ক্ষমা প্রার্থনাকারীকে তিনি ভালোবাসেন

 

        পরম প্রিয় সন্তানও যখন বিদ্রোহী হয়ে ওঠে, মাতা-পিতাও তাকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে স্বেচ্ছায় তুলে দেয়-পৃথিবীতে এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমনকি বিদ্রোহী-অপরাধী সন্তানকে জন্মদাতা পিতা, গর্ভধারিণী মাতা আপন হাতে হত্যা করতেও দ্বিধান্বিত হন না। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পরে মাতা-পিতার যে হাত দুটো পরম মমতায় সন্তানকে বুকে তুলে নিয়েছিল, সন্তানকে রক্ষার জন্য প্রয়োজনে নিজের জীবন বিপন্ন করার জন্য অনুক্ষণ প্রস্তুত ছিল, মাতা-পিতার সেই মমতার হাতই একদিন সময়ের বিবর্তনে সন্তানের মুখে জীবন সংহারী নীলকণ্ঠ-গরলে পরিপূর্ণ পাত্র উঠিয়ে দেয়।

        পক্ষান্তরে এই মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, সেই মহান স্রষ্টা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসীম ধৈর্য্যশীল। তাঁরই সৃষ্টি বান্দাহ তাঁর অস্তিত্ব, গুণাবলী, শক্তি, রাহমত, বিধানাবলী সম্পর্কে অসহনীয় কটুক্তি করে, তাঁর বিধানের ধারক-বাহকদেরকে হত্যা করে, তাঁরই সৃষ্টি পৃথিবী থেকে তাঁর নাম-নিশানা মুছে দেয়ার চেষ্টা-সাধনা করে, অথচ তিনি নির্বাকার।

        তিনি পরম মমতাভরে-করুণাসিক্ত দৃষ্টিতে বিদ্রোহী-মারাত্মক অপরাধী বান্দাকে দেখতে থাকেন। সমস্ত সৃষ্টিকে বিদ্রোহী বান্দার খেদমত থেকে বিরত থাকার কোনই আদেশ দেন না। যাবতীয় নিয়ামতসমূহ ভোগ করার সুযোগ দেন। আপন ঔদার্য্য আর বদান্যতা বার বার প্রদর্শন করে অপরাধীকে সংশোধনের নীরব আহ্বান জানান। তাঁর ক্ষমা বিদ্রোহী আর অপরাধীর পেছনে ছুটতে থাকে। আল্লাহর রাহমত বিদ্রোহী-অপরাধী বান্দাকে যেন ডাক দিয়ে বলতে থাকে, অপরাধ করেছো তো কি হয়েছে-তুমি মানুষ। তোমার ভেতরে রয়েছে অপরাধ প্রবণতা। তুমি অপরাধ করবেই। আল্লাহর ক্ষমা তোমার সাথেই রয়েছে, তিনি তোমার দিকে ক্ষমার হাত প্রসারিত করে রেখেছেন। শোন, তোমার রব্ব তোমাকে কি বলছেন-

وَإِنَّ رَبِّكَ لَذُو مَغْفِرَةٍ لِلنَّاسِ عَلَى ظُلْمِهِمْ وَإِنَّ رَبِّكَ لَشَدِيدُ الْعِقَابِ .

        তোমার রব্ব মানুষের অত্যাধিক বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শনই করে থাকেন। আর এ কথাও সত্য যে, তোমার রব্ব কঠিন শাস্তিদাতা। (সূরা আর রা'দ-৬)

        উল্লেখিত আয়াতে এ কথা বলা হয়নি যে, 'তোমাদের আল্লাহ মানুষের অত্যাধিক বাড়াবাড়ি সত্ত্বেও তাদের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে থাকেন'-বরং বলা হয়েছে তোমাদের রব্ব। অর্থাৎ পৃথিবীতে আবহমান কাল থেকে মানুষ আল্লাহর রবুবিয়াত নিয়েই বাড়াবাড়ি করেছে এবং এখনো করছে। আল্লাহকে আইনদাতা-বিধানদাতা হিসাবে গ্রহণ করতে চায়নি। এরপরও তিনি তাদের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ বর্ষণ করেই যাচ্ছেন। তিনি বিদ্রোহীদের প্রতি-তাঁর অবাধ্য বান্দাদের প্রতি ক্ষমা ও দয়ার যে হাত প্রসারিত করে রেখেছেন, তা তিনি সঙ্কুচিত করেননি।

