হযরত শু'আইব আলাইহিস্ সালাম বার বার তাঁর জাতিকে আহ্বান জানালেন, তারা যেন আল্লাহর দেয়া জীবন বিধান অনুসারে জীবন পরিচালিত করে। কিন্তু তাঁর জাতির অবাধ্য নেতৃবৃন্দ আল্লাহর রাসূলের কথা মানলো না। তারা নবীর সাথে বিদ্রোহী ভূমিকা পালন করতে থাকলো। তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন, পূর্বে হযরত নূহ, হযরত হূদ, হযরত সালেহ্ ও হযরত লূত আলাইহিস্ সালাম এসেছিলেন। হযরত লূত মাত্র কয়েক শতাব্দী পূর্বে গত হয়েছেন। তাঁর সাথে যারা অবাধ্যতা প্রদর্শন করেছিল, তাদের যে কি করুণ পরিণতি ঘটেছে, সে ইতিহাস তোমরা অবগত রয়েছো। একই পরিণতি লাভ করার পূর্বেই তোমরা তোমাদের রব্ব-এর কাছে ক্ষমা চাও, ফিরে এসো তাঁরই বিধানের দিকে। আল্লাহর রাহমত অনেক ব্যাপক এবং বিরাট। তিনি অবশ্যই তোমাদেরকে ক্ষা করে দিবেন। তিনি তাঁর জাতিকে লক্ষ্য করে কি কথা বলেছিলেন, তা সূরা হুদরে ৯০ নং আয়াতে আল্লাহ শোনাচ্ছেন-
وَاسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ ثُمَّ تُوبُوا إِلَيْهِ إِنَّ رَبِّي رَحِيمٌ وَدُودٌ -
শোন, তোমরা আপন রব্ব-এর কাছে ক্ষমা চাও এবং তাঁরই দিকে ফিরে এসো। নিঃসন্দেহে আমার রব্ব বড়ই দয়াবান এবং আপন সৃষ্টির প্রতি অতীব ভালোবাসা পোষণকারী।
ইতিহাসে দেখা যায়, পৃথিবীর অনেক রাজা-বাদশাহ্ তার অধীনস্থ লোকদেরকে অযথা কষ্ট দিয়ে আনন্দানুভ করতো। রোম ও পারস্য সম্রাটদের অধিকাংশই ছিল প্রকৃতিতে নিষ্ঠুর। সর্বগ্রাসী হুতাশনে যখন রোম জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিলো, আর রোম সম্রাট নিরো তখন মনের আনন্দে বাঁশী বাজাচ্ছিলো। তারা বিশাল আকৃতির খাঁচা বানিয়ে তার ভেতরে হিংস্র জানোয়ার রেখে দিতো। অসহায় প্রজাদের ধরে এনে সে খাঁচার ভেতরে ছেড়ে দিতো। হিংস্র বাঘ বা সিংহ কিভাবে মানুষটিকে আহার করতো তা তারা দেখতো। মানুষের মরণ আর্তনাদ তাদের আনন্দ বৃদ্ধি করতো। বর্তমানেও সেই একই ধারাবাহিকতা চলছে দেশে দেশে এবং জাতিতে জাতিতে।
শক্তিহীন দুর্বল জাতির ওপরে শক্তিশালী কোন জাতি আক্রোশভরে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। মায়ের কোল থেকে শিশুকে ছিনিয়ে নিয়ে পা ধরে ছুড়ে দিচ্ছে পাথর বা দেয়ালে। শিশুর মাথার মগজ ছিটকে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। মরণ যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে শিশুটি মারা যাচ্ছে, ওদিকে শিশুর মা বুকফাটা আর্তনাদ করছে। এই দৃশ্য দেখে ঘাতকদল অট্টহাস্যে ফেটে পড়ছে। এভাবে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি এই মানুষ চরম নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিচ্ছে। অথচ এই মানুষকে যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষকে যে কতটা ভালোবাসেন, তা কোন দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝানো যাবে না।
