বিচার দিবস সম্পর্কে কোরআনের যুক্তি

        অবিশ্বাসীদের যুক্তি হলো, এ পর্যন্ত কোন মানুষ ইন্তেকাল করার পরে পুনরায় ফিরে আসার কোন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে নেই, সুতরাং পরকালে মানুষকে পুনরায় জীবিত করো হবে, এ কথা কোনক্রমেই বিশ্বাস করা যায় না। তারা চ্যালেঞ্জ করে বলতো যে, যদি সত্যই বিচার দিবস নির্দিষ্ট করা হয়ে থাকে, সেদিন আল্লাহর আদালতে মৃত মানুষগুলো জীবিত হয়ে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করার বিষয়টি সম্ভব হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পূর্বে যারা ইন্তেকাল করেছে, তাদের মধ্য থেকে যে কোন ব্যক্তিকে জীবিত করে এনে আমাদেরকে দেখাও-তাহলে আমরা বিশ্বাস করবো, বিচার দিবস বলে কিছু আছে। এদের এই দাবিই অপ্রাসঙ্গিক।

        কারণ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর অনুসারীগণ বর্তমান সময় পর্যন্ত এমন কথা কখনো বলেননি যে, আমরা মৃত মানুষকে জীবিত করে দেখাতে পারি। ইশারা ইঙ্গিতেও তারা কখনো এ ধরনের অমূলক দাবি করেননি। তাহলে যে বিষয়ে কোন কথা বলা হয়নি বা দাবি করা হচ্ছে না, সে বিষয়কে কেন প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্য একটিই আর তাহলো, তারা বিচার দিবসকে মেনে নেবে না। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করার ইচ্ছে থাকলে তর্কের রীতি অনুসরণ না করে অপ্রাসঙ্গিক কথা টেনে আনা হতো না।

        মৃতকে জীবিত যদি কেউ দেখতে আগ্রহী হয়, তাহলে কবরের মানুষগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত না করে প্রথমে নিজের দেহের দিকে দৃষ্টিপাত করা উচিত। প্রতিদিন অসংখ্য দেহকোষ কিভাবে মৃত্যুবরণ করছে এবং কিভাবে নতুন দেহকোষ জীবিত হচ্ছে। প্রাণহীন ভ্রুণ থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ মানব শিশু জন্ম লাভ করছে। মানুষের জন্মের বিষয়টির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যেতে হয়। এক বিন্দু নাপাক পানির মধ্যে এমন কি রয়েছে, যা চোখে দেখা যায় না। তা থেকে কিভাবে পূর্ণাঙ্গ একটি মানব শিশু প্রস্তুত হয়ে পৃথিবীতে আগমন করছে। ক্রমশঃ সেই শিশু একটি সুন্দর দেহধারী মানুষে পরিণত হচ্ছে। এভাবে মানব সৃষ্টির গোটা প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে কি মৃত্যুর পরে জীবিত হওয়ার বিষয়টিকে অসম্ভব বলে মনে হয়? প্রাণী জগতের দিকে তাকালেও সেই একই বিষয় ধরা পড়ে। ডিমগুলোর মধ্যে প্রাণের কোন স্পন্দন নেই, অথচ সেই ডিম থেকে কিভাবে জীবিত বাচ্চা পৃথিবীতে বেরিয়ে আসছে।

        চৈত্র মাসের খর-তাপে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। নদী-নালা-খাল-বিল-হাওড় শুকিয়ে মরুভূমির মতো হয়ে যায়। এক সময় যেখানে সবুজের সমারোহ ছিল, দৃষ্টি-নন্দন নৈসর্গিক দৃশ্য বিরাজিত ছিল। প্রচন্ড দাবদাহে সেখানে কোন মানুষের পক্ষে মুহূর্ত কাল দাঁড়ানো কষ্টকর হয়ে ওঠে। যমীন প্রাণশক্তি হারিয়ে মৃত পতিত আকার ধারণ করে। আল্লাহ বলেন-

وَاللَّهُ الَّذِي أَرْسَلَ الرِّيحَ فَتُثِيرُ سَحَابًا فَسُقْنهُ إِلَى بَلَدٍ مَّيِّتِ فَأَحْيَيْنَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا كَذَالِكَ النُّشُورُ -

        আল্লাহই বায়ু প্রেরণ করেন তারপর তা মেঘমালা উঠায় এরপর আমি তাকে নিয়ে যাই একটি জনমানবহীন এলাকার দিকে এবং মৃত-পতিত যমীনকে সঞ্জীবিত করে তুলি। মৃত মানুষদের জীবিত হয়ে ওঠাও তেমনি ধরনের হবে। (সূরা ফাতির-৯)

