তাঁরই প্রশংসা-জগতসমূহের রব্ব যিনি

        সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। এই আল্লাহ কে-এ প্রশ্নের উদয় হবার পূর্বেই জবাব এসেছে যিনি রব্ব। কোন সে রব্ব-এ প্রশ্ন উদয় হবার পূর্বেই জবাব দেয়া হয়েছে, আলামীন-রাব্বুল আলামীন, সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। অর্থাৎ সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের প্রতিপালক, মালিক, পরিচালক, ব্যবস্থাপক, মনিব, স্রষ্টা, পরিবর্তনকারী, পরিবর্ধনকারী, প্রয়োজন পুরণকারী, দাসত্ব লাভের অধিকারী ইত্যাদি। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতেই বহুমাত্রিক জগতের ধারণা দেয়া হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা উল্লেখ করা একান্ত প্রয়োজন। তাহলো বর্তমান যুগকে অত্যাধুনিক যুগ বলে দাবি করা হয়। বিজ্ঞান দিয়েই সমস্ত কিছুর সত্যতা নির্ধারণ করা হয়। যে বিষয়টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা-পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে তাকেই একমাত্র ও চূড়ান্ত সত্য বলে গ্রহণ করার এক অযৌক্তিক মানসিকতা জড়বাদ আর বস্তুবাদী জীবন দর্শনের ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষিত এক শ্রেণীর লোকদের মধ্যে জন্মলাভ করেছে।

        প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর কিতাব এই কোরআনই হলো বিজ্ঞানের মূল উৎস। বিজ্ঞানের নবতর আবিষ্কারের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত বিজ্ঞান কোরআনের কাছে ভিক্ষার হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকবে। কোরআন যে কথা প্রায় পনের শত বছর পূর্বে পৃথিবীর মানুষের সামনে পেশ করেছে বিজ্ঞান সে কথাই নতুন করে পৃথিবীবাসীকে শোনাচ্ছে। বিজ্ঞান বলছে, জগৎ একটি নয় অসংখ্য জগৎ বিদ্যমান। অথচ বহুমাত্রিক জগতের ধারণা আল্লাহর কোরআন বহুপূর্বেই পৃথিবীবাসীকে দিয়েছে। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি এবং ব্লাকহোল ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞান'মাত্র কিছুদিন পূর্বে ধারণা দিয়েছে, পৃথিবী ব্যতীতও অন্য কোথাও প্রাণের উৎস থাকতে পারে এ ধারণা আল্লাহর কোরআন বহুপূর্বেই দিয়েছে।

        সুতরাং, আল্লাহর কোরআনের সত্যতা বিজ্ঞান প্রমাণ করবে না, বিজ্ঞানের সত্যতাই আল্লাহর কোরআন প্রমাণ করবে। একটি মাত্র কোষ থেকে মানুষ সৃষ্টি লাভ করেছে। আলো, তাপ, বাতাস ব্যতীত উদ্ভিদ বীজের অঙ্কুরোদাম ঘটে না, ফুলের পরাগায়ন পদ্ধতি, মৌমাছীর কলা-কৌশল, মরুজাহাজ উটের পানি ধারণ ক্ষমতা, মাতৃগর্ভে ভ্রূণের বিকাশ সাধন, সৃষ্টির সমতা, প্রতিটি গ্রহের আবর্তন-বিবর্তন, যার যার কক্ষপথে পরিভ্রমণ ইত্যাদি সম্পর্কে বিজ্ঞান স্বল্প কিছুদিন পূর্বে ধারণা পেশ করেছে। আর এসব তথ্য আল্লাহর কোরআন সপ্তম শতাব্দীতেই মানুষকে অবহিত করেছে এবং এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছে। অতএব বিজ্ঞানের আবিষ্কার যত বৃদ্ধি লাভ করবে ততই বিজ্ঞান কোরআনের কাছে ঋণের জালে বন্দী হবে।

