সূরা ফাতিহা একটি প্রার্থনা

 


        সূরা ফাতিহাকে একটি অভিনন্দন-পত্র (Congratulatory address) বলা যেতে পারে। বান্দাহ মহান আল্লাহকে যিনি গোটা জাহানের রব্ব, তাঁকেই অভিনন্দন-পত্র দিচ্ছে। এ অভিনন্দন-পত্র বান্দাহ স্বয়ং রচনা করে আল্লাহর দরবারে পেশ করছে না, কারণ বান্দার সে ক্ষমতা ও যোগ্যতা (Qualification) কোনটিই নেই। আল্লাহর কতৃজ্ঞতা, তাঁর প্রশংসা, তাঁর অগণিত নিয়ামতের শোকর আদায় ও তাঁকে অভিনন্দন জানানো কোনটিই মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। আল্লাহর প্রশংসা কিভাবে জানাতে হবে, কোন ভাষায় প্রশংসা করতে হবে এবং কি পদ্ধতিতে করতে হবে, এর কোনটিই বান্দা জানে না বা সে যোগ্যতা বান্দার মধ্যে নেই। এ জন্য স্বয়ং আল্লাহ অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাকে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে শিখিয়েছেন, কিভাবে ও কোন ভাষায় এবং কোন পদ্ধতিতে মনিবের প্রশংসা করতে হবে, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। এ সূরাটি মূলতঃ একটি প্রার্থনার সূরা। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে, সে কিতাব যে ব্যক্তিই অধ্যয়ন করতে আগ্রহী হবে, মহান আল্লাহ তাঁকেই এই সূরা ফাতিহার মাধ্যমে এই দোয়া করতে শিক্ষা দিয়েছেন, সে যেন এই কিতাব

        থেকে কল্যাণ লাভ করতে পারে। এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এ পৃথিবীতে মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো, একটি নির্ভুল ভারসাম্যমূলক জীবন ব্যবস্থা তথা এমন একটি সত্য সঠিক পথ-যে পথে এগিয়ে গেলে মানুষ তার সমগ্র জীবনে চরম সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়। এটাই মানুষের কামনা এবং এই কামনা সে এমন এক শক্তির কাছে পেশ করে, যে শক্তি সম্পর্কে তার দৃঢ় বিশ্বাস রয়েছে যে, সে যা কামনা করছে, তা একমাত্র ঐ শক্তির হাতেই নিবদ্ধ। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানুষের এই কামনার প্রতি লক্ষ্য রেখে সূরা ফাতিহাকে তাঁর কিতাবের শিরোভাগে স্থান দিয়েছেন, যেন মানুষ সত্যানুসন্ধিৎসু মনোভাব এবং সত্য সঠিক পথের সন্ধান লাভের উদ্দেশ্যেই তাঁর অবতীর্ণ করা এই কিতাব অধ্যয়ন করতে শুরু করে। সত্য সহজ সরল পথের সন্ধান করছে মানুষ ঐ আল্লাহর কাছে, যিনি সমস্ত জ্ঞানের উৎস এবং তিনিই নির্ভুল জ্ঞান ও পথের সন্ধান দিতে সক্ষম।

        সূরা ফাতিহাকে অনুধাবন করতে হলে একটি কথা স্মরণে রেখে অধ্যয়ন করতে হবে, গোটা কোরআনের ভেতরে মহান আল্লাহ যা আলোচনা করেছেন, তার সারমর্ম (Substance)) হচ্ছে সূরা ফাতিহা। সুতরাং, অনুসন্ধানী দৃষ্টি; সত্যানুসন্ধিৎসু মন-মানসিকতা, একনিষ্ঠ অধ্যয়ন, ব্যতীত সূরা ফাতিহার গুরুত্ব অনুধাবন ও এ সূরা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা সম্ভব হবে না।

        সূরা ফাতিহা একটি অভিনন্দন-পত্রের মতো। তিনটি বিষয়কে সম্বলিত করে একটি অভিনন্দন-পত্র রচিত হয়। এ পত্রের প্রথমে থাকে যাকে উদ্দেশ্য করে তা রচিত হচ্ছে, তার ভূয়সী প্রশংসা। দ্বিতীয় ভাগে থাকে যাকে কেন্দ্র করে অভিনন্দন পত্র রচিত হচ্ছে, তাঁর পরিচিতি। তৃতীয় ভাগে সংযোজন করা হয়ে থাকে অভিনন্দন-পত্র রচয়িতা কর্তৃক দাবী।

