আল্লাহর রাহমত লাভের আবশ্যক শর্তাবলী কি কি

        মহান আল্লাহ অসীম দাতা এবং দয়ালু, তাঁর রাহমত গোটা সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী পরিব্যাপ্ত। মানুষ ও প্রাণী জগতসহ অন্যান্য সৃষ্টি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর রাহমত লাভ করছে। এই রাহমত লাভ করার ব্যাপারে মানুষকে কোন ধরনের শর্ত পালন করতে হয় না। বৃষ্টির পানি, আলো, বাতাস, তাপ, অক্সিজেন এবং জীবন ধারনের জন্য অন্যান্য অগণিত অজস্র রাহমত লাভ করার পেছনে মানুষের কোন চেষ্টা-সাধনা নেই, এসব রাহমত পৃথিবীতে আসার পূর্বে একান্তই মানুষের প্রয়োজন হবে, এ কথা পূর্ব থেকেই জেনে সে এগুলো পৃথিবীতে মওজুদ করে রাখার ব্যাপারে আল্লাহর কাছে আবেদন করেনি। তিনি রাহমান-চাওয়ার ও প্রয়োজনের পূর্বেই তিনি এগুলো মওজুদ করেছেন।

        পক্ষান্তরে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সফলতা অর্জনের জন্য যে রাহমতের প্রয়োজন, সে রাহমত তিনি এমনতিইে দেন না। এটা লাভের জন্য যে প্রয়োজনীয় গুণাবলী অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন, যেসব শর্তাবলী পূরণ করা প্রয়োজন, তা না করে শুধু মুখে মুখে চাইলেও সে রাহমত পাওয়া যায় না।

        এ কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, একটি মাছির ডানার যে মূল্য রয়েছে-আল্লাহর কাছে এই পৃথিবীর সে মূল্যও নেই। এ জন্য মহান আল্লাহ তাঁর রাহমতকে দুই ভাগে বিভক্ত করে এক ভাগ দান করেছেন সমস্ত সৃষ্টিকে। মানুষের মধ্যে যারা তাঁর বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, তারা তাঁর সে রাহমত লাভ করে থাকে এবং যারা তাঁর বিধানের মোকাবেলায় বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করছে, তারাও লাভ করে থাকে। এই শ্রেণীর লোকদের প্রতি তাঁর রাহমতের ধারাবাহিকতা তাদের জীবন কালেই শেষ হয়ে থাকে।

        আর যারা আল্লাহভীরু, তাদের ওপরে তাঁর রাহমাতের ধারাবাহিকতা কখনো শেষ হয় না। এ ক্ষেত্রে আল্লাহভীরু লোকদেরই লাভ বেশী। পৃথিবীতে সর্বসাধারণের জন্য আল্লাহ যে রাহমত বর্ষণ করেন, তারা এসবেরও অংশ লাভ করে থাকে এবং মৃত্যুর পর থেকেও তারা আল্লাহর বিশেষ রাহমত অনন্তকালের জন্য লাভ করতে থাকে। আল্লাহর এই বিশেষ রাহমত লাভের অধিকারী কোন শ্রেণীর মানুষ হবে, এ সম্পর্কে সূরা আ'রাফের ৫৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِينَ

        নিশ্চয়ই আল্লাহর রাহমত মুহছিনীন-সচ্চরিত্রবান লোকদের অতি কাছে।

         যারা মহান আল্লাহর মুহছিন বান্দা, তাদের জন্য তিনি আখিরাতের ময়দানে সর্বোত্তম প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। পবিত্র কোরআন এই মুহছিন বান্দাদের লক্ষ্য করে সূরা আহযাবের ২৯ আয়াতে ঘোষণা করেছে-

فَإِنَّ اللَّهَ أَعَدَّ لِلْمُحْسِنَاتِ مِنْكُنَّ أَجْرًا عَظِيمًا -

        তোমাদের মধ্যে যারা সৎকর্মশীল তাদের জন্য আল্লাহ মহাপ্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ রাহমত লাভ করতে হলে অবশ্যই তাঁকে মুহছিন বান্দা হতে হবে। মুহছিন বান্দা কারা, তাদের পরিচয় স্বয়ং আল্লাহই এভাবে দিয়েছেন-

