যিনি পরম মেহেরবান ও অসীম করুণাময়

الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

        সূরা ফাতিহার ব্যাখ্যার শুরুতেই এ কথা বলা হয়েছে যে, এটা একটি অভিনন্দন-পত্রের মতো। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে তাঁর বান্দাগণ তাঁরই শেখানো ভাষায় অভিনন্দন জ্ঞাপন করছে। প্রথমে আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে বলা হয়েছে, সমস্ত প্রশংসাই তাঁর। অন্য কেউ প্রশংসা লাভের যোগ্য বলে কোনক্রমেই বিবেচিত হতে পারে না। তাঁর প্রশংসা এ জন্যই করা হয় এবং করতে হবে যে, তিনি হলেন আল্লাহ। আল্লাহর পরিচয় সম্পর্কে জানানো হলো যে, তিনি সৃষ্টি জগতসমূহের স্রষ্টা, মালিক, প্রতিপালক, ব্যবস্থাপক, পরিচালক, নিয়ন্ত্রক, আইন রচয়িতা, আইন প্রয়োগকারী, বিধানদাতা ইত্যাদি। ইতিপূর্বে তাঁর যেসব গুণ-বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে, এগুলোই শেষ নয়-তাঁর আরো গুণাবলী রয়েছে। তিনি আপন মহিমায় গৌরবান্বিত। আল্লাহর কোরআন বলছে-

اللهِ العَزِيزِ الحَمِيدِ الَّذِي لَهُ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ

        যিনি প্রবল পরাক্রান্ত এবং নিজ সত্তায় স্ব-প্রশংসিত, যিনি আকাশমন্ডল ও পৃথিবী সাম্রাজ্যের অধিকারী। (সূরা আল বুরুজ-৯-৮)

        তিনি অসংখ্য গুণ-বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। তাঁর অসংখ্য গুণ ও বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটেছে তাঁরই সৃষ্টি কর্মের মাধ্যমে। তাঁর দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান সৃষ্টি কর্মের দিকে দৃষ্টিপাত করলে স্পষ্টতই অনুভূত হয়, তিনি অসীম দাতা ও দয়ালু। তাঁর দয়া ও দানের কোন শেষ সীমা নেই। এই কথাটিরই স্বীকৃতি বান্দা দেয়া হয় সূরা ফাতিহার মাধ্যমে। বান্দা বলে, তুমি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্বই শুধু নও-তুমি মেহেরবান, তুমি এমন দাতা যে, কোনকিছু চাওয়ার পূর্বেই দিয়েছো। তুমি এমনই করুণাময় যে, আমাদেরকে সঠিক পথ প্রদর্শন করেছো এবং জীবন ধারণের জন্য যতকিছু প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা তুমি করেছো। সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, রাহমান ও রাহীম। এ দুটো শব্দ হলো মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের গুণবাচক বা সিফাতী নাম। এই দুটো নামই সূরা আল ফাতিহায় ব্যবহৃত হয়েছে। এ দুটো শব্দের উৎস হলো 'রহম' ধাতু থেকে।

        এ দুটো শব্দই তথা গুণবাচক নাম দুটোই আল্লাহ তা'য়ালার অসীম দয়া-করুণার কথা প্রকাশ করছে। কিন্তু রহমান শব্দ দিয়ে আল্লাহর যে দয়া ও অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, তাহলো অস্থায়ী দয়া ও অনুগ্রহ। আর রাহীম শব্দ দিয়ে আল্লাহ তা'য়ালার যে দয়া-করুণা, অনুগ্রহের কথা বলা হয়েছে, তাহলো স্থায়ী। রাহমান শব্দের মাধ্যমে যে গুণ প্রকাশিত হয় তার অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক হলেও তা অস্থায়ী ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহর রহমত, সর্বত্র সর্বব্যাপক। তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, তা সবই তাঁরই রহমত লাভ করে। কিন্তু এ রহমত সবাই চিরস্থায়ীভাবে লাভ করবে না। পৃথিবীতে রাহমানের রহমত সমস্ত শ্রেণীর মানুষ লাভ করলেও আখিরাতের ময়দানে তা বিশেষ শ্রেণীর জন্যই প্রযোজ্য হবে এবং তা হবে চিরস্থায়ী রহমত। পক্ষান্তরে রাহীম শব্দের মাধ্যমে আল্লাহ তা'য়ালার যে দয়া-করুণা-রহমতের কথা বলা হয়েছে, তা শুধু পরকালীন বিশেষ রহমতকে বুঝানো হয়েছে। প্রতিটি সৃষ্টির ওপরে তাঁর অসীম রহমত বৃষ্টি ধারার মতই প্রতি মুহূর্তে, বর্ষিত হচ্ছে। এই রহমত বর্ষণের ক্ষেত্রে কোন পার্থক্য করা হচ্ছে না।

