রাহমানের রাহমত সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী পরিব্যাপ্ত

        আল্লাহর কিতাবের প্রথম সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতেই বলা হয়েছে, তিনি রাহমান। আরবী ভাষায় রাহমান শব্দের ব্যাপক তাৎপর্য রয়েছে। রাহমান শব্দের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, 'অন্তর জগতের এমন একটি নমনীয়, কমনীয়, দয়ার্দ্র, করুণা মিশ্রিত উচ্ছ্বসিত অবস্থার প্রতি ইঙ্গিত করে, যার ফলে রাহমান গুণের অধিকারী সত্তার স্বতঃস্ফূর্তভাবে মহানুভবতা, প্রীতি-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, স্নেহ-ঔদার্য্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটে।' এ জন্য আল্লাহর রহমতের মধ্যে রয়েছে স্নেহ, প্রীতি-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, করুণা-অনুগ্রহ, স্বতঃস্ফূর্তভাবে দান করার প্রবণতা, অকৃতজ্ঞকে বার বার সুযোগ দেয়ার প্রবণতা, অপরাধীকে ক্ষমা করার ও সংশোধন হবার সুযোগ দানের প্রবণতা ইত্যাদি মহৎ গুণের সমাহার।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে পরিচালিত করছেন তাঁর প্রীতি-ভালোবাসা, করুণা, মায়া-মমতা, দয়া-অনুগ্রহ দিয়ে। তাঁর রহমত সমস্ত সৃষ্টিজগতের ওপরে বৃষ্টিধারার মতই বিরামহীন গতিতে বর্ষিত হচ্ছে। মানুষ যেদিকেই দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, সেদিকেই তাঁর অফুরন্ত রাহমত দেখতে পাবে। নিজের দেহসহ প্রতিটি প্রাণী ও সৃষ্টি বস্তুর গঠন প্রণালীর ভেতরেও তাঁরই অসীম রাহমত দেখতে পাবে। আল্লাহ বলেন-

وَرَحْمَتِي وَسِعَتْ كُلَّ شَيْءٍ

        আমার রাহমত সমস্ত সৃষ্টিকে পরিব্যাপ্ত করে রয়েছে। (সূরা আল আ'রাফ-১৫৬)

        সর্বত্র আল্লাহর রাহমত বৃষ্টিধারার মতোই বর্ষিত হচ্ছে-আল্লাহর এ কথার অর্থ এ নয় যে, কোন অপরাধীকে গ্রেফতার করার ক্ষেত্রেও তাঁর রাহমত এসে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে এবং সেই সুযোগে আল্লাহদ্রোহীরা মুক্তি পেয়ে যাবে। একশ্রেণীর মানুষ আল্লাহর রাহমত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষন করে যে, তিনি রাহমান-অসীম দয়ালু, তাঁর দয়ার কোন শেষ নেই। সুতরাং মানুষ যতই অপরাধী হোক না কেন, তিনি অপরাধী মানুষকে শাস্তি দান করবেন না। তাঁর ক্রোধকে তাঁরই রাহমত এসে আবৃত করে ফেলবে। যারা এ ধারণা পোষন করে, তারা এ কথাটি ভুলে যায় যে, সীমালংঘনকারী-অপরাধীকে শাস্তি দেয়াও তাঁর আরেকটি গুণ ও বৈশিষ্ট্য, তিনি আহ্হ্বামূল হাকিমিন-মানুষ যেমন, আল্লাহর রাহমত লাভ করে থাকে, সেই সাথে তারা যদি আল্লাহর রাহমাত লাভ করে বেপরোয়া হয়ে ওঠে, স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, মানুষের ওপরে অন্যায় অত্যাচারের বন্যা বইয়ে দিতে থাকে, তখন অবশ্যই আল্লাহ আযাব নাযিল করে থাকেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

رَبُّكُمْ ذُو رَحْمَةٍ وَاسِعَةٍ وَلَا يُرَدُّبَاسُه عَنِ الْقَوْمِ الْمُجْرِمِينَ

        তোমাদের রব্ব ব্যাপক রাহমতের মালিক এবং অপরাধী লোকদের প্রতি তাঁর দেয়া আযাব প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। (সূরা আন'আম-১৪৭)

        সুতরাং মজলুম জনতার আর্তনাদ যখন আল্লাহর আরশে গিয়ে পৌছায়, তখন জালিমের ওপরে অবশ্যই নিষ্ঠুরদন্ড নেমে আসবে, এতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই'। প্রতিটি জাতির ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায় যে, সেসব জাতির ভেতরে যারাই স্বৈরাচারীর নির্মম দন্ড হাতে নিয়ে জগদ্দল পাথরের মতো জাতির ঘাড়ে চেপে বসেছে, মহান আল্লাহ তাদেরকে ইতিহাসের আস্তাকুড়োয় এমনভাবে নিক্ষেপ করেছেন, তাদের নাম শুনলে একটা অবিমিশ্র ঘৃণায় মানুষের মন বিষিয়ে ওঠে।