        বিচার দিবস তথা পরকাল হবে কি হবে না, এ বিষয়টি অনুধাবন করার জন্য কোন গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না। পদতলে নিষ্পেষিত দুর্বা ঘাসগুলোর দিকে তাকালেই অনুভব করা যায়। বিশেষ মৌসুমে এই ঘাসগুলো গালিচার মতোই হয়ে ওঠে। সৌন্দর্য পিয়াসী ব্যক্তিগণ নরম তুলতুলে এই ঘাসগুলোর ওপরে শুয়ে নীল আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করে। কবি, সাহিত্যিকদের কল্পনার বদ্ধ দুয়ার দ্রুত অর্গল মুক্ত হয়। আবার বিশেষ এক মৌসুমের আগমন ঘটে, তখন সেই সুন্দর ঘাসগুলো অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে। যে স্থানে সবুজ ঘাসের নীল গালিচার ওপরে শুয়ে কবি একদিন তার কল্পনার বদ্ধ দুয়ার অর্গল মুক্ত করেছিল, সে স্থানে সবুজের কোন চিহ্ন থাকে না, রুদ্র প্রয়াগের তপ্ত নিঃশ্বাস আর মৃতের হাহাকার সেখানে ভেসে বেড়ায়।

        এরপর মাত্র এক পশলা বৃষ্টি বর্ষিত হলো, তারপর মৃত-ভূমি অকস্মাৎ সবুজ শ্যামল আভায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠলো এবং দীর্ঘকালের মৃত শিকড়গুলো সবুজ চারাগাছে রূপান্তরিত হয়ে মাটির বুকে আবার বিছিয়ে দিল নমনীয় নীল গালিচা। দৃষ্টি বিমোহিত এই দৃশ্য দেখেও কি মনে হয়, মৃত মানুষকে পুনরায় আল্লাহর পক্ষে জীবন দান করা অসম্ভব? এসব কিছু দেখার পরেও বিচার দিবস সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকতে পারে? সূরা হজ্জ-এর ৫ আয়াতে আল্লাহ বলেন-

يأَيُّهَا النَّاسُ إِنْ كُنْتُمْ فِي رَيْبٍ مِّنَ الْبَعْثِ فَإِنَّا خَلَقْنَكُمْ مِّنْ تُرَابٍ ثُمَّ مِنْ نُّطْفَةٍ ثُمَّ مِنْ عَلَقَةٍ ثُمَّ مِنْ مُّضْغَةٍ مُّخَلَّقَةٍ وَغَيْرِ مُخَلَّقَةٍ لِنُبَيِّنَ لَكُمْ وَنُقِرُّ فِي الْأَرْحَامِ مَا نَشَاءُ إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى ثُمَّ نُخْرِجُكُمْ طِفْلاً ثُمَّ لِتَبْلُغُوا أَشُدَّكُمْ

        হে মানব মন্ডলী! যদি তোমাদের মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে তোমরা জেনে রেখো, আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে, তারপর শুক্র থেকে, তারপর রক্তপিন্ড থেকে, তারপর গোস্তের টুকরা থেকে, যা আকৃতি বিশিষ্টও হয় এবং আকৃতিহীনও হয়। (এসব বর্ণনা করা হচ্ছে) তোমাদের কাছে সত্য সুস্পষ্ট করার জন্য। আমি যে শুক্রকে চাই একটি বিশেষ সময় পর্যন্ত গর্ভাশয়ে স্থিত রাখি, তারপর একটি শিশুর আকারে তোমাদের বের করে আনি, (তারপর তোমাদের প্রতিপালন করি) যেন তোমরা পূর্ণ যৌবনে পৌছে যাও। বিচার দিবসে কিভাবে মাটির সাথে মিশে যাওয়া মানুষগুলো পুনরায় জীবিত হবে, এ ব্যাপারে যদি তোমাদের কারো মনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয় তাহলে তোমরা নিজেদের অস্তিত্ব সম্পর্কে একটু চিন্তা করে দেখো, তোমরা কি ছিলে। তোমাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। এমন এক ফোটা পানি থেকে তোমাদের সৃষ্টি করা হলো, যে পানি দেহ থেকে নির্গত হলে গোসল ফরজ হয়ে যায়। সেখানে তোমাদেরকে আমি অস্তিত্ব দান করেছি। তারপর তোমাদেরকে আমিই প্রতিপালন করে সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী যুবকে পরিণত করি। এভাবে তোমাদেরকে আমি প্রথমবার যখন সৃষ্টি করেছি, তখন তোমাদেরকে পুনরায় সৃষ্টি করা কি আমার পক্ষে অসম্ভব মনে করো? শুধু তাই নয়, অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে তোমাদেরকে আমিই সৃষ্টি করে মাতৃগর্ভ থেকে শিশুর আকারে পৃথিবীতে এনে যুবকে পরিণত করি। এরপর তোমাদেরকে আমি কোন পরিণতিতে পৌঁছে দেই শোন-

وَ مِنْكُمْ مِّنْ يُتَوَفَّى وَمِنْكُمْ مِّنْ يُرَدُّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ لِكَيْلاً يَعْلَمَ مِنْ بَعْدِ عِلْمٍ شَيْئًا -

        আর তোমাদের মধ্য থেকে অনেককেই তার পূর্বেই আমি ফিরিয়ে নিয়ে আসি এবং কাউকে হীনতম বয়সের দিকে ফিরিয়ে দেয়া হয়, যেন সবকিছু জানার পরেও আর কিছুই না জানে। (সূরা আল হাজ্জ-৫)

        তোমাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, সেখান থেকে অস্তিত্ব দান করলাম। তারপর তোমাদেরকে কৈশোর, যুবক ও বৃদ্ধাবস্থার দিকে নিয়ে যেতে থাকি। এভাবে নিয়ে যাওয়ার মধ্যস্থিত সময়ে অনেককেই আমি মৃত্যু দান করি। তোমরা কেউ কিশোর অবস্থায়, তরুণ বয়সে, যুবক বয়সে মৃত্যুবরণ করো। আবার কাউকে কাউকে আমি বয়সের এমন এক প্রান্তে পৌঁছে দেই, তখন সে নিজের শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোন যত্ন নেয়া দূরে থাক, সংবাদই রাখতে সক্ষম হয় না। তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অন্যকে জ্ঞান বিতরণ করতো, সে বয়সের শেষ প্রান্তে পৌছে শুধু শিশুর মতো জ্ঞানহীনই হয়ে যায় না, একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। যে ব্যক্তির এত পান্ডিত্য ছিল, জ্ঞান ছিল, নানা ধরনের বিদ্যা অর্জন করেছিল, বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে বিশেষজ্ঞ ছিল, কত অভিজ্ঞতা ও দূরদর্শিতা ছিল। তার এসব গর্বের বস্তুকে এমনই অজ্ঞতায় পরিবর্তিত করে দেই যে, একদিন তার কথা অসংখ্য জ্ঞানী মানুষ নিবিষ্ট চিত্তে মনোযোগ দিয়ে শুনতো, এখন তার কথা শুনলে ছোট্ট একটি শিশুও হাসে। কোথা থেকে তোমাদেরকে আমি কোন অবস্থায় নিয়ে আসি, তা দেখেও কি তোমরা বুঝো না, বিচার দিবসে তোমাদেরকে আমি একত্রিত করতে সক্ষম হবো? রাব্বুল আলামীন বলেন-

وَتَرَى الْأَرْضَ هَامِدَةٌ فَإِذَا أَنْزَلْنَا عَلَيْهَا الْمَاءَ اهْتَزَّتْ وَرَبَتْ وَأَنْبَتَتْ مِنْ كُلِّ زَوْجٍ بَهِيجٍ ذَالِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّهُ يُحْيِ الموتى وَأَنَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ السَّاعَةَ آتِيَةٌ لأَرَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ مَنْ فِي الْقُبُورِ -

        আর তোমরা দেখছো যমীন বিশুষ্ক পড়ে রয়েছে তারপর যখনই আমি তার ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করেছি তখনই সে সবুজ শ্যামল হয়েছে, স্ফীত হয়ে উঠেছে এবং সবধরনের সুদৃশ্য উদ্ভিদ উদাত করতে শুরু করেছে। এসব কিছু এজন্য যে, আল্লাহ সত্য, তিনি মৃতদেরকে জীবিত করেন এবং তিনি সব জিনিসের ওপর শক্তিশালী। আর এই (এ কথার প্রমাণ) যে, কিয়ামতের সময় অবশ্যই আসবে, এতে কােন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই এবং নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদেরকে উঠবেন যারা কবরে চলে গিয়েছে। (সূরা আল হাজ্জ-৫-৭)

        যারা বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ সংশয়ের আবর্তে দোলায়িত হচ্ছে, তাদেরকে বলা হচ্ছে, আল্লাহ আছেন একথা অবশ্যই সত্য। মানুষ যখন মরে গিয়ে মাটির সাথে মিশে যাবে, তারপর তাদের আর জীবিত হবার কোনই সম্ভাবনা নেই-যারা এ ধারনা পোষণ করে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আল্লাহর অস্তিত্ব নিছক কাল্পনিক কোন বিষয় নয়। কোন বুদ্ধিবৃত্তিক জটিলতা পরিহার করার লক্ষ্যে আল্লাহর অস্তিত্ব আবিষ্কার করা হয়নি।

        তিনি নিছক দার্শনিকদের চিন্তার আবিষ্কার, অনিবার্য সত্তা ও সকল কার্যকারণের প্রথম কারণই নয় বরং তিনি প্রকৃত স্বাধীন ক্ষমতা সম্পন্ন কর্তা, যিনি সময়ের প্রতি মুহূর্তে নিজের অসীম শক্তিমত্তা, সংকল্প, জ্ঞান ও কলা-কৌশলের মাধ্যমে সমগ্র সৃষ্টিজগৎ এবং এর প্রতিটি বস্তু পরিচালনা করছেন। তিনি খেয়ালের বশে এসব কিছু সৃষ্টি করেননি। এসব সৃষ্টি করার পেছনে কোন শিশু সুলভ মনোভাবও কাজ করেনি যে, শিশুর মতো খেলা শেষ হলেই সমস্ত কিছুই ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ ধূলায় উড়িয়ে দেয়া হবে। বরং তিনি সত্য এবং তাঁর যাবতীয় কাজই গুরুত্বপূর্ণ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে পরিপূর্ণ। বিজ্ঞানের সুষমায় প্রতিটি সৃষ্টিই সুষমা মন্ডিত।

