আল্লাহ বিচার দিবসের মালিক

        সূরা ফাতিহার শুরুতেই এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই সূরাটি একটি অভিনন্দন-পত্রের মতো এবং এটা আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে তাঁর বান্দাদেরকে শিখিয়েছেন। বান্দাহ্ যখন একমাত্র আল্লাহরই প্রশংসা করে তখন প্রশ্ন আসে-তুমি কার প্রশংসা করছো? বান্দাহ্ জবাবে জানিয়ে দেয় যে, প্রশংসা তাঁরই করা হচ্ছে, যিনি জগতসমূহের রব্ব। আবার প্রশ্ন আসে, সেই রব্ব-এর গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য কি কি? আল্লাহর শেখানো বাক্যে বান্দাহ্ জানিয়ে দেয়, তিনি রাহমান-তিনি রাহীম এবং বিচার দিনের মালিক। সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে মহান আল্লাহর অসীম দয়া আর করুণার কথা বলা হলো। এমন করুণা আর দয়ার কথা জানানো হলো যে, তার কোন সীমা নেই। তাঁর দয়া আর করুণা কোন সীমার গন্ডীতে আবদ্ধ নয়।

        এই কথার পাশাপাশি এ কথাও জানানো হলো যে, তিনি শুধু দয়ালুই নন-তিনি বিচার দিনেরও একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি দয়া করে মানুষ সৃষ্টি করেছেন, মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করার পূর্বেই তিনি মানুষের জন্য যা প্রয়োজন হবে, তা মওজুদ করেছেন এবং গোটা সৃষ্টিকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করেছেন। এসবই তাঁর দয়া আর করুণার মূর্ত প্রকাশ।

        দয়া আর করুণার বিষয়টি এমনই যে, শক্তি ব্যতিত তার প্রকাশ ঘটানো সম্ভব নয়। শক্তি ও সামর্থ না থাকলে দয়া, অনুগ্রহ ও করুণার প্রকাশ ঘটানো কোনক্রমেই সম্ভব নয়। কেউ যদি কাউকে অর্থ দিয়ে, কোন জিনিস দিয়ে দয়া প্রদর্শন করতে চায়, তাহলে প্রথম শর্তই হচ্ছে, যিনি দয়া প্রদর্শন করবেন, তার কাছে অর্থ বা সেই বস্তু মওজুদ থাকতে হবে-যা দিয়ে তিনি দয়া প্রদর্শন করবেন। একজন মানুষ এসে আরেকজন মানুষের কাছে যখন বলে, 'এই পরিমাণ অর্থ সাহায্য করে আপনি আমার প্রতি দয়া করুন।' সাহায্য প্রার্থী যে ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে এ কথাটি বলবে, সেই ব্যক্তি সম্পর্কে তার সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে যে, দান করার মতো শক্তি ও সামর্থ লোকটির রয়েছে। জালিমের জুলুম থেকেও কেউ যদি কাউকে হেফাজত করতে চায় অর্থাৎ দয়া প্রদর্শন করতে চায়, তাহলে তাকে শক্তির অধিকারী হতে হবে। শক্তি না থাকলে জালিমকে সে কিভাবে পরাস্ত করবে এবং মজলুমকে হেফাজত করবে?

        সুতরাং, আল্লাহর যে অসীম দয়া ও করুণার প্রকাশ সৃষ্টির প্রতি পরতে পরতে ঘটেছে, তার কণামাত্র দেখেও যে কোন নির্বোধ লোকও অনুভব করতে সক্ষম যে, তিনি যেমন অসীম দয়ালু-তেমনি সীমাহীন শক্তি ও সামর্থের অধিকারী। যে কোন ধরনের শক্তির একচ্ছত্র অধিপতি তিনি। সমস্ত শক্তির একচ্ছত্র মালিক না হলে তাঁর পক্ষে এত বিশাল করুণা করা সম্ভব হতো না। আর মানুষ ঐ অসীম করুণাময় আর মহাশক্তিশালীরই গোলাম-তাঁরই ছত্রচ্ছায়ায় মানুষ এই পৃথিবীতে প্রতি পালিত হচ্ছে।

