কেন বিচার দিবসের প্রয়োজন

         মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এই পৃথিবীকে উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। পৃথিবী ও আকাশ এবং এর মধ্যস্থিত কোন কিছুই নিছক খেয়ালের বশে সৃষ্টি করা হয়নি। তাঁর এই সৃষ্টি কোন শিশুর খেলনার মতো নয়। শিশুদের মতো মনের সান্ত্বনা লাভ ও মন ভুলানোর জন্য কোন খেলনার মতো করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়নি যে, শিশু কিছুক্ষণ খেলে তৃপ্তি লাভ করার পরে উদ্দেশ্যহীনভাবে একে দূরে ছুড়ে ফেলে দিল অথবা অবহেলা আর অনাদরে রেখে দিল বা ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলে দিল। নিজের দেহ থেকে শুরু করে আল্লাহর সমগ্র সৃষ্টির প্রতি সাধারণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেই এমন ধারণা করার কোন অবকাশ থাকে না। বরং তাঁর এ সৃষ্টি যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ, ঐকান্তিকতা ও বুদ্ধিমত্তার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত, এ কথা দিবালোকের মতই স্পষ্ট হয়ে যায়।

        সমগ্র সৃষ্টির প্রতিটি পরতে পরতে বিরাট উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে এবং এর প্রতিটি অধ্যায়ে লক্ষ্যও স্থির করা হয়েছে। সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ একটি পর্যায় সমাপ্ত ও অতিবাহিত হবার পরে আল্লাহ তা'য়ালা নিশ্চিতভাবে যাবতীয় কার্যের হিসাব-নিকাশ গ্রহণ করবেন এবং তার ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তী অধ্যায় রচিত করবেন। তিনি সমগ্র সৃষ্টিসমূহকে মহাসত্যের সুদৃঢ় ভিত্তির ওপরে সংস্থাপিত করেছেন। সৃষ্টির প্রতিটি দিক ন্যায়বিচার, সত্যতার নিময়-নীতি ও বিচক্ষণতার ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। দৃশ্য-অদৃশ্য সমস্ত কিছুর বাদশাহী একমাত্র তাঁরই এবং তিনি যখন ইচ্ছা পোষণ করবেন, তখনই আদেশ দানমাত্র সৃষ্টির প্রতিটি অনু-পরমাণু তাঁর দরবারে উপস্থিত হতে বাধ্য। কোরআন বলছে-

وَهُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضَ بِالْحَقِّ وَيَوْمَ يَقُولُ كُنْ فَيَكُونُ قَوْلُهُ الْحَقِّ وَلَهُ الْمُلْكُ يَوْمَ يُنْفَخُ فِي الصُّورِ عَالِمُ الْغَيْبِ وَالشَّهَادَةِ وَهُوَ الْحَكِيمُ الْخَبِيرُ

        তিনিই আকাশ ও যমীনকে যথাযথভাবে সৃষ্টি করেছেন এবং যেদিন তিনি বলবেন, হাশর হও, সেদিনই হাশর হবে। তাঁর কথা সর্বাত্মকভাবে সত্য এবং যেদিন শিঙ্গায় ফুঁ দেয়া হবে, সেদিন নিরঙ্কুশ বাদশাহী তাঁরই হবে। গোপন ও প্রকাশ্য সমস্ত কিছুই তাঁর জ্ঞানের আওতায়, তিনি অত্যন্ত সুবিজ্ঞ, সম্পূর্ণ পরিজ্ঞাত। (সূরা আল আন'আম-৭৩)

        সৃষ্টিজগতে সাধারণ মানুষ চর্মচোখে যা কিছু দেখতে পাচ্ছে এবং বিজ্ঞানীগণ দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে যা কিছু পর্যবেক্ষণ করছেন, সবকিছুর ভেতরে প্রতিনিয়ত একটি পরিবর্তনের ধারা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই পরিবর্তন সৃষ্টির শুরু থেকেই চলে আসছে। ঊর্ধ্বজগত ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হচ্ছে। সৃষ্টির নিপুণতা ও বিজ্ঞ-কৌশলীর নান্দনিক নির্মাণ শৈলী দেখে এ কথা ভাবার কোন যুক্তি নেই যে, এসব কিছু শিশুর খেলার ছলে সৃষ্টি করা হয়েছে।