        মানুষ ভ্রান্তপথ অবলম্বন করে নিষ্ঠুরতায় মেতে উঠবে, অন্যায়, অবিচার ও অরাজকতায় গোটা। পৃথিবীকে পরিপূর্ণ করে ফেলবে, এসব থেকে মানবতাকে মুক্ত রাখার জন্য মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে নবীকে কিতাবসহ প্রেরণ করেছেন। তিনি রাহমান, তাঁর প্রিয় বান্দারা ভ্রান্তপথে চলতে গিয়ে সমূলে ধ্বংস হয়ে যাবে আর তিনি নীরবে দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন-এ ধরনের গুণ-বৈশিষ্ট্য থেকে তিনি সম্পূর্ণ মুক্ত। তিনি পরম করুণাময়। মানুষের দুরাবস্থা সম্পর্কে পূর্ণ সজাগ-সচেতন। এ জন্য তিনি অসীম অনুগ্রহ করে মানুষের ভেতর থেকেই একজন মহান ব্যক্তিকে নবী হিসাবে নির্বাচিত করে তাঁকে কিতাব দান করেছেন। আল্লাহর অন্য কোন রামতের কথা বাদ দিলেও শুধুমাত্র নবী-রাসূল আর কিতাব দান সম্পর্কিত রাহমাতের শোকর আদায় করা মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। পথহারা মানবতাকে পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে নবী-রাসূল আর কিতাব দান করা যে কত বড় রহমত-এ সম্পর্কে আল্লাহ স্বয়ং বলছেন-

إِلَّا رَحْمَةً مِّنْ رَّبِّكَ إِنَّ فَضْلَهُ كَانَ عَلَيْكَ كَبِيرًا -

        এই যে তুমি যা কিছু লাভ করেছো, এসব তোমার রব্ব-এর রাহমত, প্রকৃতপক্ষে তাঁর রাহমত তোমার প্রতি অনেক বড়। (সূরা বনী ইসরাঈল-৮৭)

        কোন ফেরেস্তাকে নবী হিসাবে নির্বাচিত না করে মানুষের মধ্য থেকে নবী-রাসূল নির্বাচিত করাও আল্লাহ তা'য়ালার আরেকটি বিরাট রাহমত। মানবীয় গুণাবলীর বাইরের সৃষ্টি হলো ফেরেস্তাগণ। একজন মানুষের পক্ষে আরেকজন মানুষের আবেগ-অনুভূতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা যতটা সহজ এবং স্বাভাবিক, মানবীয় গুণ-বৈশিষ্ট্য শূণ্য একজন ফেরেশতার পক্ষে তা সহজ ও স্বাভাবিক নয়। মানুষের আহার, নিদ্রা, মলমূত্র ত্যাগের প্রয়োজন রয়েছে। রিযিক লাভের জন্য তাকে কর্ম করতে হয়, সংসার ধর্ম পালন করতে হয়।

        কিন্তু ফেরেস্তার এসব কোন কিছুর প্রয়োজন হয় না। ফেরেস্তা নবী হলে মানুষের এসব কর্মের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করা কোনক্রমেই সম্ভব হতো না। ফলে ফেরেস্তা নবীর আহ্বানে সাড়া দেয়া মানুষের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। ফেরেস্তা নবীর সাথে তাঁর অনুসারী মানুষের দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগে যেতো, নবী ও অনুসারীর মধ্যে একটা বিরাট ব্যবধান সৃষ্টি হতো। আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের আবেগ-উচ্ছ্বাস ও প্রয়োজনীয়তার প্রতি দৃষ্টি রেখে মানুষের মধ্য থেকেই একজন মহৎ প্রাণ-অতিমানবকে নবী হিসাবে নির্বাচিত করেছেন। তিনি রাহমান-এটা তাঁর অসীম দয়ার প্রকাশ।

        মহান আল্লাহ অসীম রাহমাতের অধিকারী। যারা তাঁর ওপরে ঈমান আনবে এবং তাঁর নবীর ওপরে ঈমান আনবে, আল্লাহর বিধান এ পৃথিবীতে অনুসরণ করবে, তাদেরকে তিনি এ পৃথিবীতেও 'নূর' দান করবেন এবং কিয়ামতের ময়দানেও 'নূর' দান করবেন। তাদের প্রতি তিনি তাঁর রাহমতকে দ্বিগুণ করে দিবেন। সূরা হাদীদের ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

يُؤْتِكُمْ كِفْلَيْنِ مِنْ رَّحْمَتِهِ وَيَجْعَلْ لَكُمْ نُورًا تَمْشُونَ بِهِ ويغفر لكم

        আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর রাহমতের।দ্বিগুণ অংশ দান করবেন এবং তোমাদেরকে সেই নূর দান করবেন যার সাহায্যে তোমরা পথ চলবে এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন।

        পৃথিবীতে ঈমানদারও আল্লাহর রাহমত লাভ করে এবং আল্লাহ বিরোধী লোকও তাঁর রাহমত লাভ করে। কিন্তু ঈমানদারদের ওপরে আল্লাহ আরেকটি বিশেষ রাহমত করে থাকেন। , তাহলো তাদেরকে তিনি অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে থাকেন। কোরআনে সূরা হাদীদে এই অন্তর্দৃষ্টিকে 'নূর' নামে অভিহিত করা হয়েছে। ঈমানদারগণ এই নূর দিয়েই পৃথিবীর জাহিলিয়াতকে চিনতে পারে। ইজ্যা-কিয়াস যা হয়ে থাকে, তার ভিত্তিও হলো আল্লাহর দান করা সেই নূর। পৃথিবীতে নিত্য-নতুন বস্তু আবিষ্কার হচ্ছে, নানা ধরনের পথ ও মতের প্রচলন ঘটছে। আল্লাহর বিধানের সাথে এসবের সাংঘর্ষিক দিকগুলো ঈমানদারগণ কোরআনের জ্ঞান দিয়ে অতি সহজেই নির্ণয় করতে সক্ষম হন। আবার কিয়ামতের ময়দানেও তাদেরকে নূর দান করা হবে। অন্ধকার বিপদ শঙ্কুল পথ অতিক্রম করে তারা আল্লাহর জান্নাতে পৌঁছে যাবেন। আল্লাহ রাহমান-তিনি ঈমানদারকে এই পৃথিবীতেও নূর দান করবেন এবং কিয়ামতের ময়দানেও নূর দান করবেন। শুধু তাই নয়, তিনি তাদের পাপসমূহও ক্ষমা করে দিবেন। ঈমান আনার পূর্বে তারা যেসব পাপ করেছিল এবং ঈমান আনার পরে ভুলে বা অসতর্কতার দরুণ তাদের দ্বারা যেসব পাপ সংঘটিত হয়েছে, সেসব পাপ তিনি ক্ষমা করে দিবেন।

        আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ সম্পর্কে বর্ণনা করা কোন মানুষের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাঁর অনুগ্রহের বিশালতা সম্পর্কে শত-সহস্র কোটি কলম যদি কিয়ামত পর্যন্ত লিখতে থাকে, তবুও তাঁর করুণার কণামাত্র লিখে শেষ করতে সক্ষম হবে না। পৃথিবীতে কেউ কি এমন আছে যে, তার কাছে কেউ গুরুতর অপরাধ করে ফেললো। সেই তিনিই আবার অপরাধীকে ডাক দিয়ে বললেন, 'তুমি এই ভাষায় আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেবো।' এমন দয়াবানের সাথে মানবতার সাক্ষাৎ কখনো ঘটেনি। কিন্তু অসীম দয়ালু আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের সাথে ঠিক এমনি আচরণ সেই সৃষ্টির শুরুতেই করেছেন। হযরত আদম আলাইহিস্ সালামের দ্বারায় অপরাধ সংঘটিত হলো। তিনি অনুতপ্ত হলেন। আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিলেন, এই ভাষায় আমার কাছে ক্ষমা চাও, আমি ক্ষমা করে দেবো। আল্লাহর কিতাবে সূরা বাকারার ৩৭ নং আয়াতে বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করা হয়েছে-

فَتَلَقَّى آدَمُ مِنْ رَّبِّهِ كَلِمَت فَتَابَ عَلَيْهِ إِنَّهُ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

        তখন আদম তার রব্ব-এর কাছ থেকে কয়েকটি বাক্য শিখে নিয়ে তওবা করলো তার রব্ব তার এই তওবা মঞ্জুর করলেন। কারণ তিনি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী।'

        অপরাধের কারণে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করলে তিনি অবশ্যই তওবা মঞ্জুর করবেন। কোন কারণে তিনি তওবা মঞ্জুর করবেন-অনুতপ্ত অপরাধীকে ক্ষমা করে দিবেন-এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হয়েছে, তিনি বড়ই ক্ষমাশীল এবং অনুগ্রহকারী। পৃথিবীর একশ্রেণীর মানুষ 'পাপ করলে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে' এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে থাকে। মানুষ এই পৃথিবীতে মনগড়া যত কথা আৰিষ্কার করেছে, উল্লেখিত কথাটিও তার মধ্যে অন্যমত।

        হতাশাবাদের অনুসারীবৃন্দ কর্তৃক এই কথাটি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই কথাটি মানুষকে অপরাধ সংঘটিত হবার পরে অনুতপ্ত হয়ে পাপপথ থেকে বিরত হবার পরিবর্তে পাপের গহ্বরের দিকেই নিক্ষেপ করে। কারণ তার মনে এ ধারণা বদ্ধমূল থাকে যে, 'পাপ থেকে আমি যতই তওবা করি না কেন, পাপের শাস্তি আমাকে লাভ করতেই হবে।' এই মারাত্মক ধারণা মানুষকে আল্লাহ বিরোধী পথ থেকে ফিরে আসতে প্রবল বাধার সৃষ্টি করে।

        পক্ষান্তরে আল্লাহর কিতাব বলছে, মানুষ ভালো কাজ করলে উত্তম বিনিময় দান যেমন আল্লাহর ইচ্ছার ওপরে নির্ভর করে, তেমিন মানুষ অপরাধ সংঘটিত করলে তার শাস্তি দেয়াও আল্লাহর ইচ্ছার ওপরে নির্ভরশীল। মানুষ কল্যাণমূলক কর্ম করে তা থেকে শুভ পরিণতি লাভ করলো এটা সেই কল্যাণমূলক কর্মের স্বাভাবিক ফল নয়-এটা মহান আল্লাহর রাহমত বিশেষ। আবার মানুষ তার অপরাধের কারণে কোন খারাপ পরিণতির মুখোমুখী হলো, এটাও খারাপ কাজের স্বাভাবিক ও অনিবার্য পরিণতি নয়, প্রকৃতপক্ষে এ ব্যাপারেও ক্ষমা করা অথবা শাস্তি দেয়ার পূর্ণ ক্ষমতা মহান আল্লাহরই ইখতিয়ারে। তবে এ ব্যাপারে একটি কথা অত্যন্ত ভালো করে বুঝে নিতে হবে যে, মহান আল্লাহর অনুগ্রহ ও-রাহমত তাঁর একটি বিশেষ নীতির ওপরে ভিত্তিশীল।

        আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর অসীম ক্ষমতা যথেচ্ছা ও নির্বিচারে ব্যবহার করেন না। তিনি তাঁর কোন বান্দার উত্তম কাজের বিনিময় যখন দান করেন, তখন তিনি প্রত্যক্ষ করেন-তাঁর বান্দাহ একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে একনিষ্ঠভাবে উত্তম কাজ সম্পাদন করেছেন। তিনি কোন বান্দার উত্তম কাজ নামঞ্জুর করলেও তা এ কারণে করে থাকেন যে, বাহ্যিক দিক দিয়ে তা উত্তম কর্ম হলেও সে কাজ একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে করা হয়নি।