        সাধারণতঃ মানুষ এই পৃথিবীকেই প্রথম ও শেষস্থল বলে জানতো। এরপর মানুষ ধারণা লাভ করলো মানুষের জীবনাবসানের পরে পরলোক বলে আরেকটি জগৎ রয়েছে। কোরআনে বর্ণিত বহুমাত্রিক জগতের ধারণা পেয়ে চিন্তাশীল মানুষ যখন গবেষণা করেছে, তখন তারা 'আলামীন' শব্দের রহস্য উদ্ঘাটন করতে কিছুটা সমর্থ হয়েছে। সূরা ফাতিহা আল্লাহর পরিচয় দিতে গিয়ে ঘোষণা করেছে, তিনি জগতসমূহেয় প্রতিপালক। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আমরা চোখের সামনে জগৎ দেখছি মাত্র একটি এবং পৃথিবী নামক এই জগতে আমরা বসবাস করছি। অন্য জগতগুলো কোথায়? সাধারণভাবে চিন্তা করলেই সূরা ফাতিহায় বর্ণিত বহুমাত্রিক জগৎ সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যেতে পারে।

        মহাশূন্যে কতটি জগৎ রয়েছে, সে আলোচনা মুলতবী রেখে পৃথিবীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায়, পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের নীচে আরেকটি জগৎ বিদ্যমান। মাটির নানা স্তর সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ তা'য়ালা। অসংখ্য খনিজজগৎ মাটির নীচে সৃষ্টি করেছেন। খনিজ পদার্থসমূহ মাটির নীচের জগতেই অবস্থান করছে। পানির জগৎ রয়েছে মাটির নীচে। মাটির নীচে এমন ধরনের জগৎ বিদ্যমান রয়েছে যে, প্রতিটি মুহূর্তে সেখানে গলিত উত্তপ্ত লাভা আলোড়িত হচ্ছে। মাঝে মাঝে তা জ্বালামুখ দীর্ণ করে পৃথিবীতে এসে আঘাত হানছে। কোথাও রয়েছে উত্তপ্ত ফুটন্ত পানি। ফুটন্ত প্রসবণ, ঝর্ণার আকারে তা নির্গত হয়ে থাকে।

         সমুদ্র গর্ভে রয়েছে আরেকটি জগৎ। অগণিত প্রাণী সেখানে বসবাস করছে। সমুদ্রের অতল তলদেশে রয়েছে উদ্ভিদজগৎ। এরও নীচে রয়েছে উত্তপ্ত লাভার জগৎ। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠে রয়েছে মরুজগৎ, অরণ্যজগৎ, পশুজগৎ। দৃশ্যমান জগতেরই কোন শেষ সীমা নেই, এরপরেও রয়েছে অদৃশ্যজগৎ। পরমাণু জগতও সম্পূর্ণ একটি অদৃশ্যজগৎ। পরমাণু বা এ্যাটম-একে আমরা কোন কিছুর সাহায্য ব্যতীত দেখতে সক্ষম নই। এটা কেন দেখা যায় না এ প্রশ্নের জবাব পেতে হলে প্রথমে দেখতে হবে আমাদের দেখার বা চোখের ক্ষমতা কতটুকু।

        যখন আমরা কোন বস্তুকে দর্শন করি, তখন ঐ বস্তু থেকে আলোক তরঙ্গ ছড়িয়ে পরে এবং তা আমাদের চোখের ভেতরে প্রবেশ করে। আলোক তরঙ্গের বিচ্ছুরণ ব্যতীত কোন কিছুই আমরা দেখতে পাই না। যখন কোন আলোক তরঙ্গ কোন জিনিসের ওপরে পতিত হয়ে বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে আবৃত করে ফেলে তখন আলোক তরঙ্গ আর ঐ বস্তু থেকে বিচ্ছুরিত হতে পারে না। সুতরাং, কোন বস্তু থেকে আলোক তরঙ্গ বিচ্ছুরিত হবার শর্ত হলো, বস্তুতে পতিত আলোক তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অপেক্ষা বড় হতে হবে।

        এবার আসা যাক পরমাণু সম্পর্কিত ব্যাপারে। পরমাণু দৃশ্যমান আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য অপেক্ষা অনেক ছোট। এ কারণে আলোক তরঙ্গ যখন তার ওপর পতিত হয় তখন তা সম্পূর্ণ পরমাণুকে পরিপূর্ণভাবে আবৃত করে ফেলে। যে কারণে আর তা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হতে পারে না। এই কারণেই আমরা পরমাণু খালি চোখে দেখতে পাই না।