        বরং সৃষ্টিসমূহের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে প্রতিটি বস্তুর সৃষ্টির ব্যাপারে গভীর উদ্দেশ্যবাদের স্পষ্ট চিহ্ন বিদ্যমান দেখা যায়। সুতরাং, স্রষ্টাকে যখন বিজ্ঞানী, যুক্তিবাদী বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে এবং তাঁর জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার স্পষ্ট নিদর্শন মানুষের সামনে বিরাজমান, তখন তিনি মানুষকে জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি, নৈতিক চেতনা, স্বাধীন দায়িত্ব ও প্রয়োগ-ক্ষমতা দেয়ার পর তার জীবনে কৃত ও সংঘটিত কার্যাবলীর কোন হিসাব গ্রহণ করা হবে না এবং বিবেক ও নৈতিক দায়িত্বের ভিত্তিতে শাস্তি ও পুরস্কার লাভের যে অধিকার অনিবার্যভাবে জন্মে থাকে, তা স্রষ্টা নিষ্ফল ও ব্যর্থ করে দিবেন এ ধারণার কোন সত্যনিষ্ঠ ভিত্তি থাকতে পারে না। আল্লাহ বলেন-

مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَالِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ

        আল্লাহ তা'য়ালা এসব কিছুই স্পষ্ট উদ্দেশ্য সম্পন্ন করে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা ইউনুছ-৫)

         বর্তমান কালে যেমন কিছু সংখ্যক মানুষ ধারণা করে, পৃথিবীর এই জীবনই শেষ জীবন। পুনরায় আর জীবন লাভ করা যাবে না তথা পরকাল বলে কিছু নেই। এই ধারণা নতুন কিছু নয়-একই ধরনের ধারণা সুদূর অতীত কাল থেকেই এক শ্রেণীর ভোগবাদী পরকাল অবিশ্বাসী মানুষ পোষণ করে আসছে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে সময়ে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সে সময়েও মানুষের ধারণা ছিল, মানুষকে পৃথিবীতে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। মানুষ এখানে যা ইচ্ছো তাই করবে। এমন কোন উচ্চশক্তির অস্তিত্ব নেই, যার কাছে মানুষ তার যাবতীয় কর্মকান্ডের হিসাব দিতে বাধ্য। জীবন একটিই-সুতরাং যা খুশী, যেমনভাবে খুশী জীবনকে ভোগ করতে হবে। মৃত্যুর পরে আর কোন দ্বিতীয় জীবন নেই। পৃথিবীতে সংঘটিত কোন কর্মকান্ডের হিসাব কারো কাছেই দিতে হবে না।

        অতএব জীবনকালে সম্পাদিত কোন কাজের জন্য কোন শাস্তি ও পুরস্কার লাভের কোন প্রশ্নই আসে না। জীবন সৃষ্টিই হয়েছে ভোগ করার জন্য। অতএব জীবনকে কানায় কানায় ভোগ করতে হবে। তারপর একদিন মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে। কবি ওমর খৈয়াম জীবনকে যেভাবে খুশী সেভাবে ভোগ করার অনুপ্রেরণা দিয়ে বলেছিল-

নগদ যা পাও হাত পেতে নাও বাকির খাতায় শূণ্য থাক

দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।

        এদের ধারণা হলো, পৃথিবী হলো দৃশ্যমান। এর অস্তিত্ব চোখের সামনেই দেখা যাচ্ছে। অতএব এটাকেই যে কোন প্রক্রিয়ায় ভোগ করতে হবে। আর পরকালের বিষয়টি হলো বাকি। সেটা হবে কি হবে না, তার কোন নিশ্চয়তা নেই। যে বিষয়টি সংশয়পূর্ণ, সেটাকে প্রাধান্য দিয়ে পৃথিবীর ভোগ-বিলাস থেকে বিরত থাকা সম্পূর্ণ বোকামী। বহুদূর থেকে যে বাদ্য ঝংকার ভেসে আসছে, তা শোনার মধ্যে কোন তৃপ্তি নেই। চাক্ষুষ দর্শনের ভিত্তিতে যে হৃদয়গ্রাহী মনমাতানো বাদ্য ঝংকার উপভোগ করা যায়, তার ভেতরেই রয়েছে পরিপূর্ণ তৃপ্তি। পরকালে অবিশ্বাসী এসব ধারণা ও চিন্তা-চেতনা প্রকৃতপক্ষে এ কথাই ব্যক্ত করে যে, বিশ্ব জগতের সমগ্র ব্যবস্থা নিছক একজন খেলোয়াড়ের খেলা ব্যতিত আর কিছুই নয়। কোন গুরুগম্ভীর ও পরিকল্পনা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য এই সৃষ্টিজগৎ পরিচালিত হচ্ছে না। এদের এই যুক্তিহীন ধারণার প্রতিবাদ করে আল্লাহ বলেন-

