মানব চরিত্রের দুর্ভেদ্য বর্ম-বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস

        দেশ, সমাজ ও জাতির নিরাপত্তার লক্ষ্যে পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই নানা ধরনের আইন-কানুন রচিত হয়েছে। আইন প্রণীত হয়েছে মানুষকে সৎ ও চরিত্রবান হিসাবে গড়ে তোলার জন্য। শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমেও মানুষকে সৎ হিসাবে গড়ার লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো হয়ে থাকে। অপরাধ প্রবণতা দমন করে মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখার লক্ষ্যে মানবেতিহাসে সবচেয়ে অধিক প্রচেষ্টা চালানে হয়েছে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ এ ব্যাপারে কোথাও সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। বার বার তাদেরকে ব্যর্থতার গ্লানি ভোগ করতে হয়েছে। এর মূল কারণ হলো, যে বিষয়টি প্রধানতঃ মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখতে পারে, সে বিষয়টিকেই পরিহার করে নানা ধরনের অপরাধ দমন আইন ও অপরাধ প্রতিরোধক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়েছে।

    একজন মহা ক্ষমতাবান সর্বদর্শী স্রষ্টার দরবারে মানব জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ডের জবাবদিহি করতে হবে-এই অনুভূতি মানুষের হৃদয় জগতে সদাজাগ্রত না থাকলে সে মানুষ কোনক্রমেই অপরাধ প্রবণতা থেকে দূরে থাকতে পারে না, এ কথা ঐতিহাসিকভাবে পৃথিবীতে বার বার প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা চরম সত্য যে, জাতির পরিচালকগণ উল্লেখিত মূলনীতি পরিত্যাগ করেই চরিত্র সৃষ্টির যাবতীয় বিধি-বিধান প্রণয়ন করে থাকে। এ যেন ঘি-কে উত্তপ্ত অগ্নিকুন্ডের পাশে রেখে জমাট বাঁধার সাধনা করার মতো হাস্যকর প্রচেষ্টা গ্রহণ করা।

        প্রকৃত বিষয় হলো, বিচার দিবস তথা পরকাল অমান্য ও অস্বীকার করার অনিবার্য এবং নিশ্চিত পরিণাম হচ্ছে, চরিত্রহীনতার অতল তলদেশে নিমজ্জিত হওয়া। বিচার দিবস সম্পর্কিত ভীতি শূন্য মন-মানসিকতার অধিকারী মানুষ এমন সব কদর্যতামূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, যার পরিণাম ধ্বংস, পাপাচার, অরাজকতা, অশান্তি, বিশৃংখলা ইত্যাদি ব্যতিত আর কিছুই নয়। অগণিত বছরের মানবীয় আচরণ ও কর্মকান্ড এ কথার জ্বলন্ত সাক্ষী। বিষয়টির সত্যতা যাচাই করার জন্য সুদূর অতিতের ইতিহাসের পৃষ্ঠায় দৃষ্টি নিক্ষেপের কোন প্রয়োজন নেই, নিজের চারপাশের পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দিলেই সহজে অনুমান করা যাবে, বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতিহীন আইন-কানুন আর শিক্ষানীতি কি ধরনের নিরাপত্তাহীনতা আর বিশ্বাসহীনতার পরিবেশের জন্ম দিয়েছে।

        যারা নিজেদেরকে বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে বাধ্য মনে করে না, পরিশেষে নিজের সমস্ত কাজের হিসাব বিচার দিবসে প্রদান করতে হবে, এর কোন ভয় বা আশঙ্কাই মনে বোধ করে না, যারা নিশ্চিত ধরে নিয়েছে যে, এই পৃথিবীর জীবনই একমাত্র জীবন, এরপরে আর কিছুই নেই, এই পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, সম্মান-মর্যাদা, খ্যাতি-যশ, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও ক্ষমতা অর্জনকে সাফল্য লাভের একমাত্র মানদন্ড বলে মনে করে, সর্বোপরি যারা এই ধরনের বস্তুবাদী চিন্তা, বিশ্বাস ও চেতনার ভিত্তিতে আল্লাহর দেয়া বিধান অনুসরণের অযোগ্য বলে বিবেচনা করে, তাদের গোটা জীবনই অসংখ্য ভুল-ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।

