
এই সূরাটিকে কোরআনের প্রারম্ভিকা হিসাবে রাখা হয়েছে বলে এই সারাটির নামকরণ করা হয়েছে সূরা ফাতিহা-আল ফাতিহা বা ফাতিহাতুল কিতাব। এ সূরার বিষয়বস্তুর পরিপ্রেক্ষিতেই সূরাটির এই নামকরণ করা হয়েছে। যার মাধ্যমে কোন বিষয়ের সূচনা করা হয়; কোন বিষয় আরম্ভ করা হয়, কোন কাজের উদ্বোধন করা হয়, কোন গ্রন্থের শুরু করা হয় আরবী ভাষায় তাকেই 'ফাতিহা' বলা হয়।
এ সূরাকে ফাতিহাতুল কিতাবও বলা হয়। কেননা এ সূরার মাধ্যমেই আল্লাহর এই কিতাবের সূচনা করা হয়েছে। কোরআনের প্রথমেই একে স্থান দেয়া হয়েছে। এ সূরা দিয়েই আল্লাহর কোরআন উদ্বোধন করা হয়েছে। কোরআন পাঠকারী প্রথমে কোরআন উন্মোচন করেই এই সূরাটিই দেখতে পায়। এই সূরার সাহায্যেই কোরআনের উদ্বোধন করা হয়, এ জন্য এ সূরাকে ফাতিহাতুল কিতাব বা ফাতিহাতুল কোরআন বলা হয়। অর্থাৎ কোরআনের কুঞ্জিকা বা কোরআনের চাবি, যা দিয়ে কোরআন খোলা হয়।
সূরা ফাতিহার অন্যান্য নামসমূহ
সাত আয়াত সম্বলিত সূরা ফাতিহার শুধুমাত্র একটি নাম নয়-এর অনেকগুলো নাম রয়েছে। এ সূরার কম বেশী ২২ টি নাম দেখা যায়। আবার তাফসীরে রুহুল মায়ানীতে এ সূরার ৪০ টি নাম উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহর কিতাবের এ সূরাটি অত্যন্ত বরকতপূর্ণ এবং এর অসংখ্য ফযিলত বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআনের এ সূরাটিকে বলা হয়েছে 'উম্মুল কিতাব' বা কিতাবের মা। আরবী ভাষায় 'উম্ম' শব্দের অর্থ হলো কেন্দ্র। পবিত্র কোরআনে দেখা যায়, পবিত্র মক্কাকে বলা হয়েছে, 'উম্মুল কোরা' অর্থাৎ গ্রামসমূহের মা। গোটা পৃথিবীর শহর-বন্দর, গ্রাম থেকে অসংখ্য মানুষ এসে এখানে সমবেত হয়; মক্কাকে কেন্দ্র করে সারা পৃথিবীর মানুষের মহাসম্মিলন ঘটে, এ জন্য একে বলা হয়েছে উম্মুল কোরা। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেরই নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনী রয়েছে। প্রতিটি সেনাবাহিনীর রয়েছে নিজস্ব পতাকা। এই পতাকাকে বলা হয় 'উম্ম'। কারণ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্য এই পতাকাকে কেন্দ্র করে একত্রিত হয়। এই পতাকাই হলো সেনা সদস্যদের একত্রিত হবার মূলকেন্দ্র। এ জন্য একে আরবী ভাষায় 'উম্মু' বলা হয়েছে।
অনুরূপভাবে গোটা কোরআনের মধ্যে যেসব বিষয় আলোচনা করা হয়েছে, সে আলোচনার বিষয়বস্তু এই সূরা ফাতিহার সাতটি আয়াতের মধ্যে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে, এ কারণে এ সূরাকে বলা হয়েছে 'উম্মুল কিতাব'। সমস্ত কিতাবের মা। গোটা কোরআনে যা পাওয়া যাবে, এই সূরা ফাতিহাকে বিশ্লেষণ করলে তাই পাওয়া যাবে। এই সূরার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর কাছে সত্য সহজ সরল পথ কামনা করে। তার এই প্রার্থনার জবাবে আল্লাহ তা'য়ালা তার সামনে গোটা কোরআন পরিবেশন করেছেন। সত্য পথ চাও! তাহলে এ কোরআনকে অনুসরণ করো। যাবতীয় সত্য এই কিতাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
