মক্কায় অবতীর্ণ সূরাসমূহের বৈশিষ্ট্য

 

        বর্তমানে পবিত্র কোরআন যেভাবে আমাদের সামনে উপস্থিত রয়েছে, এভাবে এ কোরআনকে বিন্যাস করেছেন স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, নবুয়্যত ও রিসালাত সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে তিনি যেসব কথা বলেছেন, সেসব কথা তিনি আল্লাহর আদেশেই বলেছেন। এই কোরআনে যখন শ্রেণী বিন্যাস করা হয়, তখন তা স্বয়ং আল্লাহরই নির্দেশে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের তত্ত্বাবধানে তা করা হয়। কোন সূরার পরে কোন সূরা সাজানো হবে, কোন আয়াত কোন সূরার অংশ হবে, এ সংক্রান্ত নির্দেশ আল্লাহর রাসূল দিয়েছিলেন। আল্লাহর নবী তাঁর নবুয়তি জিন্দেগীর মোট তেইশ বছরের মধ্যে তের বছর অবস্থান করেছিলেন মক্কায় আর অবশিষ্ট দশ বছর মদীনায় অবস্থান করেন এবং সেখানেই তিনি ইন্তেকাল করেন।

        মক্কায় অবস্থানকালে তাঁর ওপরে যেসব ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল, সেগুলো মক্কী সূরা নামে অভিহিত হয়েছে। আর মদীনায় অবস্থানকালে যেসব ওহী অবতীর্ণ হয়েছিল, তা মাদানী সূরা নামে অভিহিত। অবশ্য কতকগুলো সূরা সম্পর্কে কোরআন গবেষকগণ বলেন, এসব সূরায় মক্কী ও মাদানী এ উভয় বৈশিষ্ট্যই বিদ্যমান। আল্লাহর এ কিতাবের যেসব সূরা মক্কী হিসাবে অভিহিত হয়েছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য এবং মাদানী নামে পরিচিত সূরাগুলোর বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য রয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন দায়িত্ব হলো নবী-রাসূলদের ওপরে অর্পিত দায়িত্ব। এই দায়িত্ব অর্পণ করার ক্ষণপূর্বেও নবী হিসাবে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ এ দায়িত্ব ও দায়িত্বের পরিধি-ব্যাপকতা সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখতেন না। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও তাঁর ওপরে অর্পিত দায়িত্ব অর্পণের পূর্বে কিছুই জানতেন না। সুতরাং, এ দায়িত্ব অর্পণ করার পর তাঁর মধ্যে যে অস্থিরতা প্রকাশিত হয়েছিল, মক্কী সূরায় তাঁর অস্থিরতা দূর করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণসহ আলোচনা করা হয়েছে।

        নবী ও রাসূল হিসাবে তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব কি এবং কিভাবে তিনি তা পালন করবেন, সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দান করা হয়েছে। কোরআন যে দাওয়াত নিয়ে অবতীর্ণ হচ্ছিলো, সে দাওয়াতের দিকে আল্লাহর রাসূল কোন পদ্ধতিতে মানুষকে আহ্বান জানাবেন, দাওয়াত দানকারীকে কি ধরনের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে ও গুণাবলীর অধিকারী হতে হবে, মক্কী সূরায় এ সম্পর্কিত আলোচনা লক্ষ্য করা যায়। প্রাথমিকভাবে এ দাওয়াতের যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তার মোকাবেলায় রাসূলের অবস্থান কি হবে সে সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দান করা হয়েছে। যখন বিরোধিতা শুরু করা হলো, সে বিরোধিতার ধরন অনুসারে করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে হেদায়াত দেয়া হয়েছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যারা শামিল হচ্ছিলেন, তাঁদের মাধ্যমে এক বিরাট উদ্দেশ্য সাধন করা হবে, এ লক্ষ্যে ব্যক্তি গঠনমূলক পথনির্দেশ মক্কী সূরায় স্পষ্ট লক্ষ্য করা যায়।

        মানুষের সামনে আল্লাহর একত্ববাদ, এক আল্লাহর দাসত্ব করার প্রয়োজনীয়তা, নবুয়্যত ও রিসালাত সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা, আখিরাত ও আখিরাতের আবশ্যকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান দেয়া হয়েছে মক্কী সূরায়। এসব প্রসঙ্গে বিস্তারিত বর্ণনা উপস্থাপন করতে গিয়ে গোটা বিশ্বলোক, প্রাণীজগৎ, মহাশূণ্য, উদ্ভিদজগৎ, মানব সৃষ্টির রহস্য, রাত-দিনের আবর্তন ও বিবর্তন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্র ইত্যাদি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। ইসলামী আন্দোলনের সূচনায় মক্কায় বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে যেসব সূরা অবতীর্ণ করা হতো, সেগুলো আকারে ছোট হলেও অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় সমৃদ্ধ ছিল এবং তা ছিল গভীরভাবে প্রভাব বিস্তারকারী। ইসলামী আদর্শের মৌলিক দিক হলো তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত। এ তিনটি বিষয় মানুষের সামনে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছিল এসব সূরায় এবং সেই সাথে শিরক, আল্লাহ, রাসূল ও আখিরাতের প্রতি অবিশ্বাস ইত্যাদির পরিণতি সম্পর্কে বারবার সাবধান বাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। যারা রাসূলের দাওয়াতে সাড়া দেবে না, বিরোধিতা করবে আখিরাতে তাদের জন্য কি ধরনের শাস্তির ব্যবস্থা প্রস্তুত রয়েছে, তা সবিস্তারে বর্ণনা করা হয়েছে।