ইতিপূর্বে সংক্ষিপ্তাকারে বর্ণনা দেয়া হয়েছে, মানুষের জীবন ধারণ ও ভোগের জন্য আল্লাহ তা'য়ালা কিভাবে গোটা সৃষ্টিজগতকে তার সেবায় নিয়োগ করেছেন। তিনি তাঁর রাহমত দিয়ে কিভাবে সৃষ্টিকে আবৃত করে রেখেছেন। এসব থেকেই তো প্রমাণ হয়, তিনি তাঁর বান্দাদেরকে কতটা ভালোবাসেন। আল্লাহ তা'য়ালা হৃদয়হীন, নির্দয় ও পাষাণের মতো সামান্যতম আচরণও তাঁর বান্দাদের সাথে করেন না। নিজের সৃষ্টির প্রতি তাঁর কোন শত্রুতা থাকতে পারে না। সুতরাং তিনি অযথা এবং অকারণে বান্দাকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি দিবেন, কোন ধরনের কষ্টে ফেলবেন, বান্দাদের কষ্ট দেখে তিনি আনন্দিত হবেন, এ ধরনের চিন্তা করার কোন অবকাশ নেই।
বান্দাহ্ যখন তাঁর বিধানের সাথে বিদ্রোহের সীমা অতিক্রম করে, পৃথিবীতে একের পর এক অশান্তি আর বিপর্যয় সৃষ্টি করতেই থাকে, বার বার সতর্ক করার পরও এসব অপকর্ম থেকে বিরত হয় না, তখন তাদেরকে শাস্তি দেয়া ইনসাফের দাবি হয়ে যায়। অন্যথায় বান্দার প্রতি আল্লাহর ভালোবাসা তো এমন যে, বান্দার অসংখ্য অপরাধ তিনি এমনিতেই ক্ষমা করে দেন। বান্দাহ্ যত অপরাধই করুক না কেন, সে তার কৃতকর্মের দরুণ লজ্জিত হয়ে-অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করলেই তিনি তাঁর রাহমতের বাহু প্রসারিত করে তাকে কাছে টেনে নেন।
এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে একটি ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে এভাবে যে, রাসূলের একজন সাহাবী পথ চলতে গিয়ে অনুভব করলেন, পথিপার্শ্বে একটি ঝোপের ভেতরে পাখির ছানা রয়েছে। তিনি কৌতূহল বশতঃ পাখির ছানাগুলো নিজের চাদরের ভেতরে নিলেন। ছানাগুলোকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে-দেখে তাদের মা পাখিটি বার বার সাহাবীর মাথার ওপরে এসে উড়তে লাগলো। তিনি তাঁর চাদর মেলে ধরলেন। মা পাখিটি নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ছানাগুলোর ওপরে এসে বসে পড়লো। সাহাবী মা পাখি ও ছানাগুলোসহ দরবারে রেসালাতে নিয়ে এলেন। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! দেখুন ছানার প্রতি মা পাখিটির কত মায়া! পাখিটি জানে, সে বন্দী হতে যাচ্ছে এবং তাকে জবেহ করা হতে পারে। তবুও সে তাঁর প্রাণের মায়া ত্যাগ করে ছানার কাছে এলো।'
সাহাবীর কথা শুনে আল্লাহর নবী বললেন, সন্তানের প্রতি মায়ের কত মায়া তা তুমি আমাকে দেখাচ্ছো। তুমি কি জানো, বান্দাকে আল্লাহ কত ভালোবাসেন? সমুদ্রে হাতের সবচেয়ে ছোট্ট আঙ্গুলটি ডুবিয়ে তুললে তার অগ্রভাগে একফোটা পানি ঝরে পড়ার অপেক্ষায় থাকে। আল্লাহ সেই একফোটা মায়া তাঁর সমস্ত সৃষ্টির ভেতরে বন্টন করে দিয়েছেন। এই সামান্য মমতার অধিকারী হয়ে মা তার সন্তানের জন্য প্রাণ দেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। তাহলে যে আল্লাহ মমতা সৃষ্টি করেছেন, বান্দার প্রতি সেই আল্লাহর কতটা মমতা রয়েছে, তা কি তোমরা কল্পনা করতে পারো?
আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের মমতা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি ছোট্ট উদাহরণের মাধ্যমে মানুষকে ধারণা দিয়েছেন। তিনি সাহাবীদেরকে বলেন, একটি উটের ওপরে জীবন ধারণের যাবতীয় উপকরণ সজ্জিত করে তোমাদের কেউ মরুভূমিতে পথ চলতে থাকলো। তারপর এমন এক স্থানে সে উটটি হারিয়ে গেল, যেখানে বেঁচে থাকার মতো খাদ্য এবং পানীয় কিছুই নেই। এমনকি কোন ধরনের লতা-গুল্ম কিছুই নেই। লোকটি সাম্ভাব্য উপায়ে উটটির সন্ধান করে না পেয়ে নিজের জীবনের আশা ত্যাগ করে নিরাশ হয়ে গাছের নিচে হতাশ ভঙ্গীতে বসে পড়লো। এমন সময় যদি জীবন ধারনের উপকরণে সজ্জিত উটটি এসে লোকটির সম্মুখে উপস্থিত হয়, লোকটির কেমন আনন্দ হবে?
বেঁচে থাকার সমস্ত আশা-ই যেখানে মুছে গিয়েছিল, অনাহার আর পিপাসার চরম যন্ত্রণা ভোগ করে নিষ্ঠুর মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করা ব্যতিত দ্বিতীয় পথ যখন খোলা ছিল না, তখন জীবিত থাকার যাবতীয় উপকরণ তাঁর সামনে উপস্থিত হয়ে গেল, এ অবস্থায় লোকটি যতটা আনন্দিত হবে, তার থেকে অনেক বেশী আনন্দিত হন আল্লাহ তা'য়ালা-যখন তাঁর কোন অবাধ্য বান্দাহ্, গোনাহগার বান্দাহ্ অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে তাঁর দিকে ফিরে আসে।
আল্লাহ যে রাহমান ও রাহীম-তাঁর দয়ার পরিধি কোন সীমার গন্ডীতে আবদ্ধ নেই, উল্লেখিত দৃষ্টান্ত দিয়ে রাসূল সেটাই বুঝিয়েছেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, একবার বেশ কিছু যুদ্ধবন্দীকে দরবারে রেসালাতে উপস্থিত করা হয়েছিল। বন্দীদের মধ্যে একজন নারীও ছিল। সে নারীর দুগ্ধপোষ্য শিশুটি হারিয়ে যাওয়ার কারণে তাঁর মা উন্মাদ প্রায় হয়ে উঠেছিল। আপন গর্ভজাত সন্তানের মমতায় মহিলাটির অবস্থা এমনই হয়ে পড়েছিল যে, সামনে কোন শিশু দেখলেই সে তাকে গভীর মমতায় নিজের বুকের মাঝে টেনে নিয়ে দুধ খাওয়ানোর চেষ্টা করতো। আল্লাহর রাসূল মমতভরা দৃষ্টিতে এই দৃশ্য দেখলেন। হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কি বলতে পারো, এই মা কি তার নিজের শিশু সন্তানকে নিজের হাতে জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করতে পারে?' আমরা উত্তর দিলাম, 'অসম্ভব! নিজের শিশুকে আগুনে নিক্ষেপ করা তো দূরের কথা, শিশু যদি হঠাৎ করে আগুনে পড়ে যায়, মা তাকে জীবনের শেষ শক্তি দিয়ে হলেও বাঁচানোর চেষ্টা করবে।' তখন আল্লাহর নবী বললেন-
الله ارحم بعباده من هذه بولدها
এই মা তাঁর সন্তানের জন্য যত না মমতাময়ী, আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি তারচেয়ে অনেকগুণ বেশী দয়াবান।
মানুষ অসংখ্য অন্যায় করে এবং অন্যায় করার সাথে সাথে আল্লাহ তা'য়ালা তাঁকে গ্রেফতার করেন না। তিনি দয়া করে তাঁর বান্দাকে সময় দিতে থাকেন। যদি বান্দাহ্ অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে, ফিরে আসে আবার সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে-আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তা'য়ালা অভাব শূণ্য, তাঁর দরবারে কোন জিনিসের অভাব নেই। কিন্তু দুটো জিনিসের অভাব রয়েছে মহান আল্লাহর দরবারে। এ জন্য সেই দুটো জিনিসকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসেন। সে দুটো জিনিস হলো, কান্না এবং কাকুতি-মিনতি। কারণ ফেরেশতারা কোন গুনাহ্ করে না। তাঁরা গোনাহ্ থেকে মুক্ত। তাঁদের কোন জিনিসের প্রয়োজন হয় না। এ কারণে তাঁরা আল্লাহরম কাছে কোন জিনিস কাকুতি-মিনতি করে চায় না। কিন্তু মানুষের ভেতরে পাপ প্রবণতা বিদ্যমান ও তাদের জীবন ধারনের জন্য অসংখ্য জিনিসের প্রয়োজন রয়েছে। মানুষ গোনাহ্করে এবং পরবর্তীতে সে যদি অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে কান্নাকাটি করে, আল্লাহ বড় খুশী হয়ে তাকে ক্ষমা করে দেন। আর বান্দা যখন কোন প্রয়োজনের জন্য দু'হাত তুলে তাঁর দরবারে কাকুতি-মিনতি করে চাইতে থাকে, আল্লাহ তখন ভীষণ খুশী হন।
কোন কোন কিতাবে উল্লেখ করা হয়েছে, বান্দার কান্নাকাটি ও কাকুতি-মিনতির দৃশ্য দেখে আল্লাহ তাঁর ফেরেশতাদেরকে প্রশ্ন করেন, আমার বান্দাহ্ কেন কাঁদছে? ফেরেশতারা আল্লাহর প্রশংসা করে বলে, 'হে আল্লাহ! তোমার বান্দাহ্ তোমারই ভয়ে কাঁদছে।' আল্লাহ বলেন, 'বান্দাহ্ কি আমাকে এবং আমার জাহান্নামকে কি দেখেছে?' তাঁরা জবাব দেন, 'না, তোমার বান্দাহ্ তোমাকে এবং তোমার জাহান্নামকে না দেখেই বিশ্বাস করেছে।' আল্লাহ বলেন, 'তোমরা সাক্ষী থাকো, আমার যে বান্দাহ্ আমাকে না দেখে আমার ভয়ে কাঁদে, আমি তাকে ক্ষমা করে দিলাম।'
মানুষ সারা দিন পরিশ্রম করে আল্লাহর দেয়া রিস্ক অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকে। রাতে এশার নামাজ আদায় শেষে আল্লাহর দেয়া রিফ আহার করে কর্মক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয়। ক্ষণিকের মধ্যেই গভীর ঘুম এসে তাকে অচেতন করে ফেলে। আল্লাহর দাসত্বে সচেতন তার অন্তর শেষ রাতে তাকে জাগিয়ে দেয়। প্রচন্ড ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে দেহের ওপর থেকে শীত থেকে হেফাজতের উপকরণ সরিয়ে শয্যা ছেড়ে উঠে ঠান্ডা পানি দিয়ে অজু করে আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে যায়। বান্দার এ ধরনের কর্মকান্ড আল্লাহ তা'য়ালা অত্যন্ত ভালোবাসেন। একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে ডেকে দেয়া তো দূরের কথা, ক্ষেত্র বিশেষে চাইলেও পাওয়া যায় না। আর করুণাময় আল্লাহ শেষ রাতে বান্দাদেরকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন, 'কে আছো অভাবগ্রস্থ, আমার কাছে চাও-আমি অভাব দূর করে দেবো। তোমাদের মধ্যে যে ঋণগ্রস্থ, আমার কাছে বলো-আমি ঋণ পরিশোধের পথ করে দেবো। তোমাদের মধ্যে যারা রোগী, আমাকে বলো-আমি আরোগ্য দান করবো। তোমরা যারা পর্বত সমান গোনাহ্ করেছো, আমার কাছে ক্ষমা চাও-আমার রাহমত অনেক বিশাল, আমি তোমাদের গোনাহ্ ক্ষমা করে দেবো।' এভাবে দয়াময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে ডেকে ডেকে বলতে থাকেন।
বান্দাহ্ একমাত্র তাঁরই কাছে কেঁদে কেঁদে নিজেকে নিবেদন করবে, নিজের যাবতীয় প্রয়োজনের কথা তাঁরই কাছে নিবেদন করবে, এটাই আল্লাহর সবচেয়ে পছন্দের জিনিস। হযরত আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। যেমন দুধ দোহন করে নেয়ার পরে পুনরায় তা ওলানে প্রবেশ করানো অসম্ভব। আল্লাহর পথের ধূলি ও জাহান্নামের ধোঁয়া একত্র হবে না। (তিরমিযী)
