সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহর অসীম দয়া সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। সর্বত্র তাঁর রাহমত বৃষ্টির মতোই বর্ষিত হচ্ছে। তিনি দয়া করছেন আর তাঁর দয়ার সুযোগে একশ্রেণীর লোক তাঁর বিধান একের পর এক লঙ্ঘন করেই চলেছে। তাঁর বিধান লঙ্ঘন করা হচ্ছে, অথচ সাথে সাথে তাদেরকে কোন ধরনের শাস্তির মুখোমুখী হতে হচ্ছে না, এ কারণে তারা বেপরোয়া হয়ে ধারণা করছে যে, কিয়ামতও ঘটবে না এবং তাদের কোন কর্মেরও হিসাব আল্লাহর কাছে দিতে হবে না। আল্লাহ বলেন-
كَتَبَ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ لَيَجْمَعَنَّكُمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيمَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ
তিনি নিজের ওপর দয়া ও অনুগ্রহের নীতি অবলম্বন করার বাধ্য-বাধকতা স্বীকার করে নিয়েছেন। (এ কারণেই তোমাদের আইন অমান্য ও আল্লাহদ্রোহীতার শাস্তি সাথে সাথেই দেন না।) কিয়ামতের দিন তিনি তোমাদের সবাইকে একত্রিত করবেন। বস্তুত এটা এক সন্দেহাতীত সত্য।
(সূরা আল আন'আম-১২)
তাঁর বিধান অমান্য করার সাথে সাথে তিনি এই পৃথিবীতে কাউকে গ্রেফতার করবেন না বা আযাব অবতীর্ণ করবেন না-এই নীতি তিনি গ্রহণ করেছেন। এ কারণেই দেখা যায় যে, বান্দাহ্ বিদ্রোহ করার পূর্বেও যেমন এই পৃথিবীর যাবতীয় নিয়ামত তার খেদমতে নিয়োজিত ছিল, বিদ্রোহ করার পরেও সেসব নিয়ামত তার খেদমতেই নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, তিনি তাদেরকে গ্রেফতার করবেন না। তিনি কিয়ামত সংঘটিত করবেন এবং সেদিন সবাইকে একত্রিত করে হিসাব গ্রহণ করবেন। সেদিনটি পূর্ব নির্ধারিত এবং কিয়ামত সংঘটিত হবার ব্যাপারে বিন্দমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার অগণিত সৃষ্টির মধ্যে এমন এক অদৃশ্য শক্তি যার নাম মধ্যকার্ষন-অভিকর্ষণ শক্তি সৃষ্টি করেছেন। যে শক্তি আমরা চোখে দেখতে পাই না কিন্তু অনুভব করি। পৃথিবীর আকার আয়তন যত বড় তার চেয়েও আকার আয়তনে বড় ওই সূর্য, আবার যে সমস্ত তারকা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই, তা ওই সূর্যের চেয়েও বড় আবার যে সমস্ত তারকার আলো এ পর্যন্ত পৃথিবীর এসে পৌঁছেনি, ওই সমস্ত তারকা আরো বড়। এক অদৃশ্য শক্তির কারণেই ওই সমস্ত তারকা, গ্রহ, নক্ষত্র যার যার কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে। ফিয়ামতের দিন ওই অদৃশ্য শক্তি মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিষ্ক্রিয় করে দিবেন। ফলে সমস্ত তারকা, গ্রহ, নক্ষত্র নিজের কক্ষচ্যুত হয়ে যাবে। সংঘর্ষ ঘটবে একটির সাথে অপরটির। ফলে সমস্ত কিছু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে। মধ্যাকর্ষণ শক্তি নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার ফলে পৃথিবীর সমস্ত কিছু তুলার মতো ভেসে বেড়াবে। তখন একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ ঘটে বিকৃত হয়ে অবশেষে তা ধ্বংস প্রাপ্ত হবে। এ ঘটনা ঘটবে মুহূর্তের মধ্যে। কিয়ামত সংঘটিত হতে কতটুকু সময় লাগবে সে ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন-
وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَوَتِ وَالْأَرْضِ وَمَا أَمْرُ السَّاعَةِ إِلَّا كَلَمْحِ الْبَصَرِ أَوْ هُوَ أَقْرَبُ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
মহাধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হতে কিছুমাত্র বিলম্ব হবে না। শুধু এতটুকু সময় মাত্র লাগবে, যে সময়ের মধ্যে চোখের পলক পড়ে বা তার চেয়েও কম। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ সব কিছু করতে পূর্ণ ক্ষমতাবান। (নাহল-৭৭)
