রোযার সুন্নত ছয়টি (১) বিলম্বে সেহরী খাওয়া, (২) খোরমা অথবা পানি দ্বারা মাগরিবের নামাযের পূর্বে ইফতার করা, (৩) দ্বিপ্রহরের পরে মেসওয়াক না করা, (৪) রমযান মাসে দান খয়রাত করা, (৫) কোরআন পড়া ও পড়ানো এবং (৬) মসজিদে এতেকাফ করা; বিশেষতঃ শেষ দশ দিনে। রসূলুল্লাহ (সাঃ) রমযানের শেষ দশ দিন খুব এবাদত করতেন- নিজেও মেহনত করতেন এবং পরিবারের লোকজনকেও মেহনত করাতেন। কারণ, এই দশ দিনের মধ্যে শবে কদর রয়েছে। এই দশ দিন নিরন্তর এতেকাফ করা উত্তম। এতেকাফের নিয়ত করার পর শরীয়তসম্মত প্রয়োজন ব্যতিরেকে মসজিদ থেকে বের হলে নিরন্তর এতেকাফ হবে না। যেমন, কোন রোগীকে দেখার জন্যে, সাক্ষ্য দেয়ার জন্যে, জানাযায় শরীক হওয়ার জন্যে এবং যিয়ারত করার জন্যে বের হওয়া। প্রস্রাব পায়খানার জন্যে বের হলে কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু ওষু ব্যতীত অন্য কোন কাজে মশগুল হওয়া যাবে না। দেহের কিছু অংশ: মসজিদ থেকে বের করলে এতেকাফের নিরন্তরতা ভঙ্গ হবে না। রসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের মস্তক আয়েশা (রাঃ)-এর কক্ষে বের করে দিতেন এবং তিনি চিরুনি করে দিতেন।
নফল রোযা
প্রকাশ থাকে যে, উত্তম দিনে রোযা রাখা উত্তম হয়ে থাকে। উত্তম দিনসমূহের মধ্যে কতক সম্বৎসরের মধ্যে, কতক প্রত্যেক মাসে এবং কতক প্রতি সপ্তাহে পাওয়া যায়। সম্বৎসরের মধ্যে যেসব দিন পাওয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে আরাফার দিন, আশুরার দিন, যিলহজ্জের প্রথম দশ দিন ও মহররমের দশ দিন। রসূলুল্লাহ (সাঃ) শা'বান মাসে এত বেশী রোযা রাখতেন যে, মনে হত তাও যেন রমযান মাস। এক হাদীসে আছে-রমযানের রোযার পর উত্তম রোযা হচ্ছে মহররমের রোযা। এর কারণ, মহররম বছরের প্রথম মাস। এ মাসকে সৎ কাজ দ্বারা পরিপূর্ণ করলে সারা বছর এর বরকত আশা করা যায়। এক হাদীসে আছে- মহররম মাসে একদিন রোযা রাখা অন্য মাসের ত্রিশ রোযার চেয়েও উত্তম। রমযান মাসে একদিন রোযা রাখা মহররমে ত্রিশ রোযার চেয়ে উত্তম। এক হাদীসে আছে- যেব্যক্তি মহররম মাসে তিন দিন অর্থাৎ বৃহস্পতি, শুক্র ও শনিবারে রোযা রাখে, তার প্রত্যেক রোযার বিনিময়ে সাতশ' বছরের এবাদতের সওয়াব লেখা হয়। এক হাদীসে আছে- শাবানের অর্ধেকের পর রমযান পর্যন্ত কোন রোযা নেই। এ কারণেই রমযানের পূর্বে কিছু দিন রোযা না রাখা উত্তম। শাবানের রোযার সাথে রমযানের রোযা মিলিয়ে দেয়াও জায়েয। কারণ রসূলুল্লাহ (সাঃ) একবার এরূপও করেছেন। কোন কোন সাহাবী সম্পূর্ণ রজব মাস রোযা রাখা মাকরূহ বলেছেন, যাতে রমযান মাসের মত না হয়ে যায়। মোট কথা, যিলহজ্জ, মহররম রজব ও শাবান উত্তম মাস। এক হাদীসে আছে, যিলহজ্জের দশ দিনের তুলনায় এমন কোন দিন নেই, যাতে আমল করলে আল্লাহর কাছে অধিক প্রিয় হয়। এর এক দিনের রোযা সারা বছরের রোযার সমান। এর এক রাত্রির জাগরণ শবে কদরে জাগরণের সমান। লোকেরা জিজ্ঞেস করল: আল্লাহর পথে জেহাদ করাও কি এই দিনের আমলের সমান নয়। তিনি বললেন: জেহাদও সমান নয়, তবে যদি তার ঘোড়া মারা যায় এবং সে নিজে শহীদ হয়।
যেসকল দিন মাসের মধ্যে উত্তম পাওয়া যায়, সেগুলো হচ্ছে মাসের শুরু, মধ্যবর্তী ও শেষ দিনসমূহ। মাসের মধ্যবর্তী দিনগুলোকে আইয়ামে বীয বলা হয়। এগুলো হচ্ছে চান্দ্রমাসের তের, চৌদ্দ ও পনর তারিখ সপ্তাহের উত্তম দিন হচ্ছে সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবার। উল্লিখিত উত্তম দিনগুলোতে রোযা রাখা ও বেশী পরিমাণে খয়রাত করা মোস্তাহাব। এসব দিনের বরকতে আমলের সওয়াব অনেক বেড়ে যায়।