وَمَا خَلَقْنَا السَّمَاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا لَعِبِينَ لَوَارَدْنَا أَنْ نَتَّخِذَ لَهْوًا لاتَّخَذْ لَهُ مِنْ لَدُنَّا إِنْ كُنَّا فَعِلَيْنَ

        এ আকাশ ও পৃথিবী এবং এদের মধ্যে যা কিছুই রয়েছে এগুলো আমি খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করিনি। যদি আমি কোন খেলনা সৃষ্টি করতে ইচ্ছুক হতাম এবং এমনি ধরনের কিছু আমাকে করতে হতো তাহলে নিজেরই কাছ থেকে করে নিতাম। (সূরা সূরা আম্বিয়া-১৬-১৭)

        মহান আল্লাহ বলেন, আমি খেলোয়াড় নই। খেল-তামাসা করা আমার কাজ নয়। আর এই পৃথিবী একটি বাস্তবানুগ ব্যবস্থা। কোন ধরনের মিথ্যা শক্তি পৃথিবীর মাটিতে টিকে থাকে না। মিথ্যা যখনই এই পৃথিবীতে স্বদন্তে নিজের ক্ষয়িষ্ণু অস্তিত্ব প্রকাশ করেছে, তখনই সত্যের সাথে তার অনিবার্য সংঘাত সৃষ্টি হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত তা অস্তিত্বহীন হয়ে গিয়েছে। আমার পরিকল্পনা ভিত্তিক সৃষ্টি এই পৃথিবীকে তুমি খেলাঘর মনে করে জীবন পরিচালিত করো অথবা আমার বিধানের বিরুদ্ধে মিথ্যা মতবাদ রচিত করে তার ভিত্তিতে নিজেদেরকে পরিচালিত করে থাকো, তাহাল এসবের পরিণতিতে তুমি নিজের ধ্বংসই ডেকে আনবে।

        তোমার নিকট ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দেখো, আমার সৃষ্টিকে যারা খেলাঘর মনে করেছে, পৃথিবীকে যারা ভোগের সামগ্রীতে পরিপূর্ণ একটি বিশালাকারের থালা মনে করেছে, পৃথিবীকে যারা ভোগ-বিলাসের লীলাভূমি মনে করেছে, আমার ইসলামের সাথে যারা বিরোধিতা করেছে, তাদের কি করুণ পরিণতি ঘটেছে, পৃথিবীটাকে ভ্রমণ করে দেখে নাও। তোমরা কি এ কথা মনে করেছো নাকি যে, তোমাদেরকে আমি এমনিই খেলাচ্ছলে আমোদ-আহ্লাদ করার জন্য সৃষ্টি করেছি? তোমাদের সৃষ্টির পেছনে কোন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নেই-নিছক একটি উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টি হিসাবে বানিয়ে পৃথিবীতে তোমাদেরকে ছড়িয়ে দিয়েছি, তোমাদের কোন কাজের হিসাব গ্রহণ করা হবে না, এ কথা ভেবেছো নাকি? আল্লাহ বলেন-

أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ

        তোমরা কি মনে করেছিলে আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের কখনো আমার কাছে ফিরে আসতে হবে না? (সূরা মু'মিনূন-১১৫)

