সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতেই বলা হলো, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর। কেন সমস্ত প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর? এ প্রশ্ন উদয় হবার পূর্বেই জবাব এসে গেল, তিনি জগতসমূহের রব্ব। তিনি শুধু সৃষ্টি জগতসমূহের রই নন, এই পৃথিবীতে যে আইন-বিধান দিয়ে মানুষ ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত করবে, সে আইন-বিধানও তিনিই দান করবেন, মানব জীবনের এসব বিভাগের রক্ত মহান আল্লাহ। হযত মুসা ও হযরত হারুন আলাইহিস্ সালামকে তদানীন্তন পৃথিবীর সুপার পাওয়ার (Super power) ফেরাউনের দরবারে যাবার জন্য আল্লাহ তা'য়ালা আদেশ দিলেন তখন তাঁরা আল্লাহর কাছে আবেদন করে বলেছিলেন-
قَالَا رَبَّنَا إِنَّنَا نَخَافُ أَنْ يُفْرُطَ عَلَيْنَا أَوْ أَنْ يُطْغَى
হে আমাদের রব্ব! আমারা আশঙ্কা করছি, সে আমাদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করবে অথবা আমাদের ওপরে চড়াও হবে। (সূরা ত্বা-হা-৪৫)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁদের ভেতরের শঙ্কা দূর করার জন্য বললেন-
قَالَ لَا تَخَافَا إِنَّنِي مَعَكُمْ أَسْمَعُ وَآرِى فَأْتِيهُ فَقُولَا رَبِّكَ
কোন ভয় করো না, আমি আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছি এবং আমি সব কিছু শুনছি ও দেখছি। যাও তার কাছে এবং বলো, আমরা তোমার রব্ব-এর প্রেরিত। (সূরা ত্বাহা)
বিষয়টি লক্ষ্যনীয়, হযরত মুছা আলাইহিস্ সালামকে একটি প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রশক্তির কাছে-যে রাষ্ট্র ছিল সে যুগের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। এমন একটি শক্তির কাছে পাঠাচ্ছেন আর আল্লাহ বলছেন, কোন ভয় নেই, সমস্ত শক্তির উৎস আমি আল্লাহ তোমার সাথে রয়েছি। তোমার সাথে ওরা কি আচরণ করবে তাও আমি দেখবো। তুমি একা নও, যাও তার কাছে এবং বলো-তুমি রব্ব নও। তোমার যিনি রব্ব আমাকে তিনিই তোমার কাছে পাঠিয়েছেন। তাঁর বিধানের সামনে নিজের অহঙ্কারের মাথানত করে দাও।
সূরা ত্বা-হা'র উল্লেখিত আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল, ময়দানে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সাথে আল্লাহ অবশ্যই থাকেন এবং তিনি দেখতে থাকেন, ইসলামের সৈনিকদের সাথে বাতিল শক্তি কি আচরণ করে। যথা সময়ে তাঁর সাহায্যও চলে আসে। হযরত মুছাকে ফেরাউনের কাছে গিয়ে এ কথা বলতে বলেননি যে, 'আমাকে তোমার আল্লাহ প্রেরণ করেছে' বরং তাঁকে বলতে বলা হলো, 'আমরা তোমার রব্ব-এর পক্ষ থেকে এসেছি'।
