মানুষের প্রতি রব্ব-এর অনুগ্রহরাজি

         মানুষকে সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ এবং তিনি এই মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশী অবগত রয়েছেন। মানুষ কি চায়, কিসে তার কল্যাণ এবং অকল্যাণ, বিষয়টি মানুষের চেয়ে যিনি মানুষ সৃষ্টি করেছেন-তিনিই বেশী জানেন। মহান রব্ব মানুষের এই প্রয়োজনীয়তা পূরণ করেছেন। মানুষের জীবনের জন্য যা কিছু প্রয়োজনীয় তা তিনি যথাযথভাবে পৌছিয়েছেন। মানব সভ্যতা স্থিতি ও বিকাশ লাভের জন্য যেসব উপাদান অপরিহার্য তার সমস্ত কিছুই রাব্বুল আলামীন লাভ করার ব্যবস্থা করেছেন। আকাশ ও পৃথিবী এবং এর মধ্যে যা কিছুই রয়েছে, তা এমন সব আইন ও বিধানের অনুগত করা হয়েছে যে, এসব থেকে যেন মানুষ কল্যাণ লাভ করতে সক্ষম হয়। তিনি যদি নৌ-যানকে কতকগুলো নিয়ম ও বিধানের অধীন না করতেন, তাহলে মানুষ কখনোই জলপথে ভ্রমণ করার কথা কল্পনাও করতে পারতো না। নদী, সাগর-মহাসাগরকে যদি বিশেষ নিয়মের অধীন না করতেন, তাহলে এসব থেকে মানুষ পানি বের করে এনে তা ব্যবহার করতে পারতো না। আকাশের ঐ বিশাল সূর্য এবং মায়াবী চাঁদকে যদি বিশেষ নিয়মে পরিচালিত না করতেন, তাহলে পৃথিবীতে মানব জীবনের উদাম হতো না, কোনক্রমেই একটি বিকাশমান সভ্যতা বিকশিত হতো না। মহান আল্লাহই হলেন সমস্ত কিছুর একমাত্র রব্ব-তাঁর নিয়ামত গুণে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন-

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ وَسَخَّرَ لَكُمُ الْفُلْكَ لِتَجْرِي فِي البَحْرِ بِأَمْرِهِ - وَسَخَّرَ لَكُمُ الأَنْهَرَ - وَسَخَّرَ لَكُمُ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ دَائِبَيْنِ وَسَخَّرَ لَكُمُ الَّيْلَ وَالنَّهَارَ - وَأَنكُمْ مِّنْ كُلِّ مَا سَأَلْتُمُوهُ وَأَنْ تَعُدُّوا نِعْمَتَ اللَّهِ لَا تُحْصُوهَا -

        আল্লাহ তো তিনিই, যিনি যমীন ও আকাশকে সৃষ্টি করেছেন এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করেছেন। আর তার সাহায্যে তোমাদেরকে রিযিক পৌঁছানোর জন্য নানা ধরনের ফল সৃষ্টি করেছেন, যিনি নৌ-যানকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত ও আয়ত্বাধীন করেছেন, যেন তার আদেশে তা নদী-সমুদ্রে চলাচল করে। আর নদ-নদীগুলোও তোমাদের জন্য বশীভূত করে দিয়েছেন। যিনি সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করে দিয়েছেন, তারা প্রতিনিয়ত চলছে। আর রাত ও দিনকেও তোমাদের জন্য নিয়ন্ত্রিত করেছেন। তিনি তোমাদেরকে সেসব কিছুই দিয়েছেন, যা তোমরা চেয়েছো (তোমাদের স্বভাব ও প্রকৃতির দাবিই এসব)। তোমরা যদি আল্লাহর নিয়ামতসমূহ গুণতে চাও, তাহলে তা গুণতে পারবে না। (ইবরাহীম-৩২-৩৪)

