কোরআনের প্রথম সূরা ফাতিহা


        আল্লাহর এই কিতাব পবিত্র কোরআনে মোট সূরার সংখ্যা হলো ১১৪ টি। এ সমস্ত সূরার মধ্যে সূরা ফাতিহাকে কোরআনের শুরুতেই স্থান দেয়া হয়েছে। এর অর্থ এটা নয় যে, কোরআনের অন্যান্য সূরার বোধহয় তেমন কোন মর্যাদা সেই। বিষয়টি তেমন নয়। প্রকৃত বিষয় হলো, গোটা কোরআনের প্রতিটি সূরা; প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি শব্দ ও অক্ষরই আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা এবং এর সম্মান ও মর্যাদা অতুলনীয়। কিন্তু সূরা ফাতিহার বিষয়টি একটু ভিন্ন ধরনের। কারণ, গোটা কোরআনে সূরা ফাতিহা ব্যতীত আর এমন একটি সূরাও 'নেই, যে সূরার ভেতরে গোটা কোরাআনের বিষয়বস্তু পাওয়া যাবে। কিন্তু সূরা ফাতিহার ভেতরে গোটা কোরআনের বিষয়বস্তু বিদ্যমান রয়েছে।

        অর্থাৎ গোটা কোরআন যেসব বিষয়বস্তুসহ অবতীর্ণ হয়েছে, তার সারসংক্ষেপ রয়েছে সূরা ফাতিহার মধ্যে। এই সূরা ফাতিহা-ই সর্বপ্রথম একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে। ইতিপূর্বে যেসব আয়াত অবতীর্ণ হয়েছে তা খন্ডিতাকারে অবতীর্ণ হয়েছে এবং উক্ত আয়াতসমূহ সূরা আ'লাক, সূরা মুয্যাম্মিল ও সূরার মুদ্দাসিরে সন্নিবেশিত হয়েছে।

        এ সূরা ঠিক ঐ সময় একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছিল, যখন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে আল্লাহর বিধানের দিকে আহ্বান জানানোর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। যারা তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়েছেন, আল্লাহর সৈনিক হিসাবে তাঁদের মন-মানসিকতা প্রস্তুত করার একান্ত প্রয়োজন ছিল। কেননা, এই লোকগুলোকে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন গোটা বিশ্বের মানুষের জন্য কিয়ামত পর্যন্ত মহান শিক্ষকের পদে আসীন করবেন এবং তাদের মাধ্যমেই ইসলামকে সম্প্রসারিত করাবেন। এই মহান দায়িত্ব যখন তাঁরা রাসূলের সাথে পালন করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, তখন পরিবেশ পরিস্থিতি ছিল তাঁদের সম্পূর্ণ প্রতিকূলে। বিপদ-মসিবত, নির্যাতন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল।

        এ সময়ে সেই লোকগুলোর মন-মস্তিষ্কে সময়ের প্রতিটি মুহূর্তে এ চেতনা জাগ্রত রাখার প্রয়োজন ছিল যে, তাঁদের ইলাহ কে, কার সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তাঁরা যে কোন ধরনের কোরবানী দিতে নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখবেন, সেই অসীম শক্তিশালী ইলাহ তাঁদের প্রতি অনুগ্রহশীল কিনা, তাঁর কাছে জীবনের সমস্ত কর্মকান্ডের জবাব দিতে হবে কিনা এবং তিনিই তাঁদেরকে সত্য সহজ সরল পথপ্রদর্শন করতে সক্ষম। একমাত্র তিনিই তাঁদেরকে যে কোন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম এবং তাঁর কাছেই নিজেকে নিঃশেষে নিবেদন করতে হবে। উল্লেখিত চেতনা আল্লাহর সৈনিকদের মধ্যে প্রতিটি মুহূর্তে সক্রিয় রাখা একান্তই প্রয়োজন। সূরা ফাতিহা সে চেতনা শানিত রাখার শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। প্রতিদিন নামাজে এ সূরা বারবার পাঠ করার মাধ্যমে উক্ত চেতনাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করা হয়েছে। আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবাগণের ওপরে বাতিল শক্তি নির্যাতনের ষ্টীম রোলার চালিয়েছে, তখন তাঁরা নামাজে এ সূরার মাধ্যমে নিজেদের মনের সমস্ত ব্যথা-বেদনা আল্লাহর কাছে নিবেদন করে হৃদয়-মনে এক অনাবিল শান্তি অনুভব করেছেন। তাঁদের দেহ-মনে নতুন শক্তি সঞ্চারিত হয়েছে। সম্পূর্ণ নব-উদ্যোমে তাঁরা ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