        এরা পৃথিবীতে বাধা-বন্ধন মুক্ত লাগামহীন জীবন-যাপন করে। ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর পরিচিত অপরিচিত যাবতীয় অসৎ গুণাবলী তাদের চরিত্রে বাসা বাঁধে। এদের অশুভ পদচারণায় গোটা দেশবাসী অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতিহীন মন-মানসিকতার অধিকারী ব্যক্তিগণ দেশের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরে দেশের সম্মানিত ও মর্যাদাবান আলেম-ওলামা তথা আল্লাহভীরু লোকদেরকে অসম্মানিত করে। তাদেরকে মিথ্যা মামলায় কারারুদ্ধ করে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালায়। তাদের মতের বিরোধিদেরকে সমূলে উৎখাত করার প্রচেষ্টা চালায়। সবর্ত্র দলীয় ও আত্মীয়করণ করে। জাতির সম্পদ অবাধে লুট-পাট করে। মিথ্যা-প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতে এদের বিবেকে বাধে না।

        গোটা দেশব্যাপী জুলুম আর অন্যায়-অত্যাচারের প্লাবন বইয়ে দেয়। জাতি অনাহারে থাকলেও এদের বিলাসিতার সরঞ্জামের কোন অভাব ঘটে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় জাতির পেটের চামড়া পিঠের সাথে লেগে গেলেও এদের দেহ ক্রমশঃ স্ফীত হতে থাকে। এদের লজ্জানুভূতি এতটা নিম্নস্তরে নেমে যায় যে, ভিন্ন নারীর সাথে তাদের অবৈধ সম্পর্কের কথা সদম্ভে প্রচার মাধ্যমে ঘোষণা করতেও এসব লজ্জাহীনের দল দ্বিধাবোধ করে না।

        চরিত্রহীনা নারী বৃটেনের প্রিন্সেস ডায়না অবৈধ সন্তান গর্ভে নিয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করার পরে লজ্জার পরিবর্তে এই শ্রেণীর মানুষগুলো শোকাহত হয়ে পড়েছিল। মাত্র কিছুদিন পূর্বে বৃটেনের প্রধান মন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের ষোল বছরের সন্তান 'ইউয়েন' মদপান করে রাস্তায় পড়েছিল। বিষয়টি সংবাদ মাধ্যমে সচিত্র প্রকাশ হলেও বিচার দিবসের প্রতি জবাবদিহির অনুভূতিহীনতার কারণে তারা কেউ লজ্জানুভব করেনি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের যৌন নারী মনিকা লিউনস্কির অবৈধ সম্পর্কের কথা প্রকাশ হলে দেশব্যাপী যে আলোড়ন সৃষ্টি হলো, বিচার দিবসে জবাবাদিহির অনুভূতি না থাকার কারণে কোন লজ্জাই তাকে স্পর্শ করেনি।
    
        শিক্ষাঙ্গনের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে যে, মাদ্রাসায় তথা যেসব শিক্ষাঙ্গনে বিচার দিবসে জবাবদিহি সৃষ্টির অনুভূতিমূলক সামান্য শিক্ষা দেয়া হয়, সেখানের ছাত্রদের চারিত্রিক মান আর যেখানে ঐ অনুভূতিমূলক শিক্ষার নাম-নিশানা নেই, সেখানের ছাত্রদের চারিত্রিক মানে শত যোজন পার্থক্য বিদ্যমান। দেশের সন্ত্রাসী, ছিন্তাইকারী, চাঁদাবাজ, চোর-ডাকাত, আত্মসাৎকারী, নারী ধর্ষকদের তালিকা প্রায় থানাতেই রয়েছে। এসব তালিকার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যাবে, মাদ্রাসা তথা যেখানে বিচার দিবসের অনুভূতিমূলক শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সে শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কতজন, আর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে বস্তুবাদী শিক্ষা দেয়া হয়েছে, সেই শিক্ষায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা কতজন।

