স্বয়ং আল্লাহই রাহমান এবং তাঁর অসীম করুণার কারণেই তোমরা জীবত আছো-এ কথা মানুষকে জানিয়ে দেয়া হলো। রাতের মধ্যে কি কল্যাণ নিহিত রয়েছে এবং মানুষের জন্য তার প্রয়োজনীয়তা বুঝিয়ে দেয়া হলো। দিনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জ্ঞানদান করা হলো। ঊর্ধ্বজগৎ থেকে যে ক্ষতিকর রশ্মি ধেয়ে আসে, তা প্রতিরোধ করার জন্য আকাশে বুরুজ নির্মাণ করা হয়েছে, এ সম্পর্কে বলা হলো। চন্দ্র ও সূর্যের প্রয়োজনীয়তা ও তার উপকারিতা সম্পর্কে বর্ণনা করু হলো। এ কথা বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, তিনিই রাহমান-যিনি অসীম দয়া করে তোমাদের জন্য এসব কিছুর ব্যবস্থা করেছেন, সুতরাং তাঁরই দাসত্ব করো। যারা এ কথাগুলো বুঝে তাঁর দাসত্ব কবুল করেছে, তাদের পরিচিতিসহ গুণ-বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হলো-
وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا -
রাহমানের বান্দাহ তারাই যারা পৃথিবীর বুকে নম্রভাবে চলাফেরা করে। (সূরা ফুরকান-৬৩)
রাহমানের অসীম দয়া-করুণা দেখে যারা এ কথা অনুধাবন করতে সমর্থ হয়েছে যে, প্রশংসা ও দাসত্ব একমাত্র তাঁরই করা উচিত, যাঁর করুণাধারায় টিকে আছে এ সৃষ্টিজগৎ। এ কথা অনুধাবন করার পরে তারা নিজেদের সমস্ত কিছুই ঐ রাহমানের কাছেই নিবেদন করেছে, যিনি সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। এই রাহমানের ওপরে ঈমান এনে যারা তাঁর গোলাম হয়েছে, তাদের ভেতরে অহঙ্কারের কোন অস্তিত্ব থাকে না। যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপরে ঈমান আনে, সে ব্যক্তি হয় বিনয়ী। রাহমানের গোলাম ঈমানদার হয় বিনম্র। তাঁর ব্যবহারে কখনও দাম্ভিকতা প্রকাশ পায় না। কথায় এবং আচরণে অহংকারের ছোঁয়া থাকে না। মন-মানসিকতায় স্বৈরাচারী চিন্তাধারার উদ্রেক হয় না।
করুণাময়ের গোলাম ঈমানদার ব্যক্তি যদি ধনাঢ্য হয়, বিশাল বিত্ত বৈভবের অধিকারী হয় তবুও তাঁর ভেতরে অহংকারের চিহ্নমাত্র থাকে না। কারণ ঈমানদার ব্যক্তি জানে যে, তাঁর এই সম্পদ অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। রাহমান দয়া করে দান করেছেন আবার যে কোন মুহূর্তে তিনি তাঁর কাছ থেকে এ সম্পদ-ঐশ্বর্য ছিনিয়ে নিতে পারেন। আজ তিনি দেশের ধনীদের কাতারের একজন আছেন, দেশে-বিদেশে তাকে বিশিষ্ট নাগরিকের সম্মান-মর্যাদা দান করা হচ্ছে, রাহমান ইচ্ছে করলেই মুহূর্ত কাল পরেই তাকে কপর্দক শূন্য করে দেশের ভিখারীদের কাতারে দাঁড় করিয়ে দিতে সক্ষম।