অর্থাৎ তুমি নিজেকে রব্ব বলে দাবী করছো। এ দাবীর মধ্যে সত্যতার কোন লেশ নেই বরং সম্পূর্ণ বাতুলতামাত্র। কারণ রব্ব হওয়ার জন্য যে ধরনের গুণাবলীর প্রয়োজন, তা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ভেতরে থাকতে পারে না-তোমার ভেতরেও নেই। অতএব আল্লাহই তোমার রব্ব। অতুলনীয় সমর শক্তির অধিকারী রব্ব-এর দাবীদার ফেরাউন কোনদিন স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি তার দরবারে দাঁড়িয়ে তারই মুখের ওপরে এমন ধরনের দুঃসাহসী কথা কেউ উচ্চারণ করতে পারে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ফেরাউন বিস্ময়ে অস্ফুটে প্রশ্ন করলো-
قَالَ فَمَنْ رَّبُّكُمَا بِمُوسَى
ফেরাউন বললো, আচ্ছা, তাহলে তোমাদের দু'জনের রব্ব কে হে মুছা? (সূরা ত্বা-হা-৪৯)
ফেরাউন যেদিন থেকে নিজেকে রব্ব হিসাবে ঘোষণা করেছিল, তার দাপটের মুখে নিষ্পেষিত জাতি শুধু অসহায় ক্ষোভে গুমরে ফিরেছে। কোন প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি। এ জন্য মূর্খ ফেরাউন ধারণা করেছিল, গোটা জাতির প্রতিটি সদস্যই তাকে একমাত্র রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই দু'জন লোকই আমাকে রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দেয়নি। এ জন্য সে প্রশ্ন করেছিল, 'তোমাদের দু'জনের রব্ব কে?' তার এ প্রশ্নের উত্তরে হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম বলতে পারতেন, 'আমার রব্ব হলেন আল্লাহ।' তিনি এ ধরনের জবাব না দিয়ে কে তাঁর রব্ব এবং সেই রব্ব কোন ধরনের অদ্বিতীয় গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন তাও জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর রব্ব-এর পরিচয় তিনি এভাবে দিলেন-
قَالَ رَبُّنَا الَّذِي أَعْطَى كُلَّ شَيْءٍ خَلْقَهُ ثُمَّ هَدَى -
আমাদের রব্ব তিনি যিনি প্রত্যেক জিনিসকে তার আকৃতি দান করেছেন তারপর তাকে পথ নির্দেশ দিয়েছেন। (সূরা ত্বা-হা-৫০)
তদানীন্তন মিশরের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, মিশরের অধিকাংশ জনগণ ধর্মীয় দিক দিয়ে নানা ধরনের মূর্তি ও প্রকৃতির পূজা করতো। আর ফেরাউন নিজেকে সূর্যদেবতার অবতার বলে দাবী করতো। ফেরাউন এ দাবী করতো না যে, কোন দেব-দেবীর পূজা করা চলবে না এবং দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা ত্যাগ করে আমার পূজা করতে হবে। বরং তার দাবী ছিল, • আদর্শগতভাবে মিশরের সমস্ত জনগণের ওপরে রাজনৈতিক প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব চলবে আমার। আমার আইন-কানুন, আমার ইচ্ছাশক্তির সামনে সবাইকে নত হতে হবে। আমার কথাই দেশের আইন। ফেরাউন যখন দেখলো যে, মুছার কথা মেনে নিলে দেশের বুকে আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, তার ইচ্ছার কোন মূল্য থাকবে না। সার্বভৌমত্ব থাকবে আল্লাহর। এ জন্য সে মুছ। আলাইহিস্ সালামকে হুমকি দিয়ে বলেছিল-
قَالَ لَئِنْ اتَّخَذْتَ إِلهَا غَيْرِي لأَجْعَلَنَّكَ مِنَ الْمَسْجُونِينَ .
