রাসূল কিভাবে কোরআন পাঠ করতেন


  

কোরআন কোন অবস্থায় স্পর্শ করা যেতে পারে

        আল্লাহ স্বয়ং পবিত্র এবং তাঁর বাণীও পবিত্র। তাঁর বাণী সম্বলিত পবিত্র কোরআন কোন অবস্থাতেই অপবিত্র শরীরে স্পর্শ করা যাবে না। এ মর্যাদা সম্পন্ন কিতাব স্পর্শ করতে হলে স্পর্শকারীকে অবশ্যই শরীর ও পোষাকের দিক দিয়ে পবিত্রতা অর্জন করতে হবে। এ কোরআনের মর্যাদা সম্পর্কে বলা হয়েছে-

انه لقُرآنٌ كَرِيمٌ - فِي كِتَابٍ مُكْنُون - لاَ يَمَسُّه الا المُطَهَّرُونَ . تَنْزِيلٌ مِّنْ رَّبِّ الْعَلَمِينَ 

        প্রকৃতপক্ষে এটা এক অতীব উচ্চ মর্যাদার কোরআন। একটি সুরক্ষিত গ্রন্থে দৃঢ়ভাবে লিপিবদ্ধ, যা পবিত্রতম সত্তা (ফেরেশ্তাগণ) ব্যতীত আর কেউ স্পর্শ করতে সক্ষম নয়। এটা রাব্বুল আলামীনের অবতীর্ণ করা। (সূরা ওয়াকী'আ-৭৭-৮০)

        আল্লাহর এই কোরআন এক নিখুঁত মাত্রায় পরস্পর সংযুক্ত ও সুসংবদ্ধ জীবন বিধান হিসাবে উপস্থাপিত হয়েছে। এতে আকিদা-বিশ্বাসের ভিত্তিতে চরিত্র, ইবাদাত, সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও সমাজ ব্যবস্থা, আইন ও আদালত, রাজনীতি, শিক্ষানীতি, পররাষ্ট্রনীতি, যুদ্ধ ও সন্ধিনীতি তথা মানব জীবনের সমগ্র ক্ষেত্র ও বিভাগ সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ; বিস্তীর্ণ ব্যবস্থা-বিধান দান করা হয়েছে। এ কোরআনে কোন একটি জিনিসও অপর কোন একটি জিনিস থেকে বিচ্ছিন্ন ও অসামঞ্জস্যমূলক নয়। এ কিতাবে যা বর্ণিত হয়েছে তা অবিচল; অপরিবর্তনীয় এবং এর সম্মান ও মর্যাদার দিকে দৃষ্টি রেখে তা অপবিত্রাবস্থায় পাঠ করা দূরে থাক, স্পর্শ করার অনুমতিও দেয়া হয়নি।

        মানুষকে অপবিত্রতা মুক্ত করে সৃষ্টি করা হয়নি। পক্ষান্তরে আল্লাহর ফেরেশতাগণ যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে মুক্ত। এ কোরআনে ফেরেশতাদের সত্তা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে 'পবিত্রতম সত্তা'। তাঁরা এ কোরআন যখন তখন স্পর্শ করতে পারে। কিন্তু এই মানুষের দেহের অভ্যন্তরে রয়েছে অপবিত্রতা। তা দেহের বাইরে নির্গত হলে কোন সময় মানুষের ওপরে গোসল ফরজ হয়ে দাঁড়ায়। আবার কোন অপিবত্রতা দেহ থেকে বাইরে এলে অজু করা আবশ্যক হয়। এ জন্য এসব অপবিত্রতা থেকে মুক্ত হয়ে পবিত্র বস্ত্র পরিধান করে, পবিত্র স্থানে আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন করতে হবে। এ বিষয়ে একটি কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, শয়তান স্বয়ং অপবিত্র এবং সে অপবিত্রতা পছন্দ করে। কোরআনের পাঠককে সে যদি অপবিত্র অবস্থায় পায়, তাহলে অতি সহজে সে তাকে প্রতারণা করতে সক্ষম হয়। এ জন্য আল্লাহর কিতাব অধ্যয়ন কালে পবিত্রতা অর্জনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে।

রাসূল কিভাবে কোরআন পাঠ করতেন

        পবিত্র কোরআন যে মহামানবের ওপরে অবতীর্ণ হয়েছিল, তাঁকে এ কিতাবের পঠনরীতিও শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। অর্থাৎ এ কিতাব যাঁর বাণী তিনিই তাঁকে তা পাঠ করার উপযুক্ত রীতি শিক্ষা দিয়েছিলেন। সুতরাং, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে পদ্ধতিতে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, তা ছিল মহান আল্লাহর শিখানো এবং সহীহ শুদ্ধ রীতি। ঐ একই রীতিতে কোরআন তেলাওয়াত করতে হবে পবিত্র কোরআনের অনুসারীদেরকে। আল্লাহর রাসূল কখনো দ্রুত গতিতে কোরআন তেলাওয়াত করতেন না। তিনি এমন রীতিতে তেলাওয়াত করতেন যে, প্রতিটি শব্দ স্পষ্ট বুঝা যেত। তাঁর তেলাওয়াত শুনে পাঠক অনুভর করতে পারতো, আল্লাহ তা'য়ালা কি বলছেন। আল্লাহর কালাম তেলাওয়াত শুনে শ্রবণকারী প্রভাবিত হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তেলাওয়াতের রীতি যদি এমন হয় যে, শ্রোতা রীতিমতো বিরক্তি বোধ করে অথবা তা অস্পষ্ট, এভাবে কোরআন তেলাওয়াত করা যাবে না। এ কিতাব তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে রাসূল প্রদর্শিত রীতিই অনুসরণ করতে হবে।

