শুধু পাথরের খনি বিদ্যমান নেই, আল্লাহ তা'য়ালা যে আরো অসংখ্য জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেখানেও পাথর বিদ্যমান। মাহশূন্য সম্পর্কে যাদের সামান্য লেখাপড়া রয়েছে, তারা এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারেন না যে, মহাশূন্যে বিশালাকারের একটি পাথরের জগৎ রয়েছে। মহাকাশে শূন্যতার মহাসমুদ্রে ভাসমান পাথরের জগৎ বিদ্যমান।

        মঙ্গল ও বৃহস্পতির মধ্য বলয়ে এসটিরয়েড ও মিটিওরিট বেল্ট রয়েছে। এটাই হলো এককভাবে পাথরের জগৎ। এ ছাড়াও প্রায় প্রতিটি গ্রহেই পাথর রয়েছে। মহাশূন্যে ভাসমান পাথরের এই জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞানীগণ জানতে পেরেছেন মাত্র উনিশ শতকে। অথচ আল্লাহর কোরআন এ জগৎ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেশ করেছে সেই সপ্তম শতাব্দীতে।

        আল্লাহর কিতাবের সূরা জ্বিন-এ বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে, কিভাবে মহাশূন্যে পাথর নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। বিজ্ঞান অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছে যে মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে রয়েছে একটি সুবিশাল পাথরের বেল্ট, একটি ভাসমান পাথরের জগৎ। পাথরের এই জগৎ নিয়ে বর্তমান বিজ্ঞানীগণ মারাত্মক শঙ্কিত রয়েছেন। কি জানি, কখন কি অবস্থায় এসব পাথর পৃথিবীর দিকে সেকেন্ডে শত শত কিলোমিটার গতিতে ছুটে এসে আঘাত হেনে মানব সভ্যতাকে অস্তিত্বহীন করে দেয়।

        বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই আকাশে যে শতকোটি নানা ধরনের জগৎ বিদ্যমান, এসব জগতই একদিন পৃথিবী নামক গ্রহটির সর্বনাশ করে ছাড়বে। হয়ত তাদের ধারণা একদিন বাস্তবে পরিণত হলে হতেও পারে। কারণ যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন আল্লাহর আদেশে সমস্ত আকর্ষণ বলয় ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'য়ালা যে মহাকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করে মহাশূন্যে শতকোটি বিশালাকারের গ্রহ-উপগ্রহ পরিচালিত করছেন, সে আকর্ষণ শক্তির অস্তিত্ব থাকবে না, তখন তা পৃথিবীতে পতিত হবে।

        বিজ্ঞানীগণ পর্যবেক্ষণ করে দেখেছেন, সুমেকার লেভী-৯ নামক একটি গ্রহের মাত্র একুশটি পাথর নিপতিত হয়েছিল বৃহস্পতি গ্রহের ওপর। যার ক্ষমতা ছিল প্রায় আড়াই কোটি মেগাটন টিএনটি'র ধ্বংযজ্ঞের। ছয়শত পঞ্চাশ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে একবার প্রায় দশ কিলোমিটার ব্যাসের একটি ঝুলন্ত পাথর আঘাত করে এক মহাধ্বংস যজ্ঞের সূত্রপাত করেছিল।

        জীব বিজ্ঞানীদের ধারণা সে আঘাতেই বিরাটাকারের প্রাণী ডাইনোসোর পৃথিবী থেকে অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। বিজ্ঞানীগণ বলেন, বৃহস্পতি ও মঙ্গল গ্রহের মাঝে অসংখ্য পাথরের দল মহাশূন্যে চলমান অবস্থায় রয়েছে। এগুলো পৃথিবীতে পতিত হচ্ছে না। কে এগুলোর পতন রোধ করেছেন? আল্লাহ বলেন-

وَزَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ - وَحِفْظًا ذَالِكَ تَقْدِيرُ الْعَزِيزِ الْعَلِيمِ

        আর পৃথিবীর আকাশকে আমি উজ্জ্বল প্রদীপ দিয়ে সজ্জিত করলাম এবং সর্বোত্তম পদ্ধতিতে সুরক্ষিত করে দিলাম। এসবই এক মহাপরাক্রমশালী জ্ঞানী সত্তার পরিকল্পনা। (সূরা হামীম আস সাজদাহ্-১২)

        মহাশূন্য থেকে শুধু উল্কাই নয়, এমন অসংখ্য রশ্মি পৃথিবীর দিকে প্রতি মুহূর্তে ছুটে আসছে যে, তা পৃথিবীতে পতিত হবার সুযোগ পেলে মুহূর্তে পৃথিবী নামক এই গ্রহটি প্রাণী বসবাসের উপযোগিতা হারিয়ে ফেলতো। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর আকাশকে সুরক্ষিত ছাদের মতো না করলে সূর্য থেকে আগত সৌর ঝন্‌ঝা পৃথিবীর ওপরে প্রচন্ড উত্তাপ আর ঝড়ের ধ্বংস আঘাত হানতো যে, পৃথিবীর বুকে কোন জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা করা কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। শুধু তাই নয়, মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝখানে এসটিরয়েড ও মিটিওরের বেল্ট থেকে প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় কমবেশী ত্রিশ লক্ষ উল্কা পতিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে। কোন সে বিজ্ঞানী যিনি বিশালাকারের উল্কাগুলো মহাশূন্যের গ্যাসীয় বলয়ে মিশিয়ে দিচ্ছেন? আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَجَعَلْنَا السَّمَاءِ سَقْفًا مُحْفُوظًا -