এ সূরাটির আরেকটি নাম হলো 'সূরাতুর রা'স'। আরবী রা'স শব্দের অর্থ হলো মগজ বা মগজের কেন্দ্রস্থল। মগজ হলো মাথার কেন্দ্রস্থল। আর গোটা কোরআনের কেন্দ্রস্থল হলো সূরা ফাতিহা, এ জন্য একে বলা হয়েছে সূরাতুর রা'স। কারণ এ সূরাটির মধ্যে ত্রিশপারা কোরআনের সারাংশ; মূল বিষয়বস্তু অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, ফলে এর নাম দেয়া হয়েছে রা'স।
নিত্য এবং বারবার পঠিত এ সূরাটির আরেকটি নামকরণ করা হয়েছে, 'সূরাতুল কান্য'। আরবী ভাষায় 'কান্য' শব্দের অর্থ হলো খনি। কিন্তু সূরা ফাতিহাকে কেন খনি বলা হলো? খনি এ কারণে বলা হয়েছে যে, এই সূরাটির ভেতরে মহান আল্লাহ জ্ঞান-বিজ্ঞান দিয়ে পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন। মানুষ যে কোন ধরনের জ্ঞান অর্জন করতে যদি আগ্রহী হয়, তাহলে এ সূরাটি সে সূত্র দান করতে সক্ষম। বর্তমান পৃথিবী নামক যে গ্রহে আমরা বসবাস করছি, এ ধরনের অসংখ্য গ্রহ আল্লাহ তা'য়ালা সৃষ্টি করেছেন। এই বহুমাত্রিক জগতের ধারণা এই সূরার প্রথম আয়াত থেকেই লাভ করা যায়। (বিস্তারিত ব্যাখ্যার জন্য আলামীন শব্দের ব্যাখ্যা দেখুন)
এ সূরাটির আরেকটি নাম হলো, 'সূরাতুল ওয়াফিয়া'। পূর্ণত্বপ্রাপ্ত কোন জিনিসকে আরবী ভাষায় বলা হয়, 'ওয়াফিয়া'। এটা একটি পূর্ণ সূরা। এঁকে খন্ডিত করে পাঠ করার কোন অবকাশ নেই। আল্লাহর কিতাবের অন্য যে কোন সূরা খন্ডিত করে নামাজে পাঠ করা যেতে পারে। কিন্তু কেবলমাত্র ব্যতিক্রম হলো, সূরা ফাতিহা। একে খন্ডিত করে পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়নি। কেউ যদি তা করে, তাহলে তার নামাজ হবে না। এই সূরা যখন পাঠ করবে, তখন তা পরিপূর্ণভাবে পাঠ করতে হবে। এ জন্য এই সূরার নামকরণ করা হয়েছে, 'সূরাতুল ওয়াফিয়া' বা পূর্ণত্বপ্রাপ্ত সূরা।
এ সূরার আরেকটি নাম হলো 'আসাসুল কোরআন' অর্থাৎ কোরআনের ভিত্তি। ত্রিশপারা কোরআনে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি তথা জীবন ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা পেশ করা হয়েছে, তার ভিত্তি হলো এই সূরা ফাতিহা। এ জন্য এ সূরাকে বলা হয়েছে 'আসাসুল কোরআন'।
এই সূরাকে 'সূরাতুল হাম্দ'ও বলা হয়েছে। কারণ এ সূরার প্রতিটি ছত্রে ঐ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা-ই বর্ণিত হয়েছে। মানুষ জানে না সে কিভাবে আল্লাহ তা'য়ালার প্রশংসা করবে, এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে তা মানবমন্ডলীকে শিক্ষা দিয়েছেন। এ সূরা পাঠকালে পাঠকের মুখ থেকে বারবার আল্লাহ তা'য়ালার প্রশংসা উচ্চারিত হতে থাকে, এ কারণে সূরাটিকে বলা হয়েছে, 'সূরাতুল হাম্দ' বা প্রশংসার সূরা।