        গোটা বিশ্বের কোন একটি অণুও অনর্থক সৃষ্টি করা হয়নি। যা কিছু সৃষ্টি হয়েছে, তা যথার্থ সত্যের ভিত্তিতে সৃষ্টি হয়েছে এবং একটি দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনায় এটি পরিচালিত হচ্ছে। সমস্ত সৃষ্টির প্রতিটি অণু ও পরমাণু এই কথারই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, সমস্ত জিনিস পরিপূর্ণ প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা সহকারে নির্মিত হয়েছে। গোটা সৃষ্টির ভেতরে একটি আইন সক্রিয় রয়েছে। দৃশ্যমান-অদৃশ্যমান, সমস্ত কিছুই উদ্দেশ্যমূখী। মানব জাতির সমগ্র সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থব্যবস্থা ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এই কথারই সাক্ষ্য প্রদান করছে যে, একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে স্রষ্টা সমস্ত কিছু সৃষ্টি করেছেন। পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের পেছনে সক্রিয় নিয়ম-নীতি উদ্ভাবন করে এবং প্রতিটি বস্তু যে উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছে তা অনুসন্ধান করেই মানুষ এখানে এসব কিছু আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছে। যদি একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও উদ্দেশ্যহীন সৃষ্টির মধ্যে একটি খেলনার মতো মানব জাতিকে রেখে দেয়া হতো, তাহলে তাদের পক্ষে কোন ধরনের বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের কথা চিন্তাই করা যেত না।

        অতএব যে অসীম বৈজ্ঞানিক সত্তা এমন প্রজ্ঞা ও উদ্দেশ্যমূখীতা সহকারে এই পৃথিবী নির্মাণ করেছেন এবং এর ভেতরে মানুষের মতো একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিকে যাবতীয় দিক দিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও শারীরিক শক্তি, উদ্ভাবনী ক্ষমতা, ইচ্ছা ও স্বাধীন ক্ষমতা এবং নৈতিক অনুভূতি দিয়ে স্বীয় পৃথিবীর অসংখ্য উপকরণ মানুষের হাতে অর্পণ করেছেন, তিনি মানুষকে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করতে পারেন, এমন কথা কি কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি কল্পনা করতে পারে ? মানুষ কি এ কথা মনে করেছে যে, তারা এই পৃথিবীতে ভাঙবে, গড়বে, অন্যায় কর্ম করবে, সৎ কর্ম করবে, ভোগ করবে, ত্যাগ করবে এরপর একদিন মৃত্যুবরণ করে মাটির সাথে মিশে যাবে-তারপর তোমরা যে কাজ করে গেলে, তার কোন প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে না, এটা কি করে কল্পনা করলে?

        তোমরা নানাজনে নানা ধরনের কাজ করবে, তোমাদের কোন কাজের প্রতিক্রিয়া হিসাবে তোমাদের মৃত্যুর পরও অসংখ্য নিরীহ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হতে থাকবে, তোমরা এমন একটি মতবাদ বা নিয়ম-নীতির প্রতিষ্ঠিতা করে যাবে, এর ফলে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীতে অরাজকতা চলতে থাকবে, মানুষ তার নিষ্ঠুর পরিণতি ভোগ করতে থাকবে, আর তোমাদের মৃত্যুর পরই এসব কর্মের হিসাব গ্রহণ না করে তা গুটিয়ে নিয়ে মহাশূন্যে নিক্ষেপ করা হবে, এ কথাই কি তোমরা কল্পনা করো? সূরা সা-দ-এর ২৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَا خَلَقْنَا السَّاءَ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا بَاطِلاً

        আমি আকাশ ও পৃথিবীকে এবং তাদের মাঝখানে যে জগৎ রয়েছে তাকে অনর্থক সৃষ্টি করিনি। সেই আদিকাল থেকেই পরকাল বা বিচার দিবসকে সামনে রেখে মানব সমাজ পরস্পর বিরোধী দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল মানুষ ভেবেছে পৃথিবীর জীবনই একমাত্র জীবন, মৃত্যুর পরে আর কিছুই নেই। আরেক দল যুক্তি প্রদর্শন করেছে, মানুষ পৃথিবীতে যা কিছুই করছে, এর পূর্ণাঙ্গ হিসাব দিতে হবে। পরকালের প্রতি যারা অবিশ্বাস পোষণ করে, তাদের কথার পেছনে যুক্তি একটিই রয়েছে, 'পরকাল বলে কিছুই নেই' এই কথাটি ব্যতিত দ্বিতীয় আর কোন যুক্তি তাদের কাছে নেই। আর পরকাল যে অবশ্যম্ভাবী, এ কথার পেছনে অসংখ্য যুক্তি-প্রমাণ বিদ্যমান।

