মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসীম দয়ালু-কথাটি অনুধাবন করার জন্য কোন গবেষণার প্রয়োজন নেই। মাত্র একটি বারের জন্য গোটা সৃষ্টির প্রতি এবং নিজের দেহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই বিষয়টি দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরা-সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতেই আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর অসীম দয়া ও অনুগ্রহের কথা মানব জাতিকে জানিয়ে দিয়েছেন। এরপর তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ কিভাবে কোথায় কার্যকর করেছেন, তা কোরআনের বিভিন্ন আয়াতে আলোচনা করে মানব জাতির দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে দয়া ও অনুগ্রহের কথা জানিয়েই তিনি ঘোষণা করেছেন-তিনিই বিচার দিবসের মালিক।
দয়া অনুগ্রহ ও বিচার দিবসের মালিক-দুটো বিষয়ের পাশাপাশি উল্লেখ করার কারণ হলো, পৃথিবীর মানব-মন্ডলীর কাছে তিনি এ কথা স্পষ্ট করে দিয়েছেন-তিনি শুধু অসীম দয়ালুই নন, তিনি ন্যায় বিচারক, ইনসাফকারী, তিনি অধিকার প্রদানকারী। পৃথিবীতে আল্লাহর উন্মুক্ত ও অবারিত দয়া পরিবেষ্টিত থেকে শক্তি ও প্রভাব-প্রতিপত্তির কারণে যারা ন্যায় বিচারকে ভূলুণ্ঠিত করছে, অপরের অধিকার ছিনিয়ে নিচ্ছে, দুর্বলকে ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করছে, তিনিই আল্লাহ-যিনি বিচার দিবসে বিচারকের আসনে আসীন হয়ে ন্যায় বিচার করবেন। পৃথিবীতে যারা অধিকার বঞ্চিত ছিল, তাদেরকে তিনি প্রাপ্য অধিকার প্রদান করবেন-ইনসাফ করবেন।
একজন ব্যক্তি দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণের দিকে লক্ষ্য রেখে মহান আল্লাহর দেয়া জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি প্রয়োগ করে একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করলো এবং সে নিয়ম-পদ্ধতি দেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালো। প্রচেষ্টা চালাতে গিয়ে সে কারাগারে যেতে বাধ্য হলো, নির্যাতিত হলো, সহায়-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হলো। দেশের জনগণ এবং জাতির কর্ণধারগণ লোকটির আবিষ্কৃত কল্যাণকর নিয়ম-পদ্ধতির কল্যাণকারিতা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়ে অথবা অবহেলা করে তার নিয়ম-পদ্ধতি গ্রহণ করলো না বরং তার প্রতি নানা ধরনের নির্যাতন অনুষ্ঠিত করলো। এরপর নিয়ম মাফিক লোকটি একদিন এ পৃথিবী থেকে একবুক হাহাকার নিয়ে চিরবিদায় গ্রহণ করলো। তার ইন্তেকালের অনেক বছর পরে নতুনভাবে যারা দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো, তারা এসে দেখলো, ঐ লোকটি কর্তৃক আবিষ্কৃত নিয়ম-পদ্ধতি দেশের বুকে প্রতিষ্ঠিত করলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে এবং তারা বাস্তবে তাই করলো। দেশ ও জাতি লোকটির প্রবর্তিত নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ করে সমৃদ্ধশালী জাতিতে পরিণত হলো।