        মানুষ আল্লাহর দাস এবং যাবতীয় ব্যাপারে তাকে সেই আল্লাহরই মুখাপেক্ষী হতে হবে, এ চেতনা পৃথিবীর এই প্রতিকূল পরিবেশে সদাজাগ্রত রাখার জন্যই এ সূরাকে কোরআনের প্রথমে স্থান দিয়ে বারবার পঠনীয় করা হয়েছে। কোরআন পাঠ শুরুর সাথে সাথেই এ সূরা পাঠ করার মাধ্যমে পাঠকের চেতনায় এ কথা জাগ্রত হয়ে ওঠে, সে কার বাণী পাঠ করতে যাচ্ছে এবং তাঁর পরিচয় কি। পাঠকের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক কোন ধরনের। এসব কথা কোরআনের পাঠকের কাছে সূরা ফাতিহার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে যায়।

        বর্তমানে আল্লাহর কিতাবের সূরাসমূহ যে ক্রমিকধারা অনুসারে সাজানো হয়েছে, এই ধারা অনুসারে কোরআন অবতীর্ণ হয়নি। আল্লাহর কোরআনের বর্তমান ক্রমিক সজ্জা সূরাসমূহের কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তুর পারস্পরিক সামঞ্জস্যের কারণে আল্লাহর আদেশে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করেছেন এবং তিনিই সূরা ফাতিহাকে কোরআনের প্রথমে স্থান দিয়েছেন। এ সূরার মূল বিষয়বস্তুর দিকে দৃষ্টি রেখেই একে সর্বপ্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে।

        কারণ, মানুষের পক্ষে কোনক্রমেই সম্ভব নয় যে, সে আল্লাহর প্রশংসা করে শেষ করতে পারে। কিভাবে কোন কোন বাক্যে আল্লাহর প্রশংসা করা যেতে পারে, এ বিষয়টি এই সূরার মাধ্যমে মানুষকে শিক্ষা দেয়া হয়েছে। অক্ষম দুর্বল মানুষ কিভাবে নিজেকে আল্লাহর-কাছে নিবেদন করবে, কিভাবে সে তার আবেগ-উচ্ছ্বাস মহান মালিকের দরবারে প্রকাশ করবে, কোন কথার মাধ্যমে সে আল্লাহর অফুরন্ত দান ও অনুগ্রহের স্বীকৃতি দেবে, মানব প্রকৃতির কামনা-বাসনা কি-ইত্যাদি বিষয়সমূহ এ সূরার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

        এ সূরার ফযিলত সম্পর্কে হাদীসে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা বর্ণনা করেছেন, আল্লাহর নবী বলেন, যে ব্যক্তি এমন নামাজ আদায় করলো, যার মধ্যে উম্মুল কোরআন অর্থাৎ সূরা ফাতিহা পাঠ করেনি, তার নামাজ ব্যর্থ ও মূল্যহীন থেকে যাবে। বর্ণনাকারী বলেন, আল্লাহর রাসূল এ কথাটি তিনবার উচ্চারণ করেন। তার নামাজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আমরা যখন ইমামের পেছনে নামাজ আদায় করবো, তখন কি করবো? আল্লাহর রাসূল জবাবে বললেন, তখন সূরা ফাতিহা মনে মনে পাঠ করবে। কেননা, আমি আল্লাহর রাসুলকে বলতে শুনেছি, মহান আল্লাহ বলেন-আমি নামাজকে আমার এবং বান্দার মাঝে সমান দুই ভাগে ভাগ করে নিয়েছি। বান্দাহ যা কামনা করবে আমি তাকে তা দান করবো।

