রাহমান কে ?

 


        পবিত্র কোরআন মজীদে আল্লাহর রাহমান নাম উল্লেখ করে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ যে রাহমান-অসীম দাতা ও দয়ালু, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো এই যে, তিনি মানব জাতিকে সঠিক পথ ও জ্ঞান দান করার লক্ষ্যে নবী-রাসূল প্রেরণ করে তাঁদের মাধ্যমে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন। যেহেতু এই পৃথিবীর প্রতিটি বাঁকে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য অসংখ্য প্রতারক শক্তি বাঁকা পথ রচনা করে মানুষকে ধোকা দেয়ার জন্য প্রতি মুহূর্তে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের সৃষ্ট পথ ও মত মানব গোষ্ঠীকে এক চরম অরাজকতার মধ্যে নিক্ষেপ করে। মানব সভ্যতাকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দেয়। শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের প্লাবন বইয়ে দেয়। পরিশেষে পরকালীন জীবনে এক অবশ্যম্ভাবী নিকৃষ্ট পরিণতির দিকে ঠেলে দেয়। মানবতাকে এই করুণ পরিণতি থেকে হেফাজত করার দায়িত্ব যিনি গ্রহণ করবেন তিনিই হবেন মানবতার সবচেয়ে বড় বন্ধু এবং অসীম দয়ালু। এই কঠিন দায়িত্ব কে পালন করবে? সূরা নাহলের ৯ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَعَلَى اللَّهِ قَصْدُ السَّبِيلِ وَمِنْهَا جَائِرٌ

        পৃথিবীতে অসংখ্য বাঁকা পথের অস্তিত্ব রয়েছে, সুতরাং মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শনের দায়িত্ব আমার। (সূরা আন্ নাহল)

        অন্ধকে পথ প্রদর্শন না করলে সে মারাত্মক বিপদে পতিত হয়। মানব জাতিও ছিল অন্ধ, প্রকৃত সত্য ও শান্তির পথের সন্ধান ছিল তাদের কাছে অজানা। সুতরাং অজানা পথের সন্ধান যিনি দান করেন, তিনি যে কত দয়ালু-তা সহজেই কল্পনা করা যেতে পারে। চরম বিপদের মুহূর্তে এক জন মানুষ যখন আরেকজন মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসে। তখন সাহায্যপ্রাপ্ত ব্যক্তি সাহায্য দানকারীর প্রতি তার হৃদয়ের সবটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মানুষও ছিল চরম বিপদাপন্ন। সঠিক পথ না পেয়ে তারা অন্ধকারে হাতড়ে ফিরছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তাঁর অসীম দয়া প্রদর্শন করলেন-

كَذَالِكَ أَرْسَلْنكَ فِي أُمَّةٍ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهَا أُمَمٌ لِتَعْلُوا عَلَيْهِمُ الَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَهُمْ يَكْفُرُونَ بِالرَّحْمَنِ

        (হে রাসূল!) এভাবে মর্যাদা সহকারে আমি তোমাকে রাসূল নির্বাচিত করে প্রেরণ করেছি এমন এক জনগোষ্ঠীর মধ্যে, যাদের পূর্বে বহুসংখ্যক মানবগোষ্ঠী অতীত হয়ে গিয়েছে, আমি যে পয়গাম তোমার প্রতি অবতীর্ণ করেছি, তা তুমি এই লোকদের কাছে পৌছাতে সক্ষম হও এই অবস্থায় যে, এই লোকগুলো তাদের অতীব দয়াময় আল্লাহর প্রতি অমান্যকারী হয়ে রয়েছে। (সূরা আর রা'দ-৩০)

        সত্য-সঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে মানবতা ভ্রান্তপথ অনুসরণ করছিল। অসংখ্য অরাজকতা তাদেরকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছিল। জুলুম-অত্যাচারে-নিপিড়ীতের ক্রন্দন-রোল আকাশ-বাতাসে এক করুণ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। ঠিক এ অবস্থাতেই আল্লাহ তা'য়ালা রাহমান হিসাবে মানবতার মুক্তির জন্য বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন। তাঁর মাধ্যমে এমন এক কিতাব মানব জাতিকে দান করেছেন, যে কিতাব মানব জাতিকে যাবতীয় অরাজকতা মুক্ত করে উন্নতির সর্বোচ্চ সোপানে পৌঁছে দিয়ে তার পরকালীন জীবনকে সাফল্যমন্ডিত করার একমাত্র মাধ্যম। মহান আল্লাহ যে রাহমান-তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো তিনি মানুষকে কোরআনের জ্ঞান দান করেছেন এবং কলম দান করে তার মাধ্যমে জ্ঞান সংরক্ষণ ও বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারীদের ভেতরে বিতরণ করার ব্যবস্থা করেছেন।

        কোরআন বলছে-

الرَّحْمَنُ - عَلَّمَ القُرآنُ - خَلَقَ الْإِنْسَانَ عَلَمَهُ الْبَيَانَ

        পরম দয়াময় এই কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিক্ষা দিয়েছেন। (সূরা আর রাহমান-১-৪)