        কোন বান্দাহ্ অপরাধ করলেই তিনি তাকে সাথে সাথে শস্তি দেন না। তিনি দেখেন, বান্দাহ বিদ্রোহাত্মক মন-মানসিকতা নিয়ে অপরাধ সংঘটিত করেছে কিনা। অপরাধ করার পরে বান্দার মনে অনুশোচনা এসেছে কিনা। বান্দাহ অপরাধ করে আপন কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হয়েছে, অনুতপ্ত হয়েছে, অনুশোচনা করছে, বার বার তওবা করছে, দৃঢ় সঙ্কল্প করছে-ভবিষ্যতে সে আর এমন অপরাধ করবে না, এভাবে আত্মসংশোধনের দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, তখন সে তো শাস্তিলাভের যোগ্যই থাকে না-বরং ক্ষমার উপযুক্ত বলে বিবেচিত হয়। এরপরেও যারা সজ্ঞানে আল্লাহ বিরোধী ভূমিকা পালন করেছে, তারাও যদি প্রকৃত অর্থে তওবা করে আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করে, আল্লাহ অত্যন্ত খুশী হন, তিনি অনুগ্রহ করে তাকেও ক্ষমাপ্রাপ্ত দলে শামিল করে নেন।

        মহান আল্লাহ সীমায়িত, সঙ্কীর্ণমনা, সঙ্কীর্ণ দৃষ্টি ও সঙ্কীর্ণ হস্ত নন, আল্লাহর 'সাম্রাজ্য অত্যন্ত বিশাল এবং তাঁর দৃষ্টিকোণ ও রাহমত-অনুগ্রহ বিতরণের ক্ষেত্রও অত্যন্ত প্রশস্ত। তাঁর কোন বান্দাহ পৃথিবীর কোন কোণে বসে কি উদ্দেশ্যে তাঁকে ডাকছে, সেটাও তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি রাহমান, পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টি যার যার ভাষায় একযোগে তাঁকে ডাকে, তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তিনি সবার প্রার্থনা শোনেন। তিনি তাঁর বিশেষ রাহমত দানের জন্য 'কাকে নির্বাচিত 'করবেন, সেটা তাঁরই এখতিয়ারে। আল্লাহ বলেন-

يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ العَظِيمِ

        তিনি নিজের রাহমত-অনুগ্রহের জন্য যাকে খুশী নির্বাচিত করে নেন, আর তাঁর অনুগ্রহও অনেক বেশী এবং বিরাট। (সূরা আলে ইমরাণ-৭৪)

        তিনি অসীম রাহমতের অধিকারী। তাঁর রাহমত ব্যতিত কারো তব্দির পরিবর্তন হয় না। তিনি যদি কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে চান তাহলে কেউ তাকে বাধা দিতে পারে না। কোন ব্যক্তি, দল বা জাতি যখন আল্লাহর বিধানের মোকাবিলায় বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করে, আল্লাহ তাদেরকে বার বার সতর্ক করতে থাকেন। সতর্ক না হলে আল্লাহ তা'য়ালা তাদের ওপরে আযাব প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। জালিম দলকে লাঞ্ছিত করে ক্ষমতা থেকে বিদায় করে দেন, বিদ্রোহী জাতির ওপরে ভিন্ন জাতির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করে তাদেরকে গোলামীর জীবন বরণ করতে বাধ্য করেন। এ ব্যাপারে তাঁকে কারো কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। আর সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যারা ময়দানে জান-মাল দিয়ে আন্দোলন করে, শয়তানের অনুসারীরা তাদের ক্ষতি করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। আর আল্লাহ যদি সত্যপন্থীদের কল্যাণ করতে চান, তাহলে ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র পানির বুদ্বুদের মতই শূন্যে মিলিয়ে যায়। আল্লাহ বলেন-

قُلْ مَنْ ذَا الَّذِي يَعْصِمُكُمْ مِّنَ اللَّهِ إِنْ أَرَادَ بِكُمْ سُوْءٍ أَوْ أَرَدَبِكُمْ رَحْمَةً

        তাদেরকে বলো, কে তোমাদের রক্ষা করতে পারে আল্লাহর হাত থেকে যদি তিনি তোমাদের ক্ষতি করতে চান? আর কে তাঁর রাহমতকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে যদি তিনি চান তোমাদের প্রতি মেহেরবানী করতে? (সূরা আল আহ্যাব-১৭)

        সূরা যুমারে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে রাহ্মাতের অধিকারী মনে করে তার দাসত্ব করতে থাকে, আল্লাহর আযাবকে প্রতিরোধ করার কোন ক্ষমতা তাদের নেই। আর আল্লাহ যদি কারো ওপরে রহম করতে চান, তাঁর রাহমতকেও তারা প্রতিরোধ করতে পারে না। সুতরাং তিনিই রাহমাতের অধিকারী-তাঁর কর্তৃত্বের মূলধারাই হলো করুণা। তাঁর করুণা থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। যারা তাঁর করুণা সম্পর্কে হতাশ হয়, তারা মুমিন নয়। সূরা ইউসুফের ৮ ও ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَلَا تَايْنَسُوا مِنْ رُوْحِ اللَّهِ إِنَّهُ لَآيَايْنَسُ مِنْ رُوحِ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الكفرون