        বান্দাহ যখন বলে, আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন-অর্থাৎ যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি সারা জাহানের প্রতিপালক। তখন আল্লাহ তা'য়ালা বলেন, বান্দাহ আমার প্রশংসা করেছে। যখন বান্দাহ বলে, আর রাহমানির রাহীম। অর্থাৎ তিনি দয়াময়, তিনি অনুগ্রহকারী। তখন মহান আল্লাহ বলেন, বান্দাহ আমার মর্যাদা স্বীকার করেছে এবং আমার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। বান্দাহ যখন বলে, ইয়্যাকা না'বুদু ওয়া ইয়্যাকা নাহুতাঈ'ন। অর্থাৎ আমরা কেবল তোমারই ইবাদাত করি এবং কেবলমাত্র তোমার কাছেই সাহায্য প্রার্থনা করি। তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার এবং বান্দার মাঝে (অর্থাৎ বান্দাহ আমার দাসত্ব করবে আর আমি তাকে সাহায্য করবো), আমার বান্দাহ যা চায় তা আমি দান করবো। যখন বান্দাহ বলে, ইহদিনাস্ সিরাত্বাল মুস্তাকিম, সিরাত্বাল্লাযিনা আনআ'মতা আলাইহিম গাইরিল মাগদুবি আলাইহিম ওয়ালাদ্ দোয়াল্লীন। অর্থাৎ আমাদেরকে সরল পথে পরিচালিত করুন, সেইসব বান্দাদের পথে যাদের আপনি নি'য়ামত দান করেছেন, যারা অভিশপ্তও নয় এবং পথভ্রষ্টও নয়। তখন আল্লাহ বলেন, এটা আমার বান্দার জন্য এবং আমার বান্দাহ যা প্রার্থনা করেছে তা সে পাবে। (মুসলিম, আবুদাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ, মুসনাদে আহমাদ)

        নামাজে এ সূরা অবশ্যই পাঠ করতে হবে। এ সূরা পাঠ করা ব্যতীত কোন নামাজ আদায় হবে না। জামাআতে নামাজে মুক্তাদীগণকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে কিনা, এ সম্পর্কে ইসলাম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতানৈক্য বিরাজমান। হাদীস শরীফে দেখা যায়, হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, মুক্তাদীগণ সূরা ফাতিহা নীরবে পাঠ করবে। ইমাম শাফেঈ (রাহ) বলেন, মুক্তাদীগণকে যে কোন অবস্থায় সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে। ইমাম আবু হানিফা (রাহ) বলেন, কোন অবস্থায়ই মুক্তাদীগণকে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে না।

        ইমাম মালিক ও ইমাম আহমদ (রাহ) বলেন, ইমাম সাহেব যে সূরা ফাতিহা পাঠ করেন, তা যদি মুক্তাদীগণ শুনতে পায়, তাহলে তাদের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করার কোন প্রয়োজন নেই। তাঁরা ইমামের পাঠ মনোযোগ দিয়ে শুনবে। কিন্তু ইমামের পাঠ যদি মুক্তাদীগণ শুনতে না পায়, তাহলে তাঁদেরকে তা পাঠ করতে হবে।

        এ সম্পর্কে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদুদী (রাহ) ভারসাম্যমূলক মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, 'ইমামের পেছনে সূরা ফাতিহা পাঠ সম্পর্কে আমি যতটুকু অনুসন্ধান করেছি, তার আলোকে সর্বোত্তম পন্থা হলো, ইমাম যখন উচ্চকণ্ঠে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে তখন মুক্তাদীগণ নীরব থাকবেন। আর যখন ইমাম নীরবে পাঠ করবেন, তখন মুক্তাদীগণও নীরবে সূরা ফাতিহা পাঠ করবে। এ পদ্ধতি অবলম্বন করলে কোরআন ও হাদীসের কোন নির্দেশের বিরোধিতা করার কোন সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে না। জামাআতে নামাজে মুক্তাদীগণ কর্তৃক ফাতিহা পাঠ সম্পর্কিত যাবতীয় দলীল-প্রমাণের দিকে দৃষ্টি রেখে এ ধরনের একটি মধ্যমপন্থা অবলম্বন করায় দোষের কিছু দেখি না। কিন্তু যে ব্যক্তি জামাআতে নামাজ আদায়কালে যে কোন অবস্থাতেই সূরা ফাতিহা পাঠ করে, তার সম্পর্কে এ কথা বলা যাবে না যে তার নামাজ হবে না। কারণ উভয় মতের পক্ষে দলীল-প্রমাণ রয়েছে এবং জামাআতে সূরা ফাতিহা পাঠকারী ব্যক্তি জেনে বুঝে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশের বিরোধী আচরণ করছে না। বরং তার কাছে দলীলের ভিত্তিতে যে মতটি প্রমাণিত, সে ব্যক্তি উক্ত মতের ওপর আমল করছে এবং তা অনুসরণ করছে।

Post a Comment

0 Comments