        অতীতে যারা নবী-রাসূলদের সাথে বিরোধিতা করেছে, ইতিহাসে তাদের কি পরিণতি ঘটেছে, সেসব ইতিহাস থেকে দৃষ্টান্ত পেশ করা হয়েছে। যারা বিরোধিতা করতো, তারা যেসব ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান রাখতো, সেগুলোও তুলে ধরা হয়েছে। যারা রাসূলের ইসলামী আন্দোলনে শামিল হবে এবং রাসূল কর্তৃক আনিত আদর্শ অনুসরণ করবে, আখিরাতে তাদের সম্মান ও মর্যাদা এবং প্রতিদান সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়েছে।

        মাতা-পিতা তাদের অবাধ্য সন্তানকে যেমন স্নেহমাখা কণ্ঠে সোজা সরল পথে চলার জন্য নানা ধরনের যুক্তি দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন এবং সন্তানকে সত্য পথে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টার কোন ত্রুটি করেন না, মক্কী সূরার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে সে বিষয়টি প্রতিভাত হয়ে ওঠে। সত্য সহজ সরল পথ গ্রহণ করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর বান্দাহদেরকে বারবার বুঝিয়েছেন। বারবার বুঝানোর পরেও বান্দাহ্ বিদ্রোহীর ভূমিকা অবলম্বন করছে, তবুও আল্লাহ তাদেরকে বুঝানোর ব্যাপারে বিরতি দেননি বা বিরক্ত হয়ে তাদেরকে পরিত্যাগ করেননি। তারা যেন সত্য পথ গ্রহণ করে, এ ব্যাপারে আহ্বান জানিয়েছেন।

        রাসূল এবং রাসূলের সাথীদের ওপরে যখন চরম নিষ্ঠুর নির্যাতন অনুষ্ঠিত হয়েছে, প্রবল বাধার সৃষ্টি করা হয়েছে, এ অবস্থায় ইসলামী আন্দোলনের সৈনিকদেরকে কি ভূমিকা পালন করতে হবে তা বলে দেয়া হয়েছে এবং বারবার সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে।

        ইসলামী আন্দোলনে শামিল হবার কারণে অতীতে যাঁরা নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁরা কিভাবে ধৈর্য ধারণ করেছিলেন, এখন তাঁদেরকে কিভাবে ধৈর্য ধারণ করতে হবে, নির্যাতনের মধ্য দিয়েই কিভাবে আন্দোলনকে বিজয়ের পথে অগ্রসর করাতে হবে, এর বিনিময়ে তাঁদেরকে কিভাবে সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হবে এবং সামনে তাঁরা বিজয়ের সোনালী সূর্যের আভায় অচিরেই সিক্ত হবেন, এ সম্পর্কিত বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সেই সাথে ইসলাম বিরোধিদেরকে মারাত্মক পরিণতি ভোগ করতে হবে, এ ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাদেরকে আখিরাতের ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে।

        এ পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে এবং কিভাবে ধ্বংস হবে, মাটির সাথে মিশে যাওয়া মৃত মানুষগুলো আবার জীবিত হবে, পৃথিবীতে মানুষ যা করেছে তার প্রতিটি কর্মকান্ডের চুলচেরা হিসাব দিতে হবে, এসব দিক আলোচনা করে বিরোধিদেরকে বিরোধিতা থেকে বিরত থাকার উপদেশ দেয়া হয়েছে। আখিরাত সম্পর্কে গোটা কোরআনে এত কথা আলোচনা করা হয়েছে যে, তা একত্রিত করলে গোটা কোরআনের তিন ভাগের এক ভাগের সমান হবে। এত কথা একটি বিষয়ের ওপরে এ জন্য বলা হয়েছে যে, যে কোন ধরনের কঠিন আইন প্রণয়ন করে তা জারি করেও মানুষকে অন্যায় করা থেকে বিরত রাখা যায় না এবং মানুষের ভেতর থেকে অপরাধ প্রবণতা দূর করা যায় না। এক কথায় মানুষের চরিত্র কিছুতেই ভালো করা যায় না। মানুষের চরিত্র ভালো করতে হলে মানুষের চিন্তার জগৎ থেকে অপরাধ প্রবণতা দূর করতে হলে, অন্যায় কাজ থেকে মানুষকে দূরে রাখতে হলে মানুষের ভেতরে আখিরাতে জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি করতে হয়। মক্কী সূরাসমূহে এ প্রচেষ্টার আধিক্য লক্ষ্যণীয়।

Post a Comment

0 Comments