সর্বকালের রোযার মধ্যে আরও অতিরিক্ত দিনসহ এ সকল দিনও শামিল। কিন্তু এ ব্যাপারে সাধককুলের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ কেউ সর্বকালের রোযা মাকরূহ বলেন। হাদীস থেকে তাই বুঝা যায়।
সর্বকালীন রোযার এক প্রকার হচ্ছে দুই ঈদের দিন এবং তাশরীকের দিনগুলোতেও রোযা রাখা। একে সওমে দাহর বলা হয়। এই প্রকার রোযা যে মাকরূহ, তা বলাই বাহুল্য। এ ছাড়া সর্বকালীন রোযার মধ্যে রোযার বিরতি জনিত সুন্নত, থেকে মুখ ফেরানো হয় এবং রোযাকে নিজের উপর জরুরী করে নেয়া হয়। অথচ আল্লাহর পক্ষ থেকে রোযা না রাখার যে অনুমতি আছে, তা পালন করা আল্লাহ পছন্দ করেন, যেমন ফরয ও ওয়াজেব পালন করা তিনি পছন্দ করেন। এ কারণেও সর্বকালীন রোযা মাকরূহ। যদি সর্বকালীন রোযা রাখার মধ্যে উপরোক্ত দুটি অনিষ্টের মধ্য থেকে একটিও না হয় এবং সর্বকালীন রোযা রাখার মধ্যে নফসের কল্যাণ জানা যায়, তবে সর্বকালীন রোযা রাখবে। কেননা, অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী সর্বকালীন রোযা রেখেছেন। হযরত আবু মূসা আশআরী (রঃ)-এর রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ
من صام الدهر كله ضيقت عليه جهنم هكذا .
অর্থাৎ, যেব্যক্তি দাহরের রোযা রাখে, জাহান্নামে তার জন্য কোন স্থান থাকে না।
রোযার আর একটি স্তর হচ্ছে অর্ধ দাহরের রোযা রাখা। অর্থাৎ, একদিন রোযা রাখা ও একদিন রোযা না রাখা। এভাবে সারা জীবন রোযা রাখা। এটা নফসের জন্যে অধিক কঠিন। ফলে নফস খুব দমিত হয়। হাদীসে এ রোযার ফযীলত বর্ণিত আছে। এ রোযায় বান্দা একদিন সবর করে ও একদিন শোকর করে। রসূলে আকরাম (সাঃ) বলেনঃ আমার সামনে দুনিয়ার ধন-ভান্ডারের চাবি এবং ভূপৃষ্ঠে সমাহিত ধন-সম্পদ পেশ করা হয়েছে। আমি সেগুলো প্রত্যাখ্যান করে বলেছি: আমি একদিন অভুক্ত থাকব এবং একদিন পেট পুরে আহার করব। যেদিন পেট পুরে খাব, সেদিন আপনার প্রশংসা করব। আর যেদিন অভুক্ত থাকব, সেদিন আপনার কাছে মিনতি করব। এক হাদীসে আছে-
আমার ভাই দাউদ (আঃ)-এর রোযা উত্তম রোযা ছিল। তিনি একদিন রোযা রাখতেন ও একদিন রোযা রাখতেন না।
জীবনের অর্ধেক দিন রোযা রাখা সম্ভব না হলে এক-তৃতীয়াংশ দিন রোযা রাখবে। অর্থাৎ, একদিন রোযা রাখবে এবং দুদিন রোযা রাখবে না। মাসের প্রথম তিন দিন, আইয়ামে বীযের তিন দিন এবং শেষ তিন দিন রোযা রাখলে এক-তৃতীয়াংশে এবং উত্তম দিনেও রোযা হয়ে যায়। সপ্তাহে সোম, বৃহস্পতি ও শুক্রবারে রোযা রাখলে এক-তৃতীয়াংশের কিছু বেশী হয়ে যায়।
যেব্যক্তি অন্তরের সূক্ষ্ম অবস্থা বুঝে এবং আপন অবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখে, কোন কোন সময় চায়, সে সর্বকালে রোযা রাখুক এবং কখনও চায়, সর্বকালে রোষা না রাখুক। আবার কখনও চায়, মাঝে মাঝে রোযা রাখুক। এ কারণেই বর্ণিত আছে, রসূলুল্লাহ (সাঃ) কখনও এত রোযা রাখতেন যে, লোকেরা মনে করত তিনি আর কখনও রোযা ছাড়বেন না। কখনও এত বেশী দিন রোযাহীন অবস্থায় অতিবাহিত করতেন যে, মানুষ মনে করত, তিনি আর রোষা রাখবেন না। তিনি রাত্রিকালে এত বেশী নিদ্রা যেতেন, মনে করা হত, তাহাজ্জুদের জন্যে গাত্রোত্থান করবেন না। আবার জাগরণও এত বেশী করতেন যে, বলা হত আর নিদ্রা যাবেন না। কোন কোন আলেম নিরন্তর চার দিনের বেশী রোযাহীন অবস্থায় থাকা মাকরূহ বলেছেন। তাঁদের মতে এটা অন্তরকে কঠোর করে, বদভ্যাস সৃষ্টি করে এবং কামনা বাসনার দ্বার উন্মুক্ত করে। বাস্তবে রোযাহীন অবস্থা অধিকাংশ লোকের মধ্যে এ প্রভাবই সৃষ্টি করে। বিশেষতঃ যারা দিনে ও রাতে দু'বার আহার করে, তাদের জন্যে এটা খুবই ক্ষতিকর।
0 Comments