মহাবিশ্ব ও মহাবিশ্বের সমস্ত কিছুর রব্ব আল্লাহ

        সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে, সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর-যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। পৃথিবীর মানুষ যেন আল্লাহ তা'য়ালাকে রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে একমাত্র তাঁরই বিধান অনুসরণ করে, এ জন্য নবী-রাসূলদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়েছে। আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসূল আগমন করে তাঁদের জাতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন-

يقَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَالَكُمْ مِّنْ إِلَهِ غَيْرُهُ

        হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। (সূরা আল আ'রাফ-৫৯)

        এ কথার শোনার সাথে সাথে ঐ শ্রেণীর লোকগুলো প্রথমে প্রতিবাদ করেছে, যারা মুখে দাবী না করলেও নিজেদের কাজের মাধ্যমে প্রমাণ করতো যে, 'আমরাই সমাজ, দেশ ও জাতির সার্বভৌম ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিকারী অর্থাৎ রব্ব।' এই লোকগুলোই নবী-রাসূল এবং পরবর্তী যুগে ইসলামী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দেশের অজ্ঞ-নিরক্ষর জনগণকে ক্ষেপিয়ে তুলেছে। নবী-রাসূলদের ও ইসলামের পক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তি ছড়ানো হতো, ভয়-ভীতি প্রদর্শন করা হতো, প্রলোভন দেখানো হতো, অর্থ ও প্রভাব-প্রতিপত্তি কাজে লাগিয়ে সাধারণ মানুষকে সত্য গ্রহণ ও অনুসরণে বাধা সৃষ্টি করা হতো। জনগণকে বিভ্রান্ত করার কাজে, অতীতে যে পথ ও পদ্ধতি গ্রহণ করা হতো বর্তমানে আরো অধিক শক্তিশালী পন্থায় রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং দেশের 'সুশিল সমাজ' বলে দাবীদার লোকদের পক্ষ থেকে সেই ঘৃণিত কাজের আঞ্জাম দেয়া হচ্ছে।

        হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম সম্পর্কে তৎকালীন জাতির জাতীয় নেতারা বলতো, 'এই লোকটি আমাদের জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। সে জাতীয় উন্নতি ও প্রগতির চাকাকে পেছনে ঘুরিয়ে দিতে চায়। সে যে আদর্শের কথা বলছে, তা গ্রহণ করলে জাতির চরম অবনতি ঘটবে। লোকটি নিজে স্বয়ং বিভ্রান্ত এবং গোটা জাতিকেও বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। হযরত • নূহ আলাইহিস্ সালাম সেসব নেতাদের কথার উত্তরে বলেছিলেন-

قَالَ يَقَوْمِ لَيْسَ بِي ضَللَةٌ وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِّنْ رَّبِّ العَالَمِينَ - أَبْلِغُكُمْ رِسَلْتِ رَبِّي وَأَنْصَحُ لَكُمْ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لَا تَعْلَمُونَ

        নূহ বললো, হে আমার জাতি! আমি কোন ধরনের ভ্রষ্টতায় লিপ্ত নই, আমি তো তাঁরই রাসূল-যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। আমি তোমাদের কাছে আল্লাহর পয়গামসমূহ পৌঁছে দিয়ে থাকি, আমি তোমাদের কল্যাণকামী। আমি আল্লাহর কাছ থেকে সেসব বিষয় জানি, যা তোমাদের জানা নেই। 
(সূরা আ'রাফ-৬১-৬২)

        আল্লাহর নবী হযরত নূহ আলাইহিস্ সালাম তাঁর জাতির কাছে আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে এ কথা বলেননি যে, তিনি তোমাদের ও আমার রব্ব-বরং তিনি বলেছিলেন, 'আল্লাহ হলেন গোটা সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। তোমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান যা কিছু দেখছো শুধু এগুলোই নয়-যা তোমরা দেখতে পাওনা এমন অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে, তারা সব সেই আল্লাহকেই একমাত্র রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁরই বিধান অনুসরণ করছে।'

