তিনিই রব্ব-যিনি অসীম অনুগ্রহশীল

        তিনি শুধু মুসলমান বা মানুষেরই রব্ব নন, এই সৃষ্টি জগতসমূহ এবং এর ভেতরে যা যেখানে অবস্থান করছে, তার সমস্ত কিছুরই মালিক, প্রতিপালক ও নিয়ন্ত্রণকর্তা। একমাত্র তাঁরই প্রশংসা ও তস্বীহ করতে হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-

فَسَبِّحْ بِاسْمِ رَبِّكَ الْعَظِيمِ

        অতএব হে নবী! তোমার মহামহিম রব্ব-এর নামের তস্বীহ করো। (সূরা আল হাক্কাহ্-৫২) মহান আল্লাহ হলেন রাব্বুল আযীম। তিনি মহাসম্মানিত এবং অসীম মর্যাদার অধিকারী। তাঁকে কিভাবে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করতে হবে তা মানুষ জানতো না। তিনিই এতই অনুগ্রহশীল যে, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এক হীন ও নগণ্য অবস্থা থেকে। অপবিত্র এক কাত্রা পানি থেকে তিনি এই সুন্দর মানুষের অস্তিত্ব দান করেছেন। তাকে কথা বলতে শিক্ষা দিয়েছেন। কিভাবে তাঁর প্রশংসা করতে হবে কোরআন অবতীর্ণ করে তা শিখিয়েছেন। অপরিসীম নির্ভুল জ্ঞানের ভান্ডার কিতাব দান করেছেন। তিনি মানুষকে এক নিকৃষ্ট অবস্থা থেকে মায়ের পেটে বর্ধিত করেছেন, তাকে পৃথিবীতে নিয়ে এসেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বিবেকসম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ সত্তায় পরিণত করেছেন। জ্ঞান আর বিবেকই হলো সৃষ্টিলোকের মধ্যে সর্বোত্তম এবং সর্বোচ্চ গুণ ও বৈশিষ্ট্য। এসব তিনি মানুষকেই দান করেছেন। এটা আল্লাহ তা'য়ালার এক বিশেষ অবদান, অতিবড় অনুগ্রহ এবং মহান অনুগ্রহের ফলশ্রুতি।

        মহামহিম রব্ব-এর প্রশংসা করে শেষ করা তো দূরের কথা, আল্লাহর প্রশংসা যেখানে শুরু-সেখানেই মানুষ পৌঁছতে সক্ষম নয়। তিনি রাব্বুল আকরাম। কোরআন বলছে-

اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ الَّذِي عَلَّمَ بِالقَلَم 

        পড়ো, আর তোমার রব্ব বড়ই অনুগ্রহশীল। যিনি কলমের সাহায্যে জ্ঞান শিখিয়েছেন। রাব্বুল আলামীন যে কত বড় অনুগ্রহশীল, তা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিবেক দান করেছেন। সেই সাথে কলমের ব্যবহার তথা লেখার কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ জ্ঞান আর কলম-এ দুয়ের সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। একটি ছাড়া আরেকটি চলতে পারে না। জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রচার-প্রসার, বিস্তার, উন্নয়ন এবং বংশানুক্রমে জ্ঞানের উত্তরাধিকার সৃষ্টি, জ্ঞানের বিকাশ সাধন, জ্ঞানের সংরক্ষণ ও স্থায়িত্ব-এসবের মাধ্যম বানিয়েছেন কলমকে। কিভাবে কলম আবিষ্কার করতে হবে এবং তার ব্যবহার পদ্ধতি কি হবে, এ চেতনা যদি তিনি মানুষের মনের মধ্যে জাগ্রত করে না দিতেন তাহলে মানুষের জ্ঞানার্জন এবং বিস্তারের যাবতীয় সৃষ্টিগত যোগ্যতা-প্রতিভা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়ে যেতো। জ্ঞানের বিকাশ ও উন্নয়ন এবং তা এক জাতি থেকে আরেক জাতি, পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পৌঁছানো যেতো না। শত সহস্র শতাব্দী ধরে জ্ঞান সংরক্ষণ করে তা দিয়ে মানবতা উপকৃত হতে পারতো না। তিনি রাব্বুল আকরাম-তিনিই অনুগ্রহ করে কলমের ব্যবহার শিক্ষা দিয়েছেন।