যদি আমাকে ছাড়া আর কাউকে ইলাহ্ বলে গ্রহণ করো, তাহলে মনে রেখো-আমি তোমাকে কারারুদ্ধ করবো। (সূরা শু'আরা-২৯)
এই ধরনের হুমকি শুধু ফেরাউনই দেয়নি, প্রতিটি যুগেই সত্যের বাহকদের সাথে সমকালীন রাষ্ট্রশক্তি একই ব্যবহার করেছে, বর্তমানেও করছে। পার্থক্য শুধু এটাই যে, সে যুগের স্বৈরাচারী ফেরাউন প্রকাশ্যে আল্লাহর সাথে চ্যালেঞ্জ করেছিল, আর এ যুগের রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ফেরাউনরা অঘোষিতভাবে নিজেদেরকে রব্ব বলে দাবী করে এবং সত্যের বাহকদের ওপরে বর্বর নির্যাতন চালায় এবং তাদেরকে মিথ্যা অভিযোগে কারারুদ্ধ করে।
হযরত মুহা আলাইহিস্ সালাম নিজের রব্ব-এর পরিচয় এভাবে দিলেন যে, পৃথিবীর প্রতিটি জিনিস তাঁরই নির্মাণ কৌশলে নির্মিত হয়েছে। প্রতিটি জিনিসকে তিনিই আকার-আকৃতি, গঠনশৈলী, শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা, গুণ-বৈশিষ্ট্য ও বিশেষত্ব দিয়েই সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে কর্ম সম্পাদন করার জন্য হাতের যে গঠনাকৃতির প্রয়োজন ছিল, পায়ের জন্য যে সর্বাধিক উপযুক্ত গঠনাকৃতির দরকার ছিল, চোখ, কান, মুখ, দাঁত, পেট ও পিঠের জন্য যে গঠনশৈলী ও আকৃতি প্রয়োজন ছিল তাই তিনি দিয়েছেন। মানুষ, পশু, উদ্ভিদ, জড়পদার্থ, বাতাস, পানি আলো, চন্দ্র-সূর্য, তারকা, পাহাড়-পর্বত তথা প্রতিটি জিনিসকেই এমন বিশেষ আকৃতি দান করেছেন যা এ বিশ্বজগতে তার নিজের অংশের কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল।
হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম বলিষ্ঠ ও নির্ভীক কন্ঠে জানিয়ে দিলেন, আমার রব্ব প্রতিটি জিনিসকে তার প্রয়োজনীয় বিশেষ আকৃতি দিয়েই কর্ম শেষ করেননি বরং তিনিই সবাইকে পথ দেখিয়েছেন। পৃথিবীতে এমন কোন জিনিস নেই যাকে তিনি নিজের গঠনাকৃতিকে কাজে ব্যবহার করার এবং নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য পূর্ণ করার নিয়ম-পদ্ধতি শিখিয়ে দেননি। চন্দ্র-সূর্যকে তিনিই কক্ষ পথে বিচরণ করতে শিখিয়েছেন। মানব দেহের যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, এগুলো যে কর্ম সম্পাদন করে তা তিনিই শিখিয়েছেন। পানিতে মাছ কিভাবে সাঁতার কাটবে, পাখি মহাশূন্যে কিভাবে উড়বে, প্রজাপতি ফুলে ফুলে ঘুরে কিভাবে পরাগায়ন ঘটাবে, গাছ কিভাবে ফুল দেবে, মাটি কিভাবে ফসল উৎপন্ন করবে, তা আমার রব্ব-আল্লাহ রাব্বুল আলামীন শিখিয়েছেন। অতএব সেই রব্ব-এর অনুগত হয়ে যাও।
রব্ব কে, কেন তিনি রব্ব এবং কেন তাঁকে ব্যতীত আর কাউকে রব্ব বলে স্বীকৃতি দেয়া যাবে না, হযরত মুছা আলাইহিস্ সালাম ফেরাউনের প্রশ্নের যে উত্তর দিয়েছেন, তাঁর সেই ছোট্ট উত্তরের মধ্যে সমস্ত কথা নিহিত রয়েছে। সুতরাং, এ কথা স্পষ্ট হয়ে গেল যে, 'রাষ্ট্রের শাসক থেকে শুরু করে, দেশ ও জাতির কর্তৃত্বশীল পদে যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ অধিষ্ঠিত হবে, সে বা তারা যদি আল্লাহর বিধান অনুসারে তার বা তাদের অধিনস্থদের পরিচালিত না করে নিজের অথবা অন্য কারো আইন-বিধান অনুসারে পরিচালিত করার চেষ্টা করে, তাহলে সে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ প্রকারান্তরে নিজেদের ভেতরে রবুবিয়াতের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে বলে দাবি করলো।'