        তাঁকে সে জাতির নেতৃবৃন্দ যে ধরনের ধৃষ্টতামূলক কথা বলেছিল এবং যেভাবে জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিল, বর্তমানেও ইসলামের পক্ষের শক্তি সম্পর্কে দেশের জনগণকে একশ্রেণীর নেতৃবৃন্দ সেই একই কৌশলে বিভ্রান্ত করছে। ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে দেশের তথাকথিত সুশিল সমাজ সেই পুরনো ধারণাই দিচ্ছে যে, এরা দেশের ক্ষমতায় গেলে উন্নতির চাকা পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দেবে। এই লোকগুলো নিজেদেরকে জাতির রব্ব বলে অন্তরে ধারণা পোষণ করে, কিন্তু প্রকাশ্যে সে দাবী করার মতো সাহস তাদের নেই, এ কারণে এরা ভাষাগত কৌশলের আশ্রয় নিয়ে জনগণের সাথে প্রতারণা করে থাকে। কারণ এরা জানে যে, ইসলাম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তাদের রবুবিয়াত উৎখাত হয়ে যাবে। এ জন্য এসব লোক নিজেদের প্রভুত্ব বা রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠিত রাখার লক্ষ্যে ইসলামকে মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িক, সেকেল ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষিত করছে এবং ইসলামপন্থীদেরকে সন্ত্রাসী এবং সমাজের নিকৃষ্ট মানুষ হিসাবে পরিচিত করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে।

        ইতিহাসে দেখা যায়, 'আদ জাতির ভেতরে হযরত হুদ আলাইহিস্ সালামকে আল্লাহর বিধানসহ প্রেরণ করা হয়েছিল। তিনি সে জাতিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন-

يقَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَالَكُمْ مِّنْ إِلَهِ غَيْرُهُ

        হে আমার জাতি! তোমরা আল্লাহর দাসত্ব কবুল করো, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন ইলাহ নেই। (সূরা আল আ'রাফ-৬৫)

         তিনি যখন তাঁর জাতিকে এ কথা বলে আল্লাহর বিধানের দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তখন সে জাতির জাতিয় নেতা বলে দাবীদারগণ কি বলেছিল, মহান আল্লাহ তা শোনাচ্ছে-

قَالَ الْمَلأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ قَوْمِهِ إِنَّا لَنَرَاكَ فِي سَفَاهَةٍ وَإِنَّا لَنَظُنُّكَ مِنَ الْكَاذِبِينَ

        তাঁর জাতির নেতৃবৃন্দ-যারা তাঁর আহ্বান গ্রহণ করতে অস্বীকার করছিলো-তারা জওয়াবে বললো, আমরা তোমাকে নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত বলে মনে করি। আর আমাদের ধারণা এই যে, তুমি মিথ্যাবাদী।
  (সূরা আল আ'রাফ-৬৬)

        হযরত হুদ আলাইহিস্ সালামও তাদের কাছে মহান আল্লাহর পরিচয় তুলে ধরে বলেছিলেন, তিনিই আল্লাহ-যিনি তোমাদের ও আমারই শুধু রব্ব নন, তিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। তিনিই সমস্ত কিছুর প্রয়োজন পূরণ করছেন এবং সৃষ্টিজগতের সবকিছুই তাঁর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, সবাই তাঁরই বিধান অনুসরণ করছে। তিনি তাঁর জাতিকে জানিয়ে দিলেন-

قالَ يَقَوْمِ لَيْسَ بِي سَفَاهَةً وَلَكِنِّي رَسُولٌ مِّنْ رَّبِّ الْعَالَمِينَ - أَبَلِّغُكُمْ رِسَلْتِ رَبِّي وَأَنَا لَكُمْ نَاصِحٌ أَمِينٌ

        হে আমার জাতি! আমি নির্বুদ্ধিতায় লিপ্ত নই, বরং আমি তাঁরই রাসূল যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। আমি তোমাদের কাছে আমার আল্লাহর পয়গাম পৌঁছে দিই। আমি তোমাদের এমন কল্যাণকামী যে, আমার ওপরে নির্ভর করতে পারো। (সূরা আল আ'রাফ-৬৭-৬৮)