জাতি যখন লোকটির প্রকৃত মূল্য অনুধাবন করতে সক্ষম হলো, তখন তার প্রতি শ্রদ্ধায় গোটা জাতি বিগলিত হলো। লোকটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দেশের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোর নামকরণ তার নামে করা হলো। প্রতি বছরে তার জন্ম-মৃত্যু দিবসে সংবাদ পত্রসমূহ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করার ব্যবস্থা করলো। তাকে মূল্যায়ন করে নানা ধরনের বই-পুস্তক প্রকাশ হলো। কেউ কেউ তার আবক্ষ মূর্তি নির্মাণ করে পূজা করা শুরু করলো। তার নামে বিভিন্ন ধরনের পদক প্রবর্তন করা হলো।
এসব করা হলো ঐ ব্যক্তির জন্য, যাকে একদিন গোটা জাতি লাঞ্ছিত করেছিল, নির্মম অত্যাচারে জর্জরিত করেছিল, কারারুদ্ধ করেছিল, তার সহায়-সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে তাকে দেশান্তরী করেছিল। তারপর লোকটির ইন্তেকালের বহু বছর অতিক্রান্ত হবার পর উপলব্ধিবোধ ফিরে আসার পরে জাতি তাকে পুরস্কৃত করার জন্য উল্লেখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করলো। অর্থাৎ মানুষের পক্ষে বিনিময় দেয়ার যতগুলো পন্থা রয়েছে, তার সবগুলোই অবলম্বন করা হলো।
এখন প্রশ্ন হলো, পরবর্তীতে মৃত সেই লোকটির জন্য যা করা হলো, এসবই কি লোকটির যথার্থ প্রাপ্য ছিল, না এরচেয়ে আরো বেশী কিছু প্রাপ্য ছিল? আর প্রাপ্য থাকলেও মানুষের পক্ষে লোকটির জন্য আরো বেশী কিছু করা কি সম্ভব? মাত্র একটি লোকের প্রচেষ্টায় অসংখ্য অগণিত লোক উপকৃত হলো, একটি দেশ ও জাতি বিশ্বের দরবারে সমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হলো, তার কারণে জাতি অনিয়ম, দুর্নীতি, অরাজকতা, বিশৃংখলতা, দারিদ্র থেকে মুক্তি লাভ করে শান্তি ও স্বস্তির জীবন লাভ করলো, তাকে কি কোনভাবেই মানুষের পক্ষ থেকে তার কর্মের বিনিময় স্বরূপ যথার্থ পুরস্কার প্রদান করা সম্ভব?
অনুরূপভাবে আরেকজন লোক এমন এক মতবাদ আবিষ্কার করলো, রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে এমন নিময়-পদ্ধতির প্রবর্তন করলো এবং একদিন পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করলো। তার সেই ঘৃণ্য মতবাদের কারণে যুগের পর যুগ ধরে অগণিত মানুষ চরম দুরাবস্থার মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হলো। এখন সেই মতবাদের আবিষ্কারককে কি কোনভাবেই দন্ড প্রদান করা সম্ভব? আর মানুষের নিয়ন্ত্রণে যত ধরনের দন্ড রয়েছে, তার সবগুলোই প্রয়োগ করলে কি লোকটিকে যথার্থ দন্ড দেয়া হবে। সুতরাং, মানুষের পক্ষে আরেক জন মানুষের কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন করা কোন ক্রমেই সম্ভব নয়। কারণ মানুষের শক্তি ও সামর্থ সীমিত। এ জন্য মানুষের পক্ষে যথার্থ পুরস্কার ও দন্ড দেয়া কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তাহলে কি মানুষ প্রকৃত পুরস্কার ও দন্ড লাভ থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে? প্রকৃত পুরস্কার ও দন্ডের ব্যবস্থা মানুষের আয়ত্বে নেই, এ কারণে মানুষের ভেতরে যে হতাশা, এই হাতাশা বোধেই কি মানবাত্মা অনন্তকাল ধরে আর্তনাদ করতে থাকবে?