রাহমানের গোলামদের চলাফেরা হয় একজন ভদ্র, মার্জিত ও সৎস্বভাব সম্পন্ন ব্যক্তির মতো। নম্রভাবে চলার অর্থ দুর্বল ও রোগীর মতো চলা নয় এবং একজন প্রদর্শন অভিলাষী নিজের বিনয় প্রদর্শন করার বা নিজের আল্লাহ ভীতি প্রদর্শনের জন্য যে ধরনের কৃত্রিম চলার ভঙ্গী সৃষ্টি করে সে ধরনের চলাও নয়। আল্লাহর রাসুল নিজে পথ চলার সময় এমন দৃঢ়ভাবে কদম নিক্ষেপ করতেন যেন মনে হতো তিনি কোন উঁচু স্থান থেকে নিচের দিকে নেমে আসছেন। একদিন এক যুবককে হযরত রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু দুর্বলভাবে হেঁটে যেতে দেখে ডাক দিয়ে জানতে চাইলেন, সে অসুস্থ কিনা। যুবক নেতিবাচক জবাব দিলে তিনি হাতের ছড়ি উঠিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, শক্ত হয়ে সবল মানুষের মতো হাঁটো।
সুতরাং নম্রভাবে চলার অর্থ হলো একজন ভালো মানুষের মতো স্বাভাবিকভাবে চলা। কৃত্রিম বিনয়ের সাহায্যে যে চলার ধরণ সৃষ্টি করা হয় অথবা যে চলার মধ্য দিয়ে বানোয়াট দীনতা ও দুর্বলতার প্রকাশ ঘটানো হয়, তাকে নম্রভাবে চলা বলা যেতে পারে না। একটি কথা স্মরণে রাখতে হবে যে, মানুষের চলা শুধুমাত্র তার হাঁটার একটি ভঙ্গীর নাম নয়। হাঁটা-চলা হলো মানুষের মন-মানস, চরিত্র ও নৈতিক কর্মকান্ডের প্রত্যক্ষ ফতিফলন। একজন আল্লাহভীরু আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তির হাঁটা-চলা, আর একজন চরিত্রহীন, জালিম, স্বৈরাচার, আত্মম্ভরী অহঙ্কারী ব্যক্তির হাঁটা-চলা অথবা একজন চরম গরীব মানুষের হাঁটা-চলা দেখলে অনুমান করা যায় যে, তাদের মধ্যে কোন ধরনের ব্যক্তিত্ব সক্রিয় রয়েছে। সুতরাং যারা রাহমানের গোলাম-আল্লাহর বান্দাহ তাদের চলাফেরার মধ্য দিয়েই তাদের পরিচিতি প্রকাশ পায়।
আল্লাহর গোলাম জানে, মৃত্যু যদি এই মুহূর্তে তার দিকে হীম শীতল থাবা বিস্তার করে, তাহলে তার এই বিশাল সম্পদ মূহূর্তে অন্যের মালিকানায় চলে যাবে। এসব সম্পদ তাঁর কোন কাজেই আসবে না। তাঁর কাছে যে ধন-সম্পদ রয়েছে, এসব আল্লাহ রব্বুল আলামীনের কাছে কিছুই নয়। কারণ তাঁর সম্পদ হারিয়ে যেতে পারে, ছিনতাই হতে পারে, খরচ করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আল্লাহর কাছে যে সম্পদ রয়েছে, তা কখনও হারাবে না, ছিনতাই হবে না, বিনষ্ট হবে না, তিনি দান করেন, কিন্তু ফুরিয়ে যায় না। অসীম দয়ালু রাহমান বলেন-
وَاللَّهُ الْغَنِيُّ وَأَنْتُمُ الْفُقَرَا -
আল্লাহ অভাবমুক্ত, তিনি সম্পদশালী এবং তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন আর তোমরা সবাই মুখাপেক্ষী, অভাবী। (আল কোরআন)
আল্লাহ তা'য়ালা কারো মুখাপেক্ষী নন এবং তাঁর ভান্ডার কখনও শূন্য হয় না। তাঁর সম্পদের ভান্ডার প্রতি মুহূর্ত পরিপূর্ণ। গোটা পৃথিবীবাসীকে তিনি এক মুহূর্তে অতুলনীয় সম্পদের অধিকারী বানিয়ে দিতে সক্ষম। ঈমানদার তাঁর আশ্রয়স্থল মহান আল্লাহ সম্পর্কে এই বিশ্বাস রাখেন, এ কারণে অহংকারের পরিবর্তে তাঁর গোটা দেহ বিনম্রতার বর্মে আবৃত থাকে। তাঁর কথামালায় নম্রতার দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতে থাকে। সম্পদের অহংকার সে করে না। ঈমানদারের চেতনা এ ব্যাপারে শানিত থাকে যে, আল্লাহ যদি এই মুহূর্তে তাঁর দেহে এমন কোন রোগ প্রবেশের নির্দেশ দেন, যে রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে তার অর্জিত ধন-সম্পদের এই বিশাল স্তূপ ক্রমশঃ নিঃশেষ হয়ে যাবে, তবুও তিনি রোগ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি লাভ করবেন না। আল্লাহর নির্দেশে তার মস্তিষ্কের একটি নার্ভ যদি একটির সাথে আরেকটি অর্থাৎ পরস্পরে জড়িয়ে যায়, তাহলে মুহূর্তে তার স্বাভাবিক চেতনা লোপ পাবে, ঘনিষ্ঠ মহল, পরিচিত মহলের কাছে তিনি উন্মাদ নামে আখ্যায়িত হবেন। ভোগ-বিলাসের উপকরণে সজ্জিত বিশাল বালাখানা থেকে তাকে বের করে পাগলা গারদে প্রেরণ করা হবে।
সুতরাং অহংকার শোভনীয় নয়। অহংকার একমাত্র আল্লাহর জন্য। মুমিন ব্যক্তির কথা বলার মধ্যেও নম্রতা প্রকাশ পায়। কথা বলার সময় সে তার প্রতিপক্ষের প্রতি কোন ধরনের অবজ্ঞা প্রকাশ করে না। কারণ তাঁর স্মরণে থাকে যে, তাঁর দয়াময় আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দান করেছেন-
وَلَا تُصَعِّرْ خَدَّكَ لِلنَّاسِ
মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কথা বলো না। (সূরা লোকমান-১৮)
ঈমানদার ব্যক্তির চাল-চলন হয় বিনম্রতার মাধুর্য মন্ডিত। সে অহংকারের পদভারে পাহাড়কে ধ্বসিয়ে দিতে পারবে না। কারণ সে তাঁর মালিক আল্লাহ তা'য়ালার নির্দেশ জেনেছে-
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّ اللَّهَ لَا يُحِبُّ كُلِّ مُخْتَالٍ فَخُورٍ
জমীনের ওপরে অহংকারের সাথে চলাফেরা করবে না। আল্লাহ কোন অহংকারী, দাম্ভিক মানুষকে পছন্দ করেন না। (সূরা লোকমান-১৮)
যাঁর দয়া আর দানের কোন শেষ নেই, সেই রাহমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরো বলেন-
وَلَا تَمْشِ فِي الْأَرْضِ مَرَحًا إِنَّكَ لَنْ تَخْرَنَا الْأَرْضِ وَلَنْ تَبْلُغَ الجبال تولا -
খবরদার! আমার জমীনের ওপরে অহংকারের পদভারে চলাফেরা করো না। তুমি এই জমীনকে পদাঘাতে ধ্বসিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখো না। তুমি ঐ পাহাড়ের সুউচ্চ চূড়াকেও ছাড়িয়ে যেতে পারো না।
অর্থাৎ অহঙ্কারের সাথে বুক উঁচু করে চলাফেরা করো না। তোমার চলাফেরার মাধ্যমে যেন গর্বিত স্বৈরাচারী ও বিপর্যয় সৃষ্টিকারীর চিহ্ন প্রকাশিত না হয়। আচার-আচরণের মাধ্যমে তোমার ক্ষণস্থায়ী ভঙ্গুর শক্তি প্রদর্শন করো না। যে ব্যক্তি রাহমানকে চিনেছে এবং তাঁর সত্ত্বার প্রতি ঈমান এনে মুমীনে পরিণত হয়, সে তাঁর চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করে। কর্কশ কন্ঠে চিৎকার করে সে কথা বলে না। কারণ তাঁর চেতানায় একথা জাগ্রত থাকে যে-
وَاقْصِدْ فِي مَشْيِكَ وَاغْضُضْ مِنْ صَوْتِكَ إِنَّ أَنْكَرَا الأَصْوَاتِ لَصَوْتُ الحَمِيرِ