শোকর আদায়ের বিষয়টিও অনুরূপ। এ পৃথিবীর সমস্ত মানুষই নয়, সমস্ত সৃষ্টি যদি কিয়ামত পর্যন্ত আয়ু লাভ করে আর তারা একযোগে অসংখ্য মুখে আল্লাহর প্রশংসা বাণী উচ্চারণ করতে থাকে, তবুও আল্লাহ তা'য়ালার যেমন প্রশংসা করা প্রয়োজন, তেমনভাবে তার শত সহস্র কোটি ভাগের এক ভাগও করা হবে না। এ জন্য তাঁর প্রশংসা কিভাবে করতে হবে, তা স্বয়ং আল্লাহ-ই করুণা করে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য এ সূরার আরেকটি নাম হলো 'সূরাতুশ্ শুক্র' অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সূরা। এ সূরার মাধ্যমে মানুষ মহান আল্লাহ তা'য়ালার শোকর আদায় করতে শিখেছে এবং আল্লাহভীরু বান্দাগণ তা পাঠ করে শোকর আদায় করে, এ জন্য একে সূরাতুশ্ শুক্র বলা হয়ে থাকে।
এ পৃথিবীতে মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো একটি সত্য সহজ সরল; সহজে পালনযোগ্য, যা অনুসরণ করতে, মেনে নিতে, স্বীকৃতি দিতে কোন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হবে না, এমন একটি ভারসাম্যমূলক নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা। মানুষের এ বিরাট প্রয়োজন তাঁরই অনুরূপ কোন সৃষ্টি পূরণ করতে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম। এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করতে সক্ষম হলেন কেবলমাত্র আল্লাহ তা'য়ালা। এ জন্য সূরা ফাতিহার মাধ্যমে তিনি তাঁর বান্দাহকে তাঁরই কাছে প্রয়োজনীয় জীবন ব্যবস্থা দান করার জন্য দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষ এ সূরা বারবার পাঠ করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে দোয়া করতে থাকে, এ কারণে এ সূরার আরেকটি নাম হলো, 'সূরাতুদ্ দোআ'। দোআ' করার বা প্রার্থনা করার সূরা।
সমস্ত কিছু দেয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তা'য়ালার এবং তিনিই পারেন মানুষের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করতে। মানুষ বিপদগ্রস্ত হলে তিনিই পারেন মানুষকে বিপদ থেকে মুক্ত করতে এবং রোগগ্রস্ত হলে শুধুমাত্র তিনিই পারেন মানুষকে রোগমুক্ত করতে। অনাহারীর খাদ্যের ব্যবস্থা তিনিই করেন; সন্তানহীনকে তিনিই সন্তান দান করতে পারেন। প্রচন্ড খরায়-সূর্যের উত্তপ্ত কিরণে যখন পথ-প্রান্তর ফেটে চৌচির হয়ে যায়, প্রাণীজগৎ বৃষ্টি ধারার আশায় আর্তচিৎকার করতে থাকে, মানুষ আল্লাহর কাছেই পানি চাইতে থাকে। মানুষের যা কিছু প্রয়োজন তা আল্লাহর কাছেই মানুষ চাইবে। কিভাবে চাইতে হবে, সূরা ফাতিহার মাধ্যমে আল্লাহ তা শিক্ষা দিয়েছেন। এ জন্য এ সূরার আরেক নাম হলো 'সূরাতুস্ সাওয়াল'। অর্থাৎ কামনা করার সূরা বা চাওয়ার সূরা। মানুষ এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহকে বলে থাকে, আমরা তোমারই কাছে সাহায্য কামনা করি এবং তোমার কাছে নির্ভুল জীবন ব্যবস্থা কামনা করি। এ অর্থে এ সূরাকে সূরাতুস্ সাওয়াল বলা হয়েছে।