        পৃথিবীতে যারা মুসলিম, যারা কোরআন সুন্নাহ্ অনুসরণ করার দাবি করছে, তারাই শুধু তাঁর রহমতের অংশ লাভ করছে না বা তারা যে দেশসমূহে বসবাস করে, সেই দেশের বুকেই তাঁর রহমত বর্ষিত হচ্ছে না। যারা তাঁকে অস্বীকার করছে, তাঁর বিধানের সাথে বিদ্রোহ করছে, তাঁর কোরআনের সাথে অসম্মানজনক আচরণ করছে, ইসলামের লেবাস পরিধান করে প্রতারণা করছে, কোরআন উৎখাতের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে, তারাও আল্লাহর রহমত লাভ করছে। কিন্তু আল্লাহর এই রহমত তারা লাভ করবে শুধুমাত্র এই পৃথিবীতেই, পরকালে তারা আল্লাহর রহমত লাভ করবে না। এই অর্থে আল্লাহর রহমত হলো অস্থায়ী। অর্থাৎ তাদের ওপরে যে রহমত বর্ষিত হচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা মৃত্যুর পরে আর চলতে থাকবে না। মৃত্যুবরণ করার সাথে সাথে রহমত বর্ষণের প্রক্রিয়া বন্ধ ঘোষিত হবে।

        আর যারা মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় দিবারাত্রি অহর্নিশি চেষ্টা-সাধনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত রেখেছে, অর্থাৎ আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে সাধ্যানুয়ী জীবন পরিচালিত করছে, আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন করছে, আন্দোলনের পথে কষ্টার্জিত অর্থ-সম্পদ বিলিয়ে দিচ্ছে, সময়ের কোরবানী দিচ্ছে, স্বার্থ ত্যাগ করছে, জুলুম-নির্যাতন বরদাস্ত করছে, অপমানিত ও প্রহৃত হচ্ছে, কারাগারকে হাসি মুখে স্বাগত জানাচ্ছে, ফাঁসির মঞ্চের দিকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে, প্রয়োজনে নিজের প্রিয় জীবনটাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করে দিয়ে শাহাদাতবরণ করছে, তাদের ওপরেও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে না, বরং রহমতের মাত্রা সীমাতিরিক্ত বৃদ্ধি লাভ করছে এবং তার ধারাবাহিকতা কখনো কোনদিন শেষ হবে না, অনন্ত কাল ধরে তা চলতে থাকবে।

        মহান আল্লাহর অসংখ্য গুণবাচক নামের মধ্যে রাহীম অপেক্ষা রাহমান অত্যন্ত বেশী ব্যাপক অর্থবোধক। এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য অনেক বেশী। আল্লাহ হলেন রাহমান-তিনি রাহমান পৃথিবীতে সমস্ত মানুষের জন্য আর কিয়ামতের ময়দানে শুধুমাত্র মুমিনদের জন্য। তিনি *রাহীম-তাঁর এই দয়া তিনি কিয়ামতের ময়দানে তাঁর একান্ত অনুগত বান্দাদের জন্য করবেন। এ জন্য তাফসীরে বলা হয়েছে-

الرَّحْمَنُ هُوَ ذُو الرَّحْمَةِ الشَّامِنَةِ بِجَمِيعِ الْخَلَائِقِ فِي الدُّنْيَا وَالْمُؤْمِنِينَ فِي الآخِرَةِ

        রহমান হলেন তিনি-যিনি এমন রহমতের গুণ-সম্পন্ন, তাঁর রহমত পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টিকেই আবৃত করেছে এবং আখিরাতে তা শুধুমাত্র তাঁর অনুগত বান্দাগণই লাভ করবে।

        আর রাহীম শব্দের অর্থ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তাফসীরে বলা হয়েছে-

الرَّحِيمُ ذُو الرَّحْمَةِ الشَّامِلَةِ لِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ

        রাহীম হচ্ছেন তিনি-যিনি এমন রহমতের গুণ-সম্পন্ন, আখিরাতের ময়দানে কেবলমাত্র মুমিনগণই সে রহমতের অধিকারী হবে।

        আল্লাহর রহমত ব্যতিত গোটা সৃষ্টিজগৎ এক মুহূর্তের জন্যেও সচল থাকতে পারে না। সৃষ্টির সর্বত্র তাঁর অসীম করুণা ঝর্ণাধারার মতোই প্রবাহিত হচ্ছে। তাঁর রহমতের সরোবরে অবগাহন করছে সমস্ত সৃষ্টি। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

الرَّحْمَنُ - رَحْمَنُ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ الرَّحِيمُ - رَحِيمُ الْآخِرَةِ

        আল্লাহ হচ্ছেন রাহমান-তিনি পৃথিবী ও আখিরাতে সর্বত্রই তাঁর দয়া-অনুগ্রহ বর্ষণ করছেন এবং রাহীম হচ্ছেন তিনি, যিনি আখিরাতে তাঁর বিশেষ দয়া-করুণা বর্ষণ করবেন।

        কিয়ামতের ময়দানে রাহমানের দয়া ও অনুগ্রহ শুধুমাত্র তাঁরাই লাভ করবে, যারা এ পৃথিবীতে তাঁরই বিধান অনুসরণ করেছে, ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন করেছে। আর যারা বিরোধিতা করেছে, পৃথিবীতে আল্লাহ যেমন তাদের প্রতি রাহমান রয়েছেন, কিয়ামতের ময়দানে তেমনি তিনি রাহমান থাকবেন না। কোরআন বলছে-