        আল্লাহর ক্ষমার এই সুযোগ লাভ করে বিদ্রোহীরা যদি আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে, তখন তাদেরকে বলা হয়েছে, তোমরা আমার ক্ষমা আর দয়া দেখে ভাবছো, তোমাদেরকে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে? আসলে তোমরা ভুল ধারণা পোষণ করছো। আমি যেমন দয়া-অনুগ্রহ করেছি, তেমনি আমি কঠিন শাস্তিও দিতে সক্ষম। সুতরাং তোমরা যারা বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছো, সময় থাকতে সংশোধন হয়ে যাও। নতুবা যে কোন মুহূর্তে আমার আযাব তোমাদেরকে পাকড়াও করবে। তোমরা যা করছো, সে সম্পর্কে আমার পূর্ণ জ্ঞান রয়েছে-সমস্ত কিছুই আমি দেখছি। আল্লাহ বলেন-

غَافِرِ الذَّنْبِ وَقَابِلِ التَّوْبِ شَدِيدِ الْعِقَابِ ذِي الطُّولِ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ -

        আল্লাহ সব কিছু সম্পর্কে জ্ঞাত, গোনাহ্ ক্ষমাকারী, তওবা কবুলকারী, কঠোর শাস্তিদাতা এবং দয়ালু, তিনি ব্যতিত দাসত্ব লাভের আর কেউ অধিকারী নেই। (সূরা আল মুমিন-৩)

        করুণাময় আল্লাহ তাঁর বিদ্রোহী বান্দাদেরকে এ কথা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি পরাক্রমশালী-মহাশক্তিবান, সমস্ত কিছুর ওপরে তিনি বিজয়ী। কারো ব্যাপারে তিনি যখন কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা তিনি নিশ্চিতভাবে কার্যকরী করেন। তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কেউ বিজয়ী হতে পারে না। কেউ তাঁর গ্রেফতারী এড়িয়ে চলতে পারে না। সুতরাং তাঁর বিধান ত্যাগ করে কেউ যদি সফলতার আশা পোষণ করে, কখনো সে সফল হতে পারবে না। তিনি সমস্ত কিছুই দেখছেন। তিনি অনুমান এবং ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। এখন পর্যন্ত তোমরা যারা বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করে চলছো, তোমাদের নিরাশ হবার কোন কারণ নেই। তোমরা তওবা করে আমার বিধানের আনুগত্য করো, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো এবং আমার রাহমত দানে ধন্য করবো। আর যদি তোমরা তোমাদের ভূমিকা পরিবর্তন না করো, তাহলে জেনে রেখো, আমি কঠিন শাস্তিদাতা।

        পবিত্র কোরআনে অনেক স্থানে আল্লাহ তাঁর অসীম রাহমতের কথা বলেই নিজেকে কঠিন শাস্তিদাতা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা'য়ালার অসংখ্য গুণের মধ্যে এটাও একটি অন্যতম গুণ যে, তিনি কঠিন শাস্তিদাতা। তিনি তাঁর এই গুণটি উল্লেখ করে মানব জাতিকে এ কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে, তাঁর দাসত্বের পথ অনুসরণকারীদের জন্য তিনি যতটা দয়াবান ও করুণাময়, তিনি ঠিক ততটাই কঠোর বিদ্রোহী ও অবাধ্য বান্দাদের প্রতি।

        আল্লাহর পক্ষ থেকে আযাব আসার যে সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, সেই সীমা পর্যন্ত তিনি মানুষের যাবতীয় অপরাধ উপেক্ষা করতে থাকেন। যখন কোন ব্যক্তি বা জাতি সেই সীমা অতিক্রম করে, তখন তারা শাস্তির যোগ্য হয়ে যায়। তখন তাঁর শাস্তি এমন ভয়াবহ আকারে অবতীর্ণ হয় যে, সমস্ত কিছু মুহূর্তের ভেতরে লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মানুষকে অবকাশ দেয়া হয়েছে, আল্লাহর শাস্তি অবতীর্ণ হবার পূর্বেই মানুষ যেন তওবা করে তাঁর ক্ষমা লাভ করে। তিনি ক্ষমাকারী-তাঁর এই গুণ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন-