        বুঝে স্পষ্ট উচ্চারণে কোরআন তেলাওয়াত করলে আল্লাহ কি বলছেন, তা তেলাওয়াতকারী যেমন বুঝতে পারে এবং তার ওপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। যেমন, এমন কোন আয়াতৃ পাঠ করা হচ্ছে, যে আয়াতে আল্লাহর মূল সত্তা ও তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করা হয়েছে। সে আয়াত তেলাওয়াত করার ফলে মহান আল্লাহর বিরাটত্ব ও মহানত্ব তেলাওয়াতকারীর হৃদয়-মনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। আবার যে আয়াতে আল্লাহর রহমত সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে, সে আয়াত পাঠ করার সময় আল্লাহর শোকরের আবেগে মন-মানসিকতা উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। এভাবে যে আয়াতে আযাবের কথা বলা হয়েছে, তা পাঠ করার ফলে হৃদয়ে আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়। এক কথায় কোরআন পাঠ করার বিষয়টি যেন শুধুমাত্র শব্দের উচ্চারণ ও ধ্বনি তোলার মধ্যেই যেন সীমাবদ্ধ না থাকে সেদিকে দৃষ্টি রেখে তেলাওয়াত গভীর চিন্তা-ভাবনা, অনুধাবন ও হৃদয়ংগম করা পর্যন্ত প্রসারিত করতে হবে।

        আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিভাবে কোরআন তেলাওয়াত করতেন, এ ব্যাপারে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। তিনি জানিয়ে ছিলেন যে, আল্লাহর রাসূল প্রতিটি শব্দ টেনে দীর্ঘ করে পাঠ করতেন। তিনি বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম এমনভাবে পাঠ করতেন যে, আল্লাহ রাহমান ও রাহীম এই শব্দগুলো খুব বেশী টেনে টেনে পাঠ করতেন। (বোখারী)

        হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আল্লাহর রাসূল কিভাবে কোরআন পাঠ করতেন। তিনি জানিয়ে ছিলেন, আল্লাহর রাসূল এক একটি আয়াত পৃথক পৃথকভাবে পাঠ করতেন এবং প্রতি আয়াত পাঠ করে থামতেন। যেমন আল হামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন পাঠ করে থামতেন। তারপর আর রাহমানির রাহীম পাঠ করে থামতেন। এর পরে পাঠ করতেন মালিকি ইয়াও মিদ্দিন। (আবু দাউদ, তিরমিযী)

        আরেকটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত উম্মে সালামা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা বলেন, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক একটি শব্দ সুস্পষ্ট উচ্চারণ সহকারে পাঠ করতেন। (তিরমিযী, নাসায়ী)

        হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান সালামা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, একদিন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমি রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলাম। তখন দেখলাম তিনি কোরআন এমনভাবে পাঠ করছেন যে, যেখানে আল্লাহর প্রশংসা করার কথা বলা হয়েছে, সেখানে তিনি প্রশংসা করছেন। যেখানে দোয়া চাওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেখানে তিনি দোয়া করছেন। যেখানে আল্লাহর কাছে আশ্রয় লাভের কথা বলা হয়েছে, সেখানে তিনি আল্লাহর কাছে পানাহ্ চাইতেন। (মুসলিম, নাসায়ী)

        হযরত আবু যর গিফারী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, একদিন রাতে আল্লাহর রাসূল নামাজে কোরআন পাঠ করছিলেন। তিনি যখন এ আয়াত পর্যন্ত পৌছলেন-

إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادِكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

        'হে আল্লাহ! তুমি যদি তাদেরকে আযাব দাও, তাহলে তুমি তা দিতে সক্ষম। কারণ তারা তো তোমারই বান্দাহ্ মাত্র। আর তুমি যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তাহলে তা করার ক্ষমতা তোমারই ইখতিয়ারে। কেননা তুমি তো সর্বজয়ী ও মহাবিজ্ঞানী।' তিনি এই আয়াতটি বার বার পড়তে লাগলেন। আর এভাবে প্রভাত এসে গেল। (বোখারী, মুসনাদে আহমাদ)

        অনেকে যেমন এক নিঃশ্বাসে কোরআনের কয়েকটি আয়াত পাঠ করে থাকেন। রাসূল কখনো এমন করতেন না। তিনি প্রতিটি আয়াতের শেষে বিরতি দিয়ে তারপর পরবর্তী আয়াত পাঠ করতেন। এর ফলে শ্রোতারা বুঝতে পারতো, কি পাঠ করা হচ্ছে এবং সে আয়াতে আল্লাহ কি বলছেন তার মনে কোরআনের প্রভাব সৃষ্টি হতো।

Post a Comment

0 Comments