        তিনি মহান-তিনিই রাব্বুল কারীম। সময়ের প্রতিটি মুহূর্ত মানুষ তাঁর অসীম করুণায় সিক্ত হচ্ছে। তাঁর করুণা ব্যতীত মানুষের পক্ষে একটি মুহূর্তও জীবিত থাকা সম্ভব নয়। তিনি মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন-

يَأَيُّهَا الْإِنْسَانُ مَا غَرَكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ

        হে মানুষ! কোন্ জিনিস তোমাকে তোমার সেই মহান রব্ব-এর ব্যাপারে ধোঁকায় নিমজ্জিত করেছে? (সূরা ইনফিতার-৬)

        নিজের জীবনে এবং সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী প্রতি মুহূর্তে তোমরা দেখছো, আমার করুণা কিভাবে বৃষ্টি ধারার মতই বর্ষিত হচ্ছে, এসব দেখেও কেন তোমরা আমার দাসত্ব করার ব্যাপারে অবহেলা প্রদর্শন করছো, কেন তোমরা ধোঁকায় নিমজ্জিত হচ্ছো? সমস্ত সৃষ্টির ভেতরে আমিই ভারসাম্য দান করেছি। অতএব আমার দাসত্ব করো এবং আমার নামের তস্বীহ করো। আল্লাহ বলেন-

سَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الْأَعْلَى الَّذِي خَلَقَ فَسَوَى

        তোমার মহান শ্রেষ্ঠ রব্ব-এর নামের তস্বীহ করো। যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং ভারসাম্যতা স্থাপন করেছেন। (সূরা আ'লা-১-২)

        এই মানুষের মালিক স্বয়ং মানুষ নয়, তাঁর মালিকও হলেন সেই আল্লাহ যিনি গোটা সৃষ্টি জগতসমূহের রব্ব। মানুষকে একমাত্র তাঁরই আশ্রয় কামনা করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ النَّاسِ مَلِكِ النَّاسِ الهِ النَّسِ -

         বলো, আমি আশ্রয় চাই মানুষের রব্ব, মানুষের মালিক-বাদশাহ, মানুষের মা'বুদের কাছে। মানুষের মালিক মানুষ স্বয়ং নয়, তার মালিক হলেন আল্লাহ। এ জন্য তার অধিকার নেই যে, সে তার মালিককে অস্বীকার করে নিজের খেয়াল-খুশী অনুসারে পৃথিবীতে জীবন অতিবাহিত করে। তাঁর যে মালিক ও স্রষ্টা, তাঁরই দাসত্ব এবং যাবতীয় ব্যাপারে তাঁরই আশ্রয় গ্রহণ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহর কিতাব ঘোষণা করছে-

قُلْ أَعُوذُ بِرَبِّ الفَلَقِ

        বলো, আমি আশ্রয় চাই রাব্বুল ফালাকের কাছে। (সূরা ফালাক-১)

        সূরা ফালাক আল্লাহর কিতাবের ত্রিশ পারার ছোট্ট একটি সূরা। এ সূরাটি অধিকাংশ মুসলমানের মুখস্থ রয়েছে। নামাজে এটি বার বার পাঠ করা হয়। এ সূরার প্রথম আয়াতে ফালাক শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সাথে রব্ব শব্দ সহযোগে উচ্চারিত হয়েছে, 'রাব্বুল ফালাক'। রাব্বুল ফালাক কাকে বলা হয়-বিষয়টি পরিষ্কার করে বুঝতে হবে। আরবী ফালাক শব্দের ক্রিয়ামূল হলো 'ফুল্ক'। এর অর্থ হলো 'যে চিরে ফেলে।' আর ফালাক শব্দের অর্থ হলো, কোন কিছু দীর্ণ করা বা চিরে ফেলা। সূরা আল আনআ'মের ৯৬ আয়াতে 'ফলিকুল ইস্নাহ" শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে এবং আল্লাহ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'তিনিই রাতের আবরণ দীর্ণ করে রঙিন প্রভাতের উন্মেষ ঘটান।' আর সূরা ফালাকের প্রথম আয়াতে ব্যবহৃত 'রাব্বুল ফালাক' শব্দের সরল অর্থ হলো, 'প্রভাত কালের রব্ব'।