হযরত আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, দু'টি চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে না, যে চোখ আল্লাহর ভয়ে কেঁদেছে এবং যে চোখ আল্লাহর পথে রাত জেগে প্রহরা দিয়েছে। (তিরমিযী)
কোন কোন বর্ণনায় উল্লেখ করা হয়েছে, কোন ব্যক্তির অবস্থা যদি এমন হয় যে, গোনাহ্ করতে করতে তার আমলনামা পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছে। তারপর সে অনুতপ্ত হলো এবং তওবা করে আল্লাহর ভয়ে কাঁদলো, তার চোখের পানি গড়িয়ে নাকের অগ্রভাগ ছাড়িয়ে যাবার পূর্বেই ক্ষমার যোগ্য গুনাহসমূহ আল্লাহ তা'য়ালা অনুগ্রহ করে তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ বলেন-
وَالَّذِينَ عَمِلُوا السَّيِّاتِ ثُمَّ تَابُوا مِنْ بَعْدِهَا وَأَمَنُوا إِنَّ رَبِّكَ مِنْ بَعْدِهَا لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
আর যারা খারাপ কাজ করার পরে (অনুতপ্ত হয়ে) তওবা করে ও ঈমান আনে, নিশ্চিতই এই তওবা ও ঈমানের পরে তোমার রব্ব অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও করুণাময়। (আ'রাফ-১৫৩) হযরত ইউছুফ আলাইহিস্ সালামকে হত্যা করার লক্ষ্যে কূপে নিক্ষেপ করা হলো'। তাঁর পিতার সাথে তাঁরই অন্যান্য ভাইগণ প্রতারণামূলক কথা বললো। তারপর কালের ব্যবধানে একদিন আল্লাহ তা'য়ালা সত্য সবার সম্মুখে প্রকাশ করে দিলেন। তখন অপরাধী সন্তানরা পিতা ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামের কাছে আবেদন জানালো, 'আপনি আমাদের পাপ ক্ষমার জন্য দেয়া করুন। আমরা সত্যই অপরাধী।' জবাবে হযরত ইয়াকুব (আঃ) মহান আল্লাহর অসীম করুণা ও ক্ষমাশীলতার কথা তাঁর অপরাধী সন্তানদেরকে কাছে এভাবে বললেন-
قَالَ سَوْفَ اسْتَغْفِرُ لَكُمْ رَبِّي إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
বললো, আমি আমার রব্ব-এর কাছে তোমাদের জন্য ক্ষমার আবেদন করবো, তিনি বড়ই সে ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (সূরা ইউসুফ-৯৮)
হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্ সালামের অন্যান্য সন্তানদের অপরাধ কোন মামুলি অপরাধ ছিল না। তাদের পিতা ও ভাই ছিলেন আল্লাহর নবী। তারা আল্লাহর একজন নবীর সাথে করেছিল প্রতারণা ও আরেকজন নবীকে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দেয়ার লক্ষে কুপে নিক্ষেপ করেছিল। এতবড় মারাত্মক অপরাধ করার পরেও আল্লাহর নবী সেই অপরাধীদেরকে শোনাচ্ছে, অপরাধ করেছো তো কি হয়েছে! তোমাদের অপরাধের তুলনায় আল্লাহর রাহমত অনেক বিশাল। তিনি করুণাময়-ক্ষমাশীল। তাঁর কাছেই ক্ষমা চাও, তিনি ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ তা'য়ালা হতাশা পছন্দ করেন না। তাঁর বান্দারা অপরাধ করে হতাশ হয়ে পড়বে যে, তাদের অপরাধের বুঝি ক্ষমা নেই, নিশ্চিতই তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। মহান আল্লাহ তাঁর নবীর মাধ্যমে এই শ্রেণীর বান্দাদেরকে জানিয়ে দিতে বলছেন-
نَبِّئْ عِبَادِي أَنِّي أَنَا الْغَفُورُ الرَّحِيمُ