        প্রকৃতপক্ষে বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাসের স্বপক্ষে এটা একটি অভিজ্ঞতামূলক প্রামাণ্য দলীল। এ জন্য এ কথা আমরা নিশ্চয়তা সহকারে এবং অটল বিশ্বাসে উচ্চারণ করতে পারি যে, বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতিই কেবলমাত্র মানুষকে সৎ ও চরিত্রবান করতে সক্ষম-ভিন্ন কোন ব্যবস্থা নয়। মানুষের চরিত্র পৃথিবীর কোন আইন দিয়েই সংশোধন করা যেতে পারে না। নানা অপরাধের শাস্তি হিসাবে পৃথিবীতে অসংখ্য আইন-কানুনের প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে, মানুষকে সে অপরাধ থেকে মুক্ত করা যায়নি। এ্যাসিড নিক্ষেপের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করেও অপরাধীদেরকে ঐ ঘৃণ্য নিষ্ঠুর কর্ম থেকে বিরত করা যায়নি। কঠোর আইন প্রয়োগ করেও দুষ্কৃতিকারীদেরকে মাদকদ্রব্য সেবন ও তার ব্যবসা থেকে দূরে রাখা যায়নি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুসভ্য বলে দাবিদার দেশ-আমেরিকার একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ যোগ্য। মদ্য পানকারীদের অধিকার নিশ্চিত করা হবে, এই ঘোষণাই মিঃ রুজভেল্টের প্রেসিডেন্ট পদে বিজয়কে তরান্বিত করেছিল। এরপর ১৯৩৩ সনে আমেরিকার শাসনতন্ত্রের ১৮ নম্বর সংশোধনীটি বাতিলের মাধ্যমে গোটা আমেরিকায় মদের উৎপাদন, ক্রয়-বিক্রয় ও মদ সংক্রান্ত যাবতীয় কিছু নিষিদ্ধ করা হয়।

        মদপান থেকে জাতিকে মুক্ত করার লক্ষে ১৮ নম্বর সংশোধনীটি বাতিল করার বেশ কয়েক বছর পূর্ব থেকেই এ্যান্টি সেলুন লীগ নামক একটি সংস্থা মদের অপকারিতা সম্পর্কে আধুনিক যুগের যাবতীয় সহযোগিতা গ্রহণ করে প্রচার চালিয়ে ছিল। এভাবে তারা প্রচার কার্য চালাতে গিয়ে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছিল। মদের অপকারিতা সম্পর্কে যতগুলো বই-পুস্তক প্রকাশ করা হয়েছিল, তার মোট পৃষ্ঠা ছিল প্রায় নয় কোটির মতো। মদ্য নিবারক আইনটি কার্যকর করতে গিয়ে চৌদ্দ বছরে আমেরিকার সরকার ৬৫ কোটি পাউন্ড ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছিল। দুইশত লোককে নিহত হতে হয়েছিল। ৫ লক্ষ ৩৪ হাজার ৩ শত ৩৫ জনকে জেল দেয়া হয়েছিল। ১ কোটি ৬০ লক্ষ পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছিল। ৪০ কোটি ৪০ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের নানা ধরনের সম্পদ সরকার বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল।

        আমেরিকায় মদ্যপান নিষিদ্ধ হবার সাথে সাথে গোপনে মদ উৎপাদনকারী অসংখ্য কারখানা দেশের আনাচে কানাচে প্রতিষ্ঠিত হলো। আইনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাস্তা-পথে গোপনে মদ উচ্চমূল্যে বিক্রি শুরু হলো। প্রকাশ্যে যখন মদ বিক্রি হতো, তখনকার মূল্যের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি মূল্যে গোপনে মদ বিক্রি হচ্ছে-এই সুযোগ দেশবাসী হাতছাড়া করলো না। দেশের একশেণীর জনগণ গোপনে মদের ব্যবসা শুরু করলো। পূর্বের তুলনায় মদপানকারীর সংখ্যা বহুলাংশে বৃদ্ধি লাভ করলো।

        পূর্বে যেখানে বৈধ মদের বিপনন কেন্দ্র ছিল গোটা আমেরিকায় ৪ শত, আর মদ নিষিদ্ধ হবার পরে মদের গোপন বিপনন কেন্দ্রের সংখ্যা ছিল অগণিত। ৭ বছরে নিষিদ্ধ ঘোষিত মদের বিপনন কেন্দ্রের ৭৯ হাজার ৪ শত ৩৭ জন মালিককে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং ৯৩ হাজার ৮ শত ৩১ টি মদের বিপনন কেন্দ্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। এ ধরনের অসংখ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেও মানুষকে মদ থেকে বিরত রাখতে আমেরিকার সরকার চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। পরবর্তীতে তারা পুনরায় মদ বৈধ করতে বাধ্য হয়েছিল।