        বিচার দিবসের প্রতি যারা সন্দেহ পোষণ করে, তারা যদি সৃষ্টি জগতের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা বাদ দিয়ে শুধু নিজের জন্মের প্রক্রিয়া নিয়ে সামান্য চিন্তা করে, তাহলে সে অবগত হতে পারবে যে, একজন মানুষের অস্তিত্বের ভেতরে মহান আল্লাহর প্রকৃত ও বাস্তব ব্যবস্থাপনা এবং বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশল প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় রয়েছে। প্রতিটি মানুষের অস্তিত্ব, বৃদ্ধি ও বিকাশের প্রত্যেকটি পর্যায়েই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের স্বেচ্ছামূলক সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই স্থিরীকৃত হয়ে থাকে। অবিশ্বাসীরা বলে থাকে যে, এসব সৃষ্টির পেছনে কোন নিয়মতান্ত্রিক স্রষ্টা বলে কেউ নেই। যা ঘটছে তা একটি প্রাকৃতিক নিয়মের অধিনেই ঘটছে।

        পক্ষান্তরে এই হতভাগারা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখতে পাবে যে, প্রতিটি মানুষ যেভাবে অস্তিত্ব লাভ করে এবং তারপর যে প্রক্রিয়ায় অস্তিত্ব লাভের বিভিন্ন পর্যায় অতিক্রম করে, তার ভেতরে একজন সুবিজ্ঞ, মহাবিজ্ঞানী ও একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী প্রচন্ড শাক্তিশালী সত্তার ইচ্ছামলুক সিদ্ধান্ত কিভাবে সুপরিকল্পিত পন্থায় সক্রিয় রয়েছে। মানুষের গ্রহণকৃত খাদ্যের মধ্যে কোথাও মানবিক বীজ গোপন থাকে না যা মানবিক প্রাণের বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করতে সক্ষম। গ্রহণকৃত খাদ্য উদরে প্রবেশ করে কোথাও গিয়ে রক্ত, কোথাও গিয়ে হাড়, কোথাও গিয়ে গোতে পরিণত হয়। আবার বিশেষ স্থানে তা পৌঁছে গ্রহণকৃত সেই খাদ্যই এমন শুক্রে পরিণত হয়, যার ভেতরে যাবতীয় বৈশিষ্ট্যসহ মানুষের পরিণত হবার যোগ্যতার অধিকারী বীজ লুকায়িত থামে। এই লুকায়িত বীজের সংখ্যা এতটা অধিক যে, একজন পুরুষ থেকে প্রতিবারে যে শুক্র নির্গত হয় তার মধ্যে কয়েক কোটি শুক্রকীট অবস্থান করে এবং তার প্রতিটি নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিশে মানুষের রূপ লাভ করার যাবতীয় যোগ্যতা ধারণ করে। কিন্তু একজন মহাবিজ্ঞানী, অসীম শক্তিশালী একচ্ছত্র সার্বভৌম ক্ষমতা সম্পন্ন শাসকের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সেই অসংখ্য শুক্রকীটের মধ্য থেকে মাত্র একটিকে নির্বাচিত করে নারীর ডিম্বাণুর সাথে মিলিত হবার সুযোগ করে দেয়া হয়। এভাবে চলে গর্ভধারণ প্রক্রিয়া এবং গর্ভধারণের সময় পুরুষের শুক্রকীট ও. নারীর ডিম্বকোষের মিলনের ফলে প্রাথমিক অবস্থায় এমন একটি জিনিস অস্তিত্ব লাভ করে এবং সেটা এতই ক্ষুদ্র যে, তা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতিত চোখে দেখা সম্ভব নয়।

        সেই ক্ষুদ্র জিনিসটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত গর্ভাশয়ে প্রতিপালিত হয়ে বেশ কয়েকটি স্তর অতিক্রম করে অপূর্ব সুন্দর একটি দেহ কাঠামো ধারণ করে পূর্ণাঙ্গ একটি মানুষে পরিণত হয়। মানুষের জন্মের প্রতিটি জটিল স্তরের বিষয়টি সম্পর্কে কেউ চিন্তা-করলেই তার মন-মস্তিষ্ক দ্বিধাহীন চিত্তে দৃঢ়ভাবে সাক্ষী দেবে যে, এসব বিষয়ের ওপরে প্রতি মুহূর্তে একজন সদা তৎপর মহাবিজ্ঞানীর ইচ্ছামূলক সিদ্ধান্ত সঠিক পন্থায় কাজ করে চলেছে। সেই সুবিজ্ঞ মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তা'য়ালাই সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, কোন মানুষকে তিনি পূর্ণতায় পৌঁছাবেন, কাকে তিনি ভ্রুণ অবস্থাতেই শেষ করে দিবেন, কাকে তিনি গর্ভে দেহ কাঠামো দান করার পরে শেষ করবেন, কাকে তিনি পৃথিবীতে আসার পরে প্রথম নিঃশ্বাস গ্রহণের সুযোগ দেবেন অথবা দেবেন না।