        এমন অসংখ্য সৃষ্টি রয়েছে এই পৃথিবীতে যা মানুষ চোখে দেখতে পায় না। এসব সৃষ্টি মানুষের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে। আকাশ ও পৃথিবীতে বিপুল পরিমাণ জিনিস এমন রয়েছে যা মানুষের কল্যাণ সাধন করে যাচ্ছে, অথচ কোথায় কত সেবক তার সেবা করে যাচ্ছে এবং কি ধরনের সেবা প্রদান করছে সে সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানে না। রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَالْأَنْعَامَ خَلَقَهَا لَكُمْ فِيهَا دِفْءٌ وَمَنَافِعُ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ وَلَكُمْ فِيهَا جَمَلٌ حِينَ تُرِيحُونَ وَحِينَ تَسْرَحُوْنَ وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَّمْ تَكُونُوا بَلغَيْهِ الأَ بِشِقِّ الْأَنْفُسِ إِنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رحيم والخَيْلَ وَالْبِغَالَ وَالحَمِيرَ لِتَرْكَبُوهَا وَزِينَةً وَيَخْلُقُ مَا لا تَعْلَمُونَ

        তিনি পশু সৃষ্টি করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য পোষাক, খাদ্য এবং অন্যান্য নানাবিধ উপকারিতাও। তাদের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য সৌন্দর্য যখন সকালে তোমরা তাদেরকে চারণভূমিতে পাঠাও এবং সন্ধ্যায় তাদেরকে ফিরিয়ে আনো। তারা তোমাদের জন্য বোঝা বহন করে এমন সব স্থানে নিয়ে যায় যেখানে তোমরা কঠোর প্রাণান্ত পরিশ্রম না করে পৌছতে পারো না। আসলে তোমার রব্ব বড়ই স্নেহশীল ও করুণাময়। তোমাদের আরোহণ করার এবং তোমাদের জীবনের শোভা-সৌন্দর্য সৃষ্টির জন্য তিনি ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টি করেছেন। তিনি (তোমাদের কল্যাণার্থে) আরো অনেক জিনিস সৃষ্টি করেছেন, যেগুলো তোমরা জানো না। (সূরা আন্ নাহল-৫-৮)

        মানুষের প্রয়োজনে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পশুদল সৃষ্টি করেছেন। তাদের চামড়া থেকে মানুষ নানা উপকার গ্রহণ করে। পশম দিয়ে কম্বল, পোষাক এবং অন্যান্য জিনিস প্রস্তুত করে। গোস্ত খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে। হাড় দিয়ে ব্যবহার্য সামগ্রী নির্মাণ করে। পশুর নাড়িভূড়িও মাছের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করে। পাহাড়ী এলাকায় বন্ধুর পথে যেখানে কোন যান-বাহন চলে না, সেখানে পশুকে বাহন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গভীর অরণ্যে কাঠের প্রয়োজনে বিশালাকারের গাছ কেটে তা বাইরে বের করে আনার জন্য এখানো হাতীকে ব্যবহার করা হয়। সেখানে কোন যান-বাহন প্রবেশ করতে পারে না। কাটা গাছের সাথে লোহার শিকল বেঁধে তার আরেক প্রান্ত হাতীর দেহে বেঁধে দেয়া হয়। হাতী তা টেনে ঘন জঙ্গলের বাইরে বের করে নিয়ে আসে।

        আল্লাহ তা'য়ালা লোহা সৃষ্টি করেছেন, এই লোহা দিয়ে যমীন কর্ষণ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। লোহা ব্যতিত মানব সভ্যতা সম্পূর্ণ অচল। নানা ধরনের যান-বাহন নির্মাণে, অস্ত্র প্রস্তুতকরণে, দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরীতে লোহা ব্যবহার করা হচ্ছে। আল্লাহ স্বর্ণ দিয়েছেন অল্প পরিমাণে আর লোহা দিয়েছেন বিপুল পরিমাণে। কারণ সোনার ব্যবহার কম আর লোহার ব্যবহার সবচেয়ে বেশী। জলযান নির্মাণ লোহা ব্যতিত সম্ভব নয়। সূরা বনী ইসরাঈলের ৬৬ নং আয়াতে আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

رَبُّكُمُ الَّذِي يُرْجِي لَكُمُ الفُلْكَ فِي الْبَحْرِ لِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْلِهِ إِنَّهُ كَانَ بِكُمْ رَحِيمًا -