        পৃথিবীতে এক একটি দেশে প্রভাত কিভাবে হয়? রাতের নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে পূর্ব গগনে তরুণ তপন উদিত হওয়ার প্রক্রিয়াকে প্রভাত হওয়া বলে। অর্থাৎ অন্ধকারের বুকচিরে নবারূণের আগমন ঘটে। আর এই প্রক্রিয়াকে আরবী ভাষায় বলা যেতে পারে, ফালাকুস্ সুবাহ্ অর্থাৎ প্রভাত সূর্যের উদয়। এই ফালাক শব্দের আরেকটি অর্থ করা হয়েছে 'সৃষ্টিকার্য সমাধা করা।' এই অর্থ এ জন্য করা হয়েছে যে, পৃথিবীতে যত কিছুই সৃষ্টি হয়, তা কোন না কোন জিনিস বা আবরণ ভেদ করে, দীর্ণ করেই সৃষ্টি হয়। তিমিরাবৃত রজনীর বুকচিরেই দূর নিহারিকা কুঞ্জের মিটিমিটি আলো পৃথিবীর বুকে এসে পৌঁছায়। উত্তাল সাগরের বুক চিরেই জলযানসমূহ গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যায়। খেজুর গাছে সুমিষ্ট রসের ভান্ডার মওজুদ থাকলেও তা নির্গত হয় না। খেজুর গাছকে যখন দীর্ণ করা হয়, তখনই রস বেরিয়ে আসে। রাবার গাছসমূহ দীর্ণ করা না হলে রাবার পাওয়া যায় না। ডাবের পানি পান করতে হলেও তা দীর্ণ করতে হবে। পৃথিবীর উদ্ভিদ বীজসমূহ মাটির বুকচিরেই তার অঙ্কুরোদাম ঘটে। উদ্ভিদ মাটি দীর্ণ করেই পৃথিবীর আলো বাতাসে বেরিয়ে আসে।

        ডিমের মাধ্যমে বংশধারা টিকিয়ে রাখার জন্য পৃথিবীতে যেসব প্রাণী ডিম দেয়, সেই ডিম দীর্ণ করেই শাবক পৃথিবীতে বেরিয়ে আসে। কুমিরের মতো বিশাল প্রাণীর বাচ্চাও ডিম চিরেই ভূমিষ্ঠ হয়। নদী-সাগর-মহাসাগরে যেসব প্রকান্ড মাছ বাস করে, সেসব মাছের বাচ্চাও ডিম থেকেই বেরিয়ে এসেছে। মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী মাতৃগর্ভ থেকে কোন বাধা বা আবরণ দীর্ণ করেই এই পৃথিবীতে আগমন করছে। বৃক্ষের বহিরাবরণ দীর্ণ করেই শাখায় শাখায় জাগে কিশলয়। ফুলের কুড়ি দীর্ণ করেই ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে পাঁপড়ী মেলে দেয়। অর্থাৎ পৃথিবীর সমস্ত কিছুই কোন না কোন বাধা' অপসারিত করে, কোন কিছুর বুক চিরে বা কোন আবরণ দীর্ণ করেই সৃষ্টি হয়, আর এই প্রক্রিয়ায় যিনি সৃষ্টি করেন তিনিই হলেন রাব্বুল ফালাক। তিনিই মানুষের মালিক, খালিক, সম্রাট, শাসক, আইনদাতা ও জীবন বিধানদাতা। একমাত্র তাঁরই সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই দাসত্ব লাভের অধিকারী। কোরআনের গবেষকগণ এই ফালাক শব্দের বিস্তারিত তাফসীর করেছেন।

Post a Comment

0 Comments