        আল্লাহর রাহমত থেকে নিরাশ হয়ো না, তাঁর রাহমত থেকে নিরাশ হয় তো শুধু কাফিররাই। যারা সত্য পথের পথিক নয়-পথভ্রষ্ট, মহাসত্য চিনতে যারা অক্ষম তারাই কেবল হতাশায় ভুগতে থাকে। আল্লাহর কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে-

وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَّحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُوْنَ 

        পথভ্রষ্ট লোকেরাই তো তাদের রব্ব-এর রাহমত থেকে নিরাশ হয়। (সূরা আল হিজব-৫৬)

        যে আল্লাহ না চাইতেই বান্দার প্রতি রাহমত নাযিল করেন, তাঁর রাহমত থেকে নিরাশ হওয়ার অর্থ হলো আল্লাহর মোকাবেলায় ধৃষ্টতা প্রদর্শন করা। বান্দাহ কেন তাঁর রাহমতের ব্যাপারে হতাশ হবে? কারণ সে তো দেখছে, সৃষ্টির সমস্ত কিছুই আল্লাহর নির্দেশে তার খেদমতের জন্য নিজেকে প্রসারিত করে দিয়েছে। এসব কিছু দেখে ও উপলব্ধি করে কেউ যদি আল্লাহর রাহমত থেকে নিরাশ হয় তাহলে তা হবে অকৃতজ্ঞতা। রাত এবং দিনের আবর্তনের মধ্যে মানুষ দেখতে পায়, তা কিভাবে তার জন্য রাহমত হিসাবে এসেছে। আল্লাহ বলেন-

وَهُوَ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الَّيْلَ لِبَاسَادُ النَّوْمَ سُبَاتًا وَجَعَلَ النَّهَارَ نُشُوراً -

        আর তিনিই রাতকে তোমাদের জন্য পোশাক, ঘুমকে মৃত্যুর শান্তি এবং দিনকে জীবন্ত হয়ে ওঠার সময়ে পরিণত করেছেন। (সূরা আল ফুরকান-৪৭)

        পোশাক যেমন মানুষকে লজ্জা থেকে আবৃত করে, মানুষের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে তেমনি রাত মানুষকে ঢেকে নেয়, বিরক্তিকর কোলাহল থেকে মানুষকে নির্জনতা দেয়। পার্থিব দৃষ্টিতে মৃত্যু যেমন মানুষকে যাবতীয় দুঃখ-বেদনার অনেক ঊর্ধ্বে নিয়ে যায়, তেমনি ঘুমও মানুষকে যাবতীয় দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত রাখে, ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহকে পুনরায় কর্মক্ষম করে দেয়। এগুলোই আল্লাহর রাহমত, যিনি মানুষের জন্য এসবের ব্যবস্থা করেছেন, তিনিই রাহমান। তাপ ব্যতিত পৃথিবীতে কোন কিছুই উৎপন্ন হয় না। যাবতীয় উদ্ভিদ উৎপন্ন হতে হলে তাপ, আলো ও বাতাসের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ তা'য়ালা প্রয়োজনীয় এবং পরিমিতভাবে ভারসাম্য রক্ষা করে যে তাপ সূর্যের মাধ্যমে পৃথিবীবাসীর জন্য দান করছেন, সমস্ত মানুষ একত্রিত হয়ে তাদের বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রয়োগ করেও এর শতভাগের একভাগও সৃষ্টি করতে পারবে না।

        তিনি রাহমান-তাঁর বান্দাদের জন্য প্রয়োজনীয় শীতলতা দান করছেন, বাতাস দান করছেন। মানুষ সীমিত পরিসরে কৃত্রিম শীতলতা সৃষ্টি করে গরমের অস্থিরতা থেকে মুক্ত থাকার প্রয়াস পায়। কিন্তু আল্লাহ যে বাতাসকে রাহমত হিসাবে দান করেছেন, তার মোকাবেলায় মানুষ কর্তৃক আবিষ্কৃত যান্ত্রিক শীতলতার কোনই মূল্য নেই। সূর্যের প্রখর খর-তাপে গোটা পৃথিবীর পরিবেশ যখন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে, পৃথিবীর সমস্ত এয়ার কন্ডিশনগুলো একসাথে চালনা করলেও তখন পৃথিবীর শতভাগের একভাগও ঠান্ডা হবে না। আর আল্লাহ এক পশলা বৃষ্টির মাধ্যমেই উত্তপ্ত পরিবেশকে আরামদায়ক পরিবেশে রূপান্তরিত করে দেন। আল্লাহ বলেন-

وَهُوَ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيحَ بُشْراً بَيْنَ يَدَى رَحْمَتِهِ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً طَهُورًا -

        আর তিনিই নিজের রাহমতের পূর্বে বাতাসকে সুসংবাদদাতারূপে প্রেরণ করেন। তারপর আকাশ থেকে বর্ষণ করেন বিশুদ্ধ পানি। (সূরা আল ফুরকান-৪৮)

        বৃষ্টিধারাকে আল্লাহ তা'য়ালা রাহমত হিসাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ঊর্ধ্বজগৎ থেকে যে পানি বর্ষণ করে থাকেন, তা অত্যন্ত বিশুদ্ধ পানি। এই পানি এমন যে, এর মধ্যে কোন ধরনের পঙ্কিলতা নেই, কোন ধরনের বিষাক্ত পদার্থ ও জীবানুও নেই। বৃষ্টির এই পানিকে আল্লাহ তা'য়ালা 'ত্বাহুরা' বলে উল্লেখ করেছেন। ত্বাহুরা এমন জিনিসকে বলা হয়, যা নিজে স্বয়ং পবিত্র এবং অন্যকেও পবিত্র করার ক্ষমতা রাখে। তেল, দুধ, মধু, শিরকা, যে কোন ফলের রস নিজে পবিত্র। কিন্তু এগুলো অন্য জিনিসকে পবিত্র করতে পারে না। এগুলো ব্যবহার করে অপবিত্রতা দূর করা যায় না। এগুলো দিয়ে অজু হবে না।