এই হতাশা দূর করার জন্যই আল্লাহ রাহমান ও রাহীম। তিনি অসীম অনুগ্রহ ও করুণার অধিকারী। পৃথিবীতে যেমন তিনি মানুষের ওপরে অসীম করুণা করেছেন, তেমনি তিনি করুণা করবেন বিচার দিবসে। যেদিন তিনি করুণা করে যথার্থ পুরস্কার ও দন্ডের ব্যবস্থা করবেন এবং ন্যায় বিচার পরিপূর্ণ করার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করবেন। এ কারণেই তিনি সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে দয়া ও অনুগ্রহের বিষয়টি উল্লেখ করার পরপরই তৃতীয় আয়াতে বিচার দিবসের বিষয়টি নিশ্চিত করে মানব জাতিকে হতাশা মুক্ত করেছেন। আল্লাহ বলেন-
مَنْ عَمِلَ صَالِحًا فَلِنَفْسِهِ وَمَنْ أَسَاءَ فَعَلَيْهَا وَمَا رَبُّكَ بِظَلام للعبيد
যে সৎ কাজ করবে সে নিজের জন্যই কল্যাণ করবে। আর যে দুষ্কর্ম করবে তার মন্দ পরিণাম তাকেই ভোগ করতে হবে। তোমার রব্ব বান্দাদের জন্য জালিম নন। (হামীম সেজদা-৪৬)
যার যা প্রাপ্য তাকে না দেয়াই হলো তার ওপরে জুলুম অনুষ্ঠিত করা এবং পৃথিবীতে এই জুলুম প্রতি মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জ্ঞান বিবেক বুদ্ধি এই জুলুমের অবসান কল্পে আর্তচিৎকার করছে। আল্লাহ তা'য়ালা বিচার দিবসে এই জুলুমের অবসান ঘটাবেন। মানুষের জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি এটাই দাবি করছে যে, যথার্থভাবে মানুষের কর্মের মূল্যায়ন ও তদানুযায়ী পুরস্কার এবং দন্ডের আয়োজন করা হোক। আর যেহেতু জীবিত থাকাবস্থায় মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা কোনক্রমেই সম্ভব নয়।
এজন্য মৃত্যুর পরে আরেকটি বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে সেখানে এসবের ব্যবস্থা করা উচিত। জীবিত কালে মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা এ কারণে সম্ভব নয় যে, মানুষ এমন একটি কর্ম সম্পাদন করলো, যার ফলে গোটা জাতির কাছে সে প্রশংসিত হলো। আবার সেই একই ব্যক্তির দ্বারা এমন এক জঘন্য কর্ম অনুষ্ঠিত হলো, গোটা জাতির কাছে সে নিন্দিত হলো। মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ ধরনের নিন্দিত ও প্রশংসিত নেতার অভাব নেই। সারা জীবন ধরে এক ব্যক্তি প্রশংসামূলক কর্ম সম্পাদন করলো, মৃত্যু শয্যায় শায়িত থেকে সেই একই ব্যক্তি, এমন এক নিন্দিত কাজের অনুমোদন দিয়ে গেল যে, গোটা জাতি তার মৃত্যুর পরে শোকাহত হবার পরিবর্তে তার প্রতি ধিক্কারই জানালো। এ জন্য জীবিত থাকাবস্থায় কোন মানুষের কর্মের মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মানুষের প্রতিটি খুটিনাটি কাজের মূল্যায়ন পূর্বক পুরস্কার ও দন্ডদানের ব্যবস্থার জন্যই নির্দিষ্ট করা হয়েছে বিচার-দিবস। এটা মহান আল্লাহর উন্মুক্ত ও অবারিত দয়া-অনুগ্রহের অসীম প্রকাশ।