        আমেরিকা সরকারের এই ব্যর্থতার পেছনে যে কারণটি সক্রিয় ছিল তাহলো, তারা মানুষের মনে বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি সৃষ্টি করেনি। মদপান করলে আল্লাহর আদালতে গ্রেফতার হতে হবে-এই অনুভূতি যদি তাদের ভেতরে সৃষ্টি করা হতো, তাহলে অবশ্যই জাতিকে মদপান থেকে বিরত রাখা যেতো। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে ভূখন্ডে আগমন করেছিলেন, সে জাতি ছিল অজ্ঞতা আর বর্বরতায় নিমজ্জিত। সভ্যতা-সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞানের কোন স্পর্শ ছিল না তাদের জীবনে। হিংস্রতা আর অপরাধ প্রবণতা ছিল শিরা-উপশিরায় ধাবমান। জেনা-ব্যভিচার তাদের দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ ছিল। পানির মতই তারা মদপান করতো। মদ তাদের কাছে এত অধিক প্রিয় ছিল যে, সেযুগের কাব্য আর সাহিত্য মদের উল্লেখ ব্যতিত রচিত হতো না। মদকে ভালোবেসে তারা আড়াই শতেরও অধিক নাম দিয়েছিল। সেই লোকগুলোর ভেতরে বিচার দিবসের ভীতি সৃষ্টি করে আল্লাহর রাসূল তাদের সম্পূর্ণ জীবনধারা কিভাবে পরিবর্তন করে দিয়েছিলেন, তা বর্তমানে আধুনিক যুগের পন্ডিতদের কাছে গবেষণার বিষয়। মদ সম্পর্কে রাসূলকে প্রশ্ন করা হয়েছে, তিনি জানিয়ে দিয়েছেন আল্লাহ তা'য়ালা মদ-জুয়া সম্পর্কে বলছেন-

يَسْتَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ - قُلْ فِيْهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَاثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا -

        লোকজন আপনাকে প্রশ্ন করছে মদ-জুয়া সম্পর্কে কি নির্দেশ? আপনি বলে দিন, এ দুটো জিনিস বড়ই অকল্যাণকর, যদিও এতে লোকদের জন্য কিছুটা কল্যাণও রয়েছে, কিন্তু উভয় কাজের অকল্যাণ-কল্যাণের তুলনায় অনেক বেশী। (সূরা বাকারা-২১৯)

        প্রথমবারে মদ-জুয়া সম্পর্কে আল্লাহর পক্ষ থেকে কোন আদেশ বা নিষেধ বাণী উচ্চারিত হলো না। শুধু এর কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা হলো। যখন বলা হলো, এসবের মধ্যে অকল্যাণের দিকই বেশী, তৎক্ষণাত জাতির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মদপান থেকে বিরত হলো। বেশ কিছুদিন গত হবার পরে দেখা গেল লোকজন মদপান করে নামাজ আদায় করার সময় নামাজে ভুল-ভ্রান্তি করছে। রাসূলকে পুনরায় প্রশ্ন করা হলে আল্লাহর পক্ষ থেকে সূরা নেছার ৪৩ নং আয়াতে জানিয়ে দেয়া হলো-

يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لا تَقْرَبُوا الصَّلوةَ وَأَنْتُمْ سُكْرَى حَتَّى تَعْلَمُوا مَا تَقُولُونَ

        হে ঈমানদারগণ! তোমরা যখন নেশাগ্রস্থ থাকো, তখন নামাজের কাছেও যেও না। নামাজ আদায় তখনই করবে যখন তোমরা কি বলছো, তা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।

