মানুষ মৃত্যুর পর হতে অনন্ত অসীম জীবনে মহাবিশ্বের যে অংশে অবস্থান করে ইসলামী পরিভাষায় সে অংশকেই আলমে আখিরাত বা পরলোক বলে। আখিরাত দু'ভাগে বিভক্ত। আলমে বারযাখ এবং আলমে হাশর। মানুষের আত্মা মৃত্যুর পরে কিয়ামতের মাঠে উঠার অর্থাৎ পুনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত যে জগতে অবস্থান করে, সে জগতই হলো আলমে বারযাখ। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন আল কোরআনের সূরা মুমিনুনে বলেছেন-
وَمِنْ وَرَائِهِمْ بَرْزَخٌ إِلَى يَوْمِ يُبْعَثُونَ
এখন এসব মৃত মানুষদের পিছনে একটি বরযাখ অন্তরায় হয়ে আছে পরবর্তী জীবনের দিন পর্যন্ত। (সূরা মু'মিনূন-১০০)
বারযাখ শব্দের অর্থ হচ্ছে পর্দা বা যবনিকা। পৃথিবী ছেড়ে বিদায় গ্রহণের পরে কিয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবী, জান্নাত ও জাহান্নামের মধ্যবর্তী এক জগতে মানুষের আত্মা অবস্থান করবে। এ আলমে বারযাখ এমনি একটি স্থান যেখান থেকে মানুষের আত্মা পৃথিবীতেও ফিরে আসতে পারবেনা বা জান্নাত-জাহান্নামেও যেতে পারবে না। এ আলমে বারযাখকেই কবর বলা হয়। আলমে বারযাখের দুটো স্তর। একটির নাম ইল্লিন অপরটির নাম সিজ্জিন। পৃথিবীতে যে সমস্ত মানুষ মহান আল্লাহর আইন কানুন-বিধান মেনে চলেছে সে সমস্ত মানুষের আত্মা ইল্লিনে অবস্থান করবে। ইল্লিন যদিও কোন বেহেস্ত নয়-তবুও সেখানের পরিবেশ বেহেশতের ন্যায়। পৃথিবীতে জীবিত থাকতে যারা আল্লাহর আইন মেনে চলেছে তারা মৃত্যুর পরে ইল্লিনে আল্লাহর মেহমান হিসেবে অবস্থান করবে।
আর যে সমস্ত মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে চলেনি, এমনকি ইসলামকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করেছে, মৃত্যুর পরে তাদের অপবিত্র আত্মা সিজ্জিনে অবস্থান করবে। এটা জাহান্নাম নয় কিন্তু এখানের পরিবেশ জাহান্নামের মতোই। কবর আযাব বলতে যা বুঝায় তা এই সিজ্জিনেই হবে। কবর বলতে মাটির সে নির্দিষ্ট গর্ত বা গুহাকে বুঝায় না যার মধ্যে লাশ কবরস্থ করা হয়। ইন্তেকালের পরে মানুষের দেহ ব্যঘ্র, সর্প যদি ভক্ষণ করে ফেলে বা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায় অথবা সমুদ্রে কোন জীব জন্তুর পেটে চলে যায় তবুও তার আত্মা কর্মফল অনুযায়ী ইল্লিন অথবা সিজ্জিনে অবস্থান করবে। মানুষ মৃত্যুর পর এমন এক জগতে অবস্থান করে, যে জগতের কোন সংবাদ, বা তাদের সাথে কোনরূপ যোগাযোগ স্থাপন পৃথিবীর জীবিত মানুষের পক্ষে অসম্ভবই শুধু নয়-সম্পূর্ণ অসাধ্য।