        মানুষের ভেতরে একটা প্রবণতা রয়েছে যে, মানুষ যখন কোন মহাপ্রতাপশালীর ছত্রচ্ছায়া লাভ করে, তখন সে নিজেকেও একজন শক্তিশালী বলে কল্পনা করে। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা যায়, একজন লোক দেশের চেয়ারম্যান-মেম্বারের পদ থেকে শুরু করে মন্ত্রী বা প্রেসিডেন্টের পদে আসীন হয়, তখন তার আপন আত্মীয়-স্বজনের মনে এ ধারণা জাগে যে, 'আমাদের অমুক বিশাল ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ইচ্ছা করলে অনেক কিছুই ঘটাতে পারেন।' এই ধারণা মানুষের ভেতরে সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। শুধু তাই নয়, ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির আত্মীয়-স্বজন হবার কারণে মানুষ নিজেকেও ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করে এবং তার আচার-আচরণ, কথা-বার্তায় প্রকাশও ঘটে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে তো এ কথা সর্বজনবিদিত যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তিবর্গের সন্তান-আত্মীয়-স্বজনও নিজেদেরকে ক্ষমতাদর্পী বলে মনে করে এবং তাদের দাপটে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।

        ক্ষমতাসীন ব্যক্তির ছত্রচ্ছায়া লাভ করে একজন মানুষের যদি অবস্থা এই হয়, তাহলে ঐ মহাশক্তিশালী আল্লাহর গোলাম-যাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'আমি অসীম ক্ষমতার একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ তোমাদের অভিভাবক, আমি অনুক্ষণ তোমাদের সাথে রয়েছি, আমার ওপরেই ভরসা করো, আমার দয়া ও অনুগ্রহ তোমাদেরকে পরিবেষ্টন করে রয়েছে, আমি তোমাদের শক্তি বৃদ্ধি ঘটাবো, তোমাদের যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ করবো।' সেই গোলামদের পক্ষে বাতিলের মোকাবেলায় দুর্বলতা প্রদর্শনের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।

        সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় ও তৃতীয় আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর অসীম দয়া, করুণা ও প্রচন্ড ক্ষমতার কথা প্রকাশ করে পরোক্ষভাবে আল্লাহ তাঁর সৈনিকদেরকে এ কথা বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে, পৃথিবীতে সামান্য ভঙ্গুর ক্ষমতার অধিকারীদের সন্তান, আত্মীয়-স্বজনদের আচার-আচরণ থেকে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো। ক্ষমতার অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিমন্ডলে বাস করে তারা যদি বিপুল ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়, তাহলে তোমাদের কি হলো-তোমরা তো অসীম ক্ষমতার অধিকারীর ছত্রচ্ছায়া লাভ করেছো। কেন তোমরা বাতিলদের দেখে কম্পিত হচ্ছো? পৃথিবী থেকে শয়তানি শক্তিকে উৎখাত করার লক্ষ্যে কেন তোমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছো না?

        ইসলামী আন্দোলন তথা আল্লাহর পথের সৈনিকদেরকে সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় তৃতীয় আয়াতের মাধ্যমে অনুপ্রেরণা দান করা হয়েছে। অপরদিকে আল্লাহ তাঁর বিদ্রোহী বান্দাদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন, তোমরা নিজেদেরকে অপ্রতিরোধ্য মনে করো না। আমার অসীম ক্ষমতা ও সামর্থ আছে বলেই আমার দয়া ও করুণাও অসীম এবং যার প্রকাশ তোমরা দেখতে পাচ্ছো। আমার দয়ার সুযোগে তোমরা সীমালংঘন করো না। যে অসীম দয়া দিয়ে তোমাদেরকে প্রতিপালিত করছি, সেই অসীম শক্তির সামান্য প্রভাব প্রয়োগ করে মুহূর্তের ভেতরে তোমাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবো। সুতরাং সময়-সুযোগ থাকতে সতর্ক ও সংশোধন হও।

        আল্লাহ তা'য়ালা সূরা ফাতিহার দ্বিতীয় আয়াতে নিজের অসীম অনুগ্রহের কথা জানানোর সাথে সাথে তৃতীয় আয়াতে নিজেকে 'বিচার দিবসের মালিক' বলে প্রকাশ করার মাধ্যমে এ কথাই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তোমরা স্বাধীন নও। যা খুশী তাই তোমরা আমার দয়ার সুযোগে ঘটাতে পারো না। সামান্য স্বাধীনতা তোমাদেরকে দান করা হয়েছে। স্বাধীনতার সঙ্কীর্ণ পরিবেশে নিজেদেরকে দুর্দমনীয়, অপ্রতিরোধ্য-সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করো না। তোমাদের সমস্ত কাজের হিসাব আমার কাছে দিতে হবে। জবাবাদিহির চেতনা শানিত রেখে পৃথিবীতে জীবন-যাপন করো।