        আল্লাহর পক্ষ থেকে মদ সম্পর্কে যখন এই আদেশ অবতীর্ণ হলো, তখন লোকজনের পক্ষে মদপান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠলো। ফজরের নামাজের পরে মদপান করলে সাংসারিক এবং ব্যবসায়িক কাজকর্মে ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে লাগলো। যোহরের নামাজের পরে মদপান করলে আসরের নামাজ পর্যন্ত নেশা থাকতো। আসরের নামাজের পরে মদপান করলে মাগরিবের নামাজ পর্যন্তও নেশা থাকতো। সুতরাং তারা মদপানের জন্য দুটো বিশেষ সময় নির্ধারণ করলো। ফজর ও যোহরের মধ্যবর্তী সময় আর এশার নামাজের পরে। এই আদেশের ফলেও আরো কিছু সংখ্যক লোকজন মদপান থেকে বিরত হলো। কিন্তু মদের প্রকৃত ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে লোকজন তখন পর্যন্ত অন্ধকারে ছিল। মদপান করে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মানুষ অরাজকতা সৃষ্টি করতো, হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটিয়ে বসতো নেশাগ্রস্থ হয়ে। এরপর মহান আল্লাহ সূরা মায়িদার ৯০-৯২ নং আয়াতে তাদের চোখের সামনে থেকে অন্ধকারের পর্দা উঠিয়ে নিলেন-

يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ إِنَّمَا يُرِيدُ الشَّيْطَانُ أَنْ يُوقِعَ بَيْنَكُمُ الْعَدَا وَ تَوَ الْبَغْضَاءَ فِي الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ وَيَصُدَّكُمْ عَنْ ذِكْرِ اللَّهِ وَعَنِ الصَّلُوةِ - فَهَلْ أَنْتُمْ مُنْتَهُونَ - وَأَطِيعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَاحْذَرُوا فَإِنْ تَوَلَّيْتُمْ فَاعْلَمُوا أَنَّمَا عَلَى رَسُولِنَا الْبَلْغُ الْمُبِينُ

        হে ঈমানদারগণ। এই মদ, জুয়া, মূর্তি, পাশাখেলা ইত্যাদি হলো অপবিত্র এবং শয়তান কর্তৃক উদ্ভাবিত নোংরা কর্ম। অতএব তোমরা এসব কাজ বর্জন করো। এসব কাজ বর্জনের ফলে তোমরা কল্যাণ লাভে সক্ষম হবে। শয়তানের আকাংখা হলো, মদ-জুয়ার মাধ্যমে তোমাদের পরস্পরের মধ্যে শত্রুতা ও হিংসা-বিদ্বেষের সৃষ্টি করবে এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামাজ থেকে বিরত রাখবে। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান অনুসরণ করো এবং ঐসব কাজ থেকে বিরত হও। আর তোমরা যদি এই আদেশের বিরোধিতা করো, তাহলে জেনে রেখো যে, আমার রাসূলের ওপরে দায়িত্ব ছিল, তিনি স্পষ্ট ভাষায় আমার আদেশ পৌছে দিবেন।

        ইতিহাস সাক্ষী, আল্লাহর পক্ষ থেকে মদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হবার সাথে সাথে ঐ লোকগুলোই মদ পান থেকে শুধু বিরতই হয়নি, মদভর্তি পাত্রগুলো তারা ভেঙে এমনভাবে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছিল যে, রাস্তা-পথে মদের প্লাবন বয়ে গিয়েছিল। মদ নিবারক এই আইন কার্যকরী করতে গিয়ে কোন বাহিনীর প্রয়োজন হয়নি, দীর্ঘ দিন ধরে কোন প্রচার প্রপাগান্ডা চালাতে হয়নি। কাউকে গ্রেফতার করতে হয়নি। মদ ছিল যাদের কাছে সবচেয়ে প্রিয় পানিয়-সেই মদই আল্লাহর আদেশের কারণে তাদের কাছে চরম ঘৃণার বস্তুতে পরিণত হলো। কোথাও বসে কিছু সংখ্যক লোকজন মদপান করছিল। রাসূলের ঘোষণাকারীর কণ্ঠশব্দ তাদের কানে প্রবেশ করলো, 'এখন থেকে মদ নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে'। এই ঘোষণা নেশাগ্রন্থ কানে প্রবেশ করার সাথে সাথে যে ব্যক্তি মুখের কাছে সবেমাত্র মদের পাত্র তুলে ধরেছিল, সে তা ঘৃণাভরে দূরে নিক্ষেপ করেছিল। যাদের সামনে মদ পরিপূর্ণ পাত্র ