তিনিই সৃষ্টিতে ভারসাম্যতা রক্ষা করেছেন

        তিনি রব্ব, কোন কিছুই ভারসাম্যহীন করে সৃষ্টি করেননি। যা সৃষ্টি করেছেন, তার ভেতরে ভারসাম্য রক্ষা করেই সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে মানব সভ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখার জন্য মানব সমাজের নিয়ম-শৃঙ্খলা বজায় রাখার লক্ষ্যে মহান রব্ব এমন নিয়ম করে দিয়েছেন যে, তিনি বিভিন্ন মানব গোষ্ঠীকে একটি নির্দিষ্ট সীমা পর্যন্ত আধিপত্য ও শক্তি সামর্থ লাভের সুযোগ দান করেন। কিন্তু কোন দল যখন সেই সীমা লংঘন করতে শুরু করে, তখন অপর এক মানব গোষ্ঠীকে দিয়ে তার শক্তিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেন। পৃথিবীতে যদি একটি দল ও একটি জাতির স্থায়ী প্রভুত্ব বিস্তারের ব্যবস্থা করা হতো এবং তার স্বৈরাচারী নীতি আর জুলুমমূলক ব্যবস্থা অমর অক্ষয় হয়ে থাকতো, তাহলে গোটা পৃথিবীতে এক চরম দুর্যোগ, ধ্বংস আর বিপর্যয় দেখা দিত। সূরা বাকারার ২৫১ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

ولولا دَفْعُ اللَّهِ النَّاسِ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَفَسَدَتِ الْأَرْضُ وَلَكِنَّ اللَّهَ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِينَ

        আল্লাহ যদি এভাবে মানুষের একটি দলকে অপর একটি দলের মাধ্যমে দমন না করতেন, তবে পৃথিবীর নিয়ম শৃঙ্খলা সব বিনষ্ট হয়ে যেতো। কিন্তু পৃথিবীবাসীদের প্রতি বড়ই করুণাময়।

        এভাবে মহান আল্লাহ সমস্ত কিছুতেই ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবীর বুকে কোন জালিমই স্থায়ীভাবে তার জুলুমের রাজত্ব টিকিয়ে রাখতে পারেনি। দম্ভ, অহঙ্কার স্থায়ী হয়নি। প্রাণীজগতের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেও দেখা যায়, রাব্বুল আলামীন তাদের ভেতরে কি সুন্দর করে ভারসাম্য রক্ষা করছেন।

        সামুদ্রিক কাছিমগুলোর যখন ডিম দেয়ার সময় ঘনিয়ে আসে তখন তারা রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের বেলাভূমিতে উঠে আসে, দিনের আলোয় আসে না। দিনের আলোয় এসে ডিম দিয়ে গেলে তা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর চোখে পড়বে। তার ডিম ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, তারপর পা দিয়ে তারা বালির ভেতরে গর্ত করে। গর্ত করা শেষ হলেই একের পর এক ডিম দিতে থাকে। মুরগী, হাঁস বা অন্যান্য পাখি যে সংখ্যক ডিম দিবে, তা প্রতিদিন একটি করে দিয়ে থাকে। আর কাছিম যে ডিমগুলো দিবে তা একই সময়ে একটির পর একটি করে দিতে থাকে। যতগুলো ডিম দেয়া প্রয়োজন, তা পনের বা বিশ মিনিটের মধ্যে দিয়ে দেয়। তারপর ডিমে পরিপূর্ণ গর্ত পায়ের সাহায্যে বালি দিয়ে ভরে দেয়।

         ডিমের ওপরে বসে তা দিতে হয় না। মাটি বা বালির অভ্যন্তরীণ তাপেই ডিমগুলো নির্দিষ্ট দিন পরে ফোটে। যেখানে মাটি বা বালির ঘনত্ব বেশী সেখানেও তারা ডিম দেয় না। কারণ বাচ্চাগুলো তা দীর্ণ করে পৃথিবীতে আসতে পারবে না। সমুদ্রের পানি থেকে মাত্র দশ অথবা বিশ ফুট দূরে কাছিম এভাবে ডিম দেয়। অনেক দূর থেকে আসতে আসতে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।