নিজের চাল-চলনে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করো এবং নিজের কণ্ঠস্বর নমনীয় রাখো। জেনে রেখো, সব আওয়াজের মধ্যে গর্দভের আওয়াজই হচ্ছে সবচেয়ে কর্কশ। (সূরা লোকমান-১৯) ঈমানদার ব্যক্তি শক্তির অহংকার করে না। কারণ সে জানে যে, আল্লাহর শক্তিই সবচেয়ে বেশী। কোন মানুষের এ শক্তি নেই যে, সে আল্লাহর সাম্রাজ্যের বাইরে কোথাও চলে যাবে। যারা অহংকার করে, দাম্ভিকতা প্রকাশ করে, শক্তিতে মদমত্ত হয়ে জাতির ওপরে জুলুম করে, তাদেরকে সাবধান করে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেছেন-
يمعْشَرَ الْجِنِّ وَالْإِنْسِ إِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ تَنْفُذُوا مِنْ أَقْطَارِ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ فَانْفُذُوا لَا تَنْفُذُونَ إِلَّا بِسُلْطَانٍ
হে জ্বিন ও মানুষ! যদি তোমাদের এমন ক্ষমতা থাকে যে, তোমরা এই আকাশ ও পৃথিবীর বাইরে কোথাও চলে যাবে, তাহলে চলে যাও। কিন্তু কোথায় যাবে, সমস্ত জায়গার সার্বভৌমত্ব আমার।
(সূরা আর রাহমান)
যাবার স্থান কোথাও নেই। পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরে, এই সৌর মন্ডলে দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান যেখানে যা কিছুই রয়েছে, এসব কিছুর মহান অধিপতি হলেন আল্লাহ। এই অনুভূতি ঈমানদার বাজার মন-মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকে, এ জন্য মুমীন ব্যক্তি প্রচন্ড ক্ষমতার অধিকারী হয়েও স্বৈরাচারী মনোভাব পোষণ করে না। নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব আল্লাহ পাক দান করলে সে বারবার আল্লাহর দরবারে শোকর গুজার করতে থাকে।
দৈহিক শক্তির অধিকারী কোন ব্যক্তি যখন ঈমান আনে তখন সে তাঁর শৌর্য-বীর্য শক্তির কারণে অহংকার করে না। কারণ সে জানে, তাঁর এই দৈহিক শক্তি যে কোন মুহূর্তে হারিয়ে যেতে পারে। আল্লাহর আদেশে তাঁর দেহের সমস্ত নার্ভগুলো অবশ হয়ে যেতে পারে। তাঁর চলতশক্তি হারিয়ে যেতে পারে। তাঁর পূর্বে প্রচন্ড দৈহিক শক্তি দিয়ে বিভিন্ন জাতিকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, তাদের অস্তিত্ব পৃথিবী থেকে মুছে গিয়েছে। এভাবে ঈমান মানুষকে অহংকার মুক্ত করে তার স্বভাবে বিনয় ও নম্রতার আবরণে অচ্ছাদিত করে।
রাহমানের গোলাম ঈমানদার ব্যক্তি প্রখ্যাত জ্ঞানী হিসেবে পরিচিতি লাভ করলেও সে জ্ঞানের অহংকার করে না। কারণ আল্লাহর কোরআনে সে পাঠ করেছে যে, মানুষকে অতি সামান্য জ্ঞান দান করা হয়েছে। জ্ঞানের সমস্ত ভান্ডার রয়ে গিয়েছে আল্লাহর কাছে। মানুষ সে-তার জ্ঞান পরিপূর্ণ নয় এবং নির্ভুলও নয়। যে সামান্য জ্ঞান সে অর্জন করেছে, মস্তিষ্কে কোন ত্রুটি ঘটলে, স্মৃতিশক্তির কেন্দ্রস্থল বিকল হয়ে গেলে মুহূর্তে সমস্ত জ্ঞান হারিয়ে যাবে। তাঁর জ্ঞান থাকে সব সময় সঠিক তথ্য দান করবে, এমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাঁর জ্ঞান তাকে কোন অজেয় ক্ষমতা দান করতে পারে না। অর্জিত জ্ঞান তাকে চিরঞ্জীব করতে পারে না। জ্ঞানের মাধ্যমে সে রোগ-ব্যধি-জরাকে জয় করতে পারেনি। মহান আল্লাহই হলেন সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী। রাহমানের বান্দাদের গুণাবলী সম্পর্কে সূরা ফোরকানের ৬৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَالَّذِينَ يَبِيتُونَ لِرَبِّهِمْ سُجَّدًا وَقِيَامًا -