        আর পানি দিয়ে অপবিত্রতা দূর করা যাবে, অজু করা যাবে, গোসল করা যাবে, যে কোন জিনিস ধুয়ে পরিষ্কার করা যাবে। এ জন্য বৃষ্টির পানি হলো, যে কোন ধরনের কলুষতা মুক্ত পানি। এই পানির ব্যবস্থা যিনি করেন, তিনিই রাহমান-তাকে চিনতে হবে এবং তাঁরই দাসত্ব করতে হবে। আল্লাহ বলেন-

امَنْ يَهْدِيكُمْ فِي ظُلمتِ البَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَنْ يُرْسِلُ الرِّيحَ بُشْراً بَيْنَ يَدَى رَحْمَتِهِ

        আর কে তিনি-যিনি জল-স্থলের অন্ধকারে তোমাদেরকে পথপ্রদর্শন করেন এবং কে নিজের অনুগ্রহ প্রেরণের পূর্বে বাতাসকে সুসংবাদদাতারূপে প্রেরণ করেন? (সূরা আন নামল-৬৩)

        তিনিই. রাহমান-মানুষ যেন রাতের অন্ধকারে পথ হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এ জন্য চাঁদে স্নিগ্ধ আলো দান করেছেন। নাবিক যেন মহাসমুদ্রে পথ হারিয়ে না ফেলে এ জন্য তিনি দিক নির্ণয়ের জন্য আকাশে তারকা দান করেছেন। তারকার সাহায্যে এমন ব্যবস্থা করে দিয়েছেন যার ফলে মানুষ রাতের নিকষ কালো অন্ধকারেও নিজেদের পথের সন্ধান করতে সক্ষম হয়। মানুষ জলে-স্থলে ভ্রমণ করে, সেখানে তাকে পথপ্রদর্শন করার জন্য করুণাময় আল্লাহ এমন সব উপায়-উপকরণ সৃষ্টি করেছেন, যার সাহায্যে সে নিজের গন্তব্য স্থলের দিকে চলার পথ নির্ধারণ করে নিতে পারে। দিনে ভূ-প্রকৃতির বিভিন্ন চিহ্ন এবং সূর্যের উদয় ও অস্তের দিক তাকে পথ চিনতে সাহায্য করে এবং রাতের অন্ধকারে আকাশের তারকারা পথ দেখায়।

        পাহাড়ে পথ চলতে গিয়ে মানুষ পথ হারিয়ে খানা-খন্দে পড়ে প্রাণ হারাতে পারে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভেঙে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। এ জন্য দয়াময় আল্লাহ পাহাড়ের ভেতরে পথ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে, এদের রিযিকের ব্যবস্থাও তিনি করেন। সূরা হুদ-এর ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَمَا مِنْ دَابَّةٍ فِي الْأَرْضِ إِلَّا عَلَى اللَّهِ رِزْقُهَا -

        যমীনে বিচরণশীল কোন জীব এমন নেই, যার রিযিক দানের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর ন্যস্ত নয়। মহান আল্লাহ হলেন রাহমান-তাঁর জ্ঞান-সীমা ও অবহিতির ব্যাপকতা ও গভীরতা এতটা সীমাহীন যে, পৃথিবীর কোন কোণে ক্ষুদ্র একটি ঝোপের ভেতরে অথবা মাটির গর্তে, সমুদ্রের অতল তলদেশে পাথরে নিচে শৈবাল দামের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি কীট-যা অনুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতিত দেখা যায় না, এদের যখন যে প্রয়োজন হয়, তিনি তা পূরণ করে থাকেন। কোন কিছুই তাঁর জ্ঞানের বাইরে নয়। সবাইকে তিনি নিজ নিজ অবস্থানেই জীবন জীবিকা পৌছানোর ব্যবস্থা করছেন। আল্লাহ বলেন-

وَمَنْ يَرْزُقُكُمْ مِّنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ

        আর কে তোমাদের জীবিকা দেন আকাশ ও পৃথিবী থেকে? (সূরা আন নামল-৬৪)

        মানুষের জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি মুহূর্তে অতিবাহিত হয় আল্লাহর রাহমত পরিবেষ্টিত অবস্থায়। কিন্তু সে ভুলে যায় ঐ দয়াময় আল্লাহকে। তাঁর দাসত্ব করতে হবে, একমাত্র তাঁরই প্রশংসা করতে হবে, এ কথা সে ভুলে যায়। এ ধরনের লোকদেরকে লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেন-

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مِّنْ نَزِّلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَحْيَابِهِ الْأَرْضَ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهَا لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ

        আর যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে, কে আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন এবং তার সাহায্যে মৃত পতিত ভূমিকে সঞ্জীবিত করেছেন, তাহলে তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ। বলো, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। (সূরা আনকাবুত-৬৩)

