মহান আল্লাহ রাহীম-অত্যন্ত দয়াবান


        মহান আল্লাহর গুণবাচক নাম রাহমান ও রাহীম। এ শব্দ দুটো 'রহম' ধাতু থেকে নির্গত ও গঠিত। রহম শব্দের মূল অর্থ হলো অনুগ্রহ বা দয়া। সুরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে তাঁর প্রশংসা করা হয়েছে। প্রশংসা এ জন্য করা হলো যে, তিনি রাব্বুল আলামীন তথা জগতসমূহের রব্ব। তিনি রব্ব কিন্তু তাঁর প্রকৃতি ও স্বভাব কি? এ প্রশ্নের উত্তর এলো, তিনি রাহমান ও রাহীম। তিনি অসীম দয়াবান-করুণাময়। করুণা-মন্ডিত তাঁর রবুবিয়াত। তিনি তাঁর সৃষ্টিসমূহকে প্রতিপালিত করছেন আপন রাহমত দিয়ে। অসীম ভালোবাসা আর করুণা দিয়ে তিনি তাঁর সৃষ্টিসমূহকে লালন-পালন এবং পরিচালিত করছেন। তিনি আপন রাহমত দিয়ে সমস্ত সৃষ্টিকে আবৃত করে রেখেছেন। তাঁর রাহমত সার্বজনীন-সবাই তাঁর রাহমত লাভ করে ধন্য হচ্ছে।

        কিন্তু রাহমান হিসাবে তিনি যে রাহমত করছেন, তা এই পৃথিবীতেই সর্বব্যাপক। আকাশ ও যমীন এবং এর মধ্যে যা কিছুই রয়েছে, এর সবকিছুই তাঁর রাহমত লাভ করে বটে-পক্ষান্তরে এটা কোন স্থায়ী রাহমত নয়। আখিরাতের ময়দানে তাঁর এই রাহমত পৃথিবীর অনুরূপ সার্বজনীনভাবে সবাই লাভ করবে না। সেদিন বিশেষ বিশেষ লোকজন তাঁর রাহমত লাভ করবে এবং সে রাহমতের ধারাবাহিকতা অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে।

        রাহমান ও রাহীম শব্দের ব্যাখ্যায় কোন কোন তাফসীরকার উল্লেখ করেছেন যে, আল্লাহ রাহমান হলেন এই পৃথিবীর জন্য, আর রাহীম হলেন পরকালীন জগতের ক্ষেত্রে। আদালতে আখিরাতে তাঁর বিশেষ রাহমত কিভাবে লাভ করা যেতে পারে, সে পন্থা তিনি অনুগ্রহ করে এই পৃথিবীতেই মানুষকে অবগত করেছেন তাঁর নবী ও কিতাবের মাধ্যমে। মহান আল্লাহর রাহমত-তথা তাঁর গুণাবলী বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন-

قُلْ لَوْ كَانَ الْبَحْرُ مِدَاداً لِكَلِمَتِ رَبِّي لَنَفِدَ الْبَحْرُ قَبْلَ أَنْ تَنْقَدَ كَلِمَتُ رَبِّي وَلَوْ جِئْنَا بِمِثْلِهِ مَدَدا -

        (হে রাসূল!) বলুন, আমার রব্ব-এর কথা লেখার জন্য সমুদ্র কালিতে পরিণত হয় তাহলে সেই সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে কিন্তু আমার রব্ব-এর কথা শেষ হবে না। বরং যদি এ পরিমাণ কালি পুনরায় নিয়ে আসি তবুও তা যথেষ্ট হবে না। (সূরা আল কাহ্ফ-১০৯)

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন যে কত কিছু সৃষ্টি করেছেন এবং এসব সৃষ্টির ওপরে তাঁর রাহমত কিভাবে বর্ষিত হচ্ছে, কোন মানুষের পক্ষে তা গণনা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি তা বর্ণনা করাও সম্ভব নয়। মানুষ সম্মিলিতভাবে যদি তাঁর সৃষ্টিকর্ম এবং দয়া-অনুগ্রহ সম্পর্কে লিখতে চায়, এ ধরনের কোন প্রকল্প যদি মানুষ গ্রহণ করে, শোচনীয়ভাবে তারা ব্যর্থ হবে। আল্লাহ তা'য়ালা সূরা লোকমানের ২৭ আয়াতে বলেন-

وَلَوْ أَنَّ مَا فِي الْأَرْضِ مِنْ شَجَرَةٍ أَقْلَامُ وَالْبَحْرُ يَمُدُّهُ مِنْ بَعْدِهِ سَبْعَةُ أَبْحُرٍ مَّا نَفِدَتْ كَلِمَتُ اللَّهِ - .