        সাধারণভাবে এই পৃথিবীতে সমস্ত মানুষের জীবন একইভাবে পরিচালিত হয় না। মানব সমাজে দেখা যাচ্ছে, কোন মানুষ তার গোটা জীবন ব্যাপীই অন্যের অবহেলা, অবজ্ঞা, বঞ্চনা-লাঞ্ছনা, অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতন-নিষ্পেষণ সহ্য করে আসছে। প্রভাব-প্রতিপত্তি না থাকার কারণে তাকে এসব কিছু সহ্য করে একদিন মৃত্যুর কোলে আশ্রয় গ্রহণ করতে হচ্ছে। এখানে ইসাফের দাবি ছিল, ঐ ব্যক্তির প্রতি যে অন্যায়-অবিচার অন্য মানুষে করলো, তার সুষ্ঠু বিচার হওয়া। সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিতাবস্থায় সে পৃথিবীর বন্ধন ত্যাগ করলো। গোটা পৃথিবীর সমস্ত মানুষ যদি সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে লোকটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে এনে তার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতে আগ্রহী হয়, তাহলে তা কখনোই সম্ভব হবে না। সুতরাং এখানে ইনসাফ দাবি করছে যে, মৃত্যুর পরে আরেকটি জগৎ থাকা উচিত। যে জগতে পৃথিবীতে অধিকার বঞ্চিত ব্যক্তিকে তার প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা থাকবে।

        একজন প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল শক্তির অধিকারী নেতার ষড়যন্ত্রের কারণে গোটা জাতি অধিকার বঞ্চিত হয়, দেশের স্বাধীনতা হারিয়ে ভিন্ন জাতির গোলামী করতে বাধ্য হয়, ক্ষেত্র বিশেষে জাতীয় নেতৃবৃন্দের ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিতে লক্ষ লক্ষ অসহায় জনগণ প্রাণ দিতে বাধ্য হয় অথচ বাস্তবে দেখা গেল, সেই নেতার গোপন ষড়যন্ত্রের কথা কোনদিন প্রকাশিত হলো না এবং তার কোন বিচারও হলো না। একশ্রেণীর মানুষ সেই ষড়যন্ত্রকারী রক্ত লোলুপ হিংস্র নেতাকে দেবতার আসনে আসীন করে পূজা করলো। মৃত্যুর পরেও সেই নেতার মূর্তি নির্মাণ করে, প্রতিকৃতি বানিয়ে ফুল দিয়ে পূজা করতে থাকলো।

        এ অবস্থায় জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি, ইনসাফ কি দাবি করে? দাবি তো এটাই করে যে, ষড়যন্ত্রকারী নেতার গোপন ষড়যন্ত্র জাতির সামনে প্রকাশিত হওয়া উচিত ছিল। তার ষড়যন্ত্রের কারণে জাতি পরাধীন জাতিতে পরিণত হলো, অসংখ্য মানুষ নির্মমভাবে নিহত হলো। এসব অপরাধের কারণে তাকে চরম দন্ডে দন্ডিত করা উচিত ছিল। কিন্তু সে দন্ড ভোগ করা তো দূরের কথা, জীবিতকালে বিপুল ঐশ্বর্য্য আর ভোগ-বিলাসের মাধ্যম দিয়ে সে কানায় কানায় তার জীবনকে পূর্ণ করলো। তারপর মৃত্যুর পরেও তার দলের লোকজন তার সীমাহীন বিশ্বাসঘাতকতা আর ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ জাতির কাছে গোপন করে তার প্রতিকৃতি বেদীতে স্থাপন করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পূজা করতে বাধ্য করলো।

        এভাবে গোটা জাতিকেই ইনসাফ থেকে বঞ্চিত করা হলো এবং প্রকৃত অপরাধীকে দন্ড দানের পরিবর্তে আকাশ চুম্বী সম্মান ও মর্যাদা দেয়া হলো। যদি বলা হয় যে, জাতীয় সেই নেতাকে চরম দন্ডদান করলেই তো জাতি ইনসাফ লাভ করলো। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, কিভাবে সেই বিশ্বাসঘাতক নেতাকে দন্ড দান করা হবে? তার অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী কি তাকে দন্ডদান করা যাবে? খুব বেশী হলে তাকে মৃতুদন্ড দিয়ে তা কার্যকর করা যেতে পারে।

