প্রথম দিকে যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন, তাদেরকে বলা হয় সাবিকুনাল আওয়ালিন। ইসলাম গ্রহণ করার কারণে তাদেরকে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে, সহায়-সম্পদ হারাতে হয়েছে, আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হয়েছে। এভাবে একের পর এক কঠিন পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাঁদের ঈমানী শক্তি বিকশিত হয়েছিল এবং দৃঢ়তা লাভ করেছিল। পরবর্তীকালে মক্কা বিজয়ের পরে ইসলামের সোনালী দিনে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তাদেরকে কোন ধরনের পরীক্ষা দিতে হয়নি বা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়নি। ফলে যে পরিবেশে ঈমানী শক্তি বিকশিত হয় এবং দৃঢ়তা লাভ করে, সে পরিবেশ তাঁরা পাননি।
এ জন্য যুক্তি সংগত কারণেই সাহাবাদের মধ্যে এ দুটো দলের সম্মান ও মর্যাদা সমপর্যায়ের হয়নি। এরপর আরেকটি দল ছিল ইতিহাসে যাদেরকে তোলাকা বলা হয়েছে। তোলাকা মানে হচ্ছে, মক্কার এমন এক বংশ, যারা শেষ পর্যন্ত নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং ইসলামী আন্দোলনের বিরোধী ছিল। মক্কা বিজয়ের পর আল্লাহর রাসূল তাদেরকে ক্ষমা করেন এবং তারা ইসলাম গ্রহণ করে। হযরত মুআবিয়া, ওয়ালীদ ইবনে ওকবা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু এবং মারওয়ান ইবনুল হাকামও সেই ক্ষমাপ্রাপ্ত বংশের লোক ছিলেন।
বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন এ পৃথিবী থেকে চির বিদায় গ্রহণ করলেন, তারপর থেকেই এই তোলাকাদের মধ্য থেকে এবং আরবের অন্যান্য এলাকার কিছু লোকজন ইসলাম ত্যাগ করে মুরতাদ হয়ে যাচ্ছিলো। এদের এই বিদ্রোহ দমন করার জন্য রাসূলের সাহাবাগণকে যুদ্ধের মুখোমুখী হতে হয়েছিল। এসব যুদ্ধে পবিত্র কোরআনের অসংখ্য হাফিজ শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
বিষয়টি সম্পর্কে বোখারী শরীফে এক হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেন, যে সময়ে ইয়ামামার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে অসংখ্য সাহাবা শাহাদাত বরণ করলেন। তারপর হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি উপস্থিত হয়ে দেখলাম হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুও সেখানে উপস্থিত আছেন। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু আমাকে বললেন, ওমর আমার কাছে এসেছে এবং পরামর্শ দিচ্ছে, ইয়ামামার যুদ্ধে কোরআনের অসংখ্য কারী (যাদের কোরআন মুখস্থ ছিল এবং মানুষকে তা পড়ে শোনাতেন এবং শিক্ষা দিতেন) শহীদ হয়েছেন। আমার আশঙ্কা হচ্ছে, অন্যান্য যুদ্ধেও যদি কোরআনের কারীগণ শাহাদাত বরণ করেন, তাহলে কোরআনের বিরাট অংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। এ জন্য আমার রায় হচ্ছে এই যে, আপনি কোরআনকে একত্রিত (গ্রন্থাকারে) করার নির্দেশ দেন।আল্লাহর কোরআনের অধিক সংখ্যক হাফিজগণ শহীদ হয়ে যাবার পরে হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু চিন্তা করেছিলেন, এভাবে যদি তাঁরা পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করতে থাকেন, তাহলে তো একদিন গোটা কোরআনই বিলুপ্ত হয়ে যাবে এবং অবশিষ্ট যা টিকে থাকবে, তাতেও পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটতে পারে। এ জন্য তিনি শুধু স্মৃতির পাতায় কোরআন সংরক্ষণের একমাত্র ব্যবস্থার সাথে সাথে কাগজের পাতায় তা লিপিবদ্ধ করে গ্রন্থাকারে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। সে লক্ষ্যেই তিনি খলীফাতুর রাসূলের কাছে নিজের মতামত দৃঢ়তার সাথে তুলে ধরেছিলেন।
বোখারী শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত ওমরের কথা শুনে তিনি তাঁকে বলেছিলেন, 'আল্লাহর রাসূল যে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি, সে কাজ আপনি কিভাবে করতে পারেন?'
