হেরা পর্বতের গুহায় রাসূল ধ্যানমগ্ন ছিলেন আর আল্লাহর ফেরেশ্তা এসে তাঁকে এই কোরআন নামক গ্রন্থটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বিদায় গ্রহণ করেছিলেন; রাসূল তা এনে বাড়িতে আরাম শয্যায় শুয়ে কোরআনের মর্ম অনুধাবন করেছেন-বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। পবিত্র কোরআন যে শিক্ষাদর্শ সহকারে অবতীর্ণ হলো, যে পরিবেশে অবতীর্ণ হলো, তা ছিল আল্লাহর এ কিতাবের সম্পূর্ণ বিপরীত। এই বিপরীত স্রোতধারাকে পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যেই এ কিতাব অবতীর্ণ হয়েছে। পৃথিবীতে প্রচলিত ধর্মগ্রন্থের মতো এ কোরআন কোন ধর্মগ্রন্থ নয়। এটা একটি পরিপূর্ণ ভারসাম্যমূলক জীবন ব্যবস্থা-সমাজ পরিবর্তনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। একটি বিপ্লবাত্মক দাওয়াত ও আন্দোলনের গ্রন্থ। চার দেয়ালের মধ্যে বসে এ গ্রন্থ পাঠ করলে এর সঠিক ভাবধারা উপলব্ধি করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। বসে বসে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্র পাঠ করলে রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করা যায় না। রোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে হলে চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুসারে ওষুধ সেবন করতে হবে।
আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের যে সমস্যার সমাধানের জন্য কোরআন অবতীর্ণ করেছেন, সে সমস্যার সাথে মোকাবেলা না করলে কি করে কোরআনের মূলভাবধারা অনুধাবন করা যেতে পারে? অন্যায় অত্যাচারে ভেসে যাওয়া সমাজ, অশান্তির অগ্নি গহ্বরে নিমজ্জিত দেশ ও জাতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে যারা ঘরের নিভৃত কোণে আবদ্ধ রেখে নিজেকে সবচেয়ে 'নির্বিরোধী সত্যাশ্রয়ী শান্তি প্রিয়' হিসাবে প্রমাণ করতে চায়, তাদের পক্ষে কখনোই আল্লাহর কোরআনের যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। একটা বিষয় কোরআন অধ্যয়নকারীর স্পষ্ট স্মরণে রাখতে হবে যে, আল্লাহর রাসূলের চেয়ে বড় পরহেজগার, নির্বিরোধী, সত্যাশ্রয়ী ও শান্তি প্রিয় মানুষ এ পৃথিবীতে অতীতে যেমন ছিল না, বর্তমানেও নেই এবং ভবিষ্যতেও আর আসবে না। তাঁর মতো ব্যক্তিত্বকে আল্লাহর কোরআন কি আরামের শয্যায় অবস্থান করার অনুপ্রেরণা যুগিয়ে ছিল-না রক্তক্ষয়ী উত্তপ্ত ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত করেছিল?