        পৃথিবীতে যত গাছ রয়েছে তা যদি সবই কলম হয়ে যায় এবং সমুদ্র (কালিতে পরিণত হয়), তাকে আরো সাতটি সমুদ্র কালি সরবরাহ করে তবুও আল্লাহর কথা (লেখা) শেষ হবে না।

         আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসীম দয়াবান, তাঁর বান্দাদের প্রতি তিনি যে কতভাবে দয়া করেছেন, এই মানুষ যদি ক্ষণিকের জন্যে নীরবে নিভৃতে কোথাও বসে চিন্তা করতো, তাহলে সিজদায় মাথানত হয়ে আসতো। আল্লাহ বলেন-

هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لَكُمْ مِّنْهُ شَرَابٌ وَ مِنْهُ شَجَرٌ فِيْهِ تُسِيمُونَ

        তিনিই আকাশ থেকে তোমাদের জন্য পানি বর্ষন করেন, যা পান করে তোমরা নিজেরাও পরিতৃপ্ত হও এবং যার সাহায্যে তোমাদের পশুদের জন্যও খাদ্য উৎপন্ন হয়। এই পানির সাহায্যে তিনি শস্য উৎপন্ন করেন। (সূরা আন্ নাহল-১০)

        আল্লাহ তা'য়ালা গোটা পৃথিবীকে একই ধারায় সৃষ্টি করেননি। তিনি পৃথিবীর প্রতিটি এলাকাকে নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য দিয়ে চিহ্নিত করেছেন। এ ব্যবস্থার নানা উপকারিতার মধ্যে একটি অন্যতম উপকারিতা হলো, মানুষ নিজের পথ ও গন্তব্য পৃথকভাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়। আল্লাহর এই অসীম রাহমতের গুরুত্ব মানুষ তখনই অনুধাবন করতে পারে, যখন কোন মানুষ এমন কোন মরুপ্রান্তরে যেতে বাধ্য হয় এবং যেখানে এ ধরনের বৈশিষ্ট্যমূলক চিহ্নের প্রায় কোন অস্তিত্বই থাকে না এবং মানুষ প্রতি মুহূর্তে পথ হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত থাকে। জলপথে ভ্রমণের সময় মানুষ এর থেকে আরো বেশী মারাত্মকভাবে আল্লাহর এই বিরাট রাহমতের বিষয়টি অনুভব করতে থাকে।

        কারণ সেখানে পথের চিহ্ন প্রায় থাকেনা বললেই চলে। কিন্তু মরুভূমি ও সমুদ্রের বুকেও মহান আল্লাহ দয়া করে তাঁর বান্দাদের জন্য পথ চেনার জন্য প্রাকৃতিক ব্যবস্থা করে রেখেছেন। সেই ব্যবস্থাটি হলো, প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত মানুষ আকাশের তারকার সাহায্যে পথের সন্ধান করতে সক্ষম হয়। আল্লাহ তাঁর এই রাহমতের কথা এভাবে বলেছেন-

والقى فِي الْأَرْضِ رَوَاسِيَ أَنْ تَمِيدَ بِكُمْ وَأَنْهُرًا وسُبُلًا لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ وَعَلِّمْت وَبِالنَّجْمِ هُمْ يَهْتَدُونَ

        তিনি নদী প্রবাহিত করেছেন এবং প্রাকৃতিক পথনির্মাণ করেছেন, যেন তোমরা গন্তব্যে পৌছতে সক্ষম হও। তিনি ভূ-পৃষ্ঠে পথনির্দেশক চিহ্নসমূহ রেখে দিয়েছেন এবং তারকার সাহায্যেও মানুষ পথনির্দেশ লাভ করে থাকে। (সূরা আন্ নাহল-১৫-১৬)

        মানুষ আল্লাহর সৃষ্টি সমস্ত নিয়ামত ভোগ করে, কিন্তু ভোগকৃত জিনিস সম্পর্কে চিন্তা করে দেখে না, যা ভোগ করা হচ্ছে এগুলো কে দিলেন-কিভাবে দিলেন। চোখে অনেক কিছু দেখে, কিন্তু সেসব দৃশ্য নিয়ে কখনো চিন্তা করে দেখে না। পাখি অসীম নীলিমায় ডানা ঝাল্টিয়ে উড়তে থাকে, তারপর এক সময় ডানা ঝাপ্টানো বন্ধ করে তা দু'দিকে মেলে দিয়ে স্থির হয়ে উড়ে বেড়ায়। চিল, শকুন ও বাজ পাখিই এ ধরনের অবস্থায় বেশী থাকে। মানুষ এ দৃশ্য দেখে কিন্তু তাদের মনে কোন বিস্ময় সৃষ্টি হয় না, এসব নিয়ে তারা চিন্তা করে না, কে তিনি-যিনি পাখিকে আপন রাহমত দিয়ে এভাবে থাকার তওফিক দিলেন? আল্লাহ বলেন-

أَلَمْ يَرَوْا إِلَى الطَّيْرِ مُسَخَّرَاتٍ فِي جَوَ السَّمَاءِ مَا يُمْسِكُهُنَّ إِلَّا اللَّهُ 

        এরা কি কখনো পাখিদের দেখেনি, আকাশ নিঃসীমে কিভাবে তারা নিয়ন্ত্রিত রয়েছে? আল্লাহ ব্যতিত কে তাদেরকে ধরে রেখেছে? (সূরা আন্ নাহল-৭৯)

        দাম্পত্য জীবনে মানুষ স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততি নিয়ে পরম শান্তির একটি নিবিড় গৃহকোণে সৃষ্টি করে। মানুষের জন্য আল্লাহ তা'য়ালা পশু সৃষ্টি করেছেন এবং সে পশুর মধ্যে অসংখ্য উপকারিতা রেখেছেন। পশুর গোস্ত মানুষ ভক্ষণ করে, এর রক্ত, হাড় ও অন্যান্য বর্জ্য পদার্থ দিয়ে ক্ষেতে সারের কাজ চালায়। পশুর চামড়া দিয়ে পোষাক, পাদুকা ও তাঁবু নির্মাণ করে। এই তাঁবু প্রয়োজনে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে স্থানান্তরিতও করতে পারে। আল্লাহ বলেন-