পৃথিবীর বিচারালয় সম্পর্কে মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা হলো, বিচারক স্বয়ং নানাভাবে প্রভাবিত হয়ে বিচার কার্য অনুষ্ঠিত করে থাকেন। যে বিষয়টিকে কেন্দ্র করে বিচারক বিচার করেন, সে বিষয়টি যেখানে সংঘটিত হয়, সেখানে বিচারক স্বশরীরে উপস্থিত থেকে ঘটনার প্রতিটি দিক সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করার কোন উপায় তার থাকে না। বিচার কার্য পরিচালনার সাথে যারা জড়িত, তাদের কাছ থেকে ঘটনাবলী শুনে বিচারক বিচার করে থাকেন। এ ক্ষেত্রেও পূর্ণ ঘটনা তার গোচরে আসার সম্ভাবনা নেই। উভয় পক্ষের উকিল এবং সাক্ষীগণ নিজের স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার চেষ্টা করে থাকে। এক কথায় পৃথিবীতে বিচার কার্য পরিচালনা করার সময় মানুষ বিচারককে যতগুলো দুর্বলতা পরিবেষ্টন করে রাখে, এর সবগুলো থেকে মহান আল্লাহ পাক ও পবিত্র। ঘটনা যেখানে সংঘটিত হয়, তা মহান আল্লাহর দৃষ্টির আড়ালে থাকে না। কেন ঘটনা সংঘটিত হলো, সেটাও তিনি অবগত থাকেন এবং যেখানে যার দ্বারাই সৎকাজ ও অসৎকাজ সংঘটিত হচ্ছে, সমস্ত কিছুই তিনি অবগত থাকেন। আল্লাহ বলেন-
يُسَبِّحُ مَا فِي السَّمَوتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الحَمْدُ - وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ - هَوَلَذِي خَلَقَكُمْ فَمِنْكُمْ كَافِرٌ و مِنْكُمْ مَوْ مِنْ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ
আল্লাহর তাসবীহ করছে এমন প্রতিটি জিনিস যা আকাশ জগতে রয়েছে এবং এমন প্রতিটি জিনিস যা পৃথিবীর বুকে রয়েছে। তিনিই সার্বভৌমত্বের একমাত্র অধিকারী এবং প্রশংসাও তাঁরই জন্য। আর তিনি প্রতিটি জিনিসের ওপর কর্তৃত্বের অধিকারী। তিনিই সেই সত্তা, যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। এরপর তোমাদের মধ্যে কেউ মুমিন আর কেউ কাফির। আর আল্লাহ সেসব কিছুই দেখেন যা তোমরা করে থাকো। (সূরা আত তাগাবুন-১-২)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার দিবসের মালিক, সৃষ্টিজগতে যা কিছুই রয়েছে সমস্ত কিছুই তাঁর প্রশংসা করছে। সমস্ত সৃষ্টির ওপরে একমাত্র তাঁর প্রভুত্ব ও সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। সৃষ্টির ওপরে কারো কর্তৃত্ব চলে না, কর্তৃত্ব একমাত্র তাঁর। পৃথিবীতে মানুষকে প্রেরণ করে তিনি তাদেরকে সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য দেখিয়ে দিয়ে স্বাধীন ক্ষমতা দান করেছেন, মানুষ আল্লাহ প্রদর্শিত পথ অবলম্বন করে মুমিনও হতে পারে আবার শয়তানের পথ অনুসরণ করে কাফিরও হতে পারে।
মানুষ কোথাও কোন অবস্থায় অন্ধকারে চার দেয়ালের মধ্যে লোক চক্ষুর অন্তারালে কি করছে সেটাও তিনি দেখছেন। সুতরাং একমাত্র তাঁর পক্ষেই যাবতীয় ঘটনার ন্যায় বিচার করা সম্ভব। বিচারক যদি ন্যায় বিচার করে, তাহলে সেটা তার সততা, দয়া ও অনুগ্রহের বহিঃপ্রকাশ। আর বিচারক যদি ন্যায় বিচার না করে নির্দোষকে আসামী করে শাস্তি প্রদান করেন আর দোষীকে ক্ষমা করে দিয়ে কোন দন্ডদান না করেন, এটা বিচারকের হীন ও কলুষিত মানসিকতার স্বাক্ষর বহন