        মানব সৃষ্টির প্রক্রিয়ার মধ্যেই তিনিই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, কাকে তিনি জীবিত নিয়ে আসবেন আর কাকে তিনি মৃত নিয়ে আসবেন। কাকে তিনি মাতৃগর্ভ থেকে সাধারণ মানুষের আকার আকৃতিতে বের করে আনবেন, আবার কাকে তিনি অস্বাভাবিক কোন আকার দিয়ে পৃথিবীতে আনবেন। কাকে তিনি সুন্দর অবয়ব দান করে আনবেন অথবা কুৎসিত অবয়ব দান করে পৃথিবীর আলো-বাতাসে নিয়ে আসবেন। কাকে তিনি পূর্ণাঙ্গ মানবিক অবয়ব দান করবেন অথবা বিকলাঙ্গ করে আনবেন। কাকে তিনি পুরুষ হিসাবে আনবেন অথবা কাকে তিনি নারী হিসাবে আনবেন। কাকে তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখার মতো যোগ্যতা দিয়ে আনবেন, অথবা কাকে তিনি একেবারে নির্বোধ-বোকা হিসাবে পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন।

        মানুষের সৃজন ও আকৃতিদানের এসব প্রক্রিয়া সময়ের প্রতি মুহূর্তে পৃথিবীর অসংখ্য নারীর গর্ভাশয়ে বিরামহীন গতিতে সক্রিয় রয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ভেতরে কোন একটি পর্যায়েও একমাত্র আল্লাহ ব্যতিত পৃথিবীর কোন একটি শক্তিও সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ নয়। এসব অসম্ভব প্রক্রিয়া দেখেও কেউ যদি বলে যে, বিচার দিবসে মানুষকে পুনরায় জীবনদান করা অসম্ভব ব্যাপার-তাহলে তাকে হতভাগা ও নির্বোধ ব্যতিত আর কোন বিশেষণে বিশেষিত করা যেতে পারে?

        মহান আল্লাহ মৃতদেরকে জীবিত করবেন, এ কথা শুনে অবাক হবার কিছুই নেই। প্রতিটি বস্তুর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই স্পষ্ট অনুভব করা যায় যে, আল্লাহ তা'য়ালা কোন প্রক্রিয়ায় মৃতকে জীবিত করছেন। এখানে পুনরায় বলতে হচ্ছে, গ্রহণকৃত খাদ্যের যেসব উপাদান দ্বারা মানুষের দেহ গঠিত হচ্ছে এবং যেসব উপকরণ দ্বারা সে প্রতিপালিত হচ্ছে, সেসব উপায়-উপকরণসমূহ বিশ্লেষণ করলে নানা ধরনের পদার্থ ও অন্যান্য উপাদান পাওয়া যাবে কিন্তু জীবন ও মানবাত্মার কোন বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব তার ভেতরে পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে এসব মৃত, নির্জীব উপায়-উপকরণগুলোর সমাবেশ ঘটিয়েই মানুষকে একটি জীবিত ও প্রাণের স্পন্দন সম্বলিত অস্তিত্বে পরিণত করা হয়েছে। তারপর নানা উপাদান সম্বলিত খাদ্য মানুষের শরীরে পরিবেশন করা হয় এবং দেহের অভ্যন্তরে গ্রহণকৃত খাদ্যের নির্যাসের সাহায্যে পুরুষের মধ্যে এমন শুক্রকীট এবং নারীর মধ্যে এমন ডিম্বকোষের সৃষ্টি হয়, যাদের মিলিতরূপে প্রতি মুহূর্তে জীবন্ত ও প্রাণবন্ত মানুষ প্রস্তুত হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে বের হয়ে আসছে।

        আল্লাহ তা'য়ালা কিভাবে মৃত থেকে জীবিত বের করেন, মানুষ দেখতে পারে তার চার পাশের পরিবেশের প্রতি দৃষ্টি দিয়ে। বাতাস, পাখি ও অন্যান্য প্রাণী অসংখ্য উদ্ভিদের বীজ ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে রাখে। নানা ধরনের উদ্ভিদের মূল মাটির সাথে মিশে ছিল। এসবের মধ্যে উদ্ভিদ জীবনের সামান্যতম লক্ষণও বিদ্যমান ছিলনা। এসব বীজ ও মূল যেন কবরে প্রথিত রয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। ওমনি উদ্ভিদের নিষ্প্রাণ বীজ আর বৃক্ষমূলগুলো মাটির কবর থেকে চারাগাছ রূপে মাথা উঁচু করে নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ করলো। মৃতকে জীবিত করার এই দৃষ্টি নান্দনিক দৃশ্য-এসব দেখেও যারা মনে করে, বিচার দিবসে আল্লাহর পক্ষে মৃত মানুষদেরকে জীবিত করা অসম্ভব, তাদেরকে চোখ-কান থাকার পরেও অন্ধ-বধির বিশেষণে বিশেষিত করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় থাকে না।

        সৃষ্টিজগতের এসব নিদর্শনই বলে দিচ্ছে যে, মহান আল্লাহ অসীম শক্তিশালী এবং সেই শক্তির সামান্য অংশ প্রয়োগ করেই তিনি বিচার দিবসে মৃতদেরকে জীবিত করবেন। উদ্ভিদের জীবনধারার মধ্যে আল্লাহ তা'য়ালার মক্তিমত্তার যে অভাবনীয় কর্মকুশলতা দেখা যায়, সেগুলো দেখার পর কি কোন জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি এ কথা বলতে পারে যে, সৃষ্টিজগতে এ পর্যন্ত যেসব কর্ম আল্লাহর পক্ষ থেকে সম্পাদন করা হয়েছে এবং হচ্ছে, আল্লাহ এসবের বাইরে আর কোন নতুন কর্ম সম্পাদন করতে অক্ষম?