        তোমার প্রকৃত রব্ব তো তিনিই যিনি সমুদ্রে তোমাদের নৌযান পরিচালনা করেন যেন তোমরা তাঁর অনুগ্রহ অনুসন্ধান করতে পারো। আসলে তিনি তোমাদের অবস্থার প্রতি বড়ই করুণাশীল। আল্লাহ তা'য়ালা এমন রব্ব-যিনি পশুর ভেতরে তাঁর বান্দাদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য মওজুদ রেখেছেন। সূরা নাহলের ৬৬ ও ৬৭ নং আয়াতে রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَإِنَّ لَكُمْ فِي الْأَنْعَامِ لَعِبْرَةً نُسْقِيكُمْ مِّمَّا فِي بُطُونِهِ مِنْ بَيْنِ قَرْتَ وَدَمَ لَبَنَا خَالِصَل سَائِعًا لِلشَّرِبِينَ وَمِنْ ثَمَرَاتِ النَّخِيلِ وَالْأَعْنَابِ تَتَّخِذُونَ مِنْهُ سَكَرًا وَرِزْقًا حَسَنًا -

        নিশ্চয়ই গবাদিপশুর মধ্যে তোমাদের জন্য শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। তাদের পেট থেকে গোবর ও রক্তের মাঝখানে বিদ্যমান একটি জিনিস আমি তোমাদের পান করাই, নির্ভেজাল দুধ, যা পানকারীদের জন্য বড়ই সুস্বাদু ও তৃপ্তিকর। এভাবে খেজুর গাছ ও আঙ্গুর লতা থেকেও আমি একটি জিনিস তোমাদের পান করাই, যাকে তোমরা মাদকে পরিণত করো এবং পবিত্র খাদ্যেও।

        পশু যে খাদ্য আহার করে তা থেকে একদিকে রক্ত প্রস্তুত হয় এবং অন্যদিকে প্রস্তুত হয় মলমূত্র। কিন্তু এ পশুদের স্ত্রী জাতির ভেতরে আবার এই একই খাদ্য থেকে তৃতীয় আরেকটি জিনিসও প্রস্তুত হয়। বর্ণ, গন্ধ, গুণ-বৈশিষ্ট্য, উপকারিতা ও উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে গোবর আর রক্তের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস। তারপর বিশেষ করে গবাদি পশুর মধ্যে এই দুধের উৎপাদন আল্লাহ এতটা বৃদ্ধি করে দিয়েছেন যে, পশু শাবকের প্রয়োজন পূরণ করার পরও মানুষের জন্যও উৎকৃষ্টতম খাদ্য বিপুল পরিমাণে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। এরপর ফলের রস সম্পর্কে বলা হয়েছে, এ রসের মধ্যে এমন উপাদানও রয়েছে যা মানুষের জন্য জীবনদায়ী খাদ্যে পরিণত হতে পারে, সেই সাথে এমন উপাদানও বিদ্যমান রয়েছে যে, যা পচে যাবার পরে তার মূল গুণ-বৈশিষ্ট্য হারিয়ে মাদকদ্রব্যে পরিণত হয়।

        এখন মানুষ জীবনদায়ী এই রস থেকে পাক-পবিত্র রিযিক গ্রহণ করবে, না বিবেক, বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তি বিনষ্টকারী মাদক গ্রহণ করবে, তা মানুষের নিজের নির্বাচন ক্ষমতার ওপরে নির্ভর করে। মাদকদ্রব্য যে অপবিত্র, এ কথাও উল্লেখিত আয়াতে পরোক্ষ্যে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনি রব্ব-শুকনো খেজুর গাছের ভেতরে তিনি মানুষের জন্য রিযিক রেখেছেন, গবাদি পশু আহার করে ঘাস, শুকনো খড় আর গুল্ম-লতা-পাতা। যিনি রব্ব তিনি এসব থেকে তাঁর বান্দাদের জন্য দুধের ব্যবস্থা করেছেন। এমনভাবে ব্যবস্থা করেছেন যে, গরুর বাচ্চার প্রয়োজনও পূরণ হবে সেই সাথে মানুষেরও প্রয়োজন পূরণ হবে। সূরা মু'মিনুনের ২১ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