মৃত মানুষগণ কি অবস্থায় কোথায় অবস্থান করছে, তা পৃথিবীর জীবিত মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। এ কারণেই মৃত্যুর পরের ও কিয়ামতের পূর্বের এ রহস্যময় জগতকে বলা হয় আলমে বারযাখ বা পর্দা আবৃত জগত। মৃত্যুর পরবর্তী জগত সম্পর্কে বর্ণনা প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআন ও হাদীসে কবরের বর্ণনা করা হয়েছে। আলমে বারযাখই হলো সেই কবর। কিয়ামতের সময় তৃতীয় ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি মানুষ ঐ কবর থেকে বের হয়ে হাশরের ময়দানের দিকে দ্রুত ধাবিত হবে এবং তারপরই শুর হবে বিচার পর্ব। মহান আল্লাহ বলেন-
وأنَّ السَّاعَةَ اتِيَةٌ لأَرَيْبَ فِيهَا وَأَنَّ اللَّهَ يَبْعَثُ مَنْ فِي الْقُبُورِ -
কিয়ামতের মুহূর্তটি অবশ্যই আসবে। এতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই। আর আল্লাহ সেই মানুষদের অবশ্যই উঠাবেন যারা কবরে শায়িত। (সূরা হজ্জ্ব-৭)
পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত মানুষকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তারা সবাই কবর থেকে বেরিয়ে আসবে। সূরা ইয়াছিনে আল্লাহ তা'য়ালা বলেছেন-
وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَاهُمْ مِّنَ الْأَجدَاثِ إِلَى رَبِّهِمْ يَنْسِلُوْنَ
পরে একবার সিংগায় ফুঁক দেয়া হবে। আর অমনি তারা নিজেদের রব্ব-এর দরবারে উপস্থিত হওয়ার জন্য কবরসমূহ থেকে বের হয়ে পড়বে। (সূরা ইয়াছিন-৫১)
মানুষকে মৃত্যুর পরে যেখানে যে অবস্থায়ই দাফন দেয়া হোক অথবা পুড়িয়ে ফেলা হোক না কেন, সবার আত্মা আলমে বারযাখ বা কবরে অবস্থান করছে। সেখান থেকেই তারা হাশরের ময়দানে একত্রিত হবে। কবর থেকে উঠে এমনভাবে মানুষ আদালতে আখেরাতের দিকে দৌড়াবে যেমনভাবে মানুষ কোন আকর্ষণীয় বস্তু দেখার জন্য ছুটে যায়। আল্লাহ বলেন-
يَوْمَ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ سِرَعًا كَأَنَّهُمْ إِلَى نُصُبٍ يُوفِضُونَ
সেদিন তারা কবর হতে বের হয়ে এমনভাবে দৌড়াবে যে, দেবতার স্থানসমূহের দিকে দৌড়াচ্ছে। তখন তাদের দৃষ্টি অবনত হবে। অপমান লাঞ্চনা তাদেরকে (পাপীদেরকে) ঘিরে রাখবে। এটা সেই দিন যার ওয়াদা তাদের নিকট করা হয়েছিল। (সূরা মায়ারিজ-৪৩)
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সূরা আদিয়াতে বলেছেন-
أَفَلَا يَعْلَمُ إِذَا بُعْثِرَ مَا فِي الْقُبُورِ -
তারা কি সে সময়ের কথা জানে না, যখন কবরে সমাহিত সবকিছু বের করা হবে।
কিয়ামতের দিন ভয়বিহ্বল চেহারা নিয়ে মানুষ আল্লাহর দরবারের দিকে দৌড়াতে থাকবে। পবিত্র কোরআনের সূরা ক্বামার-এর ৬-৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
يَوْمَ يَدْعُ الدَّاعِ إِلَى شَيْءٍ نُّكْرٍ خُشَعًا أَبْصَارُهُمْ يَخْرُجُونَ مِنَ الْأَجْدَاثِ كَأَنَّهُمْ جَرَادُ مُنْتَشِرُ