কোন প্রক্রিয়ায় সেই মহাধ্বংসযজ্ঞ অনুষ্ঠিত হবে সে সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কোরআনে সূরা যুমারের ৬৮ নং আয়াতে বলেছেন-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ إِلَّا شَاءَ اللَّهُ
আর সেদিন শিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। সাথে সাথে আকাশ ও পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে তা সমস্তই মরে পড়ে থাকবে। তবে আল্লাহ যাদের জীবিত রাখতে ইচ্ছুক তারা ব্যতিত।
এই পৃথিবী যে ক্রমশঃ ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে, এ কথা আমরা পূর্বেই আলোচনা করেছি। সুদূর সপ্তম শতাব্দীতে পবিত্র কোরআন ঘোষণা করেছে এই পৃথিবী নির্দিষ্ট সময়ে ধ্বংস হবে, সে কথাাটি বিজ্ঞান নতুন করে মানুষকে জানিয়ে দিয়েছে। সুতরাং কিয়ামতের ব্যাপার যারা সন্দেহ করে তাদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ বলেন-
اذا وَقَعَتِ الْوَاقِعَةُ لَيْسَ لِوَقْعَتِهَا كَاذِبَةٌ
যখন সেই সংঘটিত হবার ঘটনাটি হয়েই যাবে, তখন তার সংঘটনের ব্যাপারে মিথ্যা বলার মতো কেউ থাকবে না। (সূরা ওয়াকিয়াহ্-১-২)
সমস্ত কিছুই মুহূর্তে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে সেদিন, পার্থিব কোন কিছুই টিকে থাকবে না। শুধু টিকে থাকবে মহান আল্লাহর আরশে আযিম। তাঁর চিরঞ্জীব সত্তা ব্যতিত অন্য কোন কিছুই টিকে থাকবে না। সূরা রাহমানের ২৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
كُلُّ مَنْ عَلَيْهَا فَانٍ وَيَبْقَى وَجْهُ رَبِّكَ ذُو الْجَلَالِ وَا الْإِكْرَامِ -
সমস্ত কিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে শুধু টিকে থাকবে তোমার মহীয়ান-গরীয়ান রবের মহান সত্তা।
সৃষ্টি জগতের ধ্বংস, নতুন জগত সৃষ্টি ও মানুষের পুনর্জীবন লাভ সবই আল্লাহর মহান পরিকল্পনা ও কর্মসূচীর আওতাভুক্ত। মহাধ্বংসযজ্ঞ শুরু করার জন্য ফেরেশতা হযরত ইসরাফীল আলাইহিস্ সালাম সিঙ্গা মুখের কাছে ধরে আরশে আজিমের দিকে আগ্রহে তাকিয়ে আছেন, কোন মুহূর্তে আল্লাহ আদেশ দান করবেন। ব্যাপারটা সহজে বুঝার জন্যে এভাবে ধারণা করা যায়, ইসরাফীল আলাইহিস্ সালাম আল্লাহর আদেশে এক মহাশক্তিশালী সাইরেন বাজাবেন বা বংশী ধ্বনি করবেন। কোরআনে এই বংশীকে বলা হয়েছে 'সূর'। ইংরেজীতে যাকে 'বিউগল' বলা হয়। সে বংশী ধ্বনি এক মহাপ্রলয়ের মহা তান্ডবলীলার পূর্বাভাস। সেটা যে কি ধরণের বংশী এবং তার আওয়াজই বা কি ধরনের তা মানুষের কল্পনারও অতীত। একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বিষয়টা সহজ হয়ে যায়। যেমন বর্তমান কালে যুদ্ধের সময় সাইরেন বাজানো হয়। যুদ্ধকালীন সাইরেনের অর্থ হলো বিপদ-মহাবিপদ আসন্ন। মহাবিপদের সংকেত ধ্বনি হিসেবে যুদ্ধের সময় সাইরেন বাজানো হয়।
তেমনি কিয়ামত সংঘটিত হবার মুহূর্তে চরম ধ্বংস, আতংক ও বিভীষিকা সৃষ্টি হতে যাচ্ছে-এটা জানানোর জন্যই সিংগায় ফুঁক বা সাইরেন বাজানো হবে। সিংগা থেকে ভয়ংকর শব্দ হতে থাকবে এবং বিরতিহীনভাবে এক ধরনের আতংক সৃষ্টিকারী আওয়াজ হতে থাকবে। সে শব্দে মানুষের কানের পর্দা ফেটে যাবে। সবাই একই গতিতে সেই বিকট শব্দ শুনতে পাবে। মনে হবে যেন তার কানের কাছেই এই শব্দ হচ্ছে। ভয়ংকর সেই শব্দ কেউ একটু কম কেউ একটু বেশী শুনবে না। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর অসীম কুদরতের মাধ্যমে সবার কানে সেই শব্দ একই গতিতে পৌঁছে দেবেন।