হে নবী! আমার বান্দাহদেরকে জানিয়ে দাও, আমি বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়াবান। (হিজর-৪৯) বান্দার প্রতি আল্লাহর কত দয়া! পৃথিবীর বুকে এমন অসংখ্য পথ রয়েছে, যেখানে প্রয়োজনীয় কোন বোঝা বহন করে মানুষের পক্ষে পৌছানো অত্যন্ত কষ্টদায়ক। বান্দা কষ্ট করবে আর আল্লাহ দর্শকের ভূমিকা পালন করবেন, তা হতে পারে না। বান্দার কষ্ট তিনি সহ্য করতে পারেন না। বান্দাকে যেন কষ্ট করতে না হয়, এ জন্য বোঝা বহন করার উপযুক্ত পশু তিনি সৃষ্টি করে দিলেন। আল্লাহ বলেন-
وَتَحْمِلُ أَثْقَالَكُمْ إِلَى بَلَدٍ لَّمْ تَكُونُوا بلغيه الا بشق الْأَنْفُسِ أَنَّ رَبَّكُمْ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ
এরা (পশুদল) তোমাদের ভার-বোঝা বহন করে এমন এমন স্থান পর্যন্ত নিয়ে যায় যেখানে তোমরা চরম কঠিন পরিশ্রম ব্যতিত পৌঁছতে সক্ষম হতে না। প্রকৃত বিষয় হলো, তোমাদের রব্ব বড়ই অনুগ্রহ সম্পন্ন এবং মেহেরবান। (সূরা আন নাহল-৭)
এই পৃথিবীতে যেখানে যা কিছু রয়েছে, তার মালিক হলেন আল্লাহ। কোন মানুষ তাঁর দাসত্ব করলেও তাঁর ক্ষমতা এতটুকু বৃদ্ধি লাভ করে না এবং না করলেও এতটুকু কমে না। তাঁর প্রশংসা করলে বা না করলে তাঁর ধনভান্ডার এবং ক্ষমতায় হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে না। আল্লাহ বলেন-
لَهُ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَإِنَّ اللَّهَ لَهُوَ الْغَنِيُّ الْحَمِيدُ
আকাশ ও যমীনে এবং এর ভেতরে যা কিছু রয়েছে, সব কিছুই তাঁর। তিনি যে মহাধনী ও সর্ব প্রশংসিত এতে কোন সন্দেহ নেই। (সূরা হজ্জ-৬৪)
সমস্ত কিছুই তিনি নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি তাঁর বান্দাকে অপরিসীম ভালোবাসেন। পৃথিবীর সমস্ত কিছু তিনি তাঁর বান্দাদের জন্য কর্মোপযোগী করে দিয়েছেন, সমস্ত সৃষ্টিকে তিনি বান্দার খেদমতে নিয়োজিত করেছেন। আকাশকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন, যেন তা তাঁর বান্দাদের জন্য কোন বিপদের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়। আল্লাহ বলেন-
الَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ وَالْفُلْكَ تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِأَمْرِهِ - وَيُمْسِكُ السَّمَاءَ أَنْ تَقَعَ عَلَى الْأَرْضِ إِلَّا بِإِذْنِهِ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَّحِيمٌ
তুমি কি দেখো না, তিনি পৃথিবীর সব কিছুকে তোমাদের জন্য অনুগত করে রেখেছেন এবং তিনিই নৌযানকে নিয়মের অধীন করেছেন যার ফলে তাঁর আদেশে তা সমুদ্রে বিচরণ করে আর তিনিই আকাশকে এমনভাবে ধারণ করে আছেন যে, তাঁর অনুমতি ব্যতিত তা যমীনের ওপরে আপতিত হতে পারে না? প্রকৃত বিষয় হলো, আল্লাহ মানুষের অধিকারের ব্যাপারে বড়ই দয়ার্দ্র ও অনুগ্রহ সম্পন্ন।
(সূরা হজ্জ-৬৫)
আল্লাহর স্নেহ, মায়া-মমতা, ভালোবাসা আর অনুগ্রহের সুযোগ গ্রহণ করে একশ্রেণীর মানুষ যা খুশী তাই করতে থাকে। এই শ্রেণীর লোকগুলো আল্লাহর অনুগ্রহকে দুর্বলতা মনে করে। প্রকৃত বিষয় হলো, সীমাতিক্রম করলে আল্লাহ যে বরদাস্ত করেন না, এ কথা এরা ভুলে যায়। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَإِنَّ رَبِّكَ لَهُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ
প্রকৃত সত্য বিষয় হলো, তোমার রব্ব প্রবল পরাক্রান্ত এবং করুণাময়। (সূরা শু'আরা-৯)