        আর আমি আকাশকে করেছি একটি সুরক্ষিত ছাদ। (সূরা আল আম্বিয়া-৩২)

        রাব্বুল আলামীন বায়ু মন্ডলে বিভিন্ন স্তর সৃষ্টি করেছেন। বায়ুমন্ডলীয় অদৃশ্য অথচ দৃঢ় ছাদই ক্ষতিকর বিকিরণ ছেঁকে যা পৃথিবীর পরিবেশের জন্য কল্যাণকর সেসব রশ্মি প্রবেশ করতে দেয়। এক্সরে আয়নোস্ফিয়ারে, আলট্রাভায়োলেট স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারে, মাত্রাতিরিক্ত অবলোহিত রশ্মি ট্রপোস্ফিয়ারে বিশোষিত হয়ে যায়।

        শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় রশ্মিরাই প্রতিপালন ব্যবস্থায় বিস্ময়করভাবে পৃথিবী পর্যন্ত পৌঁছতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে সোলার উইন্ড এবং লক্ষ লক্ষ উল্কাপতনের কবল থেকে নিরাপদ রাখার জন্য এই অদৃশ্য ছাদই প্রতিরোধ্যতায় অটল-অবিচল। আল্লাহ তা'য়ালা বাতাস সৃষ্টি করেছেন। এ বাতাসই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, সমুদ্র থেকে মেঘ উঠিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করে এবং মানুষ, পশু ও উদ্ভিদের জীবনে প্রয়োজনীয় গ্যাসের যোগান দেয়। বাতাসের অনুপস্থিতিতে এ পৃথিবী কোন প্রাণী বসবাসের উপযোগী অবস্থান স্থলে পরিণত হতো না।

        এই ভূ-মন্ডলের ভূ-ত্বকের নিকটবর্তী বিভিন্ন স্থানে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন খনিজ ও বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বিপুল পরিমাণে স্তূপীকৃত করেছেন। উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের জীবনের জন্য এগুলো একান্ত অপরিহার্য। পৃথিবীর যে অঞ্চলে এসবের অবস্থান নেই, সে অঞ্চলের ভূমি জীবন ধারনের উপযোগী নয়।

        পৃথিবী নামক এই গ্রহটিতে নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, হৃদ, ঝরণা ও ভূগর্ভস্থ স্রোতধারার আকারে বিপুল পরিমাণ পানির ভান্ডার গড়ে তুলেছেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন। পাহাড়ের ওপরও পানির বিশাল ভান্ডার ঘনীভূত করে এবং পরবর্তীতে তা গলিয়ে প্রবাহিত করার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। তিনি রব্ব, এ ব্যবস্থা যদি তিনি না করতেন, তাহলে পৃথিবী নামক গ্রহ প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হতো না। আবার এই পানি, বাতাস এবং পৃথিবীতে অন্যান্য যেসব বস্তুর অবস্থান রয়েছে সেগুলোকে একত্র করে রাখার জন্য এই গ্রহটিতে অত্যন্ত উপযোগী মাধ্যাকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করা হয়েছে। এ মধ্যাকর্ষণ যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের থেকে কম হতো তাহলে পৃথিবী বাতাস ও পানি শূণ্য হয়ে যেতো এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধি লাভ করে এমন প্রচন্ড আকার ধারণ করতো যে, প্রাণের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতো।

        মাধ্যাকর্ষণ যদি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশী হতো, তাহলে বাতাস এতটা ঘন হয়ে যেতো যে, কোন প্রাণী নিঃশ্বাস গ্রহণ করতে পারতো না, মৃত্যু ছিল অনিবার্য। বাতাসের চাপ বৃদ্ধি লাভ করতো এবং জলীয় বাষ্প সৃষ্টি হতো না, ফলে বৃষ্টি বর্ষিত হতো না, শীতলতা বৃদ্ধি লাভ করতো, ভূ-পৃষ্ঠের কোন এলাকাই বাসযোগ্য হতো না বরং ভারীত্বের আকর্ষণ অনেক বেশী হলে মানুষ ও পশুর শারীরিক দৈর্ঘ্য-প্রস্থ কম হতো কিন্তু তাদের ওজন এতটা বৃদ্ধি লাভ করতো যে, তাদের পক্ষে চলাফেরা করা সম্ভব হতো না।

        রাব্বুল আলামীন পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে সূর্য থেকে জনবসতির সবচেয়ে উপযোগী একটি বিশেষ দূরত্বে রেখেছেন। এরচেয়ে কম দূরত্বে যদি রাখতেন, তাহলে গোটা পৃথিবী জ্বলে পুড়ে নিঃশেষে ভষ্ম হয়ে যেতো। যদি অধিক দূরত্বে রাখতেন তাহলে পৃথিবী প্রচন্ড ঠান্ডায় বরফে পরিণত হতো। প্রতিটি জগতকে যিনি সঠিক পরিমাপে নির্দিষ্ট কক্ষ পথে পরিভ্রমণ করার ব্যবস্থা করেছেন, তিনিই হলেন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।

Post a Comment

0 Comments