হাদিস শরীফে এই 'সূর' বা সিংগাকে তিন ধরনের বলা হয়েছে। নাফখাতুল ফিযা-অর্থাৎ ভীত সন্ত্রস্ত ও আংকতগ্রস্থ করার সিংগা ধ্বনী। নাফখাতুস সায়েক-অর্থাৎ মরে পড়ে যাওয়ার সিংগা ধ্বনী। নাফখাতুল কিয়াম-অর্থাৎ কবর হতে পুনর্জীবিত করে হাশরের ময়দানে সকলকে একত্র করার সিংগা ধ্বনী। অর্থাৎ হযরত ইসরাফীল আলাইহিস্ সালাম তিনবার সিংগায় ফুঁক দিবেন। প্রথমবার সিংগায় ফুঁক দেয়ার পরে এমন এক ভংকর প্রাকৃতিক বিশৃংখলা বিপর্যয় সৃষ্টি হবে যে, মানুষ ও জীবজন্তু ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উম্মাদের মতো ছুটাছুটি করবে। গর্তিনীর গর্ভের সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়ে যাবে। বাঘের পেটের নিচে ছাগল আশ্রয় নেবে কিন্তু বাঘের স্মরণ থাকবে না ছাগলকে ধরে খেতে হবে। অর্থাৎ এমন ধরনের ভয়ংকর সন্ত্রাসের সৃষ্টি হবে।
দ্বিতীয়বার সিংগায় ফুঁক দেয়ার সাথে সাথেই যে যেখানে যে অবস্থায় থাকবে, সে অবস্থায়ই মৃত্যুবরণ করবে। তারপর কিছু সময় অতিবাহিত হবে। সে সময় কত বছর, কত মাস, কতদিন বা কত ঘন্টা হবে তা মহান আল্লাহই ভালো জানেন। এরপর তৃতীয়বার সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। সাথে সাথে সমস্ত মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে হাশরের ময়দানে জমায়েত হবে। হাশরের ময়দানের বিশালতা কি ধরনের হবে তা আল্লাই জানেন। মহান আল্লাহ বলেন-
يَوْمَ تُبَدِّلُ الْأَرْضُ غَيْرَ الْأَرْضِ وَالسَّمَوَاتُ وَبَرَزُوا لِلَّهِ الْوَاحِدِ القَهَّارِ وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ سَرَابِيلُهُمْ مِّنْ قَطِرَانِ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ لِيَجْزِيَ اللَّهُ كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ إِنَّ اللَّهَ سَرِيعُ الْحِسَابِ
(তাদেরকে সেদিনের ভয় দেখাও) যেদিন যমিন আসমানকে পরিবর্তন করে অন্যরূপ দেয়া হবে। তারপর সকলেই মহাপরাক্রান্তশালী এক আল্লাহর সামনে হাতে পায়ে শিকল পরা এবং আরামহীন অবস্থায় হাজির হয়ে যাবে। সেদিন তোমরা পাপীদেরকে দেখবে আলকাতরার পোষাক পরিধান করে আছে আর আগুনের লেলিহান শিখা তাদের মুখমন্ডলের উপর ছড়িয়ে পড়তে থাকবে। এটা এ জন্যে হবে যে আল্লাহ প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের বিনিময় দেবেন। আল্লাহর হিসাব গ্রহণ করতে বিলম্ব হয় না। (সূরা ইবরাহীম-৪৮-৫১)
গভীরভাবে কোরআন হাদীস অধ্যায়ন করলে অনুমান করা যায় যে, কিয়ামতের দিন বর্তমানের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাপনার অবসান ঘটিয়ে নতুন একজগত মহান আল্লাহ প্রস্তুত করবেন। সে জগতের নামই পরকাল বা পরজগত। সে জগতের জন্যেও নিয়ম কানুন রচনা করা হবে। তারপর তৃতীয়বার সিংগায় ফুঁক দেয়ার সাথে সাথে হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শুরু করে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত মৃত্যুবরণকারী সমস্ত মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে। এই উপস্থিত হওয়াকেই কোরআনে হাশর বলা হয়েছে। হাশর শব্দের অর্থ হলো চারদিক থেকে গুটিয়ে একস্থানে সমাবেশ করা। আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন-
إِذَا رُجَتِ الْأَرْضُ رَجًا -
পৃথিবীটা তখন হঠাৎ করেই কাঁপিয়ে দেয়া হবে। (সূরা ওয়াকিয়াহ্-৪)
কিয়ামতের দিন প্রচন্ড ভূমিকম্প হবে। এ ভূমিকম্পের কম্পনের মাত্রা যে কত ভয়ংকর হবে তা অনুমান করা কঠিন। পৃথিবীর নির্দিষ্ট কোন এলাকায় ভূমিকম্প হবে না, বরং গোটা পৃথিবী জুড়ে একই সময়ে হবে। হঠাৎ করেই পৃথিবীটাকে ধাক্কা দেয়া হবে। ফলে পৃথিবী ভয়াবহভাবে কাঁপতে থাকবে। সেদিন মহাশূন্যে পাহাড় উড়বে। আল কোরআন ঘোষণা করছে, পৃথিবী সৃষ্টির পরে তা কাঁপতে থাকে, পরে পাহাড় সৃষ্টি করে মধ্যাকর্ষণ শক্তিদ্বারা পেরেকের ন্যায় পৃথিবীতে বসিয়ে দেয়া হয়। পৃথিবী তখন স্থির হয়। কিন্তু কিয়ামতের দিন মধ্যাকর্ষণ শক্তি আল্লাহ উঠিয়ে নেবেন। ফলে পাহাড়সমূহ উড়তে থাকবে অর্থাৎ মহাশূন্যে ভেসে বেড়াবে। মহান আল্লাহ বলেন-
وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا -
পাহাড় চালিয়ে দেয়া হবে। অবশেষে তা কেবল মরিচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা-২০)
মহাশূন্যে বিক্ষিপ্তভাবে পাহাড়সমূহ চলতে থাকবে। ফলে একটার সাথে আরেকটির ধাক্কা লেগে ধ্বংসের এক বিভিষীকা সৃষ্টি হবে। অন্যত্র আল্লাহ বলেন-
وَيَسْتَلُونَكَ عَنِ الْجِبَالِ فَقُلْ يَنْسِفُهَا رَبِّي نَسْفًا -
আর মানুষ আপনাকে পাহাড় সম্পর্কে প্রশ্ন করে, আপনি জানিয়ে দিন আমার রব্ব তা সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দিবেন। (সূরা ত্ব-হা-১০৫)
পাহাড় বলতে মানুষ অনুমান করে এমন একবস্তু যা কোন দিন হয়ত ধ্বংস হবে না। মানুষ কোন বিষয়ের স্থিরতা সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে পাহাড়ের দৃষ্টান্ত দিয়ে কথা বলে। কিন্তু মহান আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
وَتَرَى الْجِبَالَ تَحْسَبُهَا جَامِدَةً وَهِيَ تَمُرُّ مَرَّ السَّحَابِ
আজ তুমি পাহাড় দেখে মনে করছো যে এটা বোধহয় অত্যন্ত দৃঢ়মূল হয়ে আছে, কিন্তু সেদিন তা মেঘের মতোই উড়তে থাকবে। (সূরা নামল-৮৮)
পৃথিবীর সমস্ত বস্তু যার যার স্থানে স্থির রয়েছে-আল্লাহর সৃষ্টি বিশেষ এক আকর্ষণী শক্তির কারণে। সেদিন এসব আকর্ষণী শক্তি আল্লাহর আদেশে অকেজো হয়ে পড়বে। ফলে পাহাড়গুলো যমীনের ওপরে আছাড়ে পড়তে থাকবে এবং তার অবস্থা কেমন হবে, আল্লাহ বলেন-
وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَالْعِهْنِ
পাহাড়গুলো রংবেরংয়ের ধুনা পশমের মতো হয়ে যাবে। (সূরা মায়ারিজ-৯)
পৃথিবীর পাহাড়সমূহকে শূন্যে উঠিয়ে তা আবার যমীনের বুকে আছড়ে ফেলা হবে। ফলে তা প্যাঁজা ধুনা তুলার মতো করে-বালির মতো করে মহাশূন্যে উড়িয়ে দেয়া হবে। পৃথিবীতে কোথায় কোনদিন পাহাড় ছিল, এ কথা কল্পনাও করা যাবে না। সূরা কারিয়ায় বলা হয়েছে-
الْقَارِعَةُ مَا الْقَارِعَةُ - وَمَا أَدْرَاكَ مَا الْقَارِعَةُ يَوْمَيَكُونُ النَّاسُ كَالْفَرَاشِ الْمَبْثُوثِ وَتَكُوْنُ الْجِبَالُ كَا الْعِهْنِ الْمَنْفُوشِ
ভয়াবহ দূর্ঘটনা! কী সেই ভয়াবহ দূর্ঘটনা? তুমি কি জানো সেই ভয়াবহ দূর্ঘটনা কি? সেদিন যখন মানুষ বিক্ষিপ্ত পোকার মতো এবং পাহাড়সমূহ রংবেরংয়ের ধুনা পশমের মতো হবে।
পৃথিবীর সমস্ত পর্বত একই ধরনের নয়। সব পর্বতের রং ও বর্ণও এক নয়। কোনটা লাল কোনটা কালো আবার কোনটা শুধু বরফের। পশম যেহেতু বিভিন্ন রংয়ের হয়ে থাকে সে হেতু পশমের সাথে আল্লাহ তুলনা দিয়েছেন। পশম বাতাসে উড়ে। পাহাড়সমূহও কিয়ামতের দিন পশমের মতো উড়তে থাকবে। শুধু তাই নয়, সেদিন ওই বিশাল পর্বতমালা শুন্যে উঠিয়ে মাটির উপর প্রচন্ড বেগে আছাড় দেয়া হবে। মহান আল্লাহ সেদিনের অবস্থা সম্পর্কে বলেন- وحملت الأَرْضُ وَالْجِبَالُ فَدُكَّتَا دَكَّةً وَاحِدَةً فَيَوْمَئِذٍ وَقَعَتِ الْوَاقِعةُ. পৃথিবী ও পর্বতসমূহকে শুন্যে প্রচন্ড আঘাতে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। সেদিন সেই সংঘটিতব্য ঘটনা ঘটবেই। (সূরা হাক্কাহ্-১৪-১৫)
পাহাড়সমূহ কিয়ামতের দিন মরিচীকার ন্যায় অস্তিত্বহীন হয়ে যাবে। যেখানে পাহাড়সমূহ স্থির অটলভাবে দাঁড়িয়ে ছিল, তার কোন চিহ্নই থাকবে না। কোরআন বলছে-
وبست الجِبَالُ بَسًا - فَكَانَتْ هَبَاءً مُّنْبَثًا -
