কোরআনের সূরা সংখ্যা ও নামসমূহ

        পবিত্র কোরআনে মোট সূরার সংখ্যা হলো ১১৪ টি। আল্লাহর রাসূলের হিজরাতের পূর্ব জীবনে যেসব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, যেগুলোকে মক্কী সূরা নামে অভিহিত এবং হিজরাতের পরবর্তী সময়ে যেসব সূরা অবতীর্ণ হয়েছে, সেগুলো মাদানী সূরা নামে অভিহিত হয়েছে। এমন কি হিজরাতের পর মক্কার কাছে অবস্থিত হুদায়বিয়ার সন্ধী (Hudaibiya treaty) সম্পাদিত হবার পর এবং বিদায় হজ্জ উপলক্ষ্যে মূল মক্কা নগরীতে যা কিছু আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল, সেগুলোও মাদানী সূরার অন্তর্গত হয়েছে। এ দিক দিয়ে মক্কী সূরার মোট সংখ্যা হলো ৮৬ টি। আর মাদানী সূরার মোট সংখ্যা হলো ২৮ টি। এভাবে কোরআনের মোট সূরার সংখ্যা দাঁড়ায় মোট ১১৪ টি। কতকগুলো সূরা এমন যে, তার প্রথম অংশ মক্কী এবং পরবর্তী অংশ মাদানী। কিন্তু গোটা সূরাটিই মক্কী হিসাবেই গণনা করা হয়েছে। সূরা মুযাম্মিল এ ধরনের একটি সূরা।

        কোরআনের মোট সূরার মধ্যে ১৭ টি সূরা মক্কী না মাদানী এ বিষয়ে মতপার্থক্য বিরাজমান। এই ১৭ টি সূরার মধ্যে আবার সূরা বাইয়েনাহ, সূরা আল আদিয়াহ, সূরা আল মাউন, সূরা আল ফালাক ও সূরা আননাস-অর্থাৎ মোট ৫ টি সূরা নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ব্যাপক মতপার্থক্য বিদ্যমান। এই ১৭ টি সূরার মধ্যে সূরা আর রাদ, সূরা আর রাহমান, সূরা আদ দাহার ও সূরা আল যিলযাল অর্থাৎ ৪ টি সূরা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এগুলো মাদানী সূরা। আবার সূরা আত তীন, সূরা আল কদর, সূরা আত তাকাসুর, সূরা আল আসর, সূরা আল কোরাইশ, সূরা আল কাউসার, সূরা আল কাফিরুন ও সূরা ইখলাস-এই ৮ টি সূরা সম্পর্কে অধিকাংশ গবেষকগণ বলেছেন, এগুলো মক্কী সূরা।

        আল্লাহর কোরআনের কোন বিষয় ভিত্তিক নাম নেই। এ কিতাবের যতগুলো নাম পাওয়া যায়, তা সবই গুণবাচক নাম। যেমন কোরআন একটি নাম এবং এর অর্থ হলো যা পাঠ করা হয় বা যা পাঠ করা একান্তই জরুরী। অর্থাৎ এটা এমনই একটি কিতাব, যা প্রতিটি মানুষের জন্য পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য। কারণ এ কিতাব ব্যতীত মানুষ কোনক্রমেই নির্ভুল পথ এবং জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম নয়। আর নির্ভুল পথ ও জ্ঞান মানুষের জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন। এ প্রয়োজনীয়তা পূরণের লক্ষ্যেই এ কিতাব অবশ্যই পাঠ করা কর্তব্য। এ জন্য আল্লাহর এ কিতাবকে বলা হয়েছে কোরআন।

