কোরআন সম্পর্কে যাঁরাই চিন্তা-গবেষণা করেন, কোরআন বুঝে পাঠ করতে আগ্রহী, তাদের মনে একটি প্রশ্ন বার বার উঁকি দেয়, পবিত্র কোরআনে সূরা ফাতিহার ওপরে আরেকটি আয়াত রয়েছে, সে আয়াতটি হলো-
بِسْمِ اللهِ الرَّحْمَنِ الرَّحِيمِ
পরম করুণাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি। (সূরা আন্ নাম্স-৩০)
সূরা আন্ না বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহিম-আয়াতটি উল্লেখ রয়েছে এভাবে যে, হযরত সুলাইমান আলাহিস্ সালাম সাবার রাণীর কাছে ইসলাম গ্রহণ করার দাওয়াত দিয়ে যে পত্র হুদহুদ পাখির মাধ্যমে প্রেরণ করেছিলেন, সে পত্র তিনি শুরু করেছিলেন বিস্মিল্লাহ দিয়ে। সুতরাং এটা কোরআনের আয়াত এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু সূরা ফাতিহার ওপরে এটা স্থান লাভ করেছে, এ জন্য এটা সূরা ফাতিহার অন্তর্ভুক্ত একটি আয়াত কিনা, এটাই প্রশ্ন। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে দেখা যায়, কোন কোন সাহাবী বিস্মিল্লাহকে সূরা ফাতিহার একটি অংশ বলে ধারণা করতেন।
সাহাবাদের পরবর্তী যুগের ইমামগণের মধ্যে ইমাম শাফেয়ী (রাহঃ) ও বিস্মিল্লাহকে সূরা ফাতিহার অংশ বলে ধারণা করতেন। ইমাম আলুসী (রাহঃ) তাঁর তাফসীরের মধ্যে এ সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের দশটি মতামত উল্লেখ করেছেন। ইমাম রাযী (রাহঃ) তাঁর রচিত তাফসীরের মধ্যে বিসমিল্লাহকে সূরা ফাতিহার অংশ হিসাবে প্রমাণ করতে গিয়ে মোট ষোলটি যুক্তির অবতারণা করেছেন।
পক্ষান্তরে ইমাম আলুসী (রাহঃ) বিস্মিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ-এর পক্ষের সমস্ত যুক্তি খন্ডন করে বহু দলীলের ওপর ভিত্তি করে এ কথা প্রমাণ করেছেন যে, এটা সূরা ফাতিহার অংশ নয়। তিনি মতামত পেশ করেছেন যে, বিস্মিল্লাহ একটি স্বতন্ত্র আয়াত এবং তা কোরআনেরই আয়াত। এটা সূরা ফাতিহার কোন অংশ নয়। মহান আল্লাহর কিতাব পবিত্র কোরআনের সূরা আন্ নামের ৩০ নম্বর আয়াত হলো বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। অধিকাংশ সাহাবায়ে কেরামের মতামত হলো, এটা সূরা ফাতিহার অন্তর্গত কোন আয়াত নয়। মহান আল্লাহর আদেশে কোরআনের প্রতিটি সূরার ওপরে বিস্মিল্লাহ সংযোজন করা হয়েছে কিন্তু ব্যতিক্রম হলো সূরা আত্ তাওবা।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোরআনের ১১৪ টি সূরার মধ্যে ১১৩ টি সূরার ওপরে বিস্মিল্লাহ রয়েছে, একটি সূরার ওপরে নেই। কিন্তু কোন মানুষ যদি গোটা ত্রিশপারা কোরআন পাঠ করতে চায়, তাহলে তাঁকে বিস্মিল্লাহ ১১৪ বারই পাঠ করতে হবে। কারণ সূরা তাওবার ওপর বিস্মিল্লাহ সংযোজন করা না হলেও সূরা আন্ নামের ৩০ নম্বর আয়াত পাঠ করার কারণে পাঠকের ১১৪ বারই বিস্মিল্লাহ পাঠ করা হয়ে যায়।
এই বিস্মিল্লাহ আল্লাহ তা'য়ালা যে ভাষায় অবতীর্ণ করেছেন এবং রাসূল তা যেভাবে পাঠ করেছেন, এর বিপরীত পাঠ করা যাবে না। বোঝার জন্য যে কোন ভাষায় অনুবাদ করা যেতে পারে। কিন্তু তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে আরবী ভাষাতেই তেলাওয়াত করতে হবে। 'বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম' না বলে 'পরম করুণাময়ের নামে শুরু করছি' এভাবে যারা এটাকে পাঠ করতে আগ্রহী, তারা অজ্ঞতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। ইসলামী শরিয়ত আল্লাহর কালাম অনুবাদের মাধ্যমে তেলাওয়াত করার অনুমতি দেয়নি।