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِّنْ بُيُوتِكُمْ سَكَنًا وَجَعَلَ لَكُمْ مِّنْ جُلُودِ الْأَنْعَامِ بُيُوتًا تَسْتَخِفُونَهَا يَوْمَ ظَعْنِكُمْ وَيَوْمَ إِقَامَتِكُمْ وَمِنْ أَصْوَفِيْهَا وَأَوْبَارِهَا وَأَشْعَارِهَا أَثَاثًا وَمَتَاعًا إِلَى حِينٍ

        আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের ঘরগুলোকে বানিয়েছেন শান্তির আবাস। তিনি পশুদের চামড়া থেকে তোমাদের জন্য এমনসব ঘর নির্মাণ করে দিয়েছেন যেগুলোকে তোমারা ভ্রমণকালে ও স্বগৃহে অবস্থানকালে-উভয় অবস্থাতেই সহজে বহন করতে পারো। তিনি পশুদের পশম, লোম ও চুল থেকে তোমাদের জন্য পরিধেয় ও ব্যবহার-সামগ্রীসমূহ সৃষ্টি করেছেন, যা জীবনের নির্ধারিত সময় পর্যন্ত তোমাদের কাজে লাগবে। (সূরা আন্ নাহল-৮০) সূর্যের তাপে মানুষ কষ্ট পাবে, এটাও আল্লাহ সহ্য করেননি। এ পৃথিবীতে তিনি এমন অসংখ্য বৃক্ষ সৃষ্টি করেছেন, যা মানুষকে ছায়াদান করবে, মেঘের ব্যবস্থা করেছেন, সূর্যকে আড়াল করে মানুষের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করে দিবে। মানুষ ঠান্ডায় কষ্ট পাবে, এ জন্য তিনি পশুর পশম থেকে পোষাক প্রস্তুত করার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন, আবার এমন ধরনের পোষাকের ব্যবস্থাও তিনি করেছেন, যা মানুষের ঊর্ধ্বজগত ভ্রমণে সহায়ক হয়, যুদ্ধে ব্যবহার করে, মরুভূমির লু-হাওয়া থেকে হেফাজত করে। এভাবে অসংখ্য কাজে মানুষ তিন্ন ভিন্ন পোষাক ব্যবহার করবে, এ জন্য আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে পৃথক পোষাকের ব্যবস্থা করেছেন। এসবই হলো তাঁর দয়া এবং অনুগ্রহ। তাপ ব্যতিত এই পৃথিবীতে কোন কিছুই জন্ম নিতে পারে না। আল্লাহ দয়া করে সূর্যে তাপ দান করেছেন, যেন তা মানুষের কল্যাণ করতে পারে। পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে ঐ তাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে না, সূর্য প্রতি সেকেন্ডে যে পরিমাণ তাপ নির্গত করছে। মানুষ নিজের আবাসস্থল নির্মাণ করবে, সেখানে সে মানসিক প্রশান্তি, স্থিতি ও স্বস্তি লাভ করবে।

        এই ঘর বানানোর উপকরণও তিনিই দান করেছেন। যেখানে ইট, পাথর, কাঠ, টিন দিয়ে ঘর বানানোর পরিবেশ নেই, আল্লাহ তা'য়ালা সেখানে পশুর চামড়া দান করেছেন। তাপমাত্রা যেখানে হিমাঙ্কের নীচে অবস্থান করতে থাকে। বরফের দেশ, সেখানে মানুষ তাঁবু নির্মাণ করে পশুর চামড়া দিয়ে। সেই তাঁবু দিয়ে ঘর বানিয়ে মানুষ বাস করে। মানুষের যেখানে যে অবস্থায় যা প্রয়োজন, তিনি সেখানে তাই দান করে বান্দার প্রয়োজন পূরণ করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمْ مِّمَّا خَلَقَ ظِلُلاً وَجَعَلَ لَكُمْ مِّنَ الْجِبَالِ أَكْنَانًا وَجَعَلَ لَكُمْ سَرَابِيلَ تَقِيكُمُ الْحَرِّ وَسَرَابِيلَ تَقِيكُمْ بَأْسَكُمْ كَذَالِكَ يُتِمُّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكُمْ لَعَلَّكُمْ تُسْلِمُونَ

        তিনি নিজের সৃষ্ট বহু জিনিস থেকে তোমাদের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা করেছেন, পাহাড়ে তোমাদের জন্য আশ্রয় নির্মাণ করেছেন এবং তোমাদের এমন পোষাক দিয়েছেন, যা তোমাদের গরম থেকে রক্ষা করে আবার এমন কিছু অন্যান্য পোষাক তোমাদের দিয়েছেন যা পারস্পরিক যুদ্ধে তোমাদের হেফাজত করে। এভাবে তিনি তোমাদের প্রতি তাঁর নিয়ামতসমূহ সম্পূর্ণ করেন, হয়তো তোমরা অনুগত হবে।
 (সূরা আন্ নাহল-৮১)

            পৃথিবীর মানুষের প্রতি তিনি তাঁর নিয়ামতসমূহ পূর্ণ করেছেন-এ কথার অর্থ হলো, এখানে মানুষের জীবন ধারনের জন্য যেসব উপায়-উপকরণ প্রয়োজন, তার কোন কিছুই তিনি বাদ রাখেননি। সবকিছুই তিনি পরিপূর্ণভাবে দান করেছেন। শুধু তাই নয়, মানুষ এই পৃথিবীতে আল্লাহ সম্পর্কে যে ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করে, এর জবাবে আল্লাহ সাথে সাথে গযব দিয়ে মানুষের ঠুনকো অহঙ্কার চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতেন।

        সূরা নূরে বলা হয়েছে, মানুষের প্রতি তাঁর অসীম দয়া ও করুণা না থাকলে মহাশাস্তি নেমে আসতো। ইবলিস শয়তান, জ্বিন শয়তান, মানুষ শয়তান ও নম্স শয়তান প্রতি মুহূর্তে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে থাকে। এসব শক্তি মানুষকে ধ্বংসের পথে পরিচালিত করে। এদের কবল থেকে হেফাজত করার জন্যই তিনি মানুষকে সঠিক পথপ্রদর্শনের জন্য অনুগ্রহ করে নবী দিয়েছেন-কিতাব দিয়েছেন। মানুষ যদি নবী ও কিতাব লাভ না করতো, তাহলে সে নিজের শক্তিতে কোনক্রমেই সত্যপথের সন্ধান পেতো না, ফলশ্রুতিতে ধ্বংস গহ্বরে নিমজ্জিত হতো। আল্লাহ অসীম করুণা করেছেন তাঁর বান্দার প্রতি। কোরআন মানুষকে এই করুণার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছে-

يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ وَمَنْ يُتبع خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ فَإِنَّهُ يَأْمُرُ بِالْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَوْلا فَضْلُ اللهِ عَلَيْكُمْ وَرَحْمَتُهُ مَازَكَى مِنْكُمْ مِّنْ أَحَدٍ أَبَدًا - (نُور )

        হে ঈমানদারগণ! শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলো না। যে কেউ তার অনুসরণ করবে তাকে সে অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ করার জন্য অনুপ্রাণিত করবে। যদি তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণা না থাকতো তাহলে তোমাদের একজনও পবিত্র হতে পারতে না। কোরআন না থাকলে মানুষের পক্ষে কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা তা জানার কোন উপায় ছিল না। তেমনি মহাশূন্য আর পৃথিবীর বস্তু নিচয় সম্পর্কে কোরআনের সাহায্য ব্যতিত সঠিক তথ্য লাভ করা মানুষের পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হতো না। এটা আল্লাহর অসীম অনুগ্রহ যে, তিনি গোটা পৃথিবীর ভূ-মন্ডলকে একই ধরনের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত করেননি। একে বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত করেছেন, যা পরস্পর মিলিত ও সংযোজিত হওয়ার পরও এর রূপ, বর্ণ, গন্ধ, গঠন-প্রণালী, উপাদান, বিশেষত্ব, উর্বরা শক্তি, উৎপাদন যোগ্যতা ও রাসায়নিক অথবা খনিজ সম্পদের দিক দিয়ে পরস্পর বিভিন্ন প্রকারের। আল্লাহ তা'য়ালা এই ব্যবস্থা করেছেন, এর মধ্যে মানুষের জন্য অসংখ্য কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।

        একই যমীনের পাশাপাশি দুটো গাছ অবস্থান করছে, মাটির গঠন প্রণালী ও রাসায়নিক গুণাগুণও একই ধরনের। একই সার ও পানি লাভ করার পরেও দুটো গাছের ফুল ও ফল দু'ধরনের। খেজুর গাছ থেকে শীত মৌসুমে সুস্বাদু রস নির্গত হয়। এই গাছের পাশেই এমন গাছ অবস্থান করছে যার ফলের স্বাদ অম্ল বা তিক্ত। খেজুর গাছ যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে গভীর গর্ত করেও এক ফোটা সুস্বাদু রস পাওয়া যাবে না। আল্লাহ রাহমান ও রাহীম, তিনি দয়া করে তাঁর বান্দাদের জন্য এমন ব্যবস্থা করেছেন। সূরা রাদ-এর আল্লাহ বলেন-

وَفِي الْأَرْضِ قطع مُتَجَاوِرَاتٌ وَجَنَتٌ مِّنْ أَعْنَابٍ وَزَرْعُ وَ نَخِيلٌ صِنْوَانٌ وَغَيْرُ صِنْوَانٍ يُسْقَى بِمَاءٍ وَاحِدٍ وَنُفَضِّلُ بَعْضَهَا عَلَى بَعْضٍ فِي الْأُكُلِ

        আর লক্ষ্য করো, পৃথিবীতে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চল রয়েছে, যা মূলত পরস্পর সংযুক্ত। আঙ্গুরের বাগান রয়েছে, ক্ষেত-খামার রয়েছে, খেজুরের গাছ রয়েছে, যাদের কিছু এক কান্ডবিশিষ্ট এবং কিছু দ্বৈত কান্ডবিশিষ্ট। একই পানি সবকিছুকেই সিক্ত করে; কিন্তু স্বাদের দিক দিয়ে আমি কিছুকে অত্যন্ত সুস্বাদু বানিয়ে দিই এবং কিছুকে ভিন্ন স্বাদের বানিয়ে দিই।

        আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের জন্য এমনভাবে রাহমত করেছেন যে, মাটির ওপরে মানুষ বাস করছে, এই মাটিকে তিনি এমনভাবে গঠন করেছেন যে-মানুষের প্রয়োজনে এই মাটি কর্দমাক্ত হয়ে যায়। মৃত্তিকা শিল্পে নিয়োজিত লোকজন এই মাটিকে যেমনভাবে খুশী, তারা তা তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারছে। মাটি দিয়ে তারা মানুষের ব্যবহার যোগ্য তৈজষ-পত্র নির্মাণ করছে। ইট প্রস্তুত করে তা দিয়ে বিশাল বিশাল অট্টালিকা নির্মাণ করছে। কৃষক এই মাটিকে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করছে।

        এই মাটিকে এতটা নরম করা হয়েছে যে, তার ভেতরে গর্ত করে পানি বের করা হচ্ছে। ওজন সহ্য করার মতো গুণ আল্লাহ তা'য়ালা এই মাটির ভেতরে দান করেছেন। অগণিত অট্টালিকা এই মাটির ওপরে নির্মাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। আল্লাহর এই রাহমত লাভ করেও মানুষ যদি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে, তাঁর দাসত্ব ও প্রশংসা না করে, তাহলে আল্লাহর আযাব যে অকৃজ্ঞদেরকে গ্রেফতার করবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ বলেন-

وَالْأَرْضَ مَدَدْنَهَا وَالْقَيْنَا فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْبَتْنَا فِيهَا مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ تَبْصِرَةً وَذِكْرَى لِكُلِّ عَبْدٍ مُنِيبٍ وَنَزَّلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً مُبرَ كَافَأَنْبَتْنَا بِهِ جَنَّتِ وَحَبِّ الْحَصِيدِ وَالنَّخْلَ بسِقْت لَهَا طَلْعُ نَضِيدٌ

        আর আমি পৃথিবীকে বিছিয়ে দিয়েছি এবং তাতে পাহাড়সমূহ সংস্থাপন করেছি এবং এর মধ্যে সর্বপ্রকারের সুদৃশ্যময় উদ্ভিদরাজি উৎপাদন করেছি। এসব কিছুই চক্ষু উন্মোচনকারী ও অতীব শিক্ষাপ্রদ-এমন প্রতিটি বান্দার জন্য, যে প্রকৃত সত্যের দিকে প্রত্যাবর্তনকরে। আর আমি ঊর্ধ্বজগৎ থেকে অতীব বরকতময় পানি অবতীর্ণ করেছি। তারপর তার সাহায্যে বাগান ও কৃষিজাত শস্যাদি এবং সুউচ্চ সমুন্নত খেজুর বৃক্ষ সৃষ্টি করেছি, যার ভেতরে ফলের সম্ভারপূর্ণ ছড়া একের পর একটা ধরে।
 (সূরা ক্বাফ-৭-১০)

        মানুষকে আহার দান করার জন্য আল্লাহর রাহমত কিভাবে সক্রিয় রয়েছে তা লক্ষ্য করে দেখার মতো। মানুষ ক্ষেতে বীজ বপন করে বাড়িতে গিয়ে হিসাব নিকাশ করা শুরু করে, এবারে সে কত মণ ফসল ক্ষেত থেকে লাভ করবে। আল্লাহ তা'য়ালা ইচ্ছা করলে সে ফসলে কোন দানা না দিয়ে ভূষিতে পরিণত করে দিতে পারতেন। তিনি তা না করে বীজকে আদেশ দেন তা যেন অঙ্কুরিত হয়। বীজ অঙ্কুরিত হয়ে গাছ বের হলো। শিকরগুলো যমীনের গভীরে যেতে থাকলো। মাটিতে যে উপাদান রয়েছে, তা শিকরগুলো শোষণ করতে থাকলো। কিন্তু যমীনের ওপরে গাছের সদ্যজাত পাতাগুলো সূর্যের প্রখর তাপে নুয়ে পড়লো। এমনভাবে তা নুয়ে পড়ে যে, দেখলে মনে হয় এই গাছ আর হবে না।

        সুতরাং, ফসল লাভেরও কোন আশা নেই। কৃষক হতাশ হয়ে পড়ে। দিনের বেলা সূর্য প্রখর তাপ বিকিরণ করে পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। দিবাবসানে রাতের অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। নিশীথ শিশির আল্লাহর রাহমত হিসাবে ঊর্ধ্বজগৎ থেকে ঝরতে থাকে। বইতে থাকে স্নিগ্ধ শীতল দক্ষিণা মলয় সমীরণ। কণা কণা নিশীথ শিশির বিন্দু আর শীতল সমীরণ-উভয়ের সমন্বিত মমতা সিক্ত যত্নে নুয়ে পড়া সদ্য প্রস্ফুটিত পাতাগুলো পুনরায় সজীব-প্রাণবন্ত হয়ে যায়। এভাবে আল্লাহ তাঁর রাহমত দিয়ে গাছ বড় করেন, ফুলের সৃষ্টি করে তার ভেতরে ফলদান করেন। এই ফলগুলো আল্লাহ আবরণহীন দেন না। প্রতিটি দানা ও ফলই খোসা দিয়ে আবৃত করে দেন। পরম যত্নে এসব কিছুকে তিনি উৎপাদন করে তাঁর সম্মানিত বান্দার হাতে তুলে দিয়ে বলেন, এসব খাও আর আমার দাসত্ব করো-আমারই প্রশংসা করো।

        মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি অসীম স্নেহশীল। তিনি তাঁর বান্দার যা প্রয়োজন হবে, তা বান্দাহ না চাইতেই দান করেছেন। তিনি রোগ সৃষ্টি করেছেন, রোগে বান্দাহ আক্রান্ত হবে এ জন্য তিনি ওষুধ সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীতে এমন কোন রোগ নেই যে রোগের ওষুধ আল্লাহ দেননি। সমুদ্রের মধ্যে আল্লাহ মাছ দিয়েছেন, এমন অনেক মাছ রয়েছে, যার তেল ও কাঁটা দিয়ে বিভিন্ন রোগের ওষুধ প্রস্তুত করা হয়। অসংখ্য উদ্ভিদ তিনি সৃষ্টি করেছেন, যা বিভিন্ন রোগের ওষুধ হিসাবে ব্যবহার হয়ে থাকে। বনৌষধি সম্পর্কে যারা ধারণা রাখে, তারা জানে কোন গাছ দিয়ে কোন রোগের উপশম হয়।

        পাহাড়-পর্বত, মরুভূমি, গ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে কোন ডিগ্রীধারী ডাক্তার নেই, সেখানের মানুষ যেন রোগ যন্ত্রণায় কষ্ট না পায়, এ জন্য অসীম দয়ালু আল্লাহ তাদের হাতের কাছেই নানা ধরনের উদ্ভিদ দান করেছেন, যেন তারা এসব ব্যবহার করে রোগ থেকে মুক্তি লাভ করতে পারে। মানুষ তরকারীতে যেসব মসল্লা ব্যবহার করে, তার প্রতিটি মসল্লা-ই বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রতিষেধক। তরকারী হিসাবে যেসব সব্জী আহার করা হয়, সেগুলোও রোগের প্রতিষেধক।

সজনে ডাটা এমন ঋতুতে আল্লাহ তা'য়ালা দিয়ে থাকেন, যে ঋতুতে মানুষ পানি পক্সে আক্রান্ত হতে পারে। এই সজনে ডাটার ভেতরে রয়েছে পানি পক্সের প্রতিষেধক। বরই বা কুল-এর ভেতরেও রয়েছে বসন্ত রোগের প্রতিষেধক। কম দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন যারা, তাদের জন্য কচু শাকের ভেতরে রয়েছে প্রতিষেধক। কচু শাক আহার করলে দৃষ্টিশক্তি বৃদ্ধি লাভ করে।

উচ্ছে বা করলার ভেতরে রয়েছে বসন্ত রোগের প্রতিষেধক। এই সব্জী ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখে। এর রস প্রতিদিন সকালে অন্য কিছু আহার করার পূর্বে পান করলে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। যেখানে বসন্ত রোগের টিকা গ্রহণ করার কোন ব্যবস্থা নেই, সেখানের মানুষ এসব আহার করে ঐ সমস্ত রোগ থেকে মুক্ত থাকতে পারে, এ জন্য দয়াময় আল্লাহ নানা ধরনের সব্জীর ভেতরে রোগ প্রতিষেধক ক্ষমতা দিয়ে তা সহজ লভ্য করে দিয়েছেন।

        ঠান্ডা প্রবণ যারা অর্থাৎ যারা অতি সহজেই সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হয়, সামুদ্রিক কটক মাছের তেলের ভেতরে তাদের জন্য প্রতিষেধক রেখে দিয়েছেন। পরিমিত পরিমাণ ঐ মাছের তেল আহার করলে সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত হবার কোন সম্ভাবনা থাকে না। যারা বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত, নিয়মিত মেথী আহার করলে বহুমূত্র রোগ তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কালোজিরা সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল বলেছেন, 'কালোজিরা মৃত্যু ব্যতিত সকল রোগের ওষুধ।' যে কোন রোগ উপশমে কালোজিরার ভূমিকা অদ্বিতীয়। সদ্য প্রসূতিকে কালোজিরা আহার করালে তার শরীরের ব্যথা দ্রুত উপশম হয়। যে কোন বাতে আক্রান্ত ব্যক্তি কালোজিরা নিয়মিত আহার করলে বাতের ব্যথা উপশম হয়।

        মধু সম্পর্কে আল্লাহ তা'য়ালা কোরআনে বলেছেন, এর মধ্যে মানুষের জন্য নিরাময় রয়েছে। মধু যে একটি উপকারী ও কল্যাণময় এবং সুস্বাদু খাদ্য তা কোন মানুষেরই বোধহয় অজানা নেই। এই মধুর ভেতরে যে রোগ নিরাময় শক্তি নিহিত রয়েছে, একথাটা তুলনামূলকভাবে অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গিয়েছে। মধু স্বয়ং কোন কোন রোগে এমনিতেই উপকারী।

        এই মধুর মধ্যে রয়েছে ফুল ও ফলের রস এবং তাদের উন্নত মানের গ্লুকোজ। মধুর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, তা স্বয়ং পচে না এবং অন্য জিনিসকেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত নিজের মধ্যে পচন থেকে সংরক্ষিত রাখে। এ কারণে ওষুধ প্রস্তুত করার সময় মধুর সাহায্য গ্রহণ করার মতো গুণগতমান এর ভেতরে সৃষ্টি হয়। এ জন্যই ওষুধ নির্মাণ শিল্পে এ্যালকোহলের পরিবর্তে মধুর ব্যবহার চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। এটা ছাড়াও মৌমাছি যদি এমন কোন এলাকায় বাসা বাঁধে যেখানে কোন বিশেষ ধরনের বনৌষধি বিপুল পরিমাণে সহজ লভ্য হয় তাহলে সেই এলাকার মধু নিছক মধুই থাকে না, বরং তা ঐ ঔষধির সর্বোত্তম উপাদান ধারণ করে এবং যে রোগের ওষুধ আল্লাহ ঐ ঔষধির মধ্যে দিয়েছেন, তার জন্য সেটাও উপকারী হয়।

        গবেষকগণ বলেন, যদি পরিকল্পিত উপায়ে মধুমক্ষিকাদের দিয়ে এ কাজ করানো হয় এবং বিভিন্ন ঔষধি বৃক্ষের উপাদান তাদের মাধ্যম্যে নির্গত করে তাদের মধু পৃথক পৃথকভাবে সংরক্ষিত করা হয়, তাহলে সেই মধু গবেষণাগারে প্রস্তুত উপাদানের থেকেও অধিক কল্যাণকর বলে প্রমাণিত হবে। এই মধু সম্পর্কে আল্লাহ কোরআনে উল্লেখ করেছেন এবং মৌমাছির নামে একটি সূরা রয়েছে। সে সূরাটির নাম হলো নাহল। আরবী নাহল শব্দের অর্থ হলো মৌমাছি। আল্লাহর কোরআন বলছে-

وأوحى رَبُّكَ إِلى النَّخْلِ أَنِ اتَّخذى مَنَ الْجِبَالِ بُيُوتًا وَ مِنَ الشَّجَرِ وَمِمَّا يَعْرِشُونَ - ثُمَّ كُلِي مِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ فَاسْلُكِي سُبُلَ رَبِّكِ ذُلُلاً - يَخْرُجُ مِنْ بُطُونِهَا شَرَابٌ مُّخْتَلِفٌ أَلْوَانُهُ فِيهِ شِفَاء لِلنَّاسِ -

        আর দেখো তোমার রব্ব মৌমাছিদেরকে এ কথা ওহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেন, তোমরা পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মাচার ওপর ছড়ানো লতাগুল্মে নিজেদের চাক নির্মাণ করো। তারপর সব ধরনের ফলের রস শোষণ করে নিজের রব্ব-এর তৈরী করা পথে চলতে থাকে। এই মাছির ভেতর থেকে একটি বিচিত্র রংগের শরবত বের হয়, যার মধ্যে রয়েছে নিরাময় মানুষের জন্য। (সূরা আন নাহল-৬৮-৬৯)

        করুণাময় আল্লাহ মধুমক্ষিকাদেরকে যেখানে যেখানে আদেশ করেছেন, তারা সেখানেই চাক নির্মাণ করে। পাহাড়ী এলাকায় যেসব মানুষ বাস করে, তারা যেন মধু সংগ্রহ করে তা থেকে উপকারিতা গ্রহণ করতে পারে, এ জন্য তাদের প্রতি আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন পাহাড়ে চাক বাঁধে। যে এলাকায় পাহাড় নেই, সে এলাকার মানুষ মধু থেকে যেন বঞ্চিত না হয়, এ জন্য তাদের প্রতি আদেশ দেয়া হয়েছে, তারা যেন গাছে চাক নির্মাণ করে। আর যে এলাকায় পাহাড় নেই, গাছও তেমন নেই, সে এলাকায় মৌমাছি চাক বাঁধে বড় বড় বিল্ডিংয়ের কার্ণিশে বা ঘরের মাচানের সাথে।

        আল্লাহ রাহমান, তিনি তাঁর বান্দাকে যাবতীয় কল্যাণ দান করেছেন। মধুর মতো উপকারী জিনিস থেকে কোন এলাকার মানুষ যেন বঞ্চিত না থাকে, এ জন্য তিনি মৌমাছির ওপরে যথাস্থানে চাক বাঁধার আদেশ দিয়েছেন। মৌমাছি শুধু মধুই সংগ্রহ করে না। এরা ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর মাধ্যমে ফুলের পরাগ সংযোগ ঘটায়। এমন অসংখ্য উদ্ভিদ রয়েছে, যারা পরাগায়নের জন্য একান্তভাবে মৌমাছির ওপরে নির্ভরশীল। প্রাণী বিজ্ঞানীগণ এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার প্রজাতির মৌমাছির সন্ধান পেয়েছেন।