        এ ধরনের অবাঞ্ছিত ধারণা আল্লাহ সম্পর্কে যারা করেন, তাদের কাছে আমরা বিনয়ের সাথে নিবেদন করতে চাই, মানুষের সম্পর্কে স্বয়ং মানুষের ধারণা আজ থেকে মাত্র এক শতাব্দী বা পঞ্চাশ বছর পূর্বে কেমন ছিল? বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের পূর্বে এই মানুষ ধারণা করতে সক্ষম হয়নি যে, তারা এরচেয়ে বড় কোন কর্ম সম্পাদন করতে সক্ষম হবে। অথচ তারা ঐ বাষ্প ইি নের থেকেও লক্ষ কোটি গুণে কার্যোপযোগী যন্ত্রযান নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯৭ সনে আমি যখন লন্ডন সফর করি তখন সেখানের কিছু লোকজন আমাকে এমন একটি ডিজিটাল ডায়েরী দিয়েছিল, যার ভেতরে অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণ করা ছাড়াও হাজার হাজার টেলিফোন নম্বর সংরক্ষণ করা যায়। এই ধরনের ডায়েরী মানুষ আবিষ্কারে সক্ষম হবে, এ কথা তারা মাত্র কিছুদিন পূর্বেও কল্পনা করতে পারেনি। মানুষ কম্পিউটার আবিষ্কার করেছে। এই কম্পিউটারের ভেতরে গোটা পৃথিবীর অসংখ্য তথ্য সংরক্ষণ করা যায়। এভাবে প্রযুক্তিগত দিক থেকে মানুষ যে উন্নতি করছে, কিছুদিন পূর্বেও মানুষ এসব বিষয় সম্পর্কে কল্পনা করতে সক্ষম হয়নি। মহাশূন্য যান সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণা ছিল না। অথচ বর্তমানে তা কঠিন বাস্তবতা এবং এসব দেখে মানুষ আর বিস্ময়বোধ করে না। সীমিত ক্ষমতার অধিকারী মানুষের কর্মক্ষমতা সম্পর্কে যখন কোন সীমা নির্ধারণ করা যায় না, অথচ এই মানুষ কি করে সেই অসীম ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর কর্ম ক্ষমতার সীমা নির্ধারণ করে দিয়ে বলে যে, মৃত্যুর পরে পুনরায় জীবন দেয়া আল্লাহর পক্ষে সম্ভব নয় এবং বিচার দিবসে তিনি সমস্ত মানুষকে একত্রিত করতে পারবেন না? তিনি এ পর্যন্ত যা কিছু সৃষ্টি করেছেন, এসবের থেকে অন্য কিছু নতুন করে সৃষ্টি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়?

        অথচ সৃষ্টিজগতের প্রতিটি সৃষ্টির নিপুণতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ঘোষণা করছে যে, তিনি অসীম ক্ষমতা ও বিজ্ঞতার অধিকারী। তিনিই মানুষকে হাসিয়ে থাকেন আবার তিনিই মানুষকে কাঁদিয়ে থাকেন। জীবন ও মৃত্যুর বাগডোর একমাত্র তাঁরই হাতে নিবদ্ধ। সূরা নাজম-এর ৪৩ থেকে ৪৮ নং আয়াতে ঘোষণা করা হয়েছে-

وَأَنَّهُ هُوَ أَضْحَكَ وَابْكَى - وَأَنَّهُ هُوَ أَمَاتَ وَأَحْيَا وَأَنَّهُ خَلَقَ الزَّوْجَيْنِ الذكر والأنثى - مِنْ نُّطْفَةٍ إِذَا تُمْنَى وَأَنَّ عَلَيْهِ النَّشَاةَ . الأخرى - وَأَنَّهُ هُوَ اغْنى وَأَقْنى

        আর এই যে, তিনিই মানুষকে আনন্দানুভূতি দিয়েছেন এবং তিনিই দুঃখানুভূতি দিয়েছেন। তিনিই মৃত্যু দিয়েছেন এবং তিনিই জীবনদান করেছেন। তিনিই পুরুষ ও স্ত্রীর জোড়া সৃষ্টি করেছেন, এক ফোটা শুক্র থেকে যখন তা নিক্ষিপ্ত হয়। দ্বিতীয়বার জীবনদান করাও তাঁরই দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত। তিনিই ধনী বানিয়েছেন এবং বিষয়-সম্পত্তি দান করেছেন।

        নিত্য নতুন নানা ঘটনা আল্লাহ তা'য়ালা ঘটিয়ে চলেছেন। পত্র-পত্রিকায় মাঝে মধ্যে সংবাদ পরিবেশিত হয়, মানুষ চোখেও দেখে থাকে, মাতৃগর্ভের গর্ভাশয়ে একসাথে পাঁচটি দশটি পর্যন্ত সন্তান আল্লাহ দান করে থাকেন। এসব দেখেও মানুষ কি করে ধারণা করে, নতুনভাবে তিনি দ্বিতীয় বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে পারবেন না? আল্লাহ প্রশ্ন করছেন-