সুতরাং, এ কোরআন বুঝতে হলে এবং এ থেকে পথনির্দেশনা লাভ করতে হলে পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির ভেতরে আসন গেড়ে বসা আল্লাহ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। সমাজ দেহে অনুপ্রবিষ্ট আল্লাহ বিরোধী শক্তি যে ক্যান্সার সৃষ্টি করেছে, তা নিরাময়ের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি আল্লাহর কোরআন অধ্যয়ন করলে তখন আল্লাহর কোরআনের প্রকৃত ভাবধারা অনুধাবন করা সহজ হবে। কোরআন অবতীর্ণ হয়ে আল্লাহর রাসূলকে যে আন্দোলনের পথে অগ্রসর করালো, সেই আন্দোলনের দাওয়াত মানুষের ঘরে ঘরে পৌছে গেল। যারা সর্বপ্রকার দাসত্বের বন্ধন দূরে ছুড়ে ফেলে একমাত্র আল্লাহর দাসত্ব করতে আগ্রহী ছিল, তাঁরা সর্বপ্রথম কোরআনের আন্দোলনে শামিল হলো।
দেশ ও জাতির ওপরে যারা নিজেদের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত রেখে শোষণ যন্ত্রটি সক্রিয় রাখতে আগ্রহী ছিল, তারা চরমভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলো। কোরআনের আন্দোলনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে তারা সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। শুরু হয়ে গেলো কোরআনের সৈনিকদের সাথে শয়তানের সৈনিকদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। আল্লাহর কিতাব যাদেরকে প্রস্তুত করছিল, তাঁদের ওপরে লোমহর্ষক নির্যাতন শুরু হলো, তাঁরা সহায়-সম্পদ হারালেন; অপমানিত লাঞ্ছিত হলেন। তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হলো। কষ্টার্জিত সমস্ত সম্পদ বাতিল করা হলো। কারাবরণ করতে হলো। শাহাদাতের পেয়ালাও হাসি মুখে পান করতে হলো। এভাবে সূচনা থেকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌছতে দীর্ঘ তেইশটি বছর লেগে গেলো। আল্লাহর এই কোরআন দীর্ঘ তেইশটি বছর ইসলামী আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করে তা সফলতার সিংহদ্বারে পৌঁছে দিল
অতএব এই কোরআনকে বুঝতে হলে আল্লাহর রাসূল ও তাঁর সাহাবাগণ যে পথে তাঁদের পবিত্র পদচিহ্ন এঁকেছেন, তাঁরা যে পরিবেশ ও পরিস্থিতির মোকাবেলা করেছেন, সে পথে এগিয়ে যেতে হবে, সেই পরিবেশ ও পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য নিজের সমস্ত কিছু উৎসর্গ করার মন-মানসিকতা নিয়ে অগ্রসর হতে হবে। তাহলে কোরআনের অধ্যয়নকারীর কাছে মনে হবে, বর্তমানে তিনি যে সমস্যার মোকাবিলা করছেন, এ সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে মহান আল্লাহ বোধহয় এই মাত্র কোরআন অবতীর্ণ করেছেন। এ সময়ে কোরআনকে সেই চৌদ্দশত বছর পূর্বে অবতীর্ণ করা কোন কিতাব মনে হবে না, কোরআন যে চির নতুন-এ কথা নতুন করে পাঠকের সামনে প্রতিভাত হবে।
কোথাও যদি আগুন প্রজ্জ্বলিত করা হয় আর সে আগুনের উত্তাপে চারদিকের আবর্জনা নিঃশেষে পুড়ে না যায়, তাহলে বাহ্যিক দিক থেকে তা আগুন মনে হলেও তা আগুন নয়। এ ধরনের দহন ক্ষমতাহীন আগুনের কোন মূল্য নেই। শত সহস্র কণ্ঠে যদি কোরআন তেলাওয়াত করা হয়, আর সে তেলাওয়াতের আঘাতে মানব রচিত মতবাদ মতাদর্শের ধারক-বাহকদের ক্ষমতার মসনদ টল-টলায়মান হয়ে না ওঠে, তাদের ভেতরে কোন প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি না হয়, তখন তো তেলাওয়াতকারীকে এ কথা অনুধাবন