        এই মানুষ যখন সমুদ্র পথে চলতে থাকে, তখন সমুদ্রের ভয়াল রূপ দেখে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে। সাগরের উত্তাল ঊর্মিমালা-পর্বত সমান তরঙ্গ জলযানের গায়ে আঘাত করে, মানুষ তখন ভয়ে আতঙ্কে একমাত্র আল্লাহর নাম ব্যতিত নিজের অস্তিত্বের কথাও ভুলে যায়। নিজের সমস্ত সত্তাকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদন করে একমাত্র আল্লাহর কাছেই সাহায্য কামনা করতে থাকে। অভিজ্ঞতায় এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লাহর অস্তিত্বে অবিশ্বাসী ব্যক্তিও বিপদের সেই চরম মুহূর্তে 'আল্লাহ আল্লাহ' নামের যিকির করতে থাকে। যখনই জলযান বিপদ মুক্ত হয়ে যথাস্থানে পৌছে যায়, তখনই এই মানুষ আল্লাহর বিধানের মোকাবিলায় বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করে। জলযানের চালকের প্রশংসা করে বলে, 'চালকের দক্ষতার কারণেই প্রাণ রক্ষা পেয়েছে।' মানুষের এই অকৃতজ্ঞ অবস্থার বিষয়টি কোরআন এভাবে বর্ণনা করছে-

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ - فَلَمَّا نَجْهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

        যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে তখন নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে। তারপর যখন তিনি তাদেরকে উদ্ধার করে স্থলে ভিড়িয়ে দেন তখন হঠাৎ করেই তারা শিরক করতে থাকে। (সূরা আনকাবুত-৬৫)

        শিরক করতে থাকে-এ কথার অর্থ হলো, বিপদ থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষগুলো আল্লাহর গোলামী না করে অন্যের গোলামী করতে থাকে। ভয়াবহ বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করে তারা আল্লাহর শোকর আদায় না করে জলযান পরিচালকের প্রশংসা করে। মাজারে গিয়ে মৃত ব্যক্তির কাছে শোকর আদায় করে। এসব করা সম্পূর্ণ শিরক, আর যারা শিরক করবে তাদের জন্য আল্লাহর জান্নাত হারাম।

        মানুষ ক্ষেতে চাষ করে ফসল লাভের আশায় বীজ বপন করে বাড়িতে চলে আসে। কৃষক ক্ষেতে বীজ বপন করে তারপর তার পক্ষে আর মূল বিষয়ে করণীয় কিছুই থাকে না। যে ভূমিতে সে বীজ বপন করলো, এই ভূমি তার সৃষ্টি নয়। ভূমিতে উর্বরা শক্তি ও ফসল উৎপাদনের যোগ্যতা কোন মানুষ দান করেনি। বর্তমান বিজ্ঞানীগণ বলছেন, যে ঋতুতে বজ্রপাত অধিকহারে সংঘটিত হয়, সে ঋতুতে ফসলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশী বৃদ্ধি পায়। কারণ বজ্রপাতের মাধ্যমে ভূমিতে যে নাইট্রোজেন চক্র ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে, এতে করে ভূমির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি লাভ করে। এই নাইট্রোজেনই গাছের প্রাণশক্তি। যেসব মৌল উপাদান খাদ্য সামগ্রীতে সংগৃহীত হয়, সেটা মানুষের চেষ্টার ফসল নয়।

        জমিতে যে বীজ মানুষ বপন করে, তাকে বিকশিত করা ও প্রবৃদ্ধি লাভের যোগ্যতাও মানুষ সৃষ্টি করতে পারে না। এই চাষাবাদ ও বীজ বপনকে সবুজ আভায় হিল্লোলিত চারাগাছে পরিপূর্ণ ক্ষেতে পরিণত করার জন্য ভূমির মধ্যে যে কার্যক্রম এবং মাটির ওপরে যে আলো, বাতাস, তাপ, শীতলতা ও মৌসুমী অবস্থার আবর্তন হওয়া প্রয়োজন, তার ভেতরে একটি জিনিসও মানুষের সৃষ্টি নয়। ফসলের ভেতরে দানা সৃষ্টির ব্যাপারেও মানুষের কোন ভূমিকা নেই। এগুলো সবই ঐ দয়াময় রাহমান-আল্লাহই অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদের জন্য করে থাকেন। তিনি বলেন-

أَفَرَهَيْتُمْ مَّا تَحْرُثُونَ وَ أَنْتُمْ تَزْرَعُونَهُ أَمْ نَحْنُ الزَّرِعُونَ لَونَشَاءُ لَجَعَلْنَهُ حُطَامًا فَظَلْتُمْ تَفَكَّهُونَ

        তোমরা কি কখনো চিন্তা-বিবেচনা করে দেখেছো, তোমরা যে বীজ বপন করো, তা থেকে তোমরা ফসল উৎপাদন করো না আমি করি? আমি ইচ্ছা করলে এই ফসলকে দানাবিহীন ভূষি বানিয়ে দিতে পারতাম। (সূরা আল ওয়াকী'আ-৬৩-৬৫)