রোগী যেমন আরোগ্য লাভের আশায় রোগ যন্ত্রণায় আর্তনাদ করতে থাকে। তেমনি পৃথিবীতে পথহারা মানুষ অন্ধকারে পথ হারিয়ে; শোষকের শোষণে অতিষ্ঠ হয়ে, ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে মুক্তির আশায় আর্তনাদ করতে থাকে। এ অবস্থায় আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে রাসূল প্রেরণ করলেন এবং তাঁর মাধ্যমে যাবতীয় যন্ত্রণার উপশমকারী কোরআন অবতীর্ণ করে মানুষকে মুক্তি বা শিফা দান করলেন। এই শিফা বা মুক্তি চাওয়া হয় সূরা ফাতিহার মাধ্যমে। এ কারণে এ সূরাকে 'সূরাতুশ শিফা' বলা হয়েছে। শিফা বা প্রতিষেধক বলা হয়েছে এ সূরাকে। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যাবতীয় সমস্যাকে যদি রোগের সাথে তুলনা করা যায়, আর সে রোগসমূহের প্রতিষেধক বলা যেতে পারে আল্লাহর এ কিতাবকে। এই প্রতিষেধক কামনা করা হয়ে থাকে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে।
সাধারণ মানুষ যাদেরকে আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় বান্দাহ বলে মনে করে, কোন রোগ-ব্যধিতে আক্রান্ত হলে তাদের কাছে যায় পানি, তেল বা কালোজিরা নিয়ে। তাঁরা আল্লাহর কোরআন থেকে পাঠ করে সেগুলোর ওপরে ফুঁ দেন। মানুষ তা ব্যবহার করে রোগ মুক্তির আশায়। তাঁরা আল্লাহর কোরআনের এই সূরা ফাতিহা পাঠ করেই ফুঁ দেন। কোন কোন কিতাবে এ সূরার ফযিলত সম্পর্কে মুফাচ্ছিরীন এবং মুহাদ্দিছীনগণ লিখেছেন, এমন দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছে, যা কোন ওষুধে আরোগ্য লাভ করছে না। তখন প্রতিদিন ফজরের পরে সূরা ফাতিহা ৪০ বার পাঠ করে পানিতে ফুঁ দিয়ে তা ৪১ দিন রোগীকে পান করতে দিলে আল্লাহর রহমতে রোগী আরোগ্য লাভ করবে। এ জন্যও এ সূরাকে 'সূরাতুশ্ শিফা' বলা হয়েছে।
সূরা ফাতিহা পাঠ করা ব্যতীত নামাজ হবে না। এ জন্য এই সূরাকে বলা হয়েছে, 'সূরাতুস সালাত'। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে- সূরা ফাতিহা ব্যতীত নামাজই হবে না। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত শুধু ফরজ নামাজে এ সূরাটি সতের বার পাঠ করতে হয়। বিতরের নামাজসহ বিশ বার পড়তে হয়। আর সুন্নাতসহ প্রতিদিন বিয়াল্লিশ বার পাঠ করতে হয়। এ ছাড়া যে কোন ধরনের নামাজে সূরা ফাতিহা পাঠ করতেই হবে। এ সূরা পাঠ করা ব্যতীত কোন নামাজ হবে না। এ সূরার গুরুত্ব অসীম।
لاصلوةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (بخاری مسلم)
হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে-
عَنْ أَبِي سَعِيدِ بْنِ الْمُعَلَّى قَالَ كُنْتُ أَصَلَّى فِي الْمَسْجِد فَدَعَانِي النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَلَمْ أَجِبْهُ ثُمَّ آتَيْتُهُ فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنِّي كُنْتُ أَصَلَّى قَالَ أَلَمْ يَقُوْلِ اللَّهُ اسْتَجِيبُوا لِلَّهِ وَلِلرَّسُولِ إِذَا دَعَاكُمْ ثُمَّ قَالَ أَلَا أُعَلِّمُكَ أَعْظَمُ سُورَةٍ فِي الْقُرْآنِ قَبْلَ أَنْ تَخْرُجُ مِنَ الْمَسْجِدِ فَأَخَذَ بِيَدِي فَلَمَّا أَرَدْنَا أَنْ نَخْرُجَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ : إِنَّكَ قُلْتَ لَ أَعْلَمَنَّكَ أَعْظَمَ سُورَةٍ مِنَ الْقُرْآنِ قَالَ - اَلْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ هِيَ السَّبْعُ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنُ الْعَظِيمُ الَّذِي أُوتِيَتُهُ (بخاری)