        আল্লাহর নবী হযরত হুদ আলাইহিস্ সালাম তাঁর জাতিকে এ কথা জানিয়ে দিলেন যে, তোমরা এমন সব নেতাদের অনুসরণ করো, যাদের কাছে চরিত্রের বালাই নেই। নিজের স্বার্থ ছাড়া তারা আর কিছুই বোঝে না। এরা নিজেদের প্রভাব-প্রতিপত্তি ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য যে কোন ঘৃণ্য পন্থা অবলম্বন করতে পারে। এদের বিবেক বলে কিছুই নেই। এরা এ কথাও বিশ্বাস করে না যে, এদের যাবতীয় কাজ কর্মের হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে। এরা যা কিছুই করে তা একমাত্র নিজেদের স্বার্থের কারণে করে। অতএব এদেরকে কখনো বিশ্বাস করা যায় না এবং এদের ওপরে নির্ভরও করা যায় না। আমার ওপরে নির্ভর করতে পারো তোমরা। কারণ সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব আল্লাহ তা'য়ালা আমাকে তোমাদের কল্যাণের জন্যেই প্রেরণ করেছেন। তোমাদেরকে সত্য পথপ্রদর্শনের জন্যেই আমাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। আমি আল্লাহর নবী, একমাত্র নির্ভরযোগ্য নেতৃত্ব। কোন বৈষয়িক স্বার্থ আমার নেই এবং আমার নেতৃত্বের ওপরে ঈমান এনে প্রতারিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই।

        হযরত মুছা আলাইহিস্ সালামও তদানীন্তন যুগের জালিম রাষ্ট্রপতি ফেরাউনের সামনে আল্লাহর রবুবিয়াত সম্পর্কে বলেছিলেন-

وَقَالَ مُوسَى يَا فِرْعَوْنُ إِنِّي رَسُولٌ مِّنْ رَّبِّ الْعَالَمِينَ - حَقِيقٌ عَلَى أَنْ لا أَقُولَ عَلَى اللَّهِ إِلَّا الحَقِّ قَدْ جِئْتُكُمْ بِبَيِّنَةٍ مَنْ رَّبِّكُمْ

        হে ফেরাউন, আমি সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত হয়েছি, যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। আমার পদ-মর্যাদাই হলো, আল্লাহর নামে আমি প্রকৃত সত্য ব্যতিত অন্য কোন কথা বলি না। আমি তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট নিয়োগ-প্রমাণ নিয়ে এসেছি (সূরা আ'রাফ)

        ফেরাউন নিজেকে রব্ব বলে ঘোষণা করেছিল। আর হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম সেই জালিম স্বঘোষিত রব্ব-এর সামনে প্রকৃত রব্ব মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের রবুবিয়াতের ব্যাখ্যা প্রদান করেছিলেন। ফেরাউন কর্তৃক নিয়োজিত যাদুকরবৃন্দ হযরত মুছা আলাইহিস্ সালামের মাধ্যমে প্রকৃত রব্ব-এর পরিচয় যখন লাভ করেছিলেন, তখন তাঁরা ইসলাম গ্রহণ করার সময় ঘোষণা করেছিলেন-

قَالُوا أَمَنَّا بِرَبِّ الْعَالَمِينَ - رَبِّ مُوسَى وَهَارُونَ

        আমরা ঈমান আনলাম জগতসমূহের রবের প্রতি-যিনি মুছা ও হারুনেরও রব। (সূরা আ'রাফ) আল্লাহর কিতাব-এই কোরআনের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ নিজের রবুবিয়াত সম্পর্কে ঘোষণা দিয়েছেন-

وَتَفْصِيلَ الْكِتَابِ لأَرَيْبَ فِيهِ مِنْ رَّبِّ الْعَالَمِينَ

        এই কিতাব যে সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব-এর পক্ষ থেকে এসেছে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। (সূরা ইউনুছ-৩৭)

        মহান আল্লাহর রবুবিয়াতের বর্ণনায় আল্লাহর এই কোরআন পরিপূর্ণ। তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। মানুষ এমন সব শক্তিকে নিজের রব বানিয়ে নেয়, যাদের কোনই ক্ষমতা নেই। এই লোকদেরকে প্রশ্ন করার জন্য আল্লাহ বলেন-

قُلْ مَنْ رَّبُّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ - قُلِ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْ تُمْ مِّنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لَا يَمْلِكُونَ لِأَنْفُسِهِمْ نَفْعًا وَلَا صَرَّا -