        আবার প্রশ্ন ওঠে, যে ব্যক্তি জাতীয় নেতৃত্বের আসনে আসীন হয়ে গোটা জাতির সভ্যতা-সংস্কৃতি, অর্থনীতি ধ্বংস করলো, জাতিকে ভিন্ন জাতির গোলামে পরিণত করলো, অবাধে নিজে সন্তান-সন্ততি সাথে করে জাতীয় অর্থ-সম্পদ লুট করলো, দলের লোকদের দিয়ে লুট করালো, লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনহানী ঘটালো। তার কারণে অসংখ্য নারী সতীত্ব হারালো-অর্থাৎ বিশাল পর্বত সমান অপরাধের পরিবর্তে লাভ করলো শুধু মৃত্যুদন্ড। অগণিত মানুষ নিহত হলো যার কারণে, আর সে একবার মাত্র নিহত হলো-এটা কি ইনসাফ হলো?

        আসলে মানুষ ইনসাফ করবে কিভাবে? মানুষের পক্ষে তো সম্ভব নয়, লক্ষ লক্ষ নরহত্যার অপরাধে দন্ডিত ব্যক্তিকে হত্যা করে পুনরায় জীবিত করণের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ বার হত্যা করে প্রতিশোধ গ্রহণ করা। মানুষের পক্ষে কাউকে একবারই হত্যা করা বা মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা সম্ভব-বার বার নয়। এখানেও ইনসাফের দাবি হলো, মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন থাকা উচিত। যেখানে লক্ষ নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত অপরাধীকে লক্ষ বার শস্তি দেয়া যেতে পারে।

        পৃথিবীর কারাগারগুলোয় যেসব বন্দী রয়েছে, এসব বন্দীদের মধ্যে প্রতিটি ব্যক্তিই কি প্রকৃত অপরাধী? কোন একটি দেশের সরকারও এ কথা হলফ করে বলতে পারবে না যে, তার দেশের কারাগারের সকল বন্দী প্রকৃত অপরাধী। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন, যারা প্রতিহিংসা, ষড়যন্ত্র, প্রতিশোধ, আক্রোশ ইত্যাদির শিকার হয়ে বছরের পর বছর ধরে অন্যায়ভাবে কারাগারে অমানবিক নির্যাতন ভোগ করছে। আল্লাহর দেয়া পৃথিবীর মুক্ত আলো-বাতাস থেকে নির্দোষ লোকগুলোকে বঞ্চিত করা হয়েছে। স্বামী সঙ্গ থেকে স্ত্রীকে বঞ্চিত করা হয়েছে। সন্তান-সন্ততিকে পিতার স্নেহ থেকে মাহরুম করা হয়েছে।

        পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তিকে কারাবন্দী করার কারণে তার সংসার তছনছ হয়ে পড়েছে। স্ত্রীকে অপরের বাড়িতে কঠোর শ্রমের বিনিময়ে ক্ষুন্নি বৃত্তি নিবৃত্ত করতে হচ্ছে। নাবালেগ সন্তানগণ শিক্ষা জীবন থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এক মুঠো অন্নের জন্য শ্রম বিক্রি করতে হচ্ছে। এভাবে অবিচার মানব সভ্যতার মেকি মানবাধিকারের গালে বার বার চপেটাঘাত করছে। নেই-কোথাও এদের সুবিচার লাভের এতটুকু আশা নেই। সমাজের প্রভাব প্রতিপত্তিশালী কামনা তাড়িত ব্যক্তির দৃষ্টি পড়লো গরীব-দিন মজুর এক ব্যক্তির সুন্দরী স্ত্রীর প্রতি। তার যৌবনকে লেহন করার যাবতীয় প্রচেষ্টা যখন ব্যর্থ হলো, তখন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের সাথে ষড়যন্ত্র করে সেই দিন-মজুরকে চোর বা ডাকাত সাজিয়ে কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়ে কয়েক বছর জেল দেয়া হলো। এরপর দিন-মজুরের অসহায় সুন্দরী স্ত্রীকে ভোগ করার অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি করা হলো।