তারা নিজেদের রব্ব-এর সামনে সিজদায় অবনত হয়ে থাকে ও দাঁড়িয়ে রাত কাটায়। রাহমানের যারা গোলাম, তাদের দিনের জীবন আর রাতের জীবনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অর্থাৎ তাদের রাত ভোগ-বিলাসে, অহেতুক গল্প করে, অর্থহীন কোন কর্মকান্ডে অতিবাহিত হয় না। তাদের রাত কেটে যায় আল্লাহর নিয়ামত ঘুমের মধ্য দিয়ে, নামাজ আদায়ের ও দোয়া করার মধ্য দিয়ে। নীরব নিঝুম রাত-সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে, রাহমানের বান্দাগণ তখন সেজদায় পড়ে অশ্রুধারায় সেজদার স্থান ভিজিয়ে দেয়। স্বয়ং রাহমান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর সেই অনুগত বান্দাদের পরিচয় সূরা সাজদার ১৬ আয়াতে এভাবে দিচ্ছেন-
تتجا فى جُنُوبُهُمْ عَنِ الْمَضَاجِعِ يَدْعُوْنَ رَبَّهُمْ خَوْفًا وطَمَعًا وَمِمَّا رَزَقْنَهُمْ يُنْفِقُونَ
তাদের পিঠ বিছানা থেকে পৃথক থাকে, নিজেদের রব্বকে ডাকতে থাকে আশা ও আশঙ্কা সহকারে এবং যা কিছু রিযিক আমি তাদেরকে দিয়েছি তা থেকে ব্যয় করে।
সূরা কাসাসের ৫৫ আয়াতে তাদের আরেকটি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে যে, এরা কোন অশালীন অর্থহীন কথা বলে না, যারা বলে তাদের সাথেও যোগ দেয় না। সূরা যারিয়াতে এদের আরেকটি গুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
كَانُوا قَلِيلاً مِّنَ اللَّيْلِ مَا يَهْجَعُونَ - وَبِالْأَسْحَارِ هُمْ يَسْتَغْفِرُونَ
এ সকল জান্নাতবাসী ছিল এমন সব লোক যারা রাতে সামান্যই ঘুমাতো এবং ভোর রাতে মাগফিরাতের দোয়া করতো। (সূরা যারিয়াত-১৭-১৮)
রাহমানের বান্দাদের গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহর কোরআনে সূরা যুমারে বলা হয়েছে-
امنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ الَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يُحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُوا رَحْمَةَ رَبِّهِ
যে ব্যক্তি হয় আল্লাহর আদেশ পালনকারী, রাতের বেলা সিজদা করে ও দাঁড়িয়ে থাকে, আখিরাতকে ভয় করে এবং নিজের রব্ব-এর রহমতের প্রত্যাশা করে-তার পরিণাম কি মুশরিকের মতো হতে পারে? (সূরা যুমার-৯)
রাহমানের গোলাম-ইসলামী আন্দোলন যারা করে, তাদের চারিত্রিক গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা এভাবে করা হয়েছে যে-
وَالَّذِينَ يَقُولُونَ رَبَّنَا اصْرِفْ عَنَّا عَذَابَ جَهَنَّمَ إِنَّ عَذَابَهَا كَانَ غَرَامًا -
তারা দোয়া করতে থাকে, হে আমাদের রব্ব! জাহান্নামের আযাব থেকে আমাদেরকে বাঁচাও, তার আযাব তো অত্যন্ত ভয়াবহ। (সূরা ফুরকান-৬৫)
রাহমানের বান্দাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, তারা কৃপণ হয় না। আবার দান করতে করতে একেবারে কপর্দকহীনও হয়ে যায় না। অযথা তারা অর্থ অপচয় করে না। প্রদর্শনীমূলক ব্যয় তারা করে না। কোন বৈধ অনুষ্ঠানেও তারা বিলাসিতার আশ্রয় গ্রহণ করে না। সর্বাবস্থায় তারা মধ্যমপন্থা গ্রহণ করে থাকে। আল্লাহ বলেন-
وَالَّذِينَ إِذَا أَنْفَقُوا لَمْ يُسْرِقُوا وَلَمْ يَقْتُرُوا وَكَانَ بَيْنَ ذالك قواما -
তারা যখন ব্যয় করে তখন অযথা ব্যয় করে না এবং কার্পণ্যও করে না বরং উভয় প্রান্তিকের মাঝামাঝি তাদের ব্যয় ভারসাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। (সূরা ফুরকান-৬৭)
আল্লাহর কিতাবের এ কথার দিকেই ইঙ্গিত করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন, নিজের অর্থনৈতিক বিষয়াদিতে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করা মানুষের জ্ঞানবান হবার অন্যতম আলামত।
আল্লাহর যমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যারা নিয়োজিত থাকে, তারাই হলো রাহমানের বান্দাহ্। এরা আল্লাহকে ভয় করে, বিপদাপন্ন হলে তারা এক আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে সাহায্যকারী বলে মনে করে না। যে কোন প্রয়োজনে তারা একমাত্র আল্লাহকেই ডাকে। ইসলাম অনুমোদিত পন্থা ব্যতিত এরা কাউকে হত্যা করে না বা আল্লাহর কোরআন যাকে মৃত্যুদন্ড দান করে, সে দন্ড কার্যকর করা ব্যতীত এরা কাউকে হত্যা করে না। এরা চরিত্রহারা হয় না। আল্লাহর কোরআন এভাবে এদের গুণগুলো বর্ণনা করেছে-
وَالَّذِينَ لاَ يَدْعُونَ مَعَ اللهِ الهَا آخَرَ وَلَا يَقْتُلُونَ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلا بِالْحَقِّ وَلَا يَزْنُونَ
তারা আল্লাহ ব্যতিত আর কোন উপাস্যকে ডাকে না, আল্লাহ যে প্রাণকে হারাম করেছেন কোন সংগত কারণ ব্যতিত তাকে হত্যা করে না এবং ব্যভিচার করে না। (সূরা ফুরকান-৬৮) যারা রাহমানের বান্দাহ্, তারা একমাত্র তাঁকে ব্যতিত অন্য কাউকে রব্ব হিসাবে অনুসরণ করে না এবং কারো কাছে সাহায্য কামনা করে না। তারা বলে-
وَرَبُّنَا الرَّحْمَنُ الْمُسْتَعَانُ عَلَى مَا تَصِفُونَ
আমাদের রাহমান-দয়াময় রব্বই আমাদের সাহায্যকারী। (সূরা আল আম্বিয়া-১১২)
যারা রাহমানের গোলাম, তারা নিজেরা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে চলে এবং আল্লাহর যমীনে তা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইসলামী আন্দোলন করে। এই আন্দোলন করার কারণে ইসলাম বিরোধীশক্তি তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। কিছু সংখ্যক মানুষ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা পোষণ করে। এদেরকে ভয়ঙ্কর ধরনের সন্ত্রাসী বলে ধারণা করে। নানাভাবে এদেরকে কষ্ট দেয়। এ অবস্থায় রাহমানের বান্দারা প্রবল ধৈর্য্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে থাকে। আল্লাহ বলেন-
إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّلِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًا -
নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজ করছে অত্যন্ত দ্রুত রাহমান-দয়াময় তাদের অন্তরে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেবেন। (সূরা মায়াম-৯৬)
অর্থাৎ যারা তাদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করতো, এ ধারণা তাদের পরিবর্তন হয়ে যাবে। আল্লাহ তা'য়ালা রাহমান-তিনি দেখছেন, তাঁর সৈনিকগণ কিভাবে নির্যাতিত হচ্ছে।
যাবতীয় কষ্ট তারা হাসিমুখে বরণ করছে। সমাজের একশ্রেণীর মানুষ তাদের সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে কটুক্তি করছে। সন্ত্রাসী শক্তি সন্ত্রাস করে প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে, অর্থের জোরে, প্রচার মাধ্যমের জোরে তাদের মতো শান্তি প্রিয় লোকগুলোকেই সন্ত্রাসী বানিয়ে ছাড়ছে। আল্লাহ বলেন, এ অবস্থা বেশী দিন থাকবে না। পরম ধৈর্য্যের সাথে ইসলামী আন্দোলন করতে থাকলে আল্লাহ তা'য়ালা সম্পূর্ণ অবস্থা পরিবর্তন করে দেবেন। প্রচার মাধ্যমের অপপ্রচার শুনে যারা তাদেরকে সন্ত্রাসী বলে ধারণা করতো, তাদের ভুল ধারণা দ্রুত মুছে যাবে এবং তারা আল্লাহর সৈনিকদের প্রতি অন্তরে শ্রদ্ধা-ভালোবাসা পোষণ করবে।
ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদেরকে জনগণের সাহায্য সহানুভূতি লাভ করতে হলে অবশ্যই পূর্ণ ঈমানদার হতে হবে এবং আল্লাহর বিধান অনুসরণের ক্ষেত্রে ঐকান্তিক নিষ্ঠার পরিচয় দিতে হবে-উল্লেখিত আয়াতের প্রথমেই সে শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। অন্তরে কপটতা লালন করে তথা প্রদর্শনীমূলকভাবে, পার্থিব লাভের আশায় ইসলামী আন্দোলনে শামিল হলে আল্লাহর সাহায্য লাভ করা যাবে না। আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দার মনের সংবাদও রাখেন। তিনি দৃশ্য এবং অদৃশ্য সম্পর্কে পূর্ণ অবগত রয়েছেন। সূরা সাজদা-এর ৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
ذَالِكَ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ الْعَزِيزِ الرَّحِيمُ
তিনিই প্রতিটি অদৃশ্য ও দৃশ্যমানকে জানেন, মহাপরাক্রমশালী ও রাহমান-করুণাময় তিনি।
রাহমানের প্রতি ঈমান আনলে সে ঈমান মানুষকে তাঁর জীবনের প্রতিটি বিভাগ থেকে অহংকারের আবর্জনা দূরিভূত করে বিনয় আর নম্রতার আলোকে উদ্ভাসিত করে তোলে। ঈমান এনেছি, এ দাবি করার পরে যদি তার ভেতরে এসব গুণাবলীর সৃষ্টি না হয়, তাহলে তার পক্ষে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয় না। বাতিলের মোকাবেলায় উত্তপ্ত ময়দানে টিকে থাকাও সম্ভব হয় না। চরিত্রে বিনয় এবং নম্রতা না থাকলে অন্যকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করা যায় না। আর নিজের প্রতি অন্যকে আকৃষ্ট করতে না পারলে ইসলামের দাওয়াতও কারো কাছে আকর্ষণীয়ভাবে পৌছানো যায় না।
0 Comments