كَيْفَ تَكْفُرُونَ بِاللَّهِ وَكُنْتُمْ أَمْوَتًا فَأَحْيَاكُمْ ثُمَّ يُمِيْتُكُمْ ثُمَّ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

        তোমরা আল্লাহর সাথে কি করে কুফুরীর আচরণ করতে পারো। অথচ তোমরা প্রাণহীন ছিলে, তিনিই তোমাদেরকে জীবনদান করেছেন। তারপর তিনিই তোমাদের প্রাণ হরণ করবেন এবং পুনরায় তিনিই তোমাদেরকে জীবনদান করবেন। অবশেষে তাঁরই কাছে তোমাদেরকে ফিরে যেতে হবে। (সূরা বাকারা-২৮)

        মানুষ মৃত্যুর পরের জীবন তথা বিচার দিবস সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করবে, এ জন্য তিনি পৃথিবীতেই মৃত্যুর পরে জীবনদানের প্রক্রিয়া সংঘটিত করেছেন, যেন মানুষের মনে কোন ধরনের সন্দেহ-সংশয় দানা বাঁধতে না পারে। অস্তিত্বহীন মানুষকে তিনি অস্তিত্ব প্রদান করেছেন, আবার তিনিই তাকে মৃত্যুদান করবেন। আবার তিনিই পুনরায় জীবনদান করে বিচার দিবসে একত্রিত করবেন। কিভাবে করবেন, তিনি তা মানুষকে প্রত্যক্ষ করার সুযোগ দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা হাদীদের ১৭ নং আয়াতে বলেন-

اعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يُحْيِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا -

        এ কথা ভালোভাবে জেনে নাও যে, পৃথিবীর এই মৃত যমীনকে তিনিই জীবনদান করেন।

        পৃথিবীতে মানুষের চোখের সামনে মৃত জিনিসগুলোকে পুনরায় জীবনদান করে মানুষকে দেখানো হয়, এভাবেই তিনি বিচার দিবসে মানুষকে পুনরায় জীবনদান করবেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কর্মগুলোকে শক্তিমত্তার দৃষ্টি দিয়ে পর্যবেক্ষণ করলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মন সাক্ষী দেয় যে, তিনি যখনই ইচ্ছা করবেন, তখনই সমস্ত মৃতকে পুনরায় জীবিত করতে সক্ষম। ইতিপূর্বে যাদের কোন অস্তিত্ব ছিল না, তাদেরকে তিনি অস্তিত্ব দান করেছেন। অপরদিকে আল্লাহর কাজগুলোকে যদি তাঁর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হয়, তাহলে বুদ্ধিবৃত্তি সাক্ষী দেয় যে, তিনি মানুষকে পুনরায় জীবনদান করে হিসাব গ্রহণ করবেন।

        মানুষ যে সীমিত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা লাভ করেছে এর অনিবার্য ফল হিসাবে দেখা যায় যে, তারা যখনই নিজের অর্থ-সম্পদ, ব্যবসা-বাণিজ্য অন্য কারো হাতে সোপর্দ করে দেয়, তখন এমনটি কখনো ঘটে না যে, সে কোন হিসাব গ্রহণ করে না। কারো কাছে কোন কিছু সোপর্দ করলে সে তার পূর্ণ হিসাব গ্রহণ করে। পিতা তার সন্তানের পেছনে অর্থ ব্যয় করে সন্তান যেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করতে সমর্থ হয়। সন্তান কোন কারণে তা অর্জন করতে ব্যর্থ হলে পিতা তাকে বলে, এবার হিসাব দাও-তোমার পেছনে আমি এত কষ্ট করে যে অর্থ ব্যয় করলাম, তা কোন কাজে লাগলো? ব্যবসা করার জন্য অর্থ প্রদান করে পিতা দেখতে থাকেন, তার সন্তান কতটা সফলতা অর্জন করলো বা ব্যর্থ হলো।

        অর্থাৎ আমানত ও হিসাব-নিকাশের মধ্যে যেন একটি অনিবার্য যৌক্তিক সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। মানুষের সীমিত জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কোন অবস্থাতেও এ সম্পর্ক উপেক্ষা করতে পারে না। এই জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতেই মানুষ ইচ্ছাকৃত কর্ম ও অনিচ্ছাকৃত কর্মের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে। আবারা ইচ্ছাকৃত কর্মের সাথে নৈতিক দায়-দায়িত্বের ধারণা ওৎপ্রোতাভাবে জড়িত এবং তা কল্যাণ ও অকল্যাণের পার্থক্য নির্দেশ করে। কল্যাণমূলক কর্মের পরিসমাপ্তিতে সে প্রশংসা ও পুরস্কার লাভ করতে আগ্রহী হয় এবং অকল্যাণমূলক কর্মের শেষে উপযুক্ত প্রতিফল দাবি করে। এই উদ্দেশ্য সাধন করার লক্ষ্যে মানুষ আবহমান কাল থেকে পৃথিবীতে একটি প্রতিষ্ঠিত বিচার ব্যবস্থাও রচিত করেছে।