        এই অবিচারের কোন প্রতিকার করার মতো শক্তি সামর্থ গরীব-দিন মজুরের নেই। তার অর্থ নেই, প্রভাব নেই, প্রতিপত্তি নেই। আইন ব্যবসায়ীর মাধ্যমে সে জামিন নেবে, সে অর্থও তার নেই। কারণ পৃথিবীতে প্রচলিত মানুষের তৈরী করা আইনের অবস্থা হলো মাকড়শার জালের মতোই। মাকড়শার জালে যেমন কোন শক্তিশালী মাছি আটকা পড়লে তা ছিন্ন করে বের হয়ে যায় এবং দুর্বল কোন প্রাণী ধরা পড়লে সেই জাল ছিন্ন করতে পারে না। মাকড়শা তাকে কুরে কুরে খায়। পৃথিবীতে আইন প্রভাব-প্রতিপত্তি ও অর্থের কাছে বিক্রি হয়। এখানে অসহায় দুর্বল মানুষগুলোর সুবিচার লাভের কোন আশা করা যেতে পারে না। কিন্তু মানুষ হিসাবে, মানবাধিকারের দৃষ্টিতে তারও তো সুবিচার পাবার অধিকার ছিল। তাহলে অসহায় আর দুর্বলরা কি কোনদিন সুবিচার লাভ করবে না?

        বসনিয়া, হার্জেগোভিনা, আলজিরিয়া, ম্যাসেডোনিয়া, ফিলিস্তীন, কাশ্মির, সোমালিয়া, ফিলিপাইন, সুদান ও আফগানিস্থানসহ অনেক দেশেই মুসলিম বিদ্বেষী পৃথিবীর সুপার পাওয়ার মোড়ল রাষ্ট্রটির প্রত্যক্ষ মদদে অগণিত মুসলিম নারী-পুরুষ আবাল বৃদ্ধ-বণিতা লোমহর্ষক হত্যা কান্ডের শিকারে পরিণত হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। পৃথিবীতে এদের জন্মই যেন হয়েছে নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে জীবনকে বলী দেয়া। পৃথিবীবাসীর চোখে ধূলো দেয়ার জন্য তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বছরের পর বছর ধরে রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বৈঠকের নামে ভোজ সভার আয়োজন করছে। প্রকৃতপক্ষে হত্যাযজ্ঞকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যেই বৈঠকের নামে কলক্ষেপণ করা হচ্ছে। একদিকে হত্যাযজ্ঞ বন্দ করার নামে যে মুহূর্তে বৈঠক চলছে, অপরদিকে সেই মুহূর্তেই অগণিত আদম সন্তান মারণাস্ত্রের নিষ্ঠুর শিকারে পরিণত হচ্ছে। এভাবে সর্বত্র চলছে অন্যায় আর অবিচার। কিন্তু কোন প্রতিকারের ব্যবস্থা আজ পর্যন্তও করা হয়নি। বিচারের আশায় অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ অন্ধকার কারা প্রকোষ্ঠের কঠিন দেয়ালে মাথা কুটে ফিরছে। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর মর্ম যন্ত্রণার করুণ হাহাকার পৃথিবী জুড়ে বেদনা বিধুর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। প্রতিকার আর সুবিচার লাভের সামান্য আশার আলোও কোথাও চোখে পড়ছে না।

        পৃথিবীর এই বাস্তব অবস্থাই মানুষের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, বিচার দিবসের প্রয়োজনীয়তা আর মৃত্যুর পরের জীবনের আবশ্যকতা। পৃথিবীতে যদি যাবতীয় কাজের যথার্থ প্রতিফল লাভের বাস্তব অবস্থা বিরাজ করতো, তাহলে পরকালের জীবন সংশয়পূর্ণ হতো। পৃথিবীতে কর্মের যথার্থ মূল্যায়ন ও প্রতিফল দানের ক্ষমতা মানুষের নেই। এই ব্যবস্থা মানুষ কোনদিনই যথার্থভাবে করতে সক্ষম হয়নি। সুতরাং জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তি এটাই দাবি করে যে, এমন একটি জীবন অবশ্যই থাকা উচিত, যে জীবনে মানুষ তার প্রতিটি কর্মের যথোপযুক্ত প্রতিফল লাভ করবে। আর কর্ম সম্পাদনের পূর্বে যেমন ফল আশা করা যায় না, তেমনি মৃত্যুর পূর্বে মানুষও তার কর্মফল আশা করতে পারে না। কারণ মৃত্যুর মধ্য দিয়েই তার কর্মের অবসান ঘটে। এ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বিচার দিবস নির্ধারণ করেছেন। সেদিন তিনি প্রতিটি মানুষের কর্মলিপি অনুসারে বিচার কার্য অনুষ্ঠিত করবেন।

Post a Comment

0 Comments