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বললেন, 'আল্লাহর শপথ! এটা খুবই উত্তম কাজ।' এভাবে তিনি যুক্তি উত্থাপন করতে থাকেন। হযরত আবু বকরের মধ্যে প্রথম দিকে কিছুটা দ্বিধা সংকোচ থাকলেও পরে তিনি এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, 'পরবর্তীতে আল্লাহ তা'য়ালা এ কাজের জন্য আমার হৃদয়কে উন্মুক্ত করে দিলেন। ওমরের মতামতের সাথে আমার অভিমত মিলে গেল।'
হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু-যিনি ছিলেন আল্লাহর রাসূলেরণ ব্যক্তিগত সচিব। তিনি বলেন, 'খলীফাতুর রাসূল আমাকে বললেন, বয়সে তুমি নবীন এবং আল্লাহ তা'য়ালা তোমাকে জ্ঞান ও বিচক্ষণতা দান করেছেন। তুমি রাসূলের ওহী লেখার কাজেও নিয়োজিত ছিলে। তোমার দায়িত্ব হলো, বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা কোরআনের অংশসমূহ একত্র করা।'
হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, আল্লাহর শপথ! তিনি যদি আমাকে পাহাড় তুলে আনার নির্দেশ দিতেন তাহলে এটা আমার কাছে এতটা কঠিন মনে হতো না-যতটা কঠিন মনে হচ্ছে তার এই কাজের নির্দেশ। আমি আবেদন করলাম, আপনি এ কাজ কেমন করে করবেন যা রাসূল করেননি?'
তিনি জবাব দিলেন, 'আল্লাহর শপথ! এটা বড়ই উত্তম কাজ।' হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে এই মহান কাজের দায়িত্ব অর্পণ করা হলো। আল্লাহর রাসূলের ওপর যখন যে ওহী অবতীর্ণ হতো, তা স্বয়ং রাসূলের নির্দেশে লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেসব অংশ জমা করা হলো। সাহাবাদের ভেতরে যার কাছে কোরআনের যে অংশ বা সম্পূর্ণ কোরআন পাওয়া গেল, তাও জমা করা হলো। সে সময় পর্যন্ত কোরআনের হাফিজ যাঁরা ছিলেন, তাদের কাছ থেকে যাবতীয় সাহায্য সহযোগিতা গ্রহণ করা হলো- এভাবে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টার ভিত্তিতে সম্পূর্ণ নিশ্চয়তা, সন্দেহ সংশয়ের সম্ভাবনা মুক্ত হয়ে আল্লাহর কোরআন গ্রন্থাবদ্ধ করার কাজে হাত দেয়া হলো। আল্লাহর কিতাব গ্রন্থাবদ্ধ করার পূর্বে এর প্রতিটি শব্দ সম্পর্কে তাঁদেরই সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলো, যাঁদের সামনে কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল এবং যাঁরা তা কন্ঠস্থ করে রেখেছিলেন ও ওহী লিখতেন।
সময়ের ব্যবধানে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নির্ভুল পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর যখন কোরআনকে লিখিত একটি গ্রন্থের রূপ দেয়া সম্ভব হলো, তখন সেটা খলীফাতুর রাসূল হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর কাছেই রাখা হলো। তাঁর ইন্তেকালের পরে তা রাখার দায়িত্ব পালন করেছিলেন দ্বিতীয় খলীফা স্বয়ং হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। তাঁর শাহাদাতের পরে তাঁরই কন্যা উম্মুল মুমিনীন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার কাছে আমনত রাখা হলো। লোকজনকে এ অনুমতি দেয়া হয়েছিল যে, তাঁরা সে কোরআন দেখে নিজের কাছে রক্ষিত কোরআনের সাথে তা মিলিয়ে নিতে পারে, সেটা নির্ভুল কিনা তা পরীক্ষা করে দেখতে পারে।