আল্লাহর রাসূল বলেছেন, কোরআনের একটি অক্ষর উচ্চারণ করলে মানুষের আমল নামায় দশটি করে সওয়াব লেখা হবে। আরবী ভাষায় তেলাওয়াত না করে অন্য ভাষায় পাঠ করলে সওয়াব পাওয়া যাবে না এবং তা ক্রমশঃ বিকৃতির পথ খুলে দেবে। গবেষকগণ বলেন, ত্রিশপারা কোরআনের ভেতরে যা রয়েছে, সূরা ফাতিহার মধ্যে তাই আছে। আবার সূরা ফাতিহার মধ্যে যা আছে, শুধুমাত্র বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম-এর মধ্যে তাই রয়েছে। সুতরাং, এ ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ আয়াতকে যারা জেনে বুঝে বিকৃত করবে, তারা অবশ্যই আল্লাহদ্রোহীদের দলে শামিল হয়ে যাবে।
হেরা পর্বতের গুহায় যখন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপরে প্রথম ওহী অবতীর্ণ করা হয়, তার ধরন ছিল এমন-
اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ
পড়ুন আপনার রব্ব-এর নাম সহকারে যিনি সৃষ্টি করেছেন। (সূরা আলাক)
মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে রব্ব-এর নাম উচ্চারণ করে তাঁর রাসূলকে পড়তে আদেশ দেয়া হলো। রব্ব-এর নাম বলতে পরবর্তীতে আল্লাহর পক্ষ থেকে এসে গেল বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রাথমিক আদেশানুসারে তাঁর কোরআনের প্রতিটি সূরার শিরোভাগে একে স্থান দিয়ে একে কোরআনের সাথে মিলিয়ে বারবার পাঠ করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই বিস্মিল্লাহ একটি অত্যন্ত বরকত ও ফযিলতপূর্ণ আয়াত। মুসলমান যখনই কোন কাজ শুরু করবে, তাকে বিস্মিল্লাহ বলতে আদেশ করা হয়েছে। বিস্মিল্লাহর বলে যে কাজ শুরু করা হবে, মহান আল্লাহ তাতে বরকত দান করে থাকেন। বিস্মিল্লাহ বলার কারণে শয়তান বঞ্চিত হয়।
মুসলিম শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যখন কোন মানুষ তার ঘরে প্রবেশের সময় আল্লাহ তা'য়ালার নাম স্মরণ করে এবং আহার গ্রহণের পূর্বে আল্লাহর নাম নেয়, তখন শয়তান তার সাথীদের বলে, তোমাদের জন্য এই ঘরে রাত অতিবাহিত করার কোন অবকাশ নেই এবং কোন খাদ্য নেই। আর যখন কোন মানুষ আল্লাহর নাম না নিয়েই ঘরে প্রবেশ করে, তখন শয়তান তার সাথীদের বলে, এখন এ ঘরে তোমাদের রাত অতিবাহিত করার ব্যবস্থা হয়ে গেল। তারপর সে ব্যক্তি যখন আহার গ্রহণের পূর্বে আল্লাহর নাম স্মরণ করলো না, তখন শয়তান বলে, তোমাদের রাত কাটানোর ও আহার গ্রহণের ব্যবস্থা এ ঘরে হয়ে গেল।
যে কাজের শুরুতে বিস্মিল্লাহ বলা হয় না, আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয় না, সে কাজে শয়তান অংশগ্রহণ করে এবং তার ভেতরে কোন বরকত থাকে না। মুসলিম শরীফে আরেকটি হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে, হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আমরা কখনো একত্রে আহার করতে বসলে তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত আহার শুরু না করতেন, ততক্ষণ আমরা খাদ্যে হাত দিতাম না। একদিন আমরা তাঁর সাথে আহার করতে উপস্থিত হলাম। এমন সময় একটি ছোট্ট মেয়ে এসে এমনভাবে খাদ্যের ওপর ঝুঁকে পড়লো যেন সে ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর। সে খাদ্যের দিকে হাত অগ্রসর করতেই আল্লাহর রাসূল তার হাত ধরে ফেললেন।