করে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে বিচার দিবসকে নির্দিষ্ট করেছেন এবং সেদিন তিনি ন্যায় বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে দন্ডদান করবেন এবং পুরস্কার লাভের অধিকারীদের পুরস্কার প্রদান করবেন। সৎকর্মের পুরস্কার হিসাবে যারা জান্নাতে গমন করবেন, তারাও যেমন আল্লাহর অনুগ্রহ লাভে ধন্য তেমনি যারা অসৎ কাজের বিনিময় হিসাবে জাহান্নামে গমন করবে, তারাও আল্লাহর পক্ষ থেকে দয়া ও ইনাসাফ লাভ করেই যথাস্থানে গমন করবে। একদল মানুষ শাস্তি লাভের জন্য জাহান্নামে গমন করছে, এটা আল্লাহর ক্রোধের প্রকাশ নয়। এটাও তাঁর দয়া ও অনুগ্রহের প্রকাশ। কারণ তিনি দয়া করে ন্যায় বিচার করবেন এবং যেখানে যার স্থান তাকে সে স্থানেই প্রেরণ করার ব্যবস্থা করবেন। মানুষের যাবতীয় কার্যাবলী তিনি পর্যবেক্ষণ করছেন এবং তার হৃদয় কি কল্পনা করে, তাও তিনি জানেন। আল্লাহ বলেন-
يَعْلَمُ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَيَعْلَمُ مَا تُسِرُّونَ وَمَا تُعْلِنُونَ وَاللَّهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ
পৃথিবী ও আকাশমন্ডলের প্রতিটি বিষয় তিনি জানেন। তোমরা যা কিছু গোপন করো আর যা কিছু প্রকাশ করো, তা সবই তিনি জানেন। তিনি মানুষের হৃদয়সমূহের অবস্থাও জানেন।
একদিকে আল্লাহ স্বয়ং প্রত্যক্ষভাবে মানুষের গতিবিধি, যাবতীয় কার্যকলাপ ও তার চিন্তা-কল্পনা, কামনা-বাসনা সমস্ত কিছুই জানেন। অপরদিকে প্রতিটি মানুষের সাথে দু'জন করে ফেরেস্তা নিযুক্ত করেছেন। তারা মানুষের সাথে সম্পর্কশীল প্রতিটি কথা ও কাজ লিপিবদ্ধ করে রাখছে। মানুষের কোন কথা বা কাজ রেকর্ডের বাইরে অলিখিত থাকে না। বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে যখনই মানুষকে উপস্থিত করা হবে, তখন পৃথিবীর জীবনে কে কি করেছে, তখন তাদের সামনে তা প্রদর্শন করা হবে।
শুধু তাই নয়, দু'জন ফেরেস্তাও সাক্ষী হিসাবে দন্ডায়মান থাকবেন। তারা মানুষের যাবতীয় কার্যকলাপের লিখিত ও ধারণকৃত ছবি প্রমাণ হিসাবে পেশ করবেন। বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে মানুষ পৃথিবীতে যত কথা বলেছিল, সে কথাগুলো নিজের কানে নিজের কণ্ঠেই শুনতে পাবে। শুধু তাই নয়, নিজের চোখ দিয়ে তার যাবতীয় কর্মকান্ডের চলমান ছবি এমনভাবে দেখতে পাবে যে, ঘটনার যথার্থতা ও নির্ভুলতাকে অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। সূরা ক্বাফ্-এ আল্লাহ বলেন-
وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ وَنَعْلَمُ مَا تُوَسْوِسُ بِهِ نَفْسُهُ وَنَحْنُ أَقْرَبُ إِلَيْهِ مِنْ حَبْلِ الْوَرِيدِ إِذْ يَتَلَقَّى المُتَلَقِّيَانِ عَنِ الْيَمِينِ وَعَنِ الشِّمَالِ قَعِيدٌ - مَا يَلْفِظُ مِنْ قَوْل إِلا لَدَيْهِ رَقِيبٌ عَتِيدٌ