وَإِنَّ لَكُمْ فِي الأَنْعَامِ لَعِبْرَةٌ نُسْقِيكُمْ مِمَّا فِي بُطُونِهَا وَلَكُمْ فِيهَا مَنَافِعُ كَثَيْرَةٌ وَمِنْهَا تَأْكُلُونَ

        আর প্রকৃতপক্ষে তোমাদের জন্য গবাদি পশুদের মধ্যেও শিক্ষার বিষয় রয়েছে। তাদের পেটের মধ্যে যা কিছু আছে তা থেকে একটি জিনিস আমি তোমাদের পান করাই এবং তোমাদের জন্য তাদের মধ্যে আরো অনেক উপকারিতাও রয়েছে, তাদেরকে তোমরা খেয়ে থাকো।

        স্ত্রী জাতিয় গবাদি পশুর দেহের অভ্যন্তরে অস্ত্রের বস্তুনিচয় এবং রক্তের সংযোগের ফলে দুগ্ধ উৎপাদন হয় এবং তা মানুষ পান করে। শরীরে সাধারণ পুষ্টির জন্য যে বস্তুটির প্রয়োজন, তা মানুষ বা প্রাণী লাভ করে খাদ্যবস্তু থেকে। ভক্ষিত খাদ্যবস্তু প্রথমে পরিপাকযন্ত্রে পৌঁছায় এবং সেখানে তার রাসায়নিক রূপান্তর ঘটে। সেই রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যে সারবস্তু নির্গত হয়, তা অস্ত্রে প্রবিষ্ট হবার পরে আবার রূপান্তরিত হয়।

        এই রূপান্তরিত বস্তুটি একটি উপযুক্ত সময়ে অস্ত্রের আবরণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসে দেহের সরবরাহ যন্ত্রের দিকে ধাবিত হতে থাকে। রূপান্তরিত সেই রাসায়নিক বস্তুটি প্রত্যক্ষভাবে রসবাহী নালী দিয়ে আর পরোক্ষভাবে মুখবাহী নালী দিয়ে প্রবাহিত হয়। তারপর সেই রূপান্তরিত রাসায়নিক বস্তুটি প্রথমে লিভারে উপনীত হয় এবং সেখান থেকে আবার পরিবর্তিত হয়। এরপর সেই রূপান্তরিত রাসায়নিক বস্তুটি সেখান থেকে বেরিয়ে এসে যুক্ত হয় দেহের সরবরাহ যন্ত্রের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতিতে। আর এ প্রক্রিয়াতেই সর্বশেষ রূপান্তরিত রাসায়নিক বস্তুটি রক্তধারার সাথে মিশ্রিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেহের সর্বত্র। এই অদ্ভুত ও অপূর্ব জটিল ব্যবস্থা যিনি সম্পাদন করেন তিনিই হলেন রব্ব। এটা তাঁরই অনুগ্রহরাজি।

        আধুনিক দেহতত্ত্ববিদগণ বলেছেন, দুধ যেসব উপাদানে প্রস্তুত হয়, সেসব উপাদান নিঃসৃত হয় দেহের মামারী গ্লান্ড নামক দেহস্থিত একটি রসস্রাবী গ্রন্থি থেকে। এই মামারী গ্লান্ড পরিপুষ্টি লাভ করে খাদ্যের সেই সারবস্তু থেকে, যে সারবস্তু বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও রূপান্তরের মাধ্যমে রক্তধারার সহায়তায় মামারী গ্লান্ডে পৌঁছায়। সুতরাং খাদ্যবস্তু থেকে যা কিছুই লাভ করা যায় তা রক্ত এবং একমাত্র রক্তই সেসব কিছুর সংগ্রাহক ও নিয়ামক হিসাবে প্রধান ভূমিকা পালন করে।