        যাকে উদ্দেশ্য করে অভিনন্দন-পত্র রচিত হয়, শব্দের ভান্ডার থেকে সর্বোৎকৃষ্ট প্রশংসামূলক শব্দ চয়ন করে তা সংযোজন করে আকর্ষণীয় বর্ণনাশৈলীতে তা প্রথম অংশে বর্ণনা করা হয়। যার উদ্দেশ্যে অভিনন্দন পেশ করা হচ্ছে, তিনি যেন প্রথম অংশ শ্রবণ করেই বর্ণনাকারীদের প্রতি অনুগ্রহশীল হয়ে ওঠেন। দ্বিতীয় অংশে তাঁর পরিচিতি থাকে। পরিচিতির ভেতরে তাঁর অপরিসীম দয়া ও অনুগ্রহের কথা, তাঁর উদারতা ও বদান্যতার কথা; তিনি কতটা ক্ষমতাধর এবং তাঁর ক্ষমতার পরিধি কতটা ব্যাপক, যে কোন সাহায্য দানে তিনি সক্ষম ইত্যাদির কথা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়ে থাকে। তৃতীয় অংশে থাকে যারা অভিনন্দন জ্ঞাপন করছে, তারা কতটা অসহায়, অভাবী, অপারগ, মুখাপেক্ষী এবং তাদের কি প্রয়োজন তা বিনয়ের সাথে তুলে ধরা হয়।

        প্রবল ক্ষমতা ও শক্তিধরের কাছে কোন সাহায্য কামনা করার এটাই প্রথাসিদ্ধ রীতি। মূলতঃ এই শালীনতা, ভদ্রতা ও শিষ্টাচার মানুষকে শিক্ষা দিয়েছে আল্লাহর কিতাব। এই কোরআনই মানুষকে ভদ্র, মার্জিত ও রুচিবান হবার শিক্ষা দিয়েছে। এই কোরআনের শিক্ষা যাদের কাছে নেই, সেই পশ্চিমা জগৎ-আজো জানেনা কিভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছনা অর্জন করতে হয়। দিনের পর দিন অতিবাহিত হয়ে যায়, দাঁত পরিষ্কার করা, পরিধেয় বস্ত্র পবিত্র করা, মলমূত্র ত্যাগের পর পবিত্রতা অর্জন করা এবং গোসলের সাথে তাদের পরিচয় ঘটে না। অন্য জাতির সাথে ইনসাফ করতে তারা জানে না। আল্লাহর কোরআনই এসব কিছু মানব জাতিকে শিক্ষা দিয়েছেন।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা ফাতিহার মাধ্যমে তাঁর বান্দাহদেরকে শিক্ষা দিয়েছেন, কিভাবে প্রশংসা করতে হবে, কোন পদ্ধতিতে পরিচয় পেশ করতে হবে এবং কিভাবে দাবি করতে হবে। এই তিনটি জিনিস মানুষ জানতে পেরেছে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে। সূরা ফাতিহা একটি অভিনন্দন-পত্রের মতো এবং তা কিভাবে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হবে, সেটাও আল্লাহ শিখিয়ে দিয়েছেন এবং কেন-কোন উদ্দেশ্যে পেশ করতে হবে, সেটাও আল্লাহ তা'য়ালা জানিয়ে দিয়েছেন। মানব জীবনের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আল্লাহর কাছে কামনা করতে হবে, সেই জিনিসটি কি-তা সামনের দিকে বর্ণনা করা হবে ইনশাল্লাহ। আল্লাহ হলেন সবচেয়ে বড় এবং মহান; তাঁর দরবারে কামনাও করতে হবে সবচেয়ে বড় জিনিস। সেটা কামনা করার নিয়ম-পদ্ধতিই শিক্ষা দেয়া হয়েছে বান্দাকে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে।

Post a Comment

0 Comments