যেদিন আহ্বানকারী এক কঠিন ও দুঃসহ জিনিসের দিকে আহ্বান জানাবে, সেদিন মানুষ ভীত সন্ত্রন্ত দৃষ্টিতে নিজেদের কবর সমূহ হতে এমনভাবে বের হবে, যেন বিক্ষিপ্ত অস্থিসমূহ।
আধুনিক বিজ্ঞান জানাচ্ছে সমস্ত বিশ্বজগৎ অসংখ্য পরমাণু দ্বারা গঠিত। এ থিউরি অনুযায়ী কোন বস্তু বা জিনিষের নিঃশেষে ধ্বংস নেই। কোন প্রাণীর দেহকে যা-ই করা হোকনা কেন, তা নিঃশেষে ধ্বংস হয় না। মাটির সাথে মিশে থাকে। কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহর নির্দেশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ছড়িয়ে থাকা পরমাণুগুলো পুনরায় একত্রিত হয়ে পূর্বের আকৃতি ধারণ করবে। মানুষের দেহ পচে গলে যে অবস্থাই ধারণ করুক না কেন, তা সেদিন পূর্বের আকৃতি ধারণ করে নিজের কৃতকর্মের হিসাব দেয়ার জন্যে আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হবে। অবিশ্বাসীদেরকে আল্লাহ প্রশ্নের ভাষায় বলেন-
العَبِيْنَا بِالْخَلْقِ الْأَوَّلِ بَلْ هُمْ فِي لَبْسٍ مِنْ خَلْقٍ جَدِيدٍ
আমি কি প্রথম বার সৃষ্টি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি? মূলত একটি নবতর সৃষ্টিকার্য সম্পর্কে এই লোকগুলো সংশয়ে নিমজ্জিত। (সূরা ক্বাফ-১৫)
সে যুগেও ছিল বর্তমান যুগেও এক শ্রেণীর অজ্ঞ, মূর্খ, জ্ঞান পাপী আছে, যাদের ধারণা এই মানুষের দেহ সাপের পেটে বাঘের পেটে মাছের পেটে যাচ্ছে। মাটির গর্তে পচে গলে মাটির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। এই শরীর কি পুনরায় বানানো সম্ভব? সুতরাং হাশর, বিচার কিয়ামত একটা বানোয়াট ব্যাপার। পৃথিবীতে যতক্ষণ আছো, খাও দাও ফুর্তি করো। এদেরকে উদ্দেশ্য করে সূরা কিয়ামাহ্-এর ৩-৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
أَيَحْسَبُ الْإِنْسَانَ النْ نَجْمَعَ عِظَامَهُ - بَلَى قدرِينَ عَلَى أَنْ تُسَوَى بَنَانَهُ
মানুষ কি মনে করে আমি তার হাড়গুলো একস্থানে করতে পারবো না? কেন পারবো না? আমি তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গিরা (JOINT) সমূহ পর্যন্ত পূর্বের আকৃতি দিতে সক্ষম।
এই পৃথিবীতে মানুষ যে দেহ নিয়ে বিচরণ করছে, যে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করে আল্লাহর বিধান পালন করেছে অথবা অমান্য করেছে, সেই দেহ নিয়েই সেদিন উত্থিত হবে। সূরা আম্বিয়ার ১০৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
كَمَا بَدَانَا أَوَّلَ خَلْقٍ نُعِيدُه
আমি যেভাবে প্রথমবার সৃষ্টি করেছি ঠিক অনুরূপভাবেই দ্বিতীয়বার সৃষ্টি করবো।
সেদিন কেউ বাদ পড়বেনা। প্রথম মানব সৃষ্টির দিন হতে চূড়ান্ত প্রলয়ের দিন পর্যন্ত যত মানুষ পৃথিবীর আলো-বাতাসে এসেছে, তাদের সকলকেই একই সময়ে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