        এটাই আল্লাহর সবচেয়ে বড় রহমত যে, তিনি তাঁর বান্দাদেরকে সত্য পথপ্রদর্শনের লক্ষ্যে কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি নিরতিশয় অনুগ্রহশীল ও করুণা-প্রবণ। তাঁর বান্দাগণ অন্ধকারে পথের সন্ধানে ব্যাকুল হয়ে ছোটাছুটি করবে, এটা আল্লাহ সহ্য করতে পারেননি বলেই তিনি কোরআনের জ্ঞানদান করেছেন। তাঁর অসীম-অনুগ্রহ পূর্ণত্বে পরিণত হয়েছে এভাবে যে, তিনি মানব জাতিকে এমন জ্ঞানদান করেছেন, যার ওপর পৃথিবীতে মানুষের সদাচরণ ও ত্রুটিমুক্ত জীবন-যাপন এবং পরকালে মানুষের সামষ্টিক কল্যাণ একান্তভাবে নির্ভরশীল। সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন তিনি, সুতরাং তাঁরই দায়িত্ব হলো নিজের সৃষ্টিকে পথপ্রদর্শন করা। যে পথে চললে তারা নিজেদের সৃষ্টি ও অস্তিত্বের উদ্দেশ্যকে সফল ও পূর্ণ করতে সক্ষম হবে, এ পথপ্রদর্শনের ব্যবস্থা যিনি করেছেন, তিনিই হলেন রাহমান। তাঁর দয়াশীলতার অনিবার্য দাবি ছিল কোরআন অবতীর্ণ করা, তা অবতীর্ণ করে তিনি সে দাবি পূরণ করেছেন। সূরা সাজদায় আল্লাহ বলেন-

تَنْزِيلٌ مِّنَ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ

        এটা পরম দয়ালু ও মেহেরবান আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত জিনিস। (আয়াত নং ২)

        তিনি শুধু সৃষ্টিকর্তাই নন-তিনি রাহমান। একারণে সৃষ্টি করেই তিনি বিরত হননি, সৃষ্টির প্রতি যে দায়িত্ব পালন করতে হবে, সে দায়িত্ব তিনি প্রতি মুহূর্তে পালন করে যাচ্ছেন। সৃষ্টির যা যেখানে যখন প্রয়োজন, তিনি তার ব্যবস্থা করছেন। সৃষ্টিজনিত কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে কোথাও বিশ্রাম গ্রহণ করছেন না। এই সীমা সংখ্যাহীন রাজ্যে তিনি স্বয়ং রাজত্ব করছেন। তিন শুধু স্রষ্টাই নন-সমস্ত কিছুর শাসকও তিনি। আল্লাহর কোরআন বলছে-

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى لَهُ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثرى - وَإِنْ تَجْهَرْ بِالْقَوْلِ فَإِنَّهُ يَعْلَمُ السَّرِّوَاخْفَى اللَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ لَهُ الْأَسْمَاءُ الْحُسْنَى

        তিনি রাহমান-পরম দয়াবান। সৃষ্টিজগতের শাসন কর্তৃত্বের আসনে সমাসীন। যা কিছু পৃথিবীতে ও আকাশে রয়েছে, যা কিছু পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানে রয়েছে এবং যা কিছু ভূগর্ভে রয়েছে সমস্ত কিছুরই মালিক তিনি। তুমি যদি নিজের কথা উচ্চকণ্ঠে বলো, তবে তিনি তো চুপিসারে বলা কথা বরং তার থেকেও গোপনে বলা কথাও জানেন। তিনি আল্লাহ, তিনি ব্যতিত আর কোন ইলাহ নেই, তাঁর জন্য রয়েছে সর্বোত্তম নামসমূহ। (সূরা ত্বা-হা-৫-৮)

        এক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর বিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে নিজেদের খেয়াল-খুশী অনুসারে দেশ ও জাতিকে পারিচালিত করতে থাকে। আল্লাহর কিতাবের অনুসারীগণ তাদেরকে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসারে দেশ ও জাতিকে পরিচালিত করার কথা বললে তারা এদেরকে শত্রু মনে করে এবং এদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এরা অনুভব করে না, দয়াময় আল্লাহ এদের ওপরে যে কোন মুহূর্তে আযাব নাজিল করতে পারেন। আল্লাহ বলেন-

قُلْ مَنْ يُكْلَؤُكُمْ بِالْيْلِ وَالنَّهَارِ مِنَ الرَّحْمَنِ

        হে রাসূল! আপনি ওদেরকে জানিয়ে দিন, কে তোমাদেরকে রাতে ও দিনে দয়াময়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারে? (সূরা আল আম্বিয়া-৪২)

        ইসলাম বিরোধিরা নিজেদেরকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী মনে করে অন্যায় অত্যাচারের তান্ডব চালাতে থাকে। তারা ভুলে যায়, তাদের এসব কর্মকান্ডের জবাব একদিন দিতে হবে। ভুলে যায়, যে কোন সময় আল্লাহ সমস্ত কিছু লন্ডভন্ড করে দিতে সক্ষম। রাতে যখন তারা অবৈধ পন্থায় নির্মিত বিলাস ভবনে দুগ্ধ ফেনিল শয্যায় গভীর সুসুপ্তিতে নিমগ্ন থাকে, ভূমিকম্পের একটি মাত্র কাঁপুনিতেই তাদের সাধের বালাখানা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে স্বযত্নে লালিত দেহটাকে চর্বিত গোস্তের একটি পিন্ডে পরিণত করে দিতে পারে। জাতীয় অর্থ ছিনতাই আর লুটপাট করে মহাকাশ যানে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যখন তারা বিলাস ভ্রমণে আত্মহারা হয়ে ওঠে, সে মুহূর্তে মহাকাশযানটিকে বিকল করে অসংখ্য টুকরায় পরিণত করে আল্লাহ তা সাগরের অতল তলদেশে চিরতরে অদৃশ্য করে দিতে পারেন। তিনি অসীম ক্ষমতাবান, সবকিছুই তাঁর পক্ষে সম্ভব। তিনি যেমন দয়ালু, তেমনি তিনি কঠিনতম শাস্তি দাতাও।

Post a Comment

0 Comments