يَوْمَ نَحْشُرُ المُتَّقِينَ إِلَى الرَّحْمَنِ وَقْدًا - وَنَسُوقُ الْمُجْرِمِينَ إِلَى جَهَنَّمَ وِرْدا - لَا يَمْلِكُونَ الشَّفَاعَةَ إِلَّا مَنِ اتَّخَذَ عِنْدَ الرَّحْمَنِ عَهْدًا -

        সেদিনটি অচিরেই আসবে যেদিন আল্লাহভীরুদেরকে মেহমান হিসাবে রাহমানের সামনে পেশ করা হবে এবং অপরাধীদেরকে পিপাসার্ত পশুর মতো জাহান্নামের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। সে সময় যে রাহমানের কাছ থেকে পরোয়ানা অর্জন করেছে তার ছাড়া আর কারো সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকবে না। (সূরা মায়াম-৮৫-৮৭)

        আল্লাহকে যারা ভয় করে পৃথিবীতে জীবন-যাপন করে এবং যারা তাঁকে ভয় করে না, তাঁর বিধানের প্রতি বিদ্রোহী ভূমিকা পালন করে, এ দুটো দলই আল্লাহ রাহমান হিসাবে তাঁর দয়া ও অনুকম্পা ভোগ করছে। কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহ বিরোধী দল রাহমানের করুণার একবিন্দু পরিমাণও লাভ করবে না। পশু যেমন পানির পিসাসায় জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকে, আল্লাহর বিধান অমান্যকারী দলও কিয়ামতের দিন পানির পিপাসায় জিহ্বা বের করে হাঁপাতে থাকবে। এই অবস্থায় তাদেরকে বন্য পশুর মতই তারিয়ে নিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এই কাজ সম্পাদন করতে রাহমানের সামান্য দয়ারও উদ্রেক হবে না। কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তি সুপারিশ লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন, তিনিও ঐ রাহমানের অসীম দয়ার কারণেই সুপারিশের যোগ্য হবেন। সেদিন তাঁর সামনে কোন কথা বলার সাহস তো দূরে থাক, মানুষ চোখের পলক ফেলতেও ভুলে যাবে। রাহমানের অনুমতি ব্যতিত কেউ কথা বলতে সক্ষম হবে না। সূরা নাবা-এর ৩৮ আয়াতে আল্লাহ বলেন-

لا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ

        কেউ কোন কথা বলবে না সে ব্যতিত, যাকে রাহমান-পরম দয়াবান অনুমতি দিবেন।

        পৃথিবীতে একশ্রেণীর মানুষ নানাভাবে অহঙ্কারের প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। হাঁটা চলাফেরায়, কথা বলায়, পোষাক-পরিচ্ছদে গর্বিত ভঙ্গী প্রকাশ পায়। পক্ষান্তরে কিয়ামতের ময়দানে অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে যাবে। কোরআনের সূরা ত্বা-হা ঘোষণা করা হয়েছে-

يَوْمَئِذٍ يَتَّبِعُونَ الداعي لأعوَجَ لَهُ وَخَشَعَتِ الْأَصْوَاتُ لِلرَّحْمَنِ فَلا تَسْمَعُ إِلا هَمْسًا - يَوْمَئِذٍ لا تَنْفَعُ الشَّفَاعَةُ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَرَضِي لَهُ قَوْلاً -

        সেদিন সবাই আহ্বানকারীর আহ্বানে সোজা চলে আসবে, কেউ কোন সামান্য দর্পিত ভঙ্গীর প্রকাশ ঘটাতে পারবে না এবং রাহমান-করুণাময়ের সামনে সমস্ত আওয়াজ স্তব্ধ হয়ে যাবে, মৃদু খসখস শব্দ ব্যতিত কোন শব্দ শোনা যাবে না। সেদিন কোন সুপারিশ কার্যকর হবে না, তবে যদি রাহমান-করুণাময় কাউকে অনুমতি দেন এবং তার কথা শুনতে পছন্দ করেন।

        উল্লেখিত আয়াতে 'মৃদু খসখস শব্দ' বলতে বুঝানো হয়েছে, চলাচলের শব্দ। সেদিন এমন এক ভীতিপ্রদ পরিবেশ বিরাজ করবে যে, মানুষ তো দূরের কথা, কোন ফেরেশতাও কোন কথা বলতে পারবে না। তারা প্রয়োজনে চলাচল করবে। তাদের চলাচলের শব্দের কথাই বলা হয়েছে উক্ত আয়াতে। নীরবে নিভৃতে নিঃশব্দে, অত্যন্ত সন্তর্পণে ভয়-কম্পিতাবস্থায় তারা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে চলাচল করবে। আর যিনি সুপারিশ করবেন, তিনি স্বাধীনভাবে যার ব্যাপারে খুশী, তার ব্যাপারে সুপারিশ করতে পারবেন না। বরং সুপারিশ লাভের যোগ্য বলে আল্লাহ যাকে নির্বাচিত করবেন, তিনিই শুধু সুপারিশ লাভ করবেন।

Post a Comment

0 Comments