ذَالِكَ يَوْمٌ مَّجْمُوعٌ لَهُ النَّاسُ وَذَالِكَ يَوْمٌ مَّشْهُودٌ -
সেদিন সমস্ত মানুষকে একত্রিত করা হবে। তারপর (সেদিন) যা কিছু ঘটবে তা সকলের চোখের সামনেই ঘটবে। (সূরা হুদ-১০৩)
অর্থাৎ পৃথিবীতে কারো বিচার চলাকালিন অনেক অবিচারই করা হয়। আসামীর চোখের আড়ালে তাকে ফাঁসানোর জন্যে কত কিছু করা হয়। কিন্তু কিয়ামতের ময়দানে এমন করা হবে না। মানুষ প্রতি মুহূর্তে যা কিছু করছে তার রেকর্ড সংরক্ষণ করছেন সম্মানিত দু'জন ফেরেশতা। সে সব রেকর্ড মানুষ নিজেই পড়বে। সেই রেকর্ডের ভিত্তিতেই বিচার করা হবে। তার দৃষ্টির আড়ালে কিছুই করা হবে না। সূরা ওয়াকিয়ায় বলা হয়েছে-
قُلْ إِنَّ الْأَوَّلِينَ وَالْآخِرِينَ - لَمَجْمُوعُونَ إِلَى مِيْقَاتِ يَوْمٍ مَّعْلُومٍ
হে রাসূল! আপনি বলে দিন, প্রথম অতীত হওয়া ও পরে আসা সমস্ত মানুষ নিঃসন্দেহে একটি নির্দিষ্ট দিনে একত্রিত করা হবে, এর সময় নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
কিয়ামতের দিন শরীর প্রকম্পিত হওয়ার মতো অবস্থা দেখে মানুষ ভয়ে এমনই দিশেহারা হয়ে পড়বে যে, তারা কিছুতেই স্মরণ করতে পারবে না পৃথিবীতে জীবিত থাকা কালে তারা কত দিন জীবিত ছিল। পরকালের সূচনা এবং তার দীর্ঘতা দেখে পৃথিবীর শত বছরের হায়াতকে তারা মনে করবে বোধ হয় এই ঘন্টাখানেক পৃথিবীতে ছিলাম। ইসলামী বিধান যারা মানেনি তারা সেদিন পৃথিবীতে কত হায়াত পেয়েছিল তা ভুলে যাবে। এ ভুলে যাওয়া কোন স্বাভাবিকভাবে ভুলে যাওয়া নয় বরং ভয়ে আতঙ্কে ভুলে যাবে। আল্লাহ বলেন-
وَنَحْشُرُ الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ زُرْقًا - يُتَخَافَتُونَ بَيْنَهُمْ إِنْ لَبِثْتُمْ الا عشرا -
অপরাধীদেরকে এমনভাবে ঘিরে আনবো যে তাদের চক্ষু আতংকে বিস্ফোরিত হয়ে যাবে। তারা পরস্পর ফিসফিস করে বলাবলি করবে, আমরা পৃথিবীতে বড় জোর দশদিন মাত্র সময় কাটিয়েছি। (সূরা ত্ব-হা-১০২)
মহান আল্লাহ সেদিন মানুষকে প্রশ্ন করবেন-
قَالَ كَمْ لَبِثْتُمْ فِي الْأَرْضِ عَدَدَ سِنِينَ - قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْبَعْصَ يَوْمِ فَسْئَلِ الْعَادِينَ
তোমরা পৃথিবীতে কতদিন ছিলে? উত্তরে তারা বলবে একদিন বা তার চেয়ে কম সময় আমরা পৃথিবীতে ছিলাম। (সূরা মুমিনুন-১১২-১১৩)
আল্লাহর কোরআনের অন্যত্র বলা হয়েছে-
وَيَومَ تَقُومُ السَّاعَةُ يُقْسِمُ الْمُجْرِمُونَ مَا لَبِثُوا غَيْرَ سَاعَةٍ
যখন সে সময়টি এসে পড়বে, তখন অপরাধীগণ শপথ করে বলবে যে পৃথিবীতে আমরা এক ঘন্টার বেশি ছিলাম না।
(সূরা রূম-৫৫)
0 Comments