আল্লাহর এ কিতাব অবতীর্ণ হয়েছিল মক্কার কুরাইশদের ব্যবহৃত আরবী ভাষায়। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি ভাষার উচ্চারণ গোটা দেশে এক ধরনের নয়। এক একটি এলাকায় তা উচ্চারণগত দিক দিয়ে পৃথক ভঙ্গিতে উচ্চারিত হয়ে থাকে। গোটা আরবের ভাষা আরবী হলেও তা বিভিন্ন ধরনের ভঙ্গীতে উচ্চারিত হয়ে থাকে। আরবের আরবী ভাষায় বিভিন্ন অঞ্চলে তখন যেমন পার্থক্য ছিল বর্তমানেও তেমনি পার্থক্য বিদ্যমান। একই বিষয়বস্তু আরবের এক এলাকায় এক পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়, আবার অন্য এলাকায় তা ভিন্ন পদ্ধতিতে প্রকাশ করা হয়। কিন্তু এই উচ্চারণগত পার্থক্যের কারণে বর্ণিত অর্থের কোন পরিবর্তন ঘটে না। সাত হরফ বলতে হাদীসে এ বিষয়টিকেই বুঝানো হয়েছে। আল্লাহর রাসূল বলেছেন, কোরআন যদিও কোরাইশদের মধ্যে প্রচলিত বাকরীতিতে অবতীর্ণ হয়েছে, কিন্তু আরববাসীদের স্থানীয় উচ্চারণ ভঙ্গী ও বাকরীতিতে তা পাঠ করার অনুমতি দেয়া হয়েছিল।
একজন আরবী ভাষী লোক যখন আল্লাহর এই কিতাব পাঠ করে তখন ভাষার স্থানীয় পার্থক্য বর্তমান থাকার পরও অর্থ ও বিষয়বস্তুর মধ্যে তেমন কোন পরিবর্তন সূচিত হয় না। কোরআনে নিষিদ্ধ বিষয় বৈধ হয়ে যায় আবার বৈধ বিষয় নিষিদ্ধ হয়ে যায় না, আল্লাহর একত্ব তথা তাওহীদের বর্ণনা পরিবর্তিত হয়ে শিরক মিশ্রিত হয় না।
বোখারী ও মুসলিম শরীফে ঘটনাটি বর্ণনা করা হয়েছে-হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, একদিন আমি হিশাম ইবনে হাকীম ইবনে হিযামকে সূরা ফোরকান পাঠ করতে শুনলাম। কিন্তু আমি যেভাবে সূরাটি পাঠ করে থাকি, তার সাথে হিশামের পাঠে গরমিল লক্ষ্য করলাম। তখন আমি তার চাদর ধরে টানতে টানতে আল্লাহর রাসূলের কাছে নিয়ে গিয়ে এ ব্যাপারে অভিযোগ করলাম। রাসূল আমাকে আদেশ করলেন আমি যেন তাকে ছেড়ে দিই, তখন আমি রাসূলের নির্দেশ পালন করলাম। রাসূল তাকে সূরা ফোরকান পাঠ করতে বললেন, আমি যেভাবে তার মুখে পাঠ শুনেছিলাম, রাসূলের সামনেও তিনি সেভাবে পাঠ করলেন। রাসূল শুনে কোন আপত্তি না করে বললেন, কোরআন সাত হরফে অবতীর্ণ করা হয়েছে। সুতরাং যেভাবে পাঠ করা সহজ সেভাবেই পাঠ করো।
এরপর সাহাবাদের সম্মিলিতি প্রচেষ্টায় আল্লাহর ইসলাম আরব সাম্রাজ্যের বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। অসংখ্য অনারব ইসলাম কবুল করে মুসলিম মিল্লাতের অন্তর্ভুক্ত হতে থাকলো। এসব অনারবদের শিক্ষক ছিলেন আরবরাই। এসব শিক্ষকদের আরবী উচ্চারণ ভঙ্গী পৃথক ছিল। তাঁরা যাদেরকে কোরআন শিক্ষা দিচ্ছিলেন, তাঁদের পৃথক উচ্চারণ ভঙ্গীতেই তা শিক্ষা দিচ্ছিলেন। বিষয়টি বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল অনারব মুসলমান ও আরব মুসলমানদের মেলামেশার ফলে আরবী ভাষা অনারবদের দ্বারা প্রভাবান্বিত হচ্ছিলো।