        এদের চাক নির্মাণের কৌশল দেখলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হতে হয়। মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাদেরকে সেই কৌশল শিক্ষা দিয়েছেন। প্রতিটি মৌচাকে মৌমাছিদের মধ্যে একজন রাণী মৌমাছি থাকে। এদের মধ্যে কিছু পুরুষ মৌমাছি ও কর্মী মৌমাছি রয়েছে। আর স্থান-পরিবেশের কারণে এরা বিভিন্ন ধরনের চাক নির্মাণ করে থাকে। মৌচাক অসংখ্য ষড়ভূজের সমষ্টি অর্থাৎ প্রতিটি প্রকোষ্ঠ ছয়টি বাহু দ্বারা সীমাবদ্ধ। এই বাহুগুলো মোম দিয়ে নির্মিত। আবার মোম তৈরী হচ্ছে মৌমাছির পেটের ওপরের অংশে অবস্থিত গ্রন্থী থেকে নিঃসৃত লালার মাধ্যমে। মৌমাছিরা মোমকে চিবাতে থাকে ফলে মুখের লালার সাথে তা মিশে যায়। তখন তারা তা পাতলা বেড়ি আকারে মৌচাকের মধ্যে প্রকোষ্ঠ নির্মাণ করে। 

        মৌমাছিরা যে আশ্চর্যজনকভাবে ষড়ভুজ রচনা করে তা অত্যন্ত কার্যকর প্রক্রিয়ায় খুবই অল্প জায়গার মধ্যে নির্মিত হয়। তারা এসব প্রকোষ্ঠে মধু সঞ্চিত করে। এই প্রকোষ্ঠগুলো আবার দুইভাবে নির্মাণ করা হয়। ছোট আকারের প্রকোষ্ঠে কর্মী মৌমাছি বাস করে এবং এতে পরাগরেণু ও মধু সঞ্চিত থাকে। বড় আকারের প্রকোষ্ঠগুলোয় পুরুষ মৌমাছি বাস করে। এক পাউন্ড মোম দিয়ে প্রায় পঁয়ত্রিশ হাজার প্রকোষ্ঠ নির্মিত হতে পারে এবং এই পরিমাণ কক্ষে প্রায় দশ কেজি মধু সঞ্চয় করা যায়।

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন দয়া করে মধুর ব্যবস্থা করেছেন। মানুষ এই মধু পান করে কিন্তু এ সম্পর্কে চিন্তা করে না, কিভাবে আল্লাহর নির্দেশে মধুমক্ষিকারা মধু সঞ্চয় করে মানুষকে উপহার দেয়। মাত্র আধা কেজি মধু উৎপাদন করার জন্য পাঁচশত পঞ্চাশটি মৌমাছিকে অনূন্য পঁচিশ লক্ষ ফুল থেকে রস ও পরাগ সংগ্রহ করতে হয়। আর এ জন্য তাদেরকে পঁচাত্তর হাজার বার ফুলে ফুলে ভ্রমণ করতে হয়। যখন ফুল থাকে না, তখন তারা ফল থেকে মধু সংগ্রহ করে। একটি মৌচাকে ত্রিশ থেকে ষাট হাজার কর্মী মৌমাছি থাকে। মধুর ভেতরে আনুপাতিক হারে লেভলুজ থাকে চল্লিশ দশমিক পাঁচ ভাগ। ডেক্সট্রোজ চৌত্রিশ ভাগ। সুক্রোজ এক দশমিক নয় ভাগ। পানি সতের দশমিক সাত ভাগ। ডেক্সট্রিন ও গাম এক দশমিক নয় ভাগ। এ্যাশ থাকে শূন্য দশমিক আঠার ভাগ। এছাড়া মধুতে রয়েছে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি কমপ্লেক্সের সদস্য, নানা ধরনের এনজাইম, খনিজ পদার্থ, সিলিকা, ম্যাঙ্গানিজ, ক্লোরিন, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ফসফরাস, সালফার, এ্যালুমিনিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম।

         মধু বাতাস থেকে পানি শোষণ করে এ জন্য মধু কখনো জমাট বাঁধে না। মধুর ভেতরে বিভিন্ন ধরনের রোগে উপশমের উপাদান বিদ্যমান। এর অসংখ্য উপকারিতা রয়েছে। আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদেরকে এই মধু দান করেছেন। আল্লাহ বলেন-

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُّحْسِنُونَ

        আল্লাহ তাদের সাথে আছেন যারা তাকওয়া অবলম্বন করে এবং যারা সৎকর্মপরায়ণ। (নাহ) আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত স্নেহ, মায়া ও বদান্যতা প্রবণ। তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্মদর্শিতার সাথে তার এমন ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রয়োজনের প্রতিও লক্ষ্য রাখেন যোখানে কারো দৃষ্টি যায় না। সে প্রয়োজনগুলো তিনি এমনভাবে পূরণ করেন যে, বান্দা নিজেও উপলব্ধি করতে পারে না কে কখন তার কোন প্রয়োজন পূরণ করেছে। মহান আল্লাহর এই দয়া ও মেহেরবানী তাঁর সমস্ত বান্দার জন্য। পবিত্র কোরআন বলছে-

اللهُ لَطِيفٌ بِعِبَادِهِ يَرْزُقُ مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ الْقَوِيُّ الْعَزِيزُ

        আল্লাহ তাঁর বান্দার প্রতি অত্যন্ত দয়াবান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাই দান করেন। তিনি মহা, শক্তিমান ও মহা পরাক্রমশালী। (সূরা শূরা-১৯)

Post a Comment

0 Comments