করতে হবে, তার কোরআন তেলাওয়াত আর সাহাবীদের কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান। এই পার্থক্য অনুধাবন করতে হলে যে আন্দোলন ও সংগ্রামের ময়দানে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে, সে ময়দানে নামতে হবে। কোরআন অনুধাবন করে কোরআনের আদর্শে নিজেকে প্রস্তুত করে এগিয়ে যেতে থাকলে তার সামনে অবশ্য অবশ্যই মক্কার উত্তপ্ত পরিবেশ এসে উপস্থিত হবে। বদরের ময়দান তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। ওহুদের রক্ত রঞ্জিত ময়দান দৃষ্টির সামনে উদ্ভাসিত হবে। তায়েফের প্রস্তর বর্ষন কিভাবে হচ্ছে তা অবলোকন করা যাবে। হোনাইনের ময়দানে আকাশ আবৃত করে কিভাবে তীর ছুটে আসছে তা দেখা যাবে। মুতার প্রান্তরে কিভাবে রক্তের বন্যা প্রবাহিত হচ্ছে, তা দেখে শরীর শিহরিত হবে।
মানুষের মধ্যে একটি শ্রেণী কোরআন পাঠ করে, কোরআনে বর্ণিত আল্লাহ বিরোধী শক্তির অপতৎপরতার কাহিনী পড়ে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সম্মানিত সাহাবাদের সাথে কি নিষ্ঠুর আচরণ করেছে, সে কাহিনী বিভিন্ন গ্রন্থে পড়ে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু বাস্তব ময়দানে তারা আল্লাহ বিরোধী শক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। আবু জেহেল আর আবু লাহাবের ভূমিকা তাদের চোখে পড়ে না। না পড়ার কারণ হলো, এরা কোরআনকে একটি আন্দোলনের কিতাব হিসাবে পড়ে না। এরা কোরআনের ভেতরে জ্বিন তাড়ানোর আয়াত অনুসন্ধান করে। যুবক-যুবতীদের পরস্পরের মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি করার, হারানো দ্রব্য ফিরে পাবার, মামলায় জয়ী হবার, শত্রুর উৎপাত থেকে নিরাপদ থাকার, পুত্র সন্তান জন্ম দেবার, ব্যবসায়ে বরকত হবার, পরীক্ষায় পাশ করার, বিচারকের দৃষ্টি আকর্ষণ করার, বন্ধ্যা নারীর সন্তান হবার আয়াত অনুসন্ধান করে। আল্লাহর কোরআনকে এরা ঝাড়-ফুঁকের কিতাব হিসাবে পাঠ করে।
কোন ব্যক্তি যদি দেশের এক প্রান্তে অবস্থিত একটি এলাকা থেকে দেশের রাজধানীর দিকে যাওয়ার লক্ষ্যে যন্ত্রযানে আরোহন করে যাত্রা আরম্ভ করে, তাহলে তার সামনে যে মঞ্জিলগুলো আসার কথা, সে মঞ্জিল না এসে তার বিপরীত মঞ্জিল আসতে থাকে, তাহলে যাত্রীকে এ কথা বুঝতে হয়, সে যে যন্ত্রযানে আরোহন করেছে, তা তার কাংখিত স্থানের দিকে, তার গন্তব্য স্থলের দিকে যাচ্ছে না-যাচ্ছে বিপরীত দিকে। এ পথ তাকে দেশের রাজধানীর দিকে নিয়ে যাবে না, নিয়ে যাবে সেখানেই যেখানে সে যেতে ইচ্ছুক নয়। একইভাবে কোরআন নিয়ে কেউ যদি ময়দানে সক্রিয় হতে চায়, তার সামনে একে একে ঐসব মঞ্জিল এসে উপস্থিত হবে, যেসব মঞ্জিল রাসূল ও তাঁর সাহাবাদের সামনে এসেছিল। সে তখন চোখ মেলেই দেখতে পাবে, তাঁর চোখের সামনে শ্বাপদ সঙ্কুল পরিবেশ সৃষ্টি করে রেখেছে আবু জেহেল আর আবু লাহাবের দল। সামনে-পেছনে, ডানে-বামে যেদিকেই সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে, সেদিকেই সে দেখতে পাবে, আবু জেহেল আর আবু লাহাবের দল কিভাবে হুংকার ছাড়ছে। সুতরাং, কোরআনকে তার সঠিক অর্থে অনুধাবন করতে হলে, কোরআন যে আন্দোলন আর সংগ্রামের ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে, সেই ময়দানে নিজের অবস্থান নির্ণয় করে তারপর কোরআন অধ্যয়ন করতে হবে।
0 Comments