        এই লোকদেরকে প্রশ্ন করো, আকাশ ও যমীনের রব্ব কে? বলো, আল্লাহ। এরপর তাদেরকে বলো, এটাই যখন প্রকৃত ব্যাপার, তখন তোমরা কি তাঁকে বাদ দিয়ে এমন সব মাবুদকে নিজেদের কর্মকর্তা মেনে নিয়েছো, যারা স্বয়ং নিজেদেরও কোন ধরনের উপকার বা অপকার করার ক্ষমতা রাখে না।
 (সূরা আর রা'দ-১৬)

        আল্লাহ ব্যতীত কোন পীর-দরবেশকে ও মাজারে সিজদা করা যেমন শির্ক, তেমনি তাদের কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করা এবং মনের একান্ত কামনা-বাসনা পেশ করাও শির্ক। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন সত্তার কাছে দোয়া চাওয়া বা তাকে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানানোও শিরক। দোয়া ও সাহায্য চাওয়াও মূলতঃ তাত্ত্বিক বিচারে ইবাদাতের অন্তর্ভুক্ত। অতএব আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে প্রার্থনাকারী একজন মূর্তিপূজকের অনুরূপ সমান অপরাধী। তাছাড়া আল্লাহ ব্যতীত কারো কোন কল্যাণ সাধন করা বা ক্ষতি করার সামান্য ক্ষমতা নেই। অন্য কেউ কোন আপদ-বিপদ থেকে নিরাপত্তা দিতে পারে না এবং কোন খারাপ অবস্থাকে ভালো অবস্থায় পরিবর্তিত করে দিতেও পারে না। আল্লাহ ব্যতীত কোন পীর-দরবেশ বা মাজার সম্পর্কে এ ধরনের বিশ্বাস অন্তরে লালন করা একটি মুশরিকী বিশ্বাস ব্যতীত আর কিছুই নয়। আল্লাহ বলেন-

قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلَا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّعَنْكُمْ وَلَا تَحْوِيلاً - أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُوْنَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُوْنَ عَذَابَهِ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورا -

        এদেরকে বলো, আহ্বান করে দেখো তোমাদের সেই মাবুদদেরকে, যাদেরকে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের কার্যোদ্ধারকারী মনে করো, তারা তোমাদের কোন কষ্ট দূর করতে পারবে না এবং তা পরিবর্তন করতেও পারবে না। এরা যাদেরকে ডাকে তারা তো নিজেরাই নিজেদের রব্ব-এর নৈকট্যলাভের উপায় অনুসন্ধান করে ফিরছে যে, কে তাঁর নিকটতর হয়ে যাবে এবং এরা তাঁর রহমতের প্রত্যাশী এবং তাঁর শাস্তির ভয়ে ভীত। আসলে তোমার রব্ব-এর শাস্তি ভয় করার মতো। (সূরা বনী ইসরাঈল-৫৬-৫৭)

        হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম ফেরাউনকে বার বার সতর্ক করলেন যে, আল্লাহকে রব্ব বলে মেনে না নিলে তিনি ভয়ঙ্কর গযব পাঠাবেন। তবুও ফেরাউন তার নিজের দাবীতে অটল রইলো। সে নিজের চোখে দেখলো, লক্ষ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পঙ্গপাল এক মহাধ্বংসের বিভীষিকা নিয়ে এলো, ক্ষেত-খামারের মারাত্মক ক্ষতি হলো। ফলে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। আর এটা যে হবে, সে ব্যাপারে হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম পূর্বেই সতর্ক করেছিলেন। এরপর দেশ জুড়ে ব্যাঙ বের হয়ে জন-জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলা, খাদ্য গুদামে পোকা লেগে খাদ্য বিনষ্ট হওয়া বা এ ধরনের অন্যান্য জাতীয় দুর্যোগ দেখা দেয়া কোন ঐন্দ্রজালিকের কৃত্রিম শক্তি নয়, এটা কোন মানুষের ক্ষমতা নয়-এ কথা ফেরাউন ঠিকই অনুভব করেছিল। আল্লাহই যে একমাত্র রব্ব-এ কথা অনুধাবন করার পরেও ফেরাউন শক্তির দাপট দেখিয়ে যাচ্ছিলো এবং দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার জন্য হযরত মুছা আলাইহিস্সা লামকে একজন যাদুকর বলে প্রচার করছিল।