        এভাবে যদি কয়েক লক্ষ পরমাণু মানুষের চোখের সামনে রাখা হয়, তবুও তা মানুষের দৃষ্টি দেখতে সক্ষম হবে না। মানুষের দৃষ্টি যা দেখতে সম্পূর্ণ অক্ষম অথচ এই পরমাণুরে ভেতরে আল্লাহ তা'য়ালা আরেকটি শক্তিশালী জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এই জগতকেই বলা হয় পরমাণু জগৎ। মানুষের দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরমাণু ভাঙলে পাওয়া যায় ইলেক্‌ট্রন, প্রোটন, নিউট্রন, নিউক্লী, কোয়ার্ক এবং আরো কত কিছু। এ ধরনের বহু অণুকণা ও প্রতিকণা অদৃশ্য জগতে বিরাজ করছে। স্বাভাবিক দৃষ্টিশক্তির মাধ্যমে এসব কণা দর্শন করা সম্পূর্ণ অসম্ভব। ভারী মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অবিরাম নানা ধরনের তেজস্ক্রিয় রশ্মি নির্গত হচ্ছে। এসব রশ্মি অত্যন্ত শক্তিশালী এবং উচ্চ ভেদন শক্তি সম্পন্ন; এসব নিউক্লিয়াসকে ভেঙে প্রতি মুহূর্তে নির্গত হয়। এ ধরনের আরো অদৃশ্য রশ্মি সৃষ্টি জগতে বিদ্যমান এবং যা খালি চোখে দেখা সম্পূর্ণ অসম্ভব। অদৃশ্যজগতে এমন অনেক ক্ষুদ্র এককোষী প্রাণী রয়েছে যেগুলো মানুষের পরিবেশকে বেষ্টন করে আছে। এসব এককোষী প্রাণীর মধ্যে কোন একটির অভাব ঘটলে পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হবে, ফলশ্রুতিতে মানুষের জীবন বিপন্ন হবে।

        বর্তমান বিজ্ঞান বলছে, মানুষ যে সৌরজগতে বসবাস করছে এবং তার দৃষ্টির সামনে পরিদৃশ্যমান যে জগত বিদ্যমান এটাই শেষ নয়। এ ধরনের অসংখ্য সৌরজগৎ মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর প্রতি চার বিলিয়ন মানুষ যদি একটি করে সৌরজগতে অবস্থান করে, এরপরেও সহস্র বিলিয়িন তথা অসংখ্য সৌরজগৎ ফাঁকা থেকে যাবে। এত সৌরজগৎ মহান আল্লাহ মহাশূন্যে সৃষ্টি করেছেন। মহাশূন্য যে কত বিশাল তা কোন বিজ্ঞানীর পক্ষে আবিষ্কার করা তো দূরের কথা, এর বিশালতা সম্পর্কে কল্পনাও করতে পারেনি। মহাশূন্যে রয়েছে অসংখ্য চন্দ্র, সূর্য, তারকাপুঞ্জ, গ্রহ-উপগ্রহ, মিল্কীওয়ে, গ্যালাক্সী এবং ব্লাকহোল। এসবের পরিধি এবং বিশালতা দেখে বিজ্ঞানীগণ স্তম্ভিত হয়ে পড়েছেন।

        আল্লাহ তা'য়ালা যে বিশলতা দিয়ে মহাশূন্য নির্মাণ করেছেন সে তুলনায় এই পৃথিবী একটি ছোট্ট মার্বেলের সমানও নয়। মহাজগতের বিবেচনায় বর্তমানে মানুষ যেখানে অবস্থান করছে, এই সৌরজগতটি নিতান্তই ক্ষুদ এবং অতি তুচ্ছ একটি অঞ্চল। বিশাল মহাসমুদ্রে একবিন্দু পানি যেমন, মহাবিশ্বে এই সৌরজগতের অবস্থান ঠিক তেমনি। স্বয়ং পৃথিবীর অবস্থা যদি ছোট্ট একটি মার্বেলের মতো হয় তাহলে ক্ষমতাদর্পী এই মানুষের অবস্থান কোথায়? মহাশূন্যের তুলনায় মানুষ ক্ষুদ্র একটি পিপীলিকার মতও নয়। অতএব অস্তিত্বহীন শক্তি আর ক্ষুদ্র পরিসরে আবদ্ধ জীবনের অধিকারী হয়ে মানুষের পক্ষে স্বয়ং আল্লাহর প্রতি অকৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করা চরম বোকামী বৈ আর কিছুই নয়। এ জন্য পৃথিবীর বর্তমানে যারা বিখ্যাত বিজ্ঞানী তারা নাস্তিক্যবাদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করেন। মহাশূন্যের সৃষ্টিসমূহ আর বিশালতা দর্শন করে তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছেন।

Post a Comment

0 Comments