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, আমার নাম রাহমান। তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পর্কে তোমরা একটু ভেবে দেখো। আমি তোমাদের জন্য পানির ব্যবস্থা কিভাবে করেছি। এই পানি তোমাদের জীবন, তোমাদের জীবন ধারণের জন্য অন্যান্য বস্তুর থেকে পানির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী। এই পানির স্রষ্টা তোমরা নও-আমিই দয়া করে তোমাদের জন্য সে পানি পরিবেশন করেছি। পৃথিবীর বুকে এই নদী-সমুদ্র, খাল-বিল-হাওড়, বিশালাকারের জলাধার আমিই সৃষ্টি করেছি। আমি সূর্য সৃষ্টি করে তার ভেতরে তাপ দান করেছি। এমন পরিমাণে তাপ দান করেছি যেন সে তাপে পানি শোষিত হয়ে বাষ্পাকারে মহাশূন্যের দিকে উত্থিত হয়। পানির ভেতরে এই গুণ-বৈশিষ্ট্য আমিই দান করেছি যে, একটি বিশেষ মাত্রার তাপ লাভ করলেই পানি বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। আমি বাতাস সৃষ্টি করেছি। আমার আদেশে বাতাস সেই বাষ্প কণাগুলো ওপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে জমা করতে থাকে। তারপর আমার আদেশে তা মেঘমালায় পরিণত হয়। আমার আদেশে সেই মেঘ পৃথিবীর বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। যে স্থানের জন্য যতটুকু পানির অংশ ও পরিমাণ নির্দিষ্ট করা হয়, সেখানে ততটুকু পৌঁছে দেয়া হয়। ঊর্ধ্বজগতে আমি এমন এক শীতলতা সৃষ্টি করেছি যার ফলে পৃথিবী থেকে উত্থিত বাষ্প পুনরায় সেখানে পানিতে রূপান্তরিত হয়। তারপর আমারই আদেশে তা পৃথিবীতে বর্ষিত হয়।

        পানির ভেতরে মহান আল্লাহ যে বিশেষত্ব দান করেছেন, তা দেখলে সিজদায় মাথানত হয়ে আসে। সমুদ্রের পানি একদিকে লবণাক্ত, তারপরে এই মানুষ পানিতে কতকিছুর মিশ্রণ ঘটাচ্ছে। কলকারখানার নানা ধরনের বর্জ্য পদার্থ এই পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হচ্ছে। মলমূত্র, বিষাক্ত দ্রব্য ও অজস্র মৃতদেহ এই পানিতে মিশে যাচ্ছে। পানির নিচে নানা ধরনের অস্ত্রের বিস্ফোরণ ঘটানো হচ্ছে। এভাবে পানি মারাত্মক আকারে দূষিত হয়ে পড়ছে। এই পানি পান করলে মানুষের পক্ষে জীবিত থাকা সম্ভব হবে না। আল্লাহ তা'য়ালা সূর্য থেকে তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তাপের মাধ্যমে পানি শোষিত হয়ে বাষ্পাকারে ওপরের দিকে উত্থিত হচ্ছে। মহাশূন্যে আল্লাহ এমন এক অদৃশ্য শক্তিশালী ছাকনি (Filter) নির্মাণ করেছেন যে, পানিতে যত জিনিস মিশ্রিত হয়েছে, তাপের দরুন পানি যখন বাষ্পে পরিণত হয়, তখন সব ধরনের মিশ্রিত জিনিস নিচে পড়ে থাকে এবং শুধুমাত্র পানির জলীয় অংশসমূহ ওপরের দিকে উঠে গিয়ে জমা হতে থাকে।

        আল্লাহ রাহমান, তিনি দয়া করে এ ব্যবস্থা না করলে পানি যখন ওপরের দিকে উত্থিত হতো, তখন সেই পানির মিশ্রিত যাবতীয় বস্তুও উঠে যেতো। এ অবস্থায় পানি হতো দুর্গন্ধময় পানের অযোগ্য। সমুদ্র থেকে যে বাষ্প ওপরের দিকে উঠে যায়, তা লবণাক্ত বৃষ্টির আকারে নেমে এসে পৃথিবীর সমস্ত ভূমিকে লবণাক্ত করে দিতো। ফলে পৃথিবীর ভূমিতে কোন ফসল হওয়া তো দূরের ব্যাপার, ক্ষুদ্র একটি উদ্ভিদও জন্ম নিত না। মানুষ ও মিষ্টি পানির জীবজগৎ এ পানি পানও করতে সক্ষম হতো না।

        পানি থেকে অসহনীয় দুর্গন্ধ আর দ্রবণীয়-অদ্রবণীয় বর্জ্য পদার্থ এবং লবণ নিষ্কাশনের এই ব্যবস্থা যিনি করেছেন, তিনিই রাহমান-অসীম দয়ালু আল্লাহ। যিনি পানির এই বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করেছেন তিনি সমস্ত দিক বিবেচনা করে তার অসীম জ্ঞানের মাধ্যমে আপন রাহমতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই উদ্দেশ্যে করেছেন যে, তার তাঁর প্রিয় সৃষ্টিসমূহের জীবন ও প্রতিপালনের মাধ্যম ও উপায় হয়ে দাঁড়াবে। যেসব সৃষ্টি লবণাক্ত পানিতে জীবিত থাকতে ও লাতিত-পালিত হতে পারে, তিনি সেসব সৃষ্টিকে সমুদ্রে সৃষ্টি করেছেন এবং সেখানেই তারা অত্যন্ত আরামদায়ক অবস্থায় জীবন অতিবাহিত করছে। কিন্তু স্থলভাগ ও বায়ুমন্ডলে বসবাসের জন্য সৃষ্টি জীবের জীবন ও লালন-পালনের জন্য মিষ্টি পানি ছিল অপরিহার্য। এই প্রয়োজন পূরণের জন্য বৃষ্টির ব্যবস্থা কার্যকর করার পূর্বেই তিনি পানির ভেতরে এই গুণ ও বৈশিষ্ট্য রেখে দিয়েছেন যে, পানি তাপের প্রভাবে বাষ্পে পরিণত হওয়ার সময় এতে সংমিশ্রিত কোন জিনিসসহ উত্থিত হবে না বরং তা সম্পূর্ণ গন্ধ ও দূষিত বস্তু পরিশোধিত হয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পান ও জীবন ধারনের উপযোগী অবস্থায় উত্থিত হবে। তিনি রাহমান-তাঁর রাহমত সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী পরিব্যাপ্ত।

Post a Comment

0 Comments