সুতরাং আল্লাহর করুণায় সিক্ত হয়ে কেউ যদি বিদ্রোহীর ভূমিকা অবলম্বন করে, তাহলে তাঁর সতর্ক হওয়া উচিত যে, আল্লাহ শুধু করুণাই করেন না, তিনি অসীম ক্ষমতাশালী। যারা তাঁর দ্বীনের সাথে বিরোধিতা করে, তাদেরকে শায়েস্তা করতে তাঁর কোন বেগ পেতে হয় না। ইসলামের শত্রুরা ইসলামী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকে, তাদের ষড়যন্ত্র দেখে আল্লাহর সৈনিকদেরও ভয় পাবার বা হতাশ হবার কোন কারণ নেই। আল্লাহর ওপর ভরসা করতে হবে, তিনি তাঁর করুণা দিয়ে দ্বীন প্রতিষ্ঠাকামী দলকে হেফাজত করবেন। আল্লাহ বলেন-
وَتَوَكَّلْ عَلَى الْعَزِيزِ الرَّحِيمِ الَّذِي يَرَاكَ حِينَ تَقُوْمُ وَتَقَلُّبَكَ فِي السَّاجِدِينَ
এবং সেই মহাশক্তিশালী ও করুণাময়ের ওপর ভরসা করো। যিনি তোমাকে সেই সময়ও দেখতে থাকেন যখন তুমি দাঁড়াও এবং সিজদাকারীদের মধ্যে তোমার ওঠা-বসা ও নড়া চড়ার প্রতি দৃষ্টি রাখেন। (সূরা শু'আরা-২১৭-২১৯)
বাতিলের নির্যাতনের মুকাবিলায় আল্লাহর দ্বীনের সৈনিকদেরকে প্রতি পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তোমাদের ভয়ের কোন কারণ নেই। আমি দয়াবান, আমার ওপরে ভরসা করো। তোমরা যখন নামাজে দাঁড়াও, আমার কাছে সাহায্য চাও-আমি তা দেখি। সুতরাং ময়দানে তোমরা একা নও। আমি আল্লাহ তোমাদের সাথে রয়েছি। নির্ভয়ে ময়দানে এগিয়ে যাও।
আল্লাহ তা'য়ালা এমনটি চান না যে, তিনি তাঁর বান্দাদের দিয়ে জাহান্নাম পরিপূর্ণ করতে চান,। বান্দাকে যেন জাহান্নামে প্রবেশ করতে না হয়, এ জন্যই তিনি নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন এবং কিতাব দান করেছেন। তাঁর এত আদরের সৃষ্টি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এটা তাঁর কাম্য নয়। তিনি তাঁর সীমাহীন দয়ার কথা বান্দাকে জানিয়ে দিয়েছেন এ কারণে যে, মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত বান্দাহ্ যেন তাঁর দয়ার সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। আল্লাহর ক্ষমা আর রাহমত তাঁর বান্দার পেছনে ছুটে বেড়ায়। বান্দাহ্ যদি একহাত আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়, আল্লাহর রাহমত তার দিকে দশহাত ছুটে আসে। বান্দার পাপ যদি হিমালয় পর্বত সমান হয়, আল্লাহর রাহমত তখন আটলান্টিক মহাসাগরের সমান হয়ে যায়। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাঁর দয়ার কথা এত জায়গায় উল্লেখ করেছেন যে, তা একত্রিত করতে গেলে বিশালাকারের গ্রন্থ প্রণয়ন করতে হবে।
মানুষ পাপ করে, পাপ করতে করতে হৃদয় এতটা কঠোর হয়ে যায় যে, আল্লাহর ভয়ে আর কান্না আসে না। আল্লাহ বলেন, কান্না না এলেও কাঁদার চেষ্টা করো, কাকুতি-মিনতি করো-আমি রাহমান ও রাহীম-ক্ষমা করে দেবো। সুতরাং, হতাশ হবার কোন কারণ নেই। অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে ফিরে এলেই আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। তিনি করুণাময়-তাঁর এই গুণাবলীর কথাই সূরা ফাতিহার প্রথম আয়াতে যখন বলা হলো, সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তাঁরই জন্য-যিনি জগতসমূহের রব্ব। প্রশ্ন এলো, তাঁর কি আরো কোন গুণ আছে? আল্লাহর শেখানো বাক্যে বান্দাহ্ জানিয়ে দিলো, তিনি রাহমান ও রাহীম-অসীম দয়াবান ও করুণাময়।
0 Comments