কোরআনের আমাদের কী দাওয়াত দিয়েছে

        পৃথিবীতে মানুষের জীবন পরিচালনার জন্য যে হেদায়াত ও পথনির্দেশনার একান্ত প্রয়োজন, এ পৃথিবীতে মানুষের আগমনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গোটা বিশ্বলোকের নিগূঢ় তত্ত্ব ও অস্তিত্বের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য অনুধাবন করার জন্য যে জ্ঞানের প্রয়োজন, মানুষের ব্যক্তি চরিত্র গঠন ও দায়িত্ব-কর্তব্য, পারিবারিক চরিত্র গঠন ও পরিচালনা, সভ্যতা-সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা, সমাজ, দেশ ও জাতিকে সঠিক ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যেসব মূলনীতি ও আদর্শ একান্ত প্রয়োজন, সেসব লাভ করার একমাত্র মাধ্যম হলো মহান আল্লাহকে নিজেদের জন্য একমাত্র 'পথনির্দেশক হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া।

        তারপর তিনি তাঁর রাসূলের মাধ্যমে যে জীবন বিধান অবতীর্ণ করেছেন, শুধুমাত্র তাই অনুসরণযোগ্য আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে তা অনুসরণ করা। আল্লাহকে শুধুমাত্র সেজদা লাভের অধিকারী হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে তারপর জীবনের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রে পৃথিবীর চিন্তাবিদ ও দার্শনিকদের আবিষ্কৃত মতবাদ মতাদর্শ অনুসরণ করা এবং নিজেকে পরিপূর্ণরূপে নেতা নেত্রীদের নেতৃত্বাধীন করা মানুষের জন্য এক মারাত্মক ভ্রান্ত কর্মনীতি। এ ধরনের কর্মকান্ড মানুষকে ক্রমশঃ ধ্বংস গহ্বরের দিকে অগ্রসর করিয়ে থাকে। এ জন্য মহান আল্লাহ বলেছেন-

اتَّبِعُ مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِّنْ رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ 

        হে মানুষ! তোমাদের রব্ব-এর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি যা কিছু অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাই অনুসরণ করো এবং তাঁকে বাদ দিয়ে অপরাপর পৃষ্ঠপোষকদের অনুসরণ ও অনুগমন করো না। (সূরা আ'রাফ-৩)

        এই কোরআন মানুষকে আহ্বান জানায় মহান আল্লাহর দাসত্ব করার দিকে। মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়, তিনিই তোমাদের স্রষ্টা ও লালন-পালন কর্তা। সুতরাং তাঁরই আইন-কানুন অনসরণ করে চলো। কোরআন মানুষকে এভাবে দাওয়াত দেয়-

يأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ

        হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই রব্ব-এর দাসত্ব স্বীকার করো, যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তী সমস্ত মানুষের সৃষ্টি কর্তা। (সূরা বাকারা-২১)

        মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই তাঁর স্রষ্টার মুখাপেক্ষী। মানুষের সৃষ্টিগত প্রকৃতিই হলো, সে আল্লাহর দাসত্ব করবে। এই প্রকৃতি থেকে মানুষ যখন নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে, তখন সে সমস্ত সৃষ্টির দাসত্ব করতে বাধ্য হয়। সম্মান ও মর্যাদার আসন থেকে সে ঘৃণা ও লাঞ্ছনার অতল তলদেশে তলিয়ে যায়। এ জন্য কোরআন মানুষকে আল্লাহর দাসত্ব করার জন্য আহ্বান জানায় তথা মানব প্রকৃতির দিকে ফিরে আসতে উদাত্ত আহ্বান জানায়। কোরআন মানুষকে দাওয়াত দেয়-

حُنَفَاءَ لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِيْنَ بِهِ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاءِ فَتَخْطَفُةُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِى بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

        একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর বান্দাহ্ হয়ে যাও, তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করে সে যেন আকাশ থেকে পড়ে গেলো। এখন হয় তাকে পাখি ছোঁ মেরে নিয়ে যাবে অথবা বাতাস তাকে এমন স্থানে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে দেবে যেখানে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। (সূরা আল হাজ্জ-৩১)

        উল্লেখিত আয়াতে আকাশ বলতে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতিকে বুঝানো হয়েছে। তাঁর প্রকৃতি দাবি করে আল্লাহর বান্দাহ হওয়ার জন্য এবং তাওহীদ ব্যতীত সে আর অন্য কোন আদর্শ অনুসরণ করতে আগ্রহী হয়না। মানুষ জন্মগ্রহণ করে তার স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপরে আল্লাহর গোলাম হিসাবেই। পরবর্তীকালে তার প্রকৃতি নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে বিভিন্ন আদর্শের অনুসরণ করতে থাকে। মানুষ যখন তার জন্মগত স্বাভাবিক প্রকৃতিতে থাকে, তখন তাকে রাসূল প্রদর্শিত আদর্শানুসারে শিক্ষা প্রদান করা হলে তার জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি ও অন্তরদৃষ্টি স্বাভাবিক প্রকৃতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। পরবর্তী জীবনে এসব মানুষ আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে আধ্যাত্মিকতার উচ্চমার্গে আরোহন করতে সমর্থ হয়।

        আল্লাহর রাসূল বলেন, মানুষ জন্মগ্রহণ করে মুসলিম হিসাবেই, তাকে লালন-পালনকারী যারা, তারাই তাকে ভিন্ন আদর্শে গড়ে তোলে। অর্থাৎ মানুষ এক আল্লাহর গোলামী করার প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি নিয়েই পৃথিবীতে আগমন করে থাকে। মানুষের জন্য এই প্রকৃতি থেকে বিচ্যুত হবার অর্থই হলো, সম্মান-মর্যাদার উচ্চাসন থেকে ঘৃণা ও লাঞ্ছনার অতল গহ্বরে নিমজ্জিত হওয়া। এ অর্থেই বলা হয়েছে যে, আল্লাহর গোলামী ত্যাগ করে যে ব্যক্তি অন্যের অনুসরণ করলো সে যেন তাকে দাসত্ব লাভের অধিকারী বানিয়ে দিল।

        আর এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো দাসত্ব করার অর্থই হলো স্পষ্ট শিরক করা। শিরকে লিপ্ত হওয়ার মানেই হলো সম্মান ও মর্যাদার উচ্চাসন থেকে ছিটকে দূরে নিক্ষিপ্ত হওয়া। এভাবে কোন মানুষ যখন নীচে পড়ে যায়, তখন অসংখ্য শক্তির দাসত্ব করতে সে বাধ্য হয়। পরিবারে নিজের স্ত্রী থেকে শুরু করে, সমাজের নেতাদের দাসত্ব করতে থাকে, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নেতৃবৃন্দের এবং মানুষের রচনা করা রাষ্ট্রীয় আইন-কানুনের দাসত্ব করতে সে বাধ্য হয়।

        একটা পাখির শাবক যখন বাসা থেকে ছিটকে পড়ে, তখন যেমন শাবকটি বাতাসের ঝাপটায় বহুদূরে নিক্ষিপ্ত হয়ে মৃত্যু মুখে পতিত হতে পারে, অথবা অন্য কোন জন্তু-জানোয়ারের খোরাকে পরিণত হয়। তেমনি মানুষ যখন তার নিজের আসল স্থান থেকে ছিটকে পড়ে, তখন সে শয়তানের খেলনার বস্তুতে পরিণত হয়। মানুষের মধ্যে যারা শয়তান রয়েছে, তারা শিকারী পাখির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে তাকে বিভিন্ন দল ও আদর্শের দিকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়। অপরদিকে তার মধ্যে যে কুপ্রবৃত্তি রয়েছে, এই কুপ্রবৃত্তি তাকে বাতাসের গতিতে ভ্রান্ত পথে দ্রুত গতিতে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। এ জন্যই কোরআন মানুষের প্রতি এই দাওয়াত দেয়, দাসত্ব করতে হবে একমাত্র আল্লাহর এবং এ পথেই মানুষের জীবনে স্থিতি আসতে পারে। নিজের গর্দান থেকে দাসত্বের সমস্ত শৃংখল ছিন্ন করে নিজেকে এক আল্লাহর গোলামে পরিণত করার মধ্যেই রয়েছে মানব জীবনে সার্বিক সফলতা। কোরআন সেদিকেই মানুষকে আহ্বান জানায়। আল্লাহর কোরআন বলছে-

وَيَرَى الَّذِينَ أُوتُوا العِلمَ الَّذِي أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِّنْ رَّبِّكَ هُوَ الْحَقِّ يَهْدِي إِلى صِرَاطِ الْعَزِيزِ الْحَمِيدِ

        হে নবী। জ্ঞানবানরা অতি উত্তমভাবে অবগত রয়েছে যে, যা কিছু তোমার রব্ব-এর পক্ষ থেকে তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ সত্য এবং তা পরাক্রমশালী ও প্রশংসিত আল্লাহর পথপ্রদর্শন করে। (সূরা সাবা-৬)

Post a Comment

0 Comments