দেশ ও জাতি পরিচালিত হবে আল্লাহর বিধান দ্বারা। কারণ তিনিই রব্ব এবং সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক। পৃথিবীর ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর, অনু থেকে পরমাণু পর্যন্ত সমস্ত কিছুর রব্ব এবং একচ্ছত্র সার্বভৌমত্বের অধিকারী হলেন আল্লাহ। এ জন্যই সমস্ত প্রশংসা তাঁরই উদ্দেশ্যে নিবেদিত।
এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, রব্ব শব্দের অর্থ অত্যন্ত ব্যাপক। প্রতিপালনকারীকে রব্ব বলা হয়। প্রয়োজনীয় জিনিস যিনি যথাসময়ে দান করেন তাকেও রব্ব বলা হয়। যিনি ক্রমবিকাশ দাতা, দেখাশোনা করেন, পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তন করতে সক্ষম, শিখাতে পারেন, জিম্মাদার হতে পারেন, পৃষ্ঠপোষকতা করতে সক্ষম, সাহায্য করতে সক্ষম, কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করতে সক্ষম, যে সত্তাকে কেন্দ্র করে মানুষ সমবেত হয়, যিনি ভাগ্যের পরিবর্তন করতে সক্ষম, যার আইন অনুসরণ করা হয়, বিধান অনুসারে কোন কর্ম সম্পাদন করা হয়, যার সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করা হয়, যাকে দেখে ভয় করা হয়, যিনি অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞান রাখেন, দক্ষতার সাথে নেতৃত্ব ও পরামর্শ দিতে পারেন, নির্ভুলভাবে পরিদর্শন করতে পারেন, যার কর্তৃত্ব স্বীকার করা যেতে পারে, শক্তি প্রয়োগ করে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম, যার আদেশে কোন কিছু পরিচালিত হতে পারে, যার নির্দেশ পালন করা যায়, যিনি আইন জারি করতে পারেন আবার তা রদও করতে পারেন, পুরস্কার ও শাস্তি দিতে সক্ষম, আকৃতি দান করতে সক্ষম, যিনি মালিক ও মনিব এবং দৃষ্টির আড়ালে থেকে সাহায্য সহযোগিতা করতে পারেন; সৃষ্টি ও ধ্বংস করতে সক্ষম, যিনি বিচারক এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী অর্থাৎ এ ধরনের অসংখ্য গুণাবলীর যিনি অধিকারী-তাকে রব্ব বলা হয়।
এই রবুবিয়াতের গুণাবলী এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ভেতরে নেই। কোন মানুষের ভেতরে উল্লেখিত কতক গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেলেও এটা বুঝতে হবে যে, সে গুণ ও বৈশিষ্ট্য ব্যক্তির নিজস্ব সৃষ্টি নয়-বরং তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর ঐ বান্দার মধ্যে অনুগ্রহ করে দান করেছেন। আল্লাহ-রব্ব-তিনি দানকারী, তিনি অনুগ্রহ করে তাঁর ঐ বান্দার মধ্যে গুণ-বৈশিষ্ট্য দান করেছেন। এ জন্য ঐ ব্যক্তি প্রশংসা লাভের যোগ্য নয়-প্রশংসা তো তিনিই লাভ করতে পারেন-যিনি তাঁর বান্দার মধ্যে তা দিয়েছেন।
রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ব্যক্তির এ ক্ষমতা নেই যে, তিনি দেশ ও জাতির ওপরে কোন আইন জারি করতে পারেন। তাঁকে মহান রব্ব-এর পক্ষ থেকে এতটুকু অধিকার দেয়া হয়েছে যে, তিনি আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে আল্লাহর দেয়া আইন দেশ ও জাতির ওপরে প্রয়োগ করবেন। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও তিনি স্বাধীন নন। আল্লাহ রব্ব হিসাবে আইন প্রয়োগের যে মাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছেন, ততটুকু এবং যে পদ্ধতি প্রদর্শন করেছেন, সেই পদ্ধতিতে করতে পারেন। এর বেশী কিছু করার অর্থ হলো-তিনি স্বয়ং রব্ব হিসাবে নিজেকে দাবী করলেন।