        মহান আল্লাহর অবতীর্ণ করা এ কিতাবের আরেকটি নাম হলো ফোরকান। এই ফোরকান শব্দের অর্থ হলো যা সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য নির্ভুলভাবে দেখিয়ে দেয়। পৃথিবীতে এমন কোন গ্রন্থ নেই, যে গ্রন্থ দাবী করতে পারে যে, আমি সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান নির্ভুলভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম। কিন্তু আল্লাহর এই কিতাব চ্যালেঞ্জ করে দাবী করে, আমি সত্য আর মিথ্যা নির্ণয়ের একমাত্র নির্ভুল মানদন্ড-আমি সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য স্পষ্টভাবে তুলে ধরি। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَإِذْ أَتَيْنَا مُوسَى الْكِتَابَ وَالْفُرْقَانَ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ

        স্মরণ করো, আমি মুসাকে কিতাব এবং ফোরকান দান করেছি-সম্ভবত এর সাহায্যে তোমরা সহজ ও সত্য পথ লাভ করতে পারবে। (সূরা বাকারা-৫৩)

        হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের ওপরেও যে কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছিল, সে কিতাবও সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করার গুণাবলী সম্বলিত ছিল। আর কোরআন সম্পর্কে বলা হয়েছে-

 شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيْهِ القُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِّنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ

        রমজান মাস, এতেই কোরআন অবতীর্ণ করা হয়েছে, যা গোটা মানব জাতির জন্য জীবন যাপনের বিধান আর এটা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ, যা সঠিক ও সত্য পথপ্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিষ্কাররূপে তুলে ধরে। (সূরা বাকারা-১৮৫) 

        সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কোন ধরনের জড়তা বা সন্দেহ সংশয় থাকে না, সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে তা তুলে ধরে। মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, মানুষের রচনা করা বিধান অনুসরণ কেন করা যাবে না এবং কেন আল্লাহর প্রেরিত বিধান অনুসরণ করতে হবে। এ পার্থক্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট তুলে ধরে এ কিতাব। আল্লাহ বলেন-

مِنْ قَبْلُ هُدًى لِلنَّاسِ وَأَنْزَلَ الْفُرْقَانَ إِنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا بِايَتِ اللَّهِ لَهُمْ عَذَابٌ شَدِيدٌ

        আর তিনি মানদন্ড অবতীর্ণ করেছেন হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশকারী। এখন যারা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করতে অস্বীকার করবে, তাদেরকে অবশ্যই কঠিন শাস্তি প্রদান করা হবে।

 (সূরা আলে-ইমরান-৪)

        আল্লাহ তা'য়ালা যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তা অত্যন্ত কল্যাণময়। কেননা এ কিতাব মানুষের যে কোন সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম। এই পৃথিবীর ইতিহাস হলো সত্য আর মিথ্যার চিরন্তন দ্বন্দ্বের ইতিহাস। সত্যবার মিথ্যার যে চিরন্তন দ্বন্দ্ব এ পৃথিবীতে চলে আসছে, এ দ্বন্দ্ব দূরীভূত করার লক্ষ্যেই এ কিতাব অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

تَبْرَكَ الَّذِي نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلَى عَبْدِهِ لِيَكُونَ لِلْعَلَمِينَ نَذِيرًا - 

        বড়ই বরকত সম্পন্ন তিনি-যিনি এ ফোরকান তাঁর বান্দার ওপর অবতীর্ণ করেছেন, যেন সে গোটা পৃথিবীবাসীর জন্য সতর্ককারী হয়। (সূরা আল ফোরকান-১)

        মহান আল্লাহ তাঁর কিতাবকে 'যিকর' নামে অভিহিত করেছেন। প্রচলিত অর্থে যিকর বলতে একশ্রেণীর মানুষ যা বুঝে থাকে, যিকর শব্দের অর্থ বা যিকর বলতে শুধু সেটাই বুঝায় না। আল্লাহ তা'য়ালা এই যিকর শব্দকে বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার করেছেন। এ কিতাবকেও যিকর বলা হয়েছে। কোরআনকে যিকর বলা হয়েছে এ অর্থে যে, এ কিতাব ভুলে যাওয়া শিক্ষা স্মরণ করিয়ে দেয়, যা নির্ভুল উপদেশ-জ্ঞান দান করে। হযরত মুসা আলাইহিস্ সালামের ওপর যে তাওরাত অবতীর্ণ করা হয়েছিল, তাকেও যিকর বলা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