ফলে যে যার মতো আঞ্চলিক উচ্চারণে কোরআন পাঠ করতে থাকলে অনারব নও মুসলিমদের মনে কোরআন সম্পর্কে সংশয় সৃষ্টি হওয়া অসম্ভবের কিছু ছিল না। তারপর এ ধরনের সমস্যাও প্রকট হয়ে দেখা দিতে শুরু করেছিল যে, এক এলাকার সাহাবী নামাজে কোরআন তেলাওয়াত করছেন তাঁর আঞ্চলিক উচ্চারণে, অন্য এলাকার সাহাবী তা শুনে সন্দেহে পড়ে যেতেন। যেমনটি হযরত ওমর, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হযরত উবাই ইবনে কা'ব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুমসহ অনেকের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। আল্লাহর কালাম অপরিচিত উচ্চারণ ও ভঙ্গীতে পাঠ করা নিয়ে সাহাবাদের মধ্যে দলাদলি সৃষ্টি হওয়া ও অসম্ভবের কিছু ছিল না। তারপর এ পার্থক্য অদূর ভবিষ্যতে মৌলিক বিকৃতি সৃষ্টি করতো না, এ নিশ্চয়তা ছিল না।
এ ধরনের নানা আশঙ্কা দেখা দেয়ার ফলে তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু প্রবীন সাহাবা-যাদেরকে সাবিকুনাল আওয়ালীন বলা হয়, তাঁদেরকে নিয়ে বৈঠক করে সবার মতৈক্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, খলীফা তুর রাসূল হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর প্রচেষ্টায় যে কোরআন লিপিবদ্ধ হয়েছে, সেটাই এখন থেকে পঠিত হতে থাকবে। আর অন্য যেসব কোরআন রয়েছে, যা বিভিন্ন উচ্চারণ ভঙ্গীতে পাঠ করা হয়ে থাকে, তা বাতিল বলে গণ্য হবে। অবিলম্বে এই আইন কার্যকর করার ব্যবস্থা করা হলো এবং হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর সংকলিত কোরআন মুসলিম জাহানে প্রচার করা হলো। কোরআন অবতীর্ণ হবার সময় যেভাবে তা সুসংবদ্ধ ও উন্নতমানের ছিল, হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কর্তৃক সংকলিত কোরআন অনুরূপ তাই ছিল।
এ সম্পর্কে বোখারী শরীফে একটি হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আনাস ইবনে আনাস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, হযরত হুযাইফা ইবনে ইয়ামান হযরত উসমানের কাছে এলেন। এটা সেই সময়ের কথা, যখন তিনি সিরিয় বাহিনীসহ আরমেনিয়া বিজয়ে ইরাকী বাহিনীর সাথে আযারবাইজান বিজয়ে অংশগ্রহণ করেছিলেন। লোকদের বিভিন্ন রীতিতে কোরআন পাঠ হযরত হুযাইফাকে উদ্বিগ্ন করে তুললো। তাই তিনি হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! ইহুদী-খৃষ্টানদের মতো আল্লাহর কিতাবে বিভেদ সৃষ্টির পূর্বে আপনি এই জাতিকে রক্ষা করার চিন্তা-ভাবনা করুন।
এরপর হযরত উসমান হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহাকে বলে পাঠালেন, আপনার কাছে যে কোরআন রয়েছে তা আমার কাছে প্রেরণ করুন। আমরা সেটা দেখে কপি করে তা আপনাকে ফেরৎ দেবো। উম্মুল মুমিনীন হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহা পাঠিয়ে দিলেন। তারপর তিনি হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সাঈদ ইবনে আ'স এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস ইবনে হিশাম রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুম-এ চারজনকে এ কাজে নিযুক্ত করলেন। তাঁরা হযরত আবু বকর কর্তৃক সংকলিত কোরআন থেকে আরো কয়েকটি কপি প্রস্তুত করবেন।