আল্লাহর রাসূল মক্কার ইয়াহুদী ও অন্যান্য লোকদেরকে একদিন সকালে পাহাড়ের পাদদেশে সমবেত করে প্রশ্ন করলেন-আমি যদি তোমাদেরকে বলি, এই পাহাড়ের পশ্চাৎ দিক থেকে সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত একদল শত্রু তোমাদের ওপরে হামলা পরিচালিত করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। তাহলে কি তোমরা আমার এ কথা বিশ্বাস করবে? সমবেত জনতা সমস্বরে জবাব দিয়েছিল, 'তুমি জীবনে কোনদিন মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করোনি। অতএব তোমার এ কথা বিশ্বাস না করার কোন কারণ নেই।' তখন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন-
قُلْ يَأَهْلَ الكتاب تَعَالَوْا الى كَلِمَةٍ سَوَاءٍ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ أَلا نَعْبُدَ إِلا اللَّهَ وَلا نُشْرِكَ بِهِ شَيْئًا وَلا يَتَّخِذَ بَعْضُنَا بَعْضًا أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
বলো, হে আহলি কিতাব, এসো একটি কথার ওপরে আমরা মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত করি, যে কথা আমাদের ও তোমাদের মধ্যে সমানভাবে গ্রহণীয়। সে কথা হলো, আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো দাসত্ব করবো না, তাঁর সাথে কারো শরীক করবো না এবং আমাদের মধ্যে কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে রব্ব হিসাবে গ্রহণ ও স্বীকৃতি দেবো না। (ইমরাণ-৬৪)
আল্লাহর রাসূলের পবিত্র জবান মোবারক থেকে এ কথা শোনার সাথে সাথে অভিশপ্ত আবু লাহাব একটি পাথর খন্ড রাসুলের দিকে নিক্ষেপ করে বলেছিল, 'তাব্বাল্লাকা ইয়া মুহাম্মাদ আলে হাযা দাওয়াতানা?' ধ্বংস হয়ে যাও হে মুহাম্মদ! (নাউযুবিল্লাহ) তুমি কি এই জন্য আমাদেরকে ডেকেছো?
আল্লাহর রাসূল আল্লাহর শিখানো যে আয়াতের মাধ্যম্যে লোকগুলোকে ইসলামের দিকে আহ্বান জানিয়েছিলেন সেখানেও বলা হয়েছে, 'আমরা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো দাসত্ব করবো না এবং তাঁকে ছাড়া আর কাউকে রব্ব হিসাবে গ্রহণ করবো না।'
কোরআনের এ আয়াত পরিষ্কার অর্থ ব্যক্ত করছে যে, আল্লাহ অবশ্যই সেজদা লাভকারী এবং শুধু মাত্র তাঁরই ইবাদাত বন্দেগী করতে হবে। সেই সাথে আল্লাহকে যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকারী হিসাবে অর্থাৎ রব্ব হিসাবে গ্রহণ করতে হবে। বিপদের মুহূর্তে সাহায্যের আশায় কোন মূর্তি, জ্বিন প্রভাবিত ব্যক্তি, পীর, ফকীর, মাজারের কাছে গিয়ে সাহায্য চাওয়া যাবে না। কারো আইন মানাও যাবে না এবং কাউকে আইনদাতা হিসাবে মনেও করা যাবে না। অতএব নামাজ, রোজা এবং হজ্জ যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে আদায় করা হয়, সেই আল্লাহকেই আইনদাতা, বিধানদাতা, সাহায্যকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, সন্তানদানকারী, কামনা-বাসনা পূরণকারী, প্রার্থনা কবুলকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামও তাঁর জাতিকে একই কথা বলেছিলেন-
إِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٌ
আল্লাহ আমারও রব্ব, তোমাদেরও রব্ব। অতএব তোমরা তাঁরই দাসত্ব করো আসলে এটাই সঠিক ও সোজা পথ। (সূরা আলে ইমরাণ-৫১)
সেই সুদূর অতীতকাল থেকেই মানুষ আল্লাহকে গোটা বিশ্বের স্রষ্টা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছে, এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত ছিল না। আর শুধু এটুকু কথার স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অর্থাৎ 'আল্লাহ আছেন এবং তিনি গোটা বিশ্বের স্রষ্টা' নবী ও রাসূলদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়নি এবং কিতাব অবতীর্ণ হয়নি। 'আল্লাহ আছেন এবং তিনি গোটা বিশ্বের স্রষ্টা' মানব গোষ্ঠীর কাছ থেকে এ কথার স্বীকৃতি আদায় করার জন্য কোন একজন নবী ও রাসূলের সাথে প্রতিষ্ঠিত কায়েমী শক্তির যুদ্ধ তো অনেক পরের ব্যাপার-কোন বিতর্কই হয়নি। আল্লাহর কোরআন বলছে-
أَلَمْ تَرَإِلَى الَّذِي حَاجَ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ أَنَّهُ اللَّهُ الْمُلْكَ
তুমি কি সেই ব্যক্তির অবস্থা চিন্তা করোনি, যে ব্যক্তি ইবরাহীমের সাথে বিতর্ক করছিল? বিতর্ক হয়েছিল এ কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব্ব কে? এবং সে বিতর্ক এ জন্য হয়েছিল যে, আল্লাহ তা'য়ালা তাকে রাজত্ব দান করেছিলেন। (সূরা আল বাকারা-২৫৮)
তদানীন্তন সমাজের কোন সাধারণ লোক মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সাথে আল্লাহর রবুবিয়াত নিয়ে তর্ক করেনি। অর্থাৎ যারা দেশের আইন অনুসরণ করে, জারিকৃত আইন-বিধান মেনে চলতে বাধ্য-এমন ধরনের কোন লোক তাঁর সাথে রব্ব নিয়ে বিতর্ক করেনি। সেই লোকটিই বিতর্ক করেছে, যে ব্যক্তি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিল। যে ছিল দোর্দন্ড প্রতাপশালী, প্রচন্ড ক্ষমতাধর ও রাষ্ট্রশক্তি ছিল যার হাতের মুঠোয়, যে ব্যক্তি আইন রচনা করার ও প্রয়োগ করার সুযোগ লাভ করেছিল। এখানেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে গেল যে, নমরুদের সাথে হযরত ইবরাহীম আলাইহিস্ সালামের সাধারণ ধর্মীয় কোন বিষয় নিয়ে বিতর্ক হয়নি। এ কারণেও বিতর্ক হয়নি যে, তিনি নমরুদের দরবারে গিয়ে দাবী করছেন, 'তুমি আল্লাহকে স্রষ্টা হিসাবে স্বীকৃতি দাও।' আর নমরুদ তাঁর দাবীর প্রতি কর্ণপাত করছে না। বিষয়টি এমন ছিল না। বিতর্ক হয়েছিল, দেশ ও জাতি পরিচালিত হবে কার নির্দেশে, জাতি কাকে আইনদাতা ও বিধানদাতা হিসাবে স্বীকৃতি দেবে, দেশের জনগণ কাকে যাবতীয় প্রয়োজন পূরণকারী হিসাবে গ্রহণ করবে, জনগণ বিপদের মুহূর্তে কার কাছে সাহায্য ও আশ্রয় লাভের জন্য প্রার্থনা জানাবে-ইত্যাদি বিষয় অর্থাৎ কোন শক্তিকে রব্ব হিসাবে গ্রহণ করবে, তাই নিয়ে বিতর্ক চলছিল।