পাহাড়সমূহকে এমনভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়া হবে যে, তা শুধু বিক্ষিপ্ত ধুলিকনায় পরিণত হবে। (সূরা ওয়াকিয়া-৫-৬)
মহাশূন্যের যাবতীয় গ্রহ-উপগ্রহ, নক্ষত্রমালা, তারকামন্ডলী জ্যোতিহীন হয়ে যাবে এবং সমস্ত কিছুর আলো নিঃশেষ হয়ে যাবে। উর্ধ্বজগতের সে সুসংবদ্ধ ব্যবস্থার কারণে প্রতিটি তারকা ও গ্রহ-উপগ্রহসমূহ নিজ নিজ কক্ষ পথে অবিচল হয়ে রয়েছে এবং যে কারণে বিশ্বলোকের প্রতিটি জিনিস নিজ নিজ সীমার মধ্যে আটক হয়ে আছে, তা সবই চূর্ণ-বিচূর্ণ ও ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয়া হবে। যাবতীয় বন্ধান সেদিন শিথিল করে দেয়া হবে। সূরা মুরসালাতে বলা হয়েছে-
فَإِذَا النُّجُومُ طَمِسَتْ وَإِذَا السَّمَاءُ فُرِجَتْ وَإِذَا الْجِبَالُ نُسِفَتْ
এরপর যখন নক্ষত্রমালা ম্লান হয়ে যাবে। আকাশ বিদীর্ণ হবে। তখন পাহাড়-পর্বত চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেয়া হবে। (সূরা মুরসালাত-৮-১০)
কিয়ামতের দিন ওই বিশাল পাহাড়ের অবস্থা যখন ধূলিকণায় পরিণত হবে, তখন মানুষের অবস্থা যে কি ধরনের হবে তা কল্পনা করলেও শরীর শিহরিত হয়। শূন্যে ভাসমান পাহাড়কে জমিনের উপরে আছড়ানো হবে। ভাসমান অবস্থায় একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ ঘটতে থাকবে, ফলে গোটা পৃথিবী জুড়ে এক ভয়াবহ বিভীষিকার সৃষ্টি হবে। আল্লাহ কিয়ামতের দিন সম্পর্কে বলেন-
فَارْتَقِبْ يَوْمَ تَأْتِي السَّمَاءُ بِدُخَانَ مُّبِيْنٍ يُغْشَى النَّاسَ - هُذَا عَذَابٌ أَلِيمٌ
তোমরা অপেক্ষা করো সেই দিনের যখন আকাশ-মন্ডল সুষ্পষ্ট ধোঁয়া নিয়ে আসবে। তা মানুষদের উপর আচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এটা হলো পীড়াদায়ক আযাব। (সূরা দুখান-১০-১১)
সেদিন আকাশ দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে। অসংখ্য তারকামালা খচিত সৌন্দর্য-মন্ডিত আসমান বর্তমান অবস্থায় থাকবেনা। আল্লাহ তা'য়ালা বলেন-
اذا السَّمَاءُ انْفَطَرَتْ
যখন আকাশ-মন্ডল ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। (সূরা ইনফিতার-১)
সেদিন এমন ভায়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করা হবে যে, ভয়ে-আতঙ্কে, দুশ্চিন্তায় অল্প বয়স্ক বালকগুলোকে বৃদ্ধের ন্যায় দেখা যাবে। সূরা মুয্যামিলের ১৭-১৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
يَوْمًا يَجْعَلُ الوِلْدَانَ شَيْبًا - السَّمَاءُ مُنْفَطِرُ بِهِ كَانَ وَعْدُهُ مَفْعُولاً -
তাহলে সেদিন কিভাবে রক্ষা পাবে যেদিন বালকদেরকে বৃদ্ধ বানিয়ে দেয়া হবে। এবং যার কঠোরতায় আকাশ দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে। আর ওয়াদা তো অবশ্যই পূর্ণ করা হবে।
অর্থাৎ কিয়ামতের ভয়ংকর ঘটনা যে ঘটবে-আল্লাহ বারবার তা বলেছেন। সুতরাং, আল্লাহ যা বলেন তা অবশ্যই হবে। আসমান চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবে-পৃথিবীর মাটি ওলট-পালট হতে থাকবে। ফলে মাটির নিচে যা কিছু আছে, কিয়ামতের দিন মাটি তা উদগিরণ করে দেবে। আল্লাহ রব্বুল আলামীনবলেন-
إذا السَّمَاءُ انْشَقَّتْ وَآذَنَتْ لِرَبِّهَا وَحُقَّتْ وَإِذَا الْأَرْضُ مُدَّتْ وَالْقَتْ مَا فِيْهَا وَتَخَلَّتْ
যখন আকাশ মন্ডল ফেটে যাবে এবং নিজের রবের নির্দেশ পালন করবে, আর তার জন্যে এটাই যথার্থ। যখন মাটিকে সম্প্রসারিত করা হবে এবং তার গর্ভে যা কিছু আছে, তা সব বাইরে নিক্ষেপ করে মাটি শূন্য হয়ে যাবে। (সূরা ইনশিকাক-১-৪)