        বর্তমান যুগেও যারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে পরিচয় দিয়ে ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করে, তারাও অবশ্যই অনুধাবন করে যে, কেবলমাত্র ইসলামই সক্ষম সমস্ত সমস্যার ইনসাফপূর্ণ সমাধান দিতে। জেনে বুঝেই তারা বৈষয়িক স্বার্থে ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করে-মৌলবাদী বলে গালি দেয়। ফেরাউনও জানতো হযরত মুছা আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী হিসাবেই আগমন করেছেন এবং তিনি যেসব নিদর্শন প্রদর্শন করছেন, তা আল্লাহর নির্দেশেই করছেন। তবুও বৈষয়িক স্বার্থের কারণে সে হযরত মুছা কর্তৃক প্রদর্শিত নিদর্শনগুলোকে যাদু বলে প্রচার করছিল। তখন হযরত মুছা ফেরাউনকে বলেছিলেন-

قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أُنْزِلَ هؤلاء الأ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ - وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَشْهُورًا -

        ফেরাউনের অপবাদের উত্তরে মুছা বললো, তুমি খুব ভালো করেই জানো যে, এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব্ব ব্যতীত আর কেউ অবতীর্ণ করেনি আর আমার মনে হয় হে ফেরাউন! তুমি নিশ্চয়ই একজন হতভাগ্য ব্যক্তি। (সূরা বনী ইসরাঈল-১০২)

        হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম জানিয়ে দিলেন, আল্লাহ তা'য়ালা সৃষ্টিজগতের নির্দিষ্ট কোন কিছুর রব্ব নন-বরং তিনি এ মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের যেখানে যা রয়েছে সমস্ত কিছুর রব্ব। তাঁর অসীম ক্ষমতা দেখেও তুমি যখন সোজা পথে এলে না, তাঁকে রব্ব বলে স্বীকৃতি দিলে না, তাহলে তুমি অবশ্যই একজন কপাল পোড়া-তোমার থেকে দুর্ভাগা আর হতভাগা আর কেউ হতে পারে না।

        পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আস্হাফে কাহফের সেই সাতজন যুবকের কাহিনী বর্ণনা করেছেন। সে যুবকগুলো একমাত্র আল্লাহকে ব্যতীত আর কাউকে রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। সে সময়ের জালিম সম্রাট কাইজার ডিসিয়াস তাদেরকে দরবারে তলব করে প্রশ্ন করেছিল, 'বলো, তোমাদের রব্ব কে?' তাঁরা নির্ভীক চিত্তে জবাব দিয়েছিল-

رَبُّنَا رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نُدْعُوهُ مِنْ دُونِهِ إِلَهَا لَقَدْ قُلْنَا اذا شَطَطًا -

        আমাদের রব্ব তো কেবল তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব্ব। আমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কোন মাবুদকে ডাকবো না। যদি আমরা তাঁকে ব্যতীত অন্য কাউকে মাবুদ ডাকি, তাহলে তা হবে নিরর্থক। (সূরা আল কাহ্ফ-১৪)

        আস্হাবে কাহফের সেই যুবকগুলো জানতো, এ কথা বললে তাদেরকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। কিন্তু তাঁরা প্রাণের মায়া করেনি। তাঁরা এ কথা অনুভব করেছিল, 'পৃথিবীর জীবন একবারই পাওয়া যায়, দু'বার এই সুযোগ জুটবে না। অতএব যে জীবনে আল্লাহকে রব্ব বলে স্বীকৃতি দেয়া হলো না সে জীবনের কোন মূল্য নেই। আল্লাহকে আইনদাতা, বিধানদাতা তথা যে কোন প্রয়োজন পূরণকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁকেই অনুসরণ করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে সবনের সবচেয়ে বড় সফলতা।'