        এভাবে এই রক্তই দেহের অন্যান্য যন্ত্রের মতো মামারী গ্লান্ডেরও প্রয়োজনীয় পুষ্টিসাধন করে। এই প্রক্রিয়ায় রক্ত ও অস্ত্রের রাসায়নিক বস্তু সম্মিলিতভাবে মামারী গ্লান্ডে প্রস্তুত করে থাকে দুধ উৎপাদনের উপাদান। যে আল্লাহ অনুগ্রহ করে এসব কিছুর নিপুণ ব্যবস্থা করেছেন, তিনিই হলেন রব্ব অতএব একমাত্র প্রশংসা তাঁরই।

        নদী, সাগর, সমুদ্রে জলযান নিয়ে মানুষ বেরিয়ে পড়ে। সেখানে মানুষের জন্য রিষ্কের ব্যবস্থা আল্লাহ করে রেখেছেন। একশ্রেণীর মানুষ ধারণা করে, এসব জলযান বোধহয় আর্কিমিডিসের সূত্র অনুসারে চলে। পানির ভেতরে যে বস্তু যতটুকু নিমজ্জিত হয়, নিমজ্জিত বস্তু পানির ততটুকু ভর অপসারিত করে এবং এ কারণে তা ভেসে থাকে। পানির মধ্যে আল্লাহ তা'য়ালা যদি নৌযানকে ভাসিয়ে রাখার গুণাগুণ দান না করতেন, কোন সূত্রই তা ভাসিয়ে রাখতে সক্ষম হতো না। সুতরাং বিজ্ঞানী আর্কিমিডিসের কৃপায় সমুদ্রে জাহাজ চলে না, সমস্ত জ্ঞানের ভান্ডার যাঁর হাতে নিবদ্ধ, সেই আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি করুণা করেই জলযানসমূহ চলার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তিনি সমগ্র আকাশ জগতে সীমা-সংখ্যাহীন বিশাল গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জকে যার যার গতি পথে অদৃশ্য স্তম্ভের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করা করেছেন। কোন তারের সাহায্যে তাদের পরস্পরকে সংযুক্ত করে রাখা হয়নি। কোন বিশাল আকারের গজাল বা পেরেকের সাহায্যে তাদের একটির অন্যটির ওপর উল্টে পড়ে যাওয়াকে ঠেকিয়ে রাখা হয়নি। একমাত্র মাধ্যাকর্ষণ শক্তিই এ ব্যবস্থাকে সচল রেখেছে। গোটা সৃষ্টি জগতের রব্ব আল্লাহ বলেন-

خَلق السموات بِغَيْرِ عَمَد تَرَوْنَهَا وَالقَى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَأَنْزَلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَانْبَتْنَا فِيْهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍ كَرِيمٍ 

        তিনি আকাশসমূহ সৃষ্টি করেছেন স্তম্ভ ছাড়াই, যা তোমরা দেখতে পাও। তিনি পৃথিবীতে পাহাড় গেড়ে দিয়েছেন, যেন তা তোমাদেরকে নিয়ে ঢলে না পড়ে। তিনি সবধরনের জীব-জন্তু পৃথিবীতে ছড়িয়ে দিয়েছেন। আমি আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করি এবং জমিতে নানা ধরনের উত্তম জিনিস উৎপন্ন করি। (সূরা লোকমান-১০)

        রাব্বুল আলামীন বলেন, নদী-সাগর ও সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দেখো, পানির দুটো ধারা কিভাবে বয়ে চলেছে। একটি ধারা সুমিষ্ট আরেকটি ধারা লবণাক্ত। এই পানির ভেতরে নানা ধরনের মাছ আমি তোমাদের খাদ্য হিসাবে মওজুদ রেখেছি। তোমাদের সৌন্দর্য বৃদ্ধির উপকরণ নানা ধরনের অলঙ্কার প্রস্তুত করার উপাদান রেখেছি। পবিত্র কোরআন বলছে-

 وَمَا يَسْتَوِي الْبَحْرَانِ - هذا عَذْبٌ فُراتٌ سَائِعٌ شَرَابُهُ وَهَذَا مِلْحٌ أجَاجٌ وَمِنْ كُلِّ تَا كُلُوْنَ لَحْمًا طَرِبًا وَتَسْتَخْرِجُونَ حِبْيَةً تَلْبَسُونَهَا وَتَرَى الفُلْكَ فيه مَوَاخرَ لِتَبْتَغُوا مِنْ فَضْله وَلَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ - يُولِجُ اليْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اليْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ - كُلٌّ يَجْرِي لأَجَلٍ مُّسَمًّى ذَالِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ 