        পৃথিবীতে মানব সমাজে এ ধরনের অসংখ্য ব্যক্তি রয়েছেন, যারা তাদের দান, উদারতা ও ঔদার্য্যের কারণে মানুষের কাছে দয়ালু হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। সমাজে এই ধরনের প্রভাব-প্রতিপত্তিশীল লোকগুলোই সাধারাণতঃ মধ্যমণি হয়ে থাকে। সামাজিক সালিশ-বিচারের দায়িত্বও এদের ওপরে নিপতিত হয়। অপরাধ করে যারা ধরা পড়ে বিচারের মুখোমুখী হয়, তখন তারা মনে মনে আশা পোষণ করে, বিচারে রায় দেয়ার কর্তৃত্ব যার হাতে-তিনি দয়ালু ব্যক্তি। তিনি অবশ্যই ক্ষমার দৃষ্টিতে বিচার পর্ব সমাধা করবেন। ক্ষেত্র বিশেষে ঘটেও তাই।

        একদিকে পৃথিবীর বিচারকগণ পক্ষপাতিত্ব করার প্রবণতা থেকে মুক্ত নন-অপরদিকে যদি তিনি দয়ার্দ্র চিত্তের অধিকারী হন, তাহলে তার এই মানসিক প্রবণতাই ক্ষেত্র বিশেষে তাকে বাধ্য করে অপরাধীকে ক্ষমা করে দিতে। অপরাধী যখন করুণ দৃষ্টিতে বিচারকের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নীরব ভাষায় ক্ষমার আবেদন করতে থাকে, দয়ালু বিচারকের মনে করুণার উদ্রেক ঘটে। যেখানে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া প্রয়োজন ছিল, সেখানে তার করুণা তাকে ক্ষমা করতে বাধ্য করে। এভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ ন্যায় বিচার থেকে বঞ্ছিত হন। চক্ষু লজ্জার কারণে প্রতিপত্তিশীল দয়ালু বিচারককে তারা এ কথাও বলতে সাহস করে না, 'আপনার বিচার সঠিক হলো না।' বাধ্য হয়ে তারা বিচারের রায় মেনে নেন। তাহলে দেখা গেল, পৃথিবীতে দয়ালু বিচারকের দ্বারাও ক্ষেত্র বিশেষে অবিচার সংঘটিত হয়।

        পক্ষান্তরে মহান আল্লাহর দ্বারা এ ধরনের অবিচার সংঘটিত হবার কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি অসীম দয়ালু-কিন্তু তাঁর দয়া ন্যায়-নীতির গন্ডী অতিক্রম করে শাস্তি লাভের যোগ্য কোন অপরাধীর ওপরে আপতিত হয় না। দয়া ও করুণার অনিবার্য দাবিই হলো ন্যায় বিচার সংঘটিত করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সেটাই করবেন। তিনি দয়ালু-এ কারণেই প্রত্যেকেই যার যার প্রাপ্য সেদিন বুঝে পাবে। পৃথিবীতে মানুষ বিচারক নানাভাবে প্রভাবিত হতে পারে। লঘু শাস্তি লাভের যোগ্য এক ব্যক্তির বিচার পর্ব আদালাতে শুরু হলো, এ অবস্থায় অপরাধী ব্যক্তির প্রতি আক্রোশ বশতঃ দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো ক্রমাগত এমন ধরনের সংবাদ পরিবেশন করে চললো যে, দেশের সাধারণ জনগণও বিচারাধীন ব্যক্তির প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। বিচারক তখন দেশের জনগণের সেন্টিমেন্ট দ্বারা প্রভাবিত হতে বাধ্য হন। তিনি লঘু শাস্তির পরিবর্তে গুরুদন্ড দিয়ে বসেন।

        এভাবে বিচারক সেন্টিমেন্টের কাছে, প্রভাব-প্রতিপত্তির কাছে, অর্থের কাছে, সুপারিশের কারণে প্রভাবিত হতে বাধ্য হন। পক্ষান্তরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এসব দুর্বলতা থেকে মুক্ত। তাঁর বিচার কার্য কোনকিছুর প্রভাবে প্রভাবিত হবে না। কোন নবী-রাসূলেরও ক্ষমতা নেই যে, তাঁরা কোন অপরাধীর পক্ষে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবেন-আর এমন ধরনের সুপারিশ তাঁরা করবেন, এমন ধারণা পোষণ করাও তাদের সম্মান ও মর্যাদার প্রতি আঘাত করার শামিল। নবী-রাসূল তাদের জন্যই সুপারিশ করবেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে যারা সুপারিশ লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। সুতরাং, বিচার দিবসের তিনিই একচ্ছত্র অধিপতি-সেদিন তাঁর বিচারে হস্তক্ষেপ করার মতো কোন শক্তির অস্তিত্ব নেই।

Post a Comment

0 Comments