হযরত আবু সাঈদ ইবনে মুআল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন আমি মসজিদে নববীতে নামাজ (নফল) আদায় করছিলাম। এ সময় আল্লাহর রাসূল আমাকে আহ্বান জানালেন। আমি (নামাজে ছিলাম বলে) তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতে পারলাম না। (নামাজ শেষ করে) আমি তাঁর কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি নামাজ আদায় করছিলাম। তিনি বললেন, মহান আল্লাহ কি বলেননি, আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল যখন তোমাদেরকে আহ্বান জানাবেন তখন তাঁদের আহ্বানে সাড়া দাও! এ কথা বলে তিনি বললেন, তুমি মসজিদ থেকে বের হয়ে যাবার পূর্বে আমি কি তোমাকে কোরআনের সবচেয়ে মহান এবং সবচেয়ে বড় সূরাটি শিখিয়ে দেবো না? এ কথা বলে তিনি আমার হাত ধরলেন। তারপর আমরা যখন মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যোগ নিলাম, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলেছিলেন, আমি তোমাকে কোরআনের সবচেয়ে বড় সূরা শিখিয়ে দেবো। তিনি বললেন, সে সূরা হলো আলহাম্দু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন। এটাই সাবউল মাসানী (বারবার পঠিত আয়াত) এবং তার সাথে রয়েছে মহান কোরআন, যা আমাকে দান করা হয়েছে। (বোখারী)
আকারের দিক থেকে এ সূরাকে বড় বলা হয়নি, বড় বলা হয়েছে, এর ফযিলতের কারণে। এ সূরার আরেকটি নাম হলো, 'আসাব উল মাছানি' নিত্য পঠনীয় সপ্তবাক্য। বারবার এ সূরাকে পাঠ করতে হয়। নামাজের প্রতিটি রাকাআতে পাঠ করতে হয়। স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এ সূরাটি সম্পর্কে বলেছেন-
وَلَقَدْ آتَيْنَكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآنَ الْعَظِيمَ
আমি তোমাকে এমন সাতটি আয়াত দিয়েছি, যা বারবার আবৃত্তি করার মতো এবং তোমাকে দান করেছি মহান কোরআন। (সূরা আল হিজর-৮৭)জড়এ সূরাটির মাধ্যমে মানুষ নিজের যাবতীয় সত্তাকে একমাত্র আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দেয়। নিজেকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর কাছেই নিবেদন করে। এ জন্য এ সূরাকে বলা হয় 'সূরাতুত্ তাফবিয' অর্থাৎ আত্মনিবেদন করার সূরা। এ পৃথিবীর যে কোন ধরনের মানুষ, হতে পারে সে পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী, হতে পারে সে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধনী, শারীরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী, প্রভাব-প্রতিপত্তির দিক দিয়ে শক্তিশালী। যখন সে সমাজের সর্বশ্রেণীর লোকের সাথে নামাজে দাঁড়ায়, তখন তার মধ্যে আর সমাজের খেটে খাওয়া দিন মজুরের মধ্যে কোন পার্থক্য থাকে না। আল্লাহর দরবারে মনিব আর ভৃত্যের দল এক কাতারে মাথানত করে দাঁড়িয়ে যায়। ডঃ আল্লামা ইকবাল (রাহঃ) বলেন-
এক হি সফ্ মে খাড়ে হো গ্যয়ি মাহমুদ ও আয়াজ
না কো-ই বান্দাহ রাহা না কো-ই বান্দা নেয়াজ