মানুষকে সৃষ্টি করেছি আমি এবং তার মনে প্রতি মুহূর্তে কখন কি কল্পনা-কামনা-বাসনার উদয় তাও আমি জানি। আমি তার কন্ঠের শিরার থেকে অত্যন্ত কাছে অবস্থান করছি। দু'জন লেখক তার ডান ও বাম দিকে অবস্থান করে প্রতিটি বিষয় লিপিবদ্ধ করে রাখছে। মানুষ এমন কোন শব্দই উচ্চারণ করে না যা সংরক্ষণের জন্য একজন চির-উপস্থিত পর্যবেক্ষক মওজুদ থাকে না।
অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে-মানুষ নানা বয়সের হায়াত লাভ করে। কেউ একশো বছরেরও বেশী হায়াত পায়। যে ব্যক্তি একশো দশ বছর হায়াত পেয়েছিল তার ওই একশো দশ বছরের প্রতিটি মুহূর্তের হিসাব যে খাতা বা আমলনামায় লেখা হবে, সে আমলনামার সাইজ বা আকৃতি তো বিরাট হবে! অতবড় খাতা বহন করতে তো একটা ট্রাক দরকার হবে। মানুষ তা কিয়ামতের দিন হাতে নেবে কিভাবে? কিন্তু এ ব্যাপারে একটু গভীরভাবে চিন্তা করলেই উত্তরটা সহজে পাওয়া যায়। আধুনিক বিজ্ঞান ফিল্ম এবং কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে। সর্বক্ষেত্রে তা ব্যবহার হচ্ছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে ফিল্ম এবং কম্পিউটার ছাড়া বর্তমানে সবই অচল।
এই ফিল্মের মধ্যেই বিশাল ওই আকাশ, সূর্য, বিরাট সমুদ্র, বিশাল আকৃতির হাতী, পূর্ণাঙ্গ মানুষের ছবি ধরে রাখা হচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। এই ফিল্ম আবিষ্কার করার জ্ঞান মানুষকে আল্লাহ তায়ালা দান করেছেন। ছোট একটা ফিল্মের মধ্যে যদি মানুষ পারে ওই বিশাল আকাশের, সমুদ্রের ছবি ধরে রাখতে, তাহলে আল্লাহ কি পারেন না ওই ধরণের ক্ষুদ্র কোন ফিল্মের মধ্যে মানুষের মাত্র একশো দেড়শো বছরের কর্মকাণ্ডের ছবি ধরে রাখতে?
কম্পিউটারের ছোট একটা ডিসক। যা তিন আঙ্গুলে ধরা যায়। ওই ডিস্কের মধ্যে শত শত কোটি টাকার হিসাব ধরে রাখা যায়। মাউস আর কী-বোর্ডের সাহায্যে সব হিসাব বের হয়ে পড়ে। ওই ছোট একটা ডিস্কের মধ্যে লক্ষ লক্ষ পৃষ্ঠার বই ধরে রাখা যায়। মানুষ যদি ইচ্ছা করে ওই বইয়ের চল্লিশ হাজার চারশত তিরানব্বই পৃষ্ঠায় কি আছে তা পড়বে। মাউস আর কী-বোর্ডের সাহায্যে ওই কাংখিত পৃষ্ঠা কম্পিউটারের মনিটরে ভেসে উঠবে-মানুষ তা পড়তে পারবে। যে আল্লাহ তার সৃষ্টি মানুষের মথায় কম্পিউটার আবিষ্কারের জ্ঞান দান করেছেন, ওই আল্লাহ কি এর চেয়েও উন্নত কোন কিছুর মাধ্যমে মানুষের সামান্য এক দেড়শত বছরের কর্মকান্ড ধরে রেখে তা মানুষের হাতে দিতে পারবেন না? নিশ্চয়ই তিনি পারবেন।
মানুষ সৃষ্টিগতভাবে ন্যায় ও ইনসাফের মুখাপেক্ষী। যার দ্বারায় অন্যায় সংঘটিত হয়, সে ব্যক্তিও তা ন্যায় মনে করে সংঘটিত করে না। তার বিবেকই তাকে কর্মটি সম্পর্কে জানিয়ে দেয় যে-এটা অন্যায় কর্ম। সুতরাং মানুষের দ্বারা সংঘটিত যাবতীয় কর্মই দাবি করে যে, এসব কর্মের চুলচেরা বিচার হওয়া উচিত এবং উপযুক্ত কর্মফল লাভ করা উচিত। আল্লাহ রাহমান ও রাহীম, এটা তাঁর অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি মানুষের যাবতীয় কর্মফল যথাযথভাবে দান করার জন্যই ইনসাফের দাবি অনুসারে বিচার দিবস নির্দিষ্ট করেছেন।
0 Comments