        স্থলে কাছিম দ্রুত গতিতে চলতে পারে না। এ জন্য তারা পানির খুব কাছেই ডিম দেয় যেন বাচ্চা বের হয়েই দ্রুত পানির ভেতরে যেতে পারে। সদ্যজাত বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বেরিয়েই পানির দিকে ছুটতে থাকে। ওদের গতি পানির বিপরীত দিকে কখনোই হয়না। এই সাবধানতা অবলম্বন করে ডিমগুলো রক্ষা করতে হবে, পানির কাছাকাছি ডিম দিতে হবে,। বাচ্চাগুলোকে পানির দিকে ছুটতে হবে, কাছিমের ভেতরে যিনি এই চেতনা দান করেছেন, তিনিই হলেন রব্ব।

        কাছিম ডিম দিয়ে চলে যায়, ওদের ডিমের অনুসন্ধানে চলে আসে শিয়াল, বেজি এবং অন্যান্য প্রাণী। এরা সন্ধান পেলেই, ডিমগুলো খেয়ে নেয়। যেগুলোর সন্ধান পায় না সেগুলোর বাচ্চা ফোটে। এই বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বেরিয়ে পানির দিকে যাবার পথে নানা ধরনের প্রাণী এদেরকে খেয়ে ফেলে। পানির ভেতরে বড় বড় মাছ এই বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলে। আল্লাহ তা'য়ালা যদি সমস্ত কাছিমের ডিম হেফাজত করে বাচ্চা ফুটিয়ে বাচ্চাগুলোকে বাঁচতে দিতেন, তাহলে গোটা পৃথিবীই কাছিমে পরিপূর্ণ হয়ে যেতো। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَإِنْ مَنْ شَيْءٍ إِلا عِنْدَ نَا خَزَائِنُهُ وَمَا نُنَزِّ لَهُ إِلَّا بِقَدَرٍ مَّعْلُومٍ

        আমারই কাছে রয়েছে প্রতিটি বস্তুর অফুরন্ত ভান্ডার এবং আমিই তাদের সরবরাহ করি এক পরিজ্ঞাত পরিমাপে। (সূরা আল হিজর-২১)

        কুমিরের ডিমেরও এই একই অবস্থা। কুমির স্থলে ডিম দিয়ে কোন কিছু দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর পাহারা দিতে থাকে। শিয়াল, বেজি এবং অন্যান্য প্রাণী কুমিরকে প্রহরা দিতে দেখেই বুঝে নেয়, ওখানে ওর ডিম আছে। ওরা কুমিরের গতি-বিধির ওপরে নজর রাখে। ডিমের কাছ থেকে একটু দূরে গেলেই ওরা এসে ডিম খেয়ে নেয়। তারপরেও যে বাচ্চাগুলো জন্ম নেয়, সেগুলোকে ধরে মাছসহ অন্যান্য প্রাণী খেয়ে নেয়। সমস্ত কুমির, সাপ, বাঘ, ভাল্লুক ইত্যাদি যত বাচ্চা দেয়, তা যদি বাঁচতে পারতো, তাহলে এই পৃথিবী আর মানুষ বসবাসের উপযোগী থাকতো না। এদের সৃষ্টির ভেতরে রাব্বুল আলামীন ভারসাম্যতা রক্ষা করেছেন। আল্লাহ বলেন-

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى الَّذِي خَلَقَ فَسَوَى

        তোমার মহান শ্রেষ্ঠ রব্ব-এর নামের তস্বীহ করো। যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্যতা স্থাপন করেছেন। (সূরা আ'লা-১-২)

        পৃথিবীর সমস্ত উদ্ভিদেরও এই অবস্থা। আল্লাহ তা'য়ালা কোন একটি উদ্ভিদকেও মাত্রার অতিরিক্ত বিস্তৃতি ঘটতে দেন না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَكُلُّ شَيْءٍ عِنْدَهُ بِمِقْدَارٍ -

        আল্লাহর বিধানে প্রত্যেক বস্তুর জন্য নির্ধারিত রয়েছে একটি পরিমাপ। (সূরা আর রা'দ-৮) বিশেষ বিশেষ ঋতুতে অসংখ্য উদ্ভিদ জন্ম নেয়। আবার এমন ঋতু পৃথিবীতে আগমন করে, কতকগুলো উদ্ভিদ ক্রমশঃ নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে। এভাবে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে তাঁর বান্দাদের বসবাসের অনুকূল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সমস্ত সৃষ্টির ভেতরে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছেন। বান্দাকে তিনিই প্রতিপালন করেন, ধান্দার • কল্যাণে এসব ব্যবস্থা তিনিই করেন। অতএব একমাত্র তাঁরই প্রশংসা ও দাসত্ব করতে হবে।

Post a Comment

0 Comments