وَلَقَدْ أَتَيْنَا مُوسَى وَهُرُونَ الْفُرْقَانَ وَضِيَاءٌ وَذِكْرًا لِلْمُتَّقِينَ 

         পূর্বে (এই কোরআনের পূর্বে) আমি মুসা ও হারুনকে দিয়েছিলাম ফোরকান, জ্যোতি ও যিকর মুত্তাকিদের জন্য। (সূরা আল আম্বিয়া-৪৮)

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর এই কিতাবকে যিকর হিসাবে উল্লেখ করে বলেন-

وَهَذَا ذِكْرٌ مُبْرَكَ أَنْزَلْنَهُ أَفَانْتُمْ لَهُ مُنْكِرُونَ

        আর এখন এই বরকত সম্পন্ন যিকর আমি অবতীর্ণ করেছি। তবুও কি তোমরা একে মেনে নিতে অস্বীকার করবে? (সূরা আল আম্বিয়া-৫০)

        আল্লাহ তা'য়ালা সূরা আ'রাফের ৬৩ ও ৬৯ আয়াতে, সূরা ইউসুফের ১৪০ আয়াতে, সূরা হিজরের ৬ ও ৯ আয়াতে, সূরা নাহলের ৪৪ আয়াতে, সূরা কলমের ৫১ আয়াতে ও সূরা আবাসার ১১ আয়াতে যিকর শব্দের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনকে বুঝিয়েছেন। সূরা কামারের ২৫ আয়াতে যিকর শব্দ দিয়ে ওহীকে বুঝানো হয়েছে। এই কিতাব সংরক্ষণের কথা উল্লেখ করে সূরা আল হিজরের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَفِظُونَ

        আর বাণী, একে তো আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমি নিজেই এর সংরক্ষক।

        মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই কোরআনকে 'আমার যিকর' নামে অবিহিত করেছেন-যে যিকর মানুষকে সত্য সহজ পথপ্রদর্শন করে। মানুষ যে শিক্ষা ভুলে গিয়েছে তা স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ বলেন-

وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِكَرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ 

        এ বাণী তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, যাতে তুমি লোকদের সামনে সেই শিক্ষার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে যেতে থাকো। যা তাদের জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে এবং যাতে লোকেরা চিন্তা-ভাবনা করে। 
(সূরা আন নাহল-৪৪)

        এভাবে এ কিতাবকে 'নূর' বলা হয়েছে। কারণ এ কিতাব মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে অর্থাৎ মিথ্যার অন্ধকার থেকে মহাসত্যের আলোর দিকে নিয়ে আসে। এ ধরনের অনেক নাম রয়েছে এ কিতাবের। যা গুণবাচক নাম এবং সেসব নাম এ কিতাবের সম্মান-মর্যাদা ও অন্যান্য গুণাবলী প্রকাশ করে। আল্লাহর এই কিতাষে যে ১১৪ টি সূরা রয়েছে, তার ভেতরে ৯ টি সূরা ব্যতিত ১০৫ টি সূরার বিষয় ভিত্তিক নাম নেই। শুধুমাত্র পরিচিতির জন্য বিভিন্ন নাম দেয়া হয়েছে। যেমন সূরা বাকারাহ্, এর অর্থ গাভী। এ নাম এ জন্য দেয়া হয়নি যে, এ সূরায় শুধু গাভী সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সূরা আন নাহল-এর অর্থ মৌমাছি। সূরা নামল-এর অর্থ পিপিলীকা। সূরা আনকাবুত-এর অর্থ মাকড়শা। এসব সূরার মধ্যে এই শব্দগুলো উল্লেখ রয়েছে, ফলে পরিচিতির জন্য নামকরণ করা হয়েছে।

Post a Comment

0 Comments