তারপর একজন বেদুঈন এসে খাদ্যের ওপর ঝুঁকে পড়তেই আল্লাহর রাসূল তার হাতও ধরে ফেললেন। তারপর তিনি বললেন, যে খাদ্যে আল্লাহর নাম নেয়া হয় না, শয়তান এসে তা নিজের জন্য হালাল করে নেয়। শয়তান এ মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল এর মাধ্যমে তার নিজের জন্য খাদ্য হালাল করার জন্য। আমি তার হাত ধরে ফেললাম। তারপর শয়তান এই বেদুঈনকে নিয়ে এলো তার মাধ্যমে নিজের জন্য খাদ্য হালাল করার জন্য। আমি তারও হাত ধরে ফেললাম। যে আল্লাহর হাতে আমার প্রাণ, তাঁর শপথ! এ দু'জনের হাতের সাথে শয়তানের হাতও আমার হাতের মধ্যে মুষ্ঠিবদ্ধ রয়েছে। তারপর তিনি আল্লাহর নাম নিলেন অর্থাৎ বিস্মিল্লাহ বললেন এবং আহার শুরু করলেন।
আল্লাহর নাম অর্থাৎ বিসমিল্লাহ উচ্চারণ করার সাথে সাথে শয়তান বিপদাপন্ন হয়ে পড়ে। হাদীস শরীফে একটি ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে, হযরত উমাইয়্যা ইবনে মাখশী সাহাবী রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন-আল্লাহর রাসূল বসেছিলেন। একজন লোক আল্লাহর নাম উচ্চারণ না করেই খাদ্য গ্রহণ করছিল। খাদ্যের শেষ লোকমা মুখে উঠানোর সময় সে বললো, বিস্মিল্লাহি আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু অর্থাৎ আল্লাহর নাম স্মরণ করছি আমি আহার করার শুরু ও শেষভাগে। তার কথা শুনে আল্লাহর রাসূল হেসে উঠলেন। তিনি বললেন, শয়তান তার সাথে আহার করছিল। লোকটি আল্লাহর নাম স্মরণ করা মাত্রই যা কিছু শয়তানের পেটে ছিল, তা সব সে উদগিরণ করে দিল। (আবু দাউদ, নাসাঈ)
বিস্মিল্লাহর বরকত অত্যন্ত বেশী। এটা উচ্চারণ করার সাথে সাথে আল্লাহর পক্ষ থেকে বরকত অবতীর্ণ হতে থাকে। আল্লাহর রাসূল তাঁর ছয়জন সাহাবীকে সাথে নিয়ে আহার করছিলেন। এ সময় একজন বেদুঈন এসে দুই লোকমাতেই সমস্ত খাদ্য শেষ করে দিল। রাসূল বললেন, লোকটি যদি আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে আহার গ্রহণ শুরু করতো, তাহলে এ খাদ্য সবার জন্য যথেষ্ট হতো। (তিরমিযী)
আল্লাহর নামের যে কত বরকত, এর ভেতরে যে কতটা কল্যাণ নিহিত রয়েছে, তা কল্পনাও করা যাবে না। যে ছাগল কোনদিন বাচ্চা দেয়নি অথবা তার বাচ্চা দেয়ার বয়স হয়নি। আল্লাহর রাসূল বিস্মিল্লাহ বলে সে ছাগলের ওলানে হাত দেয়া মাত্র তা দুধে পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। খন্দকের যুদ্ধে পরীখা খনন করার সময় হযরত জাবির রাদিয়াল্লাহ তা'য়ালা আনহু তাঁর সাধ্যানুযায়ী শুধুমাত্র আল্লাহর রাসূলের জন্য আহারের ব্যবস্থা করে তাঁকে অনুচ্চ কণ্ঠে দাওয়াত দিয়েছিলেন। রাসূল উপস্থিত সমস্ত সাহাবাদের সাথে নিয়ে হযরত জাবিরের বাড়িতে গেলেন। হযরত জাবির অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়লেন। রাসূল তাঁকে বললেন, তুমি খাদ্যপাত্র আমার সামনে নিয়ে এসো। তা নিয়ে আসা হলো এবং তিনি বিস্মিল্লাহ বলে তা বিতরণ করতে থাকলেন। মাত্র এক দু'জনের খাদ্য কয়েক শত সাহাবী তৃপ্তির সাথে আহার করার পরও অবশিষ্ট রয়ে গেল।
0 Comments