        এ জন্য তাঁরা যে কোন পরিস্থিতিকে স্বাগত জানিয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিল একমাত্র আল্লাহকেই রব্ব হিসাবে গ্রহণ করে তাঁরই দাসত্ব করবো। আর এ পথে যদি নির্যাতন আসে, মৃত্যু হয়-মৃত্যুকেই হাসি মুখে বরণ করবো। তবুও একমাত্র আল্লাহকে ব্যতীত আর কাউকে রব্ব বলে স্বীকৃতি দেবো না। হযরত ইবরাহীম যখন তাঁর জাতির নেতৃবৃন্দকে বলেছিলেন, তোমরা যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে মাটির পুতুল এবং অন্যান্য জিনিসকে নিজেদের রব্ব হিসাবে গ্রহণ করে তাদের পূজা-অর্চনা করছো, তাদের প্রতি সীমাহীন ভক্তি প্রদর্শন করছো। তাদেরকেই ইলাহ বলে মনে করছো আসলে এগুলো কিছুই নয়।

        তাঁর জাতির লোকজন তাঁকে জবাব দিয়েছিল, আমরা আমাদের বাপ-দাদা ও পূর্ব পুরুষদেরকে এদেরই ইবাদাত করতে দেখেছি। আল্লাহর নবী হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম নির্ভীক চিত্তে বলিষ্ঠ কণ্ঠে জবাব দিলেন, তোমরাও যেমন পথভ্রষ্ট তেমনি তোমাদের বাপ-দাদা এবং পূর্ব পুরুষগণও পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত ছিল। তদানীন্তন যুগের জাতিয় নেতৃবৃন্দ হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের কথায় বিস্মিত হয়ে ভেবেছিল, তিনি বোধহয় কৌতুক করে এসব কথা বলছেন। এ জন্য তারা প্রশ্ন করেছিল-

قَالُوا أَجِئْتَنَا بِالْحَقِّ أَمْ أَنْتَ مِنَ اللَّعِبِينَ

        ইবরাহীম! তুমি কি আমাদের সামনে তোমার মনের প্রকৃত কথা বলছো, না নিছক কৌতুক করছো? (সূরা আল আম্বিয়া-৫৫)

        হযরত ইবরাহীমের কথা শুনে তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েছিল। তারা এ কথা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি যে, রাজপুরোহিতের সন্তান হয়ে কেউ এ ধরনের কথা মুখে উচ্চারণ করতে পারে। আসলে এটা ইবরাহীমের মনের কথা নয়, কৌতুক করে সে এসব কথা বলছে। কিন্তু ইবরাহীম আলাইহিস সালাম স্পষ্ট কন্ঠে রব্ব হিসাবে আল্লাহর পরিচয় জানিয়ে দিলেন-

قَالَ بَلْ رَبُّكُمْ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ الَّذِي فَطَرَ هُنَّ وَأَنَا عَلَى ذَالِكُمْ مِّنَ الشَّهِدِينَ

        না, আমি মোটেও কৌতুক করছি না। বরং আসলে তোমাদের রব্ব তিনিই যিনি পৃথিবী ও আকাশের রব্ব এবং এদের স্রষ্টা এবং এ কথার স্বপক্ষে আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি। (আম্বিয়া-৫৬

        হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালাম তাঁর জাতিকে জানিয়ে দিলেন, তোমরা যাদেরকে রব্ব বলে মনে করছো এবং তাদের ইবাদাত করছো, আসলে এগুলো রব্ব নয়, রব্ব কারো সৃষ্টি হতে পারে না-তিনি স্বয়ং স্রষ্টা। তিনিই তোমাদের রব্ব, যিনি তোমাদের মাথার ওপরে আকাশ সৃষ্টি করেছেন। এ পৃথিবী সৃষ্টি করে তোমাদের জন্য এ পৃথিবীকে কল্যাণময় করে দিয়েছেন। তোমরা যাদেরকে রব্ব বলে মনে করছো, আমার আল্লাহ এগুলোরও রব্ব।

        তিনিই রব্ব, সমস্ত সৃষ্টিই তাঁর মুখাপেক্ষী। গোটা সৃষ্টি জগতের একটি অনু-পরমাণুর ক্ষমতা নেই যে, তাঁর অনুমতি ব্যতিত নড়াচড়া করতে পারে। তিনিই মানুষকে কথা বলতে এবং লিখতে পড়তে শিক্ষা দিয়েছেন। জ্ঞান-বিবেক বুদ্ধি দান করেছেন এবং সমস্ত সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। সূরা আম্বিয়ার ৯২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