        পানির দুটো উৎস সমান নয়। একটি সুমিষ্ট ও পিপসা নিবারণকারী সুস্বাদু পানীয় এবং অন্যটি ভীষণ লবণাক্ত যা কণ্ঠনালীতে ক্ষত সৃষ্টি করে, কিন্তু উভয়টি থেকে তোমরা সজীব গোস্ত লাভ করে থাকো, পরিধান করার জন্য সৌন্দর্যের সরঞ্জাম বের করো এবং এ পানির মধ্যে তোমরা দেখতে থাকো নৌযান তার বুক চিরে ভেসে চলছে, যাতে তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ সন্ধান করো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। তিনি দিনের মধ্যে রাতকে এবং রাতের মধ্যে দিনকে প্রবেশ করিয়ে নিয়ে আসেন। চন্দ্র ও সূর্যকে তিনি অনুগত করেছেন। এসব কিছু একটি নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। এ আল্লাহই তোমাদের রব, সার্বভৌমত্বও তাঁরই। (সূরা ফাতির)

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এমন রব, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রয়োজন পূরণের জন্য সমস্ত কিছুর ব্যবস্থা করেছেন। লবণাক্ত পানি পান করার অযোগ্য কিন্তু লোনা পানির ভেতর দিয়ে মানুষ যখন জলযানে পথ অতিক্রম করতে থাকে, তখন যদি তার পানির প্রয়োজন হয়, এ জন্য আল্লাহ সাগর-মহাসাগরের ভেতরে অসংখ্য মিষ্টি পানির স্রোতধারা প্রস্তুত করে রেখেছেন। তিনি বলেন-

وَهُوَ الَّذِي مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ هَذَا عَذَبٌ فَرَمَاتٌ وَهَذَا مِلْحٌ أُجَاجٌ وَجَعَلَ بَيْنَهُمَا بَرْزَخَاو حجراً مَحْجُوراً -

        আর তিনিই দুই সাগরকে মিলিত করেছেন। একটি সুস্বাদু ও মিষ্টি এবং অন্যটি লোনা ও খারযুক্ত। আর দু'য়ের মাঝে একটি অন্তরাল রয়েছে, একটি বাধা তাদের এককার হবার পথে প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করে রেখেছে। (সূরা আল ফুরকান-৫৩)

        পৃথিবীর কোন বড় নদী এসে যেখানে সাগরে মিলিত হয়, সেখানেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাছাড়া সমুদ্রের মধ্যেও বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি পানির স্রোত পাওয়া যায়। সমুদ্রের ভীষণ লবণাক্ত পানির মধ্যেও মিষ্টি পানির স্রোত তার নিজের বৈশিষ্ট্য বজায় রাখতে সক্ষম। পারস্য উপসাগরেও মিষ্টি পানির স্রোত রয়েছে। চারদিকে লবণাক্ত পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, আর মাঝখানে গোল বৃত্তের মতো মিষ্টি পানির স্রোত ঘুরছে। একটি লবণাক্ত পানির স্রোত এসে মিষ্টি পানির স্রোতের সাথে মিলিত হয়েছে, কিন্তু সে পানি পরস্পর মিলিত হয়ে আপন বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে না। রাব্বুল আলামীন এমন এক অদৃশ্য প্রহরার ব্যবস্থা সেখানে করেছেন, যেন তারা পরস্পর মিলিত হতে না পারে। সূরা রাহমানের ২০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

مَرَجَ الْبَحْرَيْنِ يَلْتَقِينِ بَيْنَهُمَا بَرْزَخٌ لا يَبْغِينِ .

         দুটো সমুদ্রকে তিনি প্রবাহিত করেছেন, যেন পরস্পরে মিলিত হয়। এরপরেও উভয়ের মাঝে একটি আবরণ আড়াল হয়ে রয়েছে, যা তারা অতিক্রম বা লংঘন করে না।

Post a Comment

0 Comments