সেদিন আকাশ মন্ডল ভয়ংকরভাবে কাঁপতে থাকবে। কিয়ামতের দিন ঊর্ধ্বলোকের সমস্ত শৃংখলা ব্যবস্থা চুরমার হয়ে যাবে। তখন আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে মনে হবে, যে জমাট-বাঁধা দৃশ্য চিরকাল একই রকম দেখাতো-একইরূপ অবস্থা বিরাজমান মনে হতো, তা ভেঙে-চুরে পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে আর চারদিকে একটা প্রলয় ও অস্থিরতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধরিত্রীর যে শক্ত পাঞ্জা পর্বতগুলোকে অবিচল করে রেখেছিল, তা শিথিল হয়ে যাবে। পর্বতগুলো নিজের মূল থেকে বিচ্ছিন্ন ও উৎপাটিত হয়ে মহাশূন্যে এমনভাবে উড়তে থাকবে, যেমন আকাশে মেঘমালা উড়ে। সূরা তুর-এ ৯-১০ নং আয়াতে ঘোষনা করছে-
يَوْمَ تَمُورُ السَّمَاءُ مَوْرًا - وَتَسِيْرًا لِجِبَالُ سَيْرًا -
সেদিন আসমান থর থর করে কাঁপতে থাকবে। আর পর্বতসমূহ শূন্যে উড়ে বেড়াবে।
কিয়ামতের দিন কোন বস্তুই তার নির্দিষ্ট স্থানে থাকবে না। প্রতিটি বস্তু সেদিন নিজের স্থান থেকে বিচ্যুত হয়ে দ্রুত গতিতে ছুটাছুটি করতে থাকবে। ফলে একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষ ঘটে সব কিছু প্রকম্পিত হয়ে উঠবে। আকাশ মন্ডল এমনভাবে কাঁপতে থাকবে যেমনভাবে প্রচন্ড ঝড়ে বৃক্ষ তরুলতা কাঁপে। (কত জোরে কাঁপবে তা আল্লাহই ভালো জানেন। সাধারণভাবে বুঝার জন্য ঝড় এবং বৃক্ষ তরুলতার উদাহরণ দেয়া হলো।) তাবিজ বানানোর পূর্বে পাত বানোনো হয়। পরে পাত গুটিয়ে তাবিজ বানানো হয়। সেদিন আকাশের সেই অবস্থা হবে। কোন বই-পুস্তকের বন্ধন শিথিল করে প্রবল বাতাসের সামনে মেলে ধরলে যেমন একটির পর আরেকটি পৃষ্ঠা উড়তে থাকে, সেদিন আকাশমন্ডলী তেমনিভাবে উড়তে থাকবে। আকাশকে এমনভাবে গুটিয়ে নেয়া হবে, কাগজকে গুটিয়ে যেভাবে বান্ডিল বাঁধা হয়। মহান আল্লাহ বলেন-
يَوْمَ تطوى السَّاءَ كَطي السجل لِلكُتُبِ كَمَا بَدَانَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُهُ - وَعْدًا عَلَيْنَا إِنَّا كُنَّا فَاعِلَيْنَ
সেদিন, যখন আকাশকে আমি এমনভাবে গুটিয়ে ফেলবো যেমন বান্ডিলের মধ্যে গুটিয়ে রাখায় হয় লিখিত কাগজ। যেভাবে আমরা প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম, অনুরূপভাবে আমরা দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবো। এটা একটা ওয়াদা বিশেষ যা পূর্ণ করার দায়িত্ব আমার। এটা আবশ্যই আমি করবো। (সূরা আম্বিয়া-১০৪)
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন, চূড়ান্ত বিচারের দিন একটি পূর্ব নির্দিষ্ট দিন। সেদিন সিংগায় ফুঁ দেয়া হবে। তখন তোমরা দলে দলে বের হয়ে আসবে। আর আকাশমন্ডল উন্মুক্ত করে দেয়া হবে, ফলে তা কেবল দুয়ার আর দুয়ারে পরিণত হবে। পাহাড় চালিয়ে দেয়া হবে, পরিণামে তা নিছক মরীচিকায় পরিণত হবে। মহান আল্লাহ যতগুলো আকাশ সৃষ্টি করেছেন, তা একটির পর আরেকটি উন্মুক্ত হতে থাকবে। কোরআনের অন্যস্থানে আকাশ সম্পর্কে বলা হয়েছে-
يَوْمَ تَكُونُ السَّمَاءُ كَالْمُهْلِ
সেদিন আসমানসমূহ গলিত তামার ন্যায় হয়ে যাবে। (সূরা মায়ারিজ-৮)
কিয়ামতের দিন এমন অবস্থা হবে যে, যে ব্যক্তিই তখন আকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করবে শুধু আগুনের ন্যায় দেখতে পাবে। গলিত তামা যেমন অগ্নিকুন্ডে রক্তবর্ণ ধারণ করে টগবগ করে ফুটতে থাকে, সেদিন মহাশূন্যলোক তেমনি আগুনের রূপ ধারণ করবে। সূরা রাহমানের ৩৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
فَإِذَا انْشَقَّتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ وَرْدَةً كَالدِّهَانِ
যখন আকাশ মন্ডল দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে এবং তা রক্তিমবর্ণ ধারণ করবে।
সেদিন আকাশ মন্ডল উন্মুক্ত করে দেয়া হবে অর্থাৎ উর্ধ্বজগতে কোনরূপ আড়াল বা বাধা প্রতিবন্ধকতার অস্তিত্ব থাকবেনা, যেন বর্ষনের সমস্ত দরোজা খুলে দেয়া হয়েছে, গযব আসার কোন দরোজাই আর বন্ধ নেই। উর্ধ্বজগতে প্রতি মুহূর্তে বিশাল বিশাল উল্কাপাত হচ্ছে। যে উল্কা কোন দেশের উপর পড়লে সে দেশ মুহূর্তে ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু করুণাময় আল্লাহ মধ্যাকর্ষণ শক্তি এবং উর্ধ্বে শূন্যলোকে এমন অদৃশ্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছেন, যাতে করে ওই সমস্ত উল্কা পৃথিবীর মানুষের উপর পতিত না হয়। মাঝে মধ্যে দু'একটি উল্কা পৃথিবী পর্যন্ত এসে পৌঁছে, কিন্তু সেটাও মরুপ্রান্তরে পতিত হয়। কোন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পতিত হয় না। আল্লাহ বলেন-
وفُتِحَتِ السَّمَاءُ فَكَانَتْ أَبْوَابًا - وَسُيِّرَتِ الْجِبَالُ فَكَانَتْ سَرَابًا -
আকাশ মন্ডল উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। ফলে তা দুয়ার আর দুয়ার হয়ে যাবে। পাহাড়কে চলমান করে দেয়া হবে। পরিণামে তা শুধু মরিচিকায় পরিণত হবে। (সূরা নাবা-১৯-২০)
আধুনিক বিজ্ঞান বলছে এই পৃথিবী ক্রমশঃ এক মহাধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে অর্থাৎ পৃথিবীও একদিন মৃত্যুবরণ করবে। চন্দ্র, সূর্য, তারকা, গ্রহ-নক্ষত্র সমস্ত কিছু ধ্বংস হয়ে যাবে। অথচ এ সমস্ত কথা পৃথিবীর মানুষকে বহু শতাব্দী পূর্বে মহাগ্রন্থ আল কোরআন জানিয়ে দিয়েছে। কোরআন ঘোষণা করেছে-
فَإِذَا بَرِقَ الْبَصَرُ - وَخَسَفَ الْقَمَرُ - وَجُمِعَ الشَّمْسُ وَالْقَمَرُ - يَقُولُ الْإِنسَانُ يَوْمَئِذٍ أَيْنَ الْمَفَرُّ - كَلاً لا وَزَرَ إِلَى رَبِّكَ يَوْمَئِذٍ الْمُسْتَقَرُّ
দৃষ্টিশক্তি যখন প্রস্তরীভূত হয়ে যাবে এবং চন্দ্র আলোহীন হয়ে যাবে এবং সূর্যকে মিলিয়ে একাকার করে দেয়া হবে। তখন মানুষ (সন্ত্রস্ত হয়ে আর্তনাদ করে) বলবে কোথায় পালাবো? কখনো নয়, সেদিন তারা পালানোর জায়গা পাবে না। সেদিন সবাই তোমার রবের সামনে অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। (সূরা কিয়ামাহ-৮-১২)
চন্দ্রের আলোই শুধু নিঃশেষ হবে যাবে না, চন্দ্রের আলোর মূল উৎস স্বয়ং সূর্যও জ্যোতিহীন ও অন্ধকারময় হয়ে যাবে। ফলে আলো ও জ্যোতিহীনতা উভয়ই সম্পূর্ণ এক ও অভিন্ন হয়ে যাবে। কিয়ামতের দিন এই পৃথিবী অকস্মাৎ বিপরীত দিকে চলতে শুরু করবে ফলে সেদিন চন্দ্র ও সূর্য উভয়ই একই সময় পশ্চিম দিক থেকে উদিত হবে। চন্দ্র আকস্মিকভাবে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাবে ও সূর্যের গহ্বরে নিপতিত হবে। মহাশূন্যে যে সর্বভূক ব্লাকহোল সৃষ্টি করা হয়েছে, এই ব্লাকহোলের মধ্যে সমস্ত কিছু হারিয়ে যাবে। আল্লাহর কোরআনে বলা হয়েছে-
إِذا الشَّمْسُ كُورَتْ وَإِذَا النُّجُومُ انْكَدَرَتْ
যখন সূর্যকে গুটিয়ে ফেলা হবে এবং নক্ষত্ররাজি আলোহীন হয়ে যাবে। (সূরা তাকভীর-১-২) কোন বস্তুকে প্যাঁচানো বা গুটানোকে আরবী ভাষায় "তাকভির" বলা হয়। যেহেতু কিয়ামতের দিন সূর্যকে আলোহীন করা হবে সে কারণে রূপকভাবে বলা হয়েছে সূর্যকে গুটিয়ে ফেলা হবে। অর্থাৎ সূর্যের আলোকে গুটিয়ে ফেলা হবে। সমস্ত নক্ষত্রমালা জ্যোতিহীন হয়ে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়বে। চন্দ্রের নিজস্ব কোন আলো নেই। সূর্যের আলোয় চন্দ্র উজ্জ্বল দেখায়। সুতরাং সূর্যের আলো ছিনিয়ে নেয়ার পরে চন্দ্র আর আলোকিত দেখাবে না। চন্দ্র আর সূর্য বিপরীত দিকে ঘুরতে থাকবে। ফলে সূর্য পশ্চিম দিকে দেখা যাবে। এমনটিও হতে পারে চন্দ্র হঠাৎ করেই পৃথিবীর মধ্যাকর্ষন শক্তি হতে বন্ধনমুক্ত হয়ে সূর্যের কক্ষপথে গিয়ে পড়বে। ফলে চন্দ্র. সূর্য মিলে একাকার হয়ে যাবে। কিয়ামতের দিন কোন কিছুই সুশৃংখলভাবে নিজ অবস্থানে থাকতে পারবে না। সমস্ত বস্তু চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ধূলায় মিশে যাবে। নদী-সমুদ্র ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পবিত্র কোরআন মজিদে মহান আল্লাহ বলেন-