        আর আমিই তোমাদের রব্ব। অতএব তোমরা আমারই দাসত্ব করো।

        এমন এক শক্তিকেই তো অবলম্বন করা উচিত-যা অবিনশ্বর, যাঁর ক্ষমতা অপরিসীম। যিনি কখনো ধ্বংস হবেন না, তাঁকেই অবলম্বন করে জীবন পরিচালিত করা উচিত। এমন কোন ঠুনকো শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়, যা ধ্বংসশীল-একদিন নিঃশেষ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহকে যারা রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তাঁরই অনুসরণ করে তারা এমন এক রবের প্রতি নির্ভর করেছে যিনি কখনো নিঃশেষ হয়ে যাবেন না। আল্লাহ বলেন-

كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلْلِ وَالْإِكْرَامِ

        এই পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসই ধ্বংসশীল এবং শুধুমাত্র তোমার মহীয়ান গরীয়ান রব্ব-এর মহান সত্তাই অবশিষ্ট থাকবে। (সূরা আর রাহমান-২৬-২৭)

        কোন শক্তিই পৃথিবীতে টিকে নেই। বিরাট পরাক্রমশালী শক্তি আদ জাতি, ছামুদ জাতি, নমরুদ, ফেরাউন এবং সাদ্দাদ কত বিরাট শক্তির অধিকারী ছিল। ইতিহাসের পৃষ্ঠা এমন অসংখ্য জালিম নায়ক কলঙ্কিত করেছে যাদের শক্তির দাপটে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মানুষ ঐসব শক্তির সামনে আঙ্গুল উঁচু করতে সাহস পায়নি। তারা সব ইতিহাসের আস্তাকুড়োয় নিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাদের নাম-নিশানা পর্যন্ত পৃথিবীর মাটি থেকে আল্লাহ রব্বুল আলামীন নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। কেউ এ কথা বলার মতো সাহস করে না যে, 'নমরুদ বা ফেরাউন আমার পূর্বপুরুষ ছিল।' অর্থবল ও জনবল, বাহুবল ও অস্ত্রবল এবং জনপ্রিয়তা দেখে মানুষ যাদেরকে বিরাট ক্ষমতাধর-শক্তিশালী মনে করে, এরা সবই মাকড়সার জালের মতই ভঙ্গুর। আল্লাহর শক্তির সামনে এরা একটি মাছির পাখার শতকোটি ভাগের এক ভাগ শক্তির অধিকারীও নয়।

        কোন পীর, বুযর্গ-সাধারণ মানুষ যাদেরকে আল্লাহর ওলী বলে মনে করে এবং ধারণা পোষণ করে যে, তাকে সন্তুষ্ট করলেই তিনি আমার জন্য আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে মুক্তির ব্যবস্থা করে দেবেন। আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করে তিনি আমার ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিতে পারেন। আমার মনের কামনা-বাসনা তিনি পূরণ করার ব্যবস্থা করতে পারেন। এসব ধারণা মানুষের নিছক কল্পনা বৈ আর কিছু নয়। পৃথিবীর মানুষ তো অদৃশ্য জগতের কোন দৃশ্যই দেখতে পায় না। কিন্তু আল্লাহর ফেরেশতাগণ-যাঁরা প্রতি মুহূর্তে আল্লাহর আদেশ পালনে রত আছেন। তাঁরাও আল্লাহর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থাকেন। আল্লাহর অনুমতি ব্যতীত তাঁরাও কোন কথা বলতে পারবেন না। পৃথিবীতে যারা আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান অনুসরণ করেছে এবং তা দেশ ও জাতিয় জীবনে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন করেছে, আখিরাতের ময়দানে তাদেরকে পুরস্কার প্রদান করে বলা হবে-

رَبِّ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا الرَّحْمَنِ لَا يَمْلِكُونَ مِنْهُ خطابًا - يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلْئِكَةُ صَفًّا - لا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ اذنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا -

        তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে, সেই অতীব দয়াবান আল্লাহর পক্ষ থেকে যিনি যমীন ও আকাশসমূহের এবং দুটোর মধ্যে অবস্থিত প্রতিটি জিনিসের একচ্ছত্র মালিক, যাঁর সাথে কথা বলার সাহস কারো হবে না। যেদিন রুহ ও ফেরেশতাগণ কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াবে, কেউ-ই কোন কথা বলবে না-সে ব্যতীত, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দেবেন। (সূরা নাবা)

Post a Comment

0 Comments