একই সারিতে সম্রাট মাহমুদ আর তাঁর ভৃত্য আয়াজ দাঁড়িয়ে গিয়েছে, এদের মধ্যে কে সম্রাট আর কে যে ভৃত্য, সে পার্থক্য নেই।
যে কোন শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর দরবারে নামাজে দাঁড়িয়ে নিজের অসহায়ত্ব পেশ করে বলে, রাব্বুল আলামীন! আমরা তোমার গোলাম। একমাত্র তোমারই দাসত্ব করি। তোমার কাছেই সাহায্য কামনা করি। তোমার কাছেই আমরা নিজেদেরকে নিবেদন করি। এভাবে সূরা ফাতিহার মধ্য দিয়ে আল্লাহর কাছে মানুষ নিজের যাবতীয় সত্তাকে নিবেদন করে বলে এ সূরাটির নাম হযেছে 'সূরাতুত তাফবিয' বা আত্মনিবেদন করার সূরা।
এ সূরাকে বলা হয়েছে, 'সূরাতু আল কাফিয়া' অর্থাৎ যথেষ্ট। নামাজে কোরআন পাঠ করা ফরজ-এ সূরা পাঠ করলেই সে ফরজ আদায় হয়ে যায়। মানুষের হেদায়াতের জন্যও এ সূরা যথেষ্ট, কারণ এ সূরার ভেতরেই গোটা ত্রিশপ্যারা কোরআনের সারসংক্ষেপ বিদ্যমান। এ জন্য একে বলা হয়েছে, 'আল কাফিয়া'।
এ সূরাকে বলা হয়েছে, 'সূরাতুল হিক্কা' অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূরা। অসংখ্য জ্ঞানের সূত্র এ সূরায় বিদ্যমান। এ সূরাকে বিশ্লেশণ করে মানুষ জ্ঞানের যে কোন শাখায় পৌঁছতে সক্ষম, এ কারণে একে বলা হয়েছে, 'সূরাতুল হিক্কা'।
এ সূরাকে বলা হয়েছে, 'সূরাতুল আহ্লাক্' অর্থাৎ নীতি নৈতিকতার সূরা। এ সূরা মানুষকে একটি দৃঢ় নীতি অর্থাৎ আল্লাহর দাসত্ব করার দৃঢ় নীতির ওপর দন্ডায়মান করে দেয়। মানুষকে উন্নত নৈতিক চরিত্র শিক্ষা দেয়। এ জন্য একে চিহ্নিত করা হয়েছে, সূরাতুল আখলাক হিসাবে।
এ সূরাকে বলা হয়েছে, সূরাতুল কাসাস' অর্থাৎ ইতিহাসের সূরা। এ সূরা অতীত ইতিহাসের বদ্ধ দুয়ার মানব জাতির সামনে খুলে দেয়। আল্লাহর দাসত্ব করার কারণে কোন শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর নিয়ামত লাভে ধন্য হয়েছে। আর আল্লাহর দাসত্ব না করার কারণে কোন শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর ক্রোধে নিমজ্জিত হয়েছে এবং তাদের পরিণতি কতটা করুণ হয়েছে, সে ইতিহাস মানুষের সামনে এ সূরা পেশ করে, এ জন্য একে বলা হয়েছে সূরাতুল কাসাস। এই সূরা ফাতিহার যে কত মর্যাদা এবং ফযিলত, তা এ নামগুলোর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট অনুভব করা যায়।
জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রীয় বিষয় মোট তিনটি এবং তা হলো, তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাত। আল্লাহর কিতাবের সূরা ফাতিহার মধ্যে এ তিনটি বিষয়ের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। গোটা কোরআনে আলোচিত জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিমূর্ত প্রতিফলন হলো এই সূরা ফাতিহা। এ সূরাটি একটি দর্পণ বিশেষ, যার ভেতর দিয়ে মানুষ তাওহীদ, রেসালাত ও আখিরাতের চিত্র দেখতে পাবে। মক্কায় অবতীর্ণ এ সূরার মোট আয়াত সংখ্যা হলো সাত। রুকু একটি এবং এ সূরার মোট শব্দ সংখ্যা হলো ২৫ টি। এ সূরায় মোট অক্ষর ব্যবহৃত হয়েছে ১১৩ টি।
0 Comments