وبُشْرَى لِلْمُحْسِنِينَ إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ - أُولَئِكَ أَصْحَبُ الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا جَزَاءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

        (এই কিতাব) সৎ আচরণ গ্রহণকারীদের জন্য সুসংবাদ দান করে। যারা ঘোষণা করেছে আল্লাহই আমাদের রব্ব-এরপর তার ওপরে স্থির থেকে নিশ্চয়ই তাদের জন্য কোন ভয় নেই এবং তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্থ ও দুঃখ ভারাক্রান্ত হবে না। এ ধরনের সব মানুষ জান্নাতে যাবে। তারা সেখানে চিরদিন থাকবে। তাদের সেই কাজের বিনিময়ে যা তারা পৃথিবীতে করেছিলো। (সূরা আল আহকাফ-১২-১৪)

        মুহছিন কোন ধরনের লোকদেরকে বলা হয়, তাদের পরিচয় আল্লাহ দিলেন। এরা একমাত্র আল্লাহকে রব্ব-হিসাবে স্বীকৃতি দেয়ার পর আমৃত্যু সে কথা ও কাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকে। রব্ব কাকে বলে এবং আল্লাহকে রব্ব বলে স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ কি, এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এখানে সংক্ষেপে এতটুকু বলা হচ্ছে যে, জীবনের প্রতিটি বিষয়ে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রে যারা একমাত্র আল্লাহকেই আইনদাতা, বিধানদাতা, দাসত্ব লাভের অধিকারী, সাহায্যদাতা, আশ্রয় দানকারী, আশা পূরণকারী, রোগ থেকে আরোগ্য দানকারী, বিপদে মুক্তি দানকারী ইত্যাদি বলে মুখে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং দৈনন্দিন জীবনে এ কথার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।

        আল্লাহর যমীনে আল্লাহর রবুবিয়াত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন করেছে এবং এই আন্দোলন করতে গিয়ে সম্পদের কোরবানী দিয়েছে, কারাজীবনকে স্বাগত জানিয়েছে, নির্যাতন সহ্য করেছে, দেশত্যাগ করেছে, প্রয়োজনে শাহাদাতবরণ করেছে। আল্লাহ তা'য়ালা এই লোকগুলোকেই কোরআনে মুহছিন বান্দা বলে উল্লেখ করেছেন। সূরা তওবায় এদের পরিচয় দিতে গিয়ে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ آمَنُوا وَهَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ الله بأموالهم وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدِ اللَّهِ - وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُونَ يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِّنْهُ وَرِضْوَانِ وَجَنَّتٍ لَهُمْ فِيْهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا إِنَّ اللَّهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ

        যারা ঈমান এনেছে, হিজরাত করেছে এবং আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ ও প্রাণ দিয়ে জিহাদ করেছে, আল্লাহর কাছে এদের মর্যাদা অনেক বিরাট আর এরাই হলো সফলকাম। তাদের রব্ব তাদেরকে নিজের রাহমত ও সন্তোষ এবং এমন জান্নাতের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যেখানে তাদের জন্য চিরস্থায়ী সুখের সামগ্রী সুবিন্যস্ত রয়েছে। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আল্লাহর কাছে কাজের প্রতিফল দেয়ার অফুরন্ত সামগ্রী রয়েছে। (সূরা আত-তাওবা-২০-২২)

        একশ্রেণীর মানুষ ঐ ধরনের লোকদেরকে সফলকাম বলে থাকে, যারা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ লাভ করেছে, সুরম্য অট্টালিকা গড়তে সক্ষম হয়েছে, মনের মতো স্ত্রী লাভ করেছে, অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে সম্মান ও মর্যাদা লাভ করেছে, এক কথায় মানে-সম্মানে, ধনে-জনে, অর্থ-বিত্তে, সুনাম-যশে পরিপূর্ণতা লাভ করেছে। এই ধরনের লোকদেরকেই পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ সফলকাম ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করে থাকে। 