এই চারজনের মধ্যে কোরাইশ বংশের হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের, হযরত সাঈদ ও আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুমদেরকে নির্দেশ দিলেন, যদি কখনো কোরাআনের কোন জিনিস নিয়ে তোমাদের সাথে যায়েদের মতানৈক্য হয়, তাহলে তোমরা কোরআনকে কোরাইশদের বাকরীতি অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। কারণ সেই রীতিতেই কোরআন অবতীর্ণ হয়েছে। তাঁরাই তাঁর নির্দেশ অনুসারে দায়িত্ব পালন করলেন। যখন তাঁরা গ্রন্থাকারে কোরআনের সংকলন প্রস্তুত করলেন, তখন হযরত আবু বকর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কর্তৃক সংকলিত কপিটি হযরত হাফসা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহার কাছে ফেরৎ পাঠালেন।
এরপর হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কোরআনের এক একটি সংকলন ইসলামী খেলাফতের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রেরণ করলেন। তিনি সেই সাথে নির্দেশ দিলেন, এই সংকলন ব্যতীত অন্য যতো সংকলন রয়েছে, তা যেন আগুনে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সুতরাং, বর্তমান সময়ে আমরা যে কোরআন দেখছি ও পাঠ করছি, তা হযরত আবু বকর কর্তৃক সংকলিত গ্রন্থের অনুলিপি। হযরত উসমান সেই সংকলনেরই অনুলিপি সরকারীভাবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রেরণ করেছিলেন।
ইতিহাস থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু শুধু যে আল্লাহর কিতাবের বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য গ্রন্থসমূহের সংকলন প্রস্তুত করে মুসলিম সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় স্থানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন তাই নয়, একই সাথে তিনি সে কোরআনের যথার্থ পঠনরীতি মানুষকে শিক্ষা দেয়ার জন্য স্বনামধন্য ক্বারীও প্রতিটি স্থানে নিয়োগ করিয়েছিলেন। মদীনায় এ কাজের দায়িত্ব ছিল হযরত যায়েদ ইবনে সাবিত আনসারী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহুর ওপর। মক্কায় এ কাজের আঞ্জাম দিতেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। সিরিয়ায় নিয়োজিত ছিলেন হযরত মুগীরা ইবনে শিহাব রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু।
কুফায় নিয়োগ লাভ করেছিলেন হযরত আবু আব্দুর রহমান সুলামী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। বসরায় এই মহান দায়িত্ব পালন করতেন হযরত আমের ইবনে আব্দুল কায়েস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু। এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়াও যেখানেই আল্লাহর রাসূলের কাছ থেকে প্রত্যক্ষভাবে অথবা তাঁর বিদায়ের পরে কোরআন পাঠে অভিজ্ঞ ক্বারী সাহাবীদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা কোন সাহাবীর সন্ধান পাওয়া যেত, অগণিত মানুষ তাঁর কাছে গিয়ে আল্লাহর এ কিতাবের প্রতিটি শব্দ সহীহ শুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা শিখে নিতো।
পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই মুসলমান ও অমুসলমানদের কাছে কোরআনের সেই অনুলিপিই বিদ্যমান। পৃথিবীর যে কোন দেশ থেকে কোরআনের একটি কপি সংগ্রহ করে, তা আরেক দেশের কপির সাথে মিলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দুটো কপির সাথে কোন গড়মিল নেই। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানব জাতির কাছে পেশ করেছিলেন; এটাই যে সেই কোরআন, তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এই কোরআনকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য একশ্রেণীর অমুসলিম চিন্তাবিদগণ চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি। তারা যদি কোরআনের ভেতরে একটি অক্ষরেরও গড়মিল খুঁজে পেতো, তাহলে এতদিনে গোটা পৃথিবী জুড়ে তা প্রচার করতো। কোরআনের ওপরে গবেষণা করতে গিয়ে তারা কোন গড়মিল খুঁজে পায়-ই নি, উপরন্তু তারা প্রমাণ পেয়েছে, এ ধরনের কোন গ্রন্থ মানুষের পক্ষে শতকোটি বছর ধরে চেষ্টা-সাধনা করেও রচনা করা সম্ভব নয়।
বিজ্ঞানের আধুনিক যুগে কম্পিউটারের সাহায্যে তারা কোরআনের সত্যতা যাচাই করতে গিয়ে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে কোরআনের সংখ্যাতাত্ত্বিক মাহাত্মের সন্ধান লাভ করে। তারা সন্ধান পেয়েছে, আল্লাহর এই কিতাবে এক বিস্ময়কর সংখ্যাতাত্ত্বিক জটিল জাল বিছানো রয়েছে, যা অতি অদ্ভূত, অভিনব এবং বিস্ময়কর। সেই সংখ্যাটি হলো ১৯ সংখ্যার সুদৃঢ় সাম স্য। চূড়ান্ত বিশুদ্ধতায় এ কিতাব আল্লাহর বাণী এবং নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। সারা পৃথিবীর মানুষ যদি সম্মিলিতভাবে পৃথিবীর গোটা বয়সব্যাপী নিরবচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা-সাধনা করে যেত কোরআনের মতো একটি গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে, তবুও তা অনন্তকাল ধরে থেকে যেতো সাম্ভাব্যতার সীমানা থেকে শতকোটি যোজন যোজন দূরে।
এ কিতাবে যে নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুসরণ করা হয়েছে, সংখ্যাতাত্ত্বিক দিক দিয়ে যে ১৯ সংখ্যার চরম এক জটিল জালকে যেভাবে জুড়ে দেয়া হয়েছে, তেমনি সমান সংখ্যক শব্দে, সমান সংখ্যক বাক্যসংখ্যায়, সমান সংখ্যক অক্ষরে এ কোরআনের মতো একটি গ্রন্থ রচনার জন্য প্রয়োজন হতো ৬২৬, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০, ০০০ বছর। অর্থাৎ ৬২৬ সংখ্যার সাথে ২৪ টি শূণ্য জুড়ে দিলে যে সংখ্যা হতে পারে। এরপরও বলা হয়েছে, কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের কিতাব রচনা করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কেননা, পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে একত্রিত হয়ে একযোগে চেষ্টা করতে হবে, সেই সাথে প্রতিটি মানুষকে হায়াত লাভ করতে হবে শতকোটি বছরের ওপরে। সুতরাং আমাদের সামনে যে কোরআন বর্তমান রয়েছে, তা যে আল্লাহর বাণী এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে যেভাবে অবতীর্ণ করা হয়েছিল, আল্লাহর নির্দেশে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে কোরআনের বিন্যাস করেছিলেন এবং গ্রন্থাবদ্ধ করার সময় তাতে যে কোন পরিবর্তন-পরিবর্ধন ঘটেনি, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
0 Comments