وَإِذَا الْبِحَارُ فُجَرَتْ
* যখন নদী-সমুদ্রকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করা হবে। (সূরা ইনফিতার-৩)
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, কিয়ামতের সময় গোটা পৃথিবী জুড়ে জলে-স্থলে এবং অন্তরীক্ষে এক মহাকম্পন সৃষ্টি করা হবে। ঐ কম্পনের ফলে নদী এবং সমুদ্রের তলদেশ ফেটে চৌচির হয়ে যাবে। পানি বলতে কোন কিছুই নদী-সমুদ্রে অবশিষ্ট থাকবে না। আল্লাহ বলেন-
وَإِذَا الْبِحَارُ سُجْرَتْ
এবং যখন নদী, সমুদ্র আগুনে পরিণত হবে। (সূরা আত-তাকভীর-৬)
কিয়ামতের দিন পানি পূর্ণ নদী ও অগাধ জলধী-সমুদ্রে, মহাসাগরে আগুন জ্বলতে থাকবে। কথাটা অনেকের কাছে নতুন অবিশ্বাস্য দুর্বোধ্য ও আশ্চর্যজনক মনে হয়। কিন্তু বিজ্ঞান যাদের পড়া আছে সেই সাথে পানির মূল উপাদান সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে, তাদের কাছে ব্যাপারটা নতুন কিছু নয় এবং অবিশ্বাস্য তো নয়ই। আল্লাহর অসীম কুদরতের বলে পানি হচ্ছে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন নামক দু'টো গ্যাসের মিশ্রণ। হাইড্রোজেন দাহ্য, এই গ্যাস নিজে জ্বলে। আর অক্সিজেন জ্বলতে সাহায্য করে। পানি অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের মিশ্রন হলেও আল্লাহর অসীম কুদরত যে, পানিই আগুন নেভায়। পানি-আগুনের শত্রু। আবার পানির অপর নাম জীবন। এক আয়াতে কোরআন বলছে নদী, সমুদ্র কিয়ামতের সময় আগুনে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। অপর আয়াত বলছে, সেদিন নদী ও সমুদ্র দীর্ণ-বিদীণ হয়ে যাবে। এখানে দু'টো ব্যাপার, (এক) আগুনে পরিপূর্ণ হবে নদী ও সমুদ্র। (দুই) নদী, সমুদ্র, দীর্ণ-বিদীর্ণ হবে। দু'টো বিষয়কে সামনে রাখলে নদী, সমুদ্রে আগুন জ্বলার বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
বিজ্ঞান বলছে এবং টিভির মাধ্যমে মানুষকে দেখাচ্ছেও মহাসাগরের অতল তলদেশে আগ্নেয়গিরি আছে। সেখান থেকে উত্তপ্ত লাভা নির্গত হচ্ছে। কিয়ামতের সময় প্রচণ্ড কম্পনের ফলে নদী ও সমুদ্রের তলদেশ ফেটে সমস্ত পানি এমন এক স্থানে গিয়ে পৌছবে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে এক কঠিন উত্তপ্ত লাভা টগবগ করে ফুটছে ও আলোড়িত হচ্ছে। সমুদ্রের তলদেশের এই স্তরে পানি পৌঁছে পানির দু'টো মৌল উপাদানে-হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন বিভক্ত হয়ে যাবে। অক্সিজেন প্রজ্জ্বালক ও হাইড্রোজেন উৎক্ষেপক। তখন এভাবে বিশ্লেষিত হওয়া এবং অগ্নি উদগীরণ হওয়ার এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যাবে। এভাবেই পৃথিবীর নদী ও সমুদ্র কিয়ামতের সময় আগুনে পরিপূর্ণ হবে। সমস্ত প্রক্রিয়া কিভাবে সম্পন্ন হবে, সে বিষয়ে মানুষের সঠিক জ্ঞান নেই, প্রকৃত বিষয় আল্লাহই ভালো জানেন।
তবে মানুষ যদি সেদিনের অবস্থা সম্পর্কে সামান্য ধারনা লাভ করতে চায়, তাহলে বিভিন্ন আগ্নেয়গিরি থেকে ধারণা লাভ করতে পারে। এমন অনেক আগ্নেয়গিরি রয়েছে, যাদের অবস্থান মহাসমুদ্রের গভীরে অথবা সমুদ্র নিকটবর্তী। সমুদ্রের পানির প্রচন্ড চাপকে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে রক্তিমবর্ণ উত্তপ্ত লাভা তীব্র বেগে ছুটতে থাকে। পানির ভেতর দিয়ে লাভা যে পথে অগ্রসর হয়, চারদিকের পানি উত্তপ্ত লাভা শোষণ করতে থাকে বা বাষ্পাকারে উড়ে যায়। পানির ভেতরেও তপ্ত লাভা টগবগ করে ফুটতে থাকে।
0 Comments