        সৎকর্মের পুরস্কার ও অসৎকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করতে হবে-এই ধারণা যে আল্লাহ মানুষের মস্তিষ্কে দান করেছেন, স্বয়ং সেই আল্লাহ সৎকর্মের পুরস্কার ও অসৎকর্মের জন্য শাস্তি প্রদান করার ধারণা হারিয়ে ফেলেছেন, এ কথা কি কোন নির্বোধেও বিশ্বাস করবে? বৈজ্ঞানিক কলা-কৌশলে পরিপূর্ণ সৃষ্টি এই পৃথিবীর সমস্ত কিছু মানুষের অধীন করে দিয়েছেন, পৃথিবীর যাবতীয় উপায়-উপকরণ মানুষের হাতে সোপর্দ করে দিয়েছেন-বিপুল ক্ষমতা লাভ করে মানুষ এসব কোন পন্থায় কিভাবে কোন কাজে ব্যবহার করলো, আল্লাহ এসব সম্পর্কে কোন হিসাব গ্রহণ করবেন না, এ কথা কি কোন সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী ব্যক্তি অস্বীকার করতে পারে? সামান্য পুঁজি বিনিয়োগ করে মানুষ যদি বার বার হিসাব গ্রহণ করে, হিসাবে যদি দেখতে পায় যে, যার হাতে পুঁজি দেয়া হয়েছিল, সে সফলতা অর্জন করেছে। তখন তাকে পুঁজি বিনিয়োগকারী পুরস্কার দান করে। আর যদি হিসাব করে দেখে যে, বিনিয়োগকৃত পুঁজির অপব্যবহার করা হয়েছে, তখন তাকে শাস্তি প্রদান করে। এটা যদি মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে, তাহলে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু আল্লাহ মানুষের হাতে অর্পণ করার পরে তা কিভাবে মানুষ ব্যবহার করলো, এ সম্পর্কে তিনি কোন হিসাব গ্রহণ করবেন না, এ কথা কি বিশ্বাস করা যায়? আল্লাহ তা'য়ালা নিজের এতবড় বিশাল পৃথিবীর সাজ-সরঞ্জাম ও ব্যাপক ক্ষমতা সহকারে মানুষের হতে সোপর্দ করার পর তিনি হিসাব গ্রহণ করার কথা কি ভুলে গিয়েছেন? মানুষ অসৎ কর্ম সম্পাদন করে অর্থ আর প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে পৃথিবীর আইনের চোরাগলি দিয়ে বেরিয়ে এসেছে, কোন শাস্তি তাকে প্রদান করা যায়নি, কখনো কোনদিন তাকে এ ব্যাপারে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কোন আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে না, এ কথা কি মেনে নেয়া যায়? মানুষের চোখের সামনে পরিদৃশ্যমান যাবতীয় বস্তু এ কথারই সাক্ষী দিচ্ছে যে, সবকিছুর পরিসমাপ্তিতে আরেকটি জগৎ সৃষ্টি হতেই হবে এবং সেখানে মানুষের যাবতীয় কথা ও কর্ম সম্পর্কে মানুষ জিজ্ঞাসিত হবে। মানুষ তার কর্ম সম্পর্কে ভুলে যায় যে, সে অতীতে কি করেছে। তার ভুলে যাওয়া কর্ম সম্পর্কে সেদিন তাকে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহ বলেন-

 يَوْمَ يَبْعَثُهُمُ اللَّهُ جَمِيعًا فَيُنَبِّئُهُمْ بِمَا عَمِلُوا - - أَحْصَهُ اللَّهُ وَنَسُوهُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ

        সেদিন আল্লাহ তা'য়ালা এদের সবাইকে পুনরায় জীবিত করে উঠাবেন এবং তারা যা কিছু করে এসেছে তা তাদেরকে জানিয়ে দিবেন। তারা তো ভুলে গিয়েছে (নিজেদের কর্ম সম্পর্কে), কিন্তু আল্লাহ তাদের যাবতীয় কৃতকর্ম গুণে গুণে সংরক্ষিত করেছেন। আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের ব্যাপারে সাক্ষী। (সূরা আল মুজাদালা-৬)

        বিচার দিবসে মানুষ যা করেছে, তাই তার সামনে পেশ করা হবে। এ ব্যাপারে কোন হ্রাস-বৃদ্ধি করা হবে না। মানুষের কর্মই নির্ধারণ করবে তার ভবিষ্যৎ। তারই কর্মই তার জন্য স্থান নির্বাচন করবে। মানুষ নিজের হাতে যা উপার্জন করেছে, তার ভিত্তিতেই আল্লাহ তা'য়ালা সেদিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। কাউকে তিনি অযথা অভিযুক্ত করবেন না। আল্লাহ বলেন-

ذَالِكَ بِمَا قَدَّ مَنْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللَّهَ لَيْسَ بِظَلامِ لِلْعَبِيدِ

        এ হচ্ছে তোমার ভবিষ্যৎ, যা তোমার হাত তোমার জন্য প্রস্তুত করেছে, আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি যুলুম করেন না। (সূরা আল হাজ্জ-১০)

Post a Comment

0 Comments