কোরআনের উল্লেখিত আয়াত থেকে এ কথাও প্রমাণ হয়ে গেল যে, রব্ব-এর দাবী দেশের সাধারণ কোন জনগণ করে না। এই দাবী করে তারাই, যারা রাষ্ট্রের সর্বনিম্ন ক্ষমতা সম্পন্ন পদ ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য থেকে সর্বোচ্চ পদ রাষ্ট্রপতির পদে আসীন হয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের যে কোন কর্তৃত্ব যাদের হাতে থাকে; সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী পুঁজিপতি গোষ্ঠী এবং ধর্ম ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। ধর্ম ব্যবসায়ী এই গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য তাদের অনুসারীদেরকে ধর্মের নামে নানা ধরনের বিধি-বিধান অনুসরণ করতে বাধ্য করে। এদের সম্পর্কেই আল্লাহর কোরআন বলেছে, এরা নিজেদেরকে রব্ব-এর আসনে অধিষ্ঠিত করেছে-
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّنْ دُونِ اللَّهِ
এরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও দরবেশ লোকদেরকে নিজেদের রব্ব বানিয়ে নিয়েছে। (সূরা আত তাওবা-৩১)
কিভাবে লোকজন ধর্মীয় নেতাদেরকে রব্ব বানিয়ে নিয়েছিল, বিষয়টি সম্পর্কে একটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আদী ইবনে হাতিম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু যিনি পূর্বে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী ছিলেন, তিনি মদীনায় দরবারে রেসালাতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। এ সময় তিনি জানার জন্য আল্লাহর রাসূলকে নানা ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নের ভেতরে একটি প্রশ্ন এমন ছিল যে, তিনি জানতে চেয়েছিলেন, 'কোরআন বলছে-আমরা আমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দকে রব্ব বানিয়ে নিয়েছিলাম। বিষয়টির তাৎপর্য আমাকে বুঝিয়ে দিন।' রাসূল তাঁকে বলেছিলেন, 'এটা কি সত্য নয় যে, তোমাদের ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ যে জিনিসকে বৈধ বলে ঘোষণা দিত, তোমরা তাকেই বৈধ বলে মেনে নিতে। আর যে জিনিসকে অবৈধ বলে ঘোষণা দিত, তাকেই তোমরা অবৈধ বলে মনে করতে?' হযরত আদী ইবনে হাতিম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বিনয়ের সাথে বললেন, 'অবশ্যই এ কথা ঠিক, আমরা অনুরূপ করতাম।' রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, 'এমন করলেই তো তাদেরকে রব্ব বানিয়ে নেয় হলো।'
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ধর্মীয় নেতা বা পীর সাহেব যা বললেন, তা কোরআন-হাদীস সম্মত কিনা অথবা তারা কোরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা দিলেন কিনা, তা অনুসন্ধান না করেই অন্ধের মতো অনুসরণ করার অর্থই হলো তাদেরকে রব্ব বানিয়ে নেয়া। কোরআনের আয়াত থেকে এ কথা প্রমাণ হয়ে গেল যে, আল্লাহর কোরআনের সাক্ষ্য বা সনদ ব্যতীত যেসব রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ মানব জীবনের জন্য বৈধ ও অবৈধের সীমা নির্ধারণ করে, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের ধারণা অনুসারে নিজেরাই রব্ব-এর আসন ও মর্যাদা দখল করে বসে। আর যারা সরব বা নীরবে সমর্থন দিয়ে তাদেরকে আইন-বিধান রচনা বা প্রয়োগ করার সুযোগ ও অধিকার দেয়, তারাই ঐসব লোকদেরকে নিজেদের রব্ব বানিয়ে নেয়।
0 Comments