        পক্ষান্তরে ইসলামের দৃষ্টিতে মানুষের জীবনের সফলতা বলতে যা বুঝায়, তার সাথে উল্লেখিত মানবীয় চিন্তাধারার কোন সাদৃশ্য নেই। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হতে হবে, আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদর্শিত বিধান অনুযায়ী নিজের ও অন্যান্য মানুষের সার্বিক জীবনের পুনর্বিন্যাস সাধন করে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনকে যারা রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে আমৃত্যু পর্যন্ত এই কথার ওপরে দৃঢ়পদে প্রতিষ্ঠিত থাকতে পেরেছে, তারাই সফলতা অর্জন করেছে এবং তারাই আল্লাহর রাহ্মাতের অধিকারী। এইশ্রেণীর লোকদেরকেই বলা হয় মুহছিনীন।

        সুতরাং আল্লাহর রাহমত লাভের অত্যাবশ্যকীয় শর্ত হলোঃ (১) আল্লাহর গুণাবলীসহ তাঁর ওপরে ঈমান আনতে হবে। (২) রাসূলের ওপরে ঈমান এনে একমাত্র তাঁকেই জীবনের সর্বক্ষেত্রে আদর্শ নেতা হিসাবে অনুসরণ করতে হবে। (৩) আল্লাহকে রব্ব হিসাবে স্বীকৃতি দিয়ে সে কথার ওপরে আমৃত্যু অটল অবিচল থাকতে হবে। (৪) আল্লাহর রবুবিয়াতকে অনুসরণ করতে গিয়ে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকতে হবে। (৫) যে কোন নির্যাতনের মোকাবিলায় আল্লাহর রবুবিয়াতকে প্রাধান্য দান করতে হবে।

         এসব শর্তাবলী অনুসরণ করে চললে নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাহমত লাভ করা যাবে। আরেক শ্রেণীর লোক আল্লাহর রাহমত লাভের অধিকারী বলে আল্লাহ তা'য়ালা সূরা তওবায় ঘোষণা দিয়েছেন। তারা হলো সেই সবশ্রেণী, যাদের হৃদয়-মন আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত। কিন্তু প্রকৃত অক্ষমতার কারণে তারা আল্লাহর পথে জিহাদের হক আদায় করতে সমর্থ হয় না।

        সুন্নাতি পোষাক হিসাবে প্রচলিত পোষাক পরিধান করে, মাথায় টুপি-পাগড়ী পরিধান করে, দাড়ি রাখে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে আদায় করে, রামজানের রোজা আদায় করার পরও নফল রোজা প্রতি মাসে আদায় করে, তস্বীহ-তাহলীল ও তাহাজ্জুদ নামাজ আদায়সহ অন্যান্য নফল কাজ যথাযথভাবে পালন করে। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম থেকে দূরে অবস্থান করে। এই শ্রেণীর মানুষও কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর সেই বিশেষ রাহমত লাভ করতে সমর্থ হবে না।

        তাঁর বিশেষ রাহমত লাভ করতে হলে, অবশ্যই তাকে আল্লাহর সৈনিক হতে হবে, উল্লেখিত শর্তাবলী পূরণ করতে হবে। যারা নিজেদেরকে আল্লাহর মুহছিন বান্দাহ্ হিসাবে গড়তে সক্ষম  হবেন, তাদের জন্য এই পৃথিবীতেই সবচেয়ে বড় নিয়ামত হলো, স্বয়ং আল্লাহ তাদের অভিভাবক হয়ে যাবেন-তিনি তাদের সাথে থাকবেন। সূরা নাহলে মহান আল্লাহ বলেন- 

إِنَّ اللَّهَ مَعَ الَّذِينَ اتَّقَوْا وَالَّذِينَ هُمْ مُّحْسِنُونَ

        আল্লাহ তো তাদের সাথে রয়েছেন, যারা আল্লাহভীতি সহকারে কাজ করে এবং যারা মুছিন।

Post a Comment

0 Comments