 وَهُوَ الَّذِي يَقْبَلُ التّوبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَعْفُوا عَنِ السَّيِّاتِ وَيَعْلَمُ مَا تَفْعَلُونَ

        তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং মন্দ কাজসমূহ ক্ষমা করেন। (সূরা আশ্ শূরা-২৫)

        মানুষের ভেতরে অপরাধ প্রবণতা বিদ্যমান। তারা অপরাধ করবে এবং পরক্ষণেই তারা আল্লাহর ভয়ে অনুতপ্ত হবে, অনুশোচনা করবে, সংঘটিত অপরাধের কারণে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে কাঁদবে, আল্লাহ খুশী হয়ে তাদেরকে ক্ষমা করবেন। মানুষ আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসরণ করবে, হঠাৎ করে তার দ্বারা গোনাহ্ সংঘটিত হবে। শয়তানের প্রবঞ্চনায়, নক্সের তাড়নায় গোনাহ্ সংঘটিত হবার পরে আল্লাহর ভয়ে তার অন্তর থর থর করে কেঁপে উঠেছে। সেজদায় পড়ে আল্লাহর কাছে কাঁদছে। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-

 وَاخَرُونَ اعْتَرَفُوا بِذُنُوبِهِمْ خَلَطُوا عَمَلاً صَالِحًا وَآخَرَ سَيِّئًا عَسَى اللَّهُ أَنْ يَتُوبَ عَلَيْهِمْ إِنَّ اللَّهَ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

        আরো কিছু লোক এমন আছে, যারা নিজেদের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে। তাদের আমল মিশ্রিত ধরনের, কিছু ভালো কিছু মন্দ। অসম্ভব নয় যে, আল্লাহ তাদের প্রতি আবার অনুগ্রহশীল হবেন-কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (সূরা আত্ তাওবা-১০২) 

        আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, তিনি তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করবেন এবং বান্দা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় যা দান করবে, তা তিনি কবুল করবেন। আল্লাহ বলেন-

أَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ هُوَ يَقْبَلُ التَّوْبَةَ عَنْ عِبَادِهِ وَيَاخُذُ الصَّدَقَاتِ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

        তারা কি জানে না যে, তিনিই আল্লাহ-যিনি তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন এবং তাদের দান কবুল করেন, আর প্রকৃত বিষয় হলো, আল্লাহ বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা তাওবা)

        পৃথিবীতে যারা সামান্য ক্ষমতার অধিকারী, তাদের মধ্যে এমন কোন ব্যক্তি এমন নেই যে-তার বিরুদ্ধে কেউ অপরাধ সংঘটিত করলে বা তার নির্দেশ অমান্য করলে সে ডাক দিয়ে বলবে, 'আমি শাস্তি দেয়ার পূর্বেই অপরাধীরা এসো, আমার কাছে ক্ষমা চাও-আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবো।' এমন কথা বলা তো দূরে থাক, অপরাধীকে ধরার জন্য পুলিশ লেলিয়ে দেয়া হয়। পত্র-পত্রিকা প্রচার মাধ্যমে অপরাধীর ছবি দিয়ে সংবাদ পরিবেশন করা হয়, তাকে ধরে দিলে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করা হবে। পক্ষান্তরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অসীম দয়ালু, তিনি তাঁর নবীকে বলছেন-আমার বান্দার মধ্যে যারা আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে, আমার নির্দেশ অমান্য করে অপরাধ করেছে, তাদেরকে আপনি জানিয়ে দিন-

قُلْ يَعِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَّحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ - وَأَنِيبُوا إِلَى رَبِّكُمْ وَأَسْلِمُوا لَهُ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَكُمُ الْعَذَابُ ثُمَّ لَا تُنْصَرُونَ

        (হে রাসূল!) আপনি বলে দিন, হে আমার বান্দারা যারা নিজের আত্মার ওপরে জুলুম করেছো আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চিতভাবে আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। ফিরে এসো তোমাদের রব্ব-এর দিকে এবং তাঁর অনুগত হয়ে যাও তোমাদের ওপরে আযাব আসার পূর্বেই। (আযাব এসে গেলে) তখন কোন দিক থেকেই আর সাহায্য পাওয়া যাবে না। 
(সূরা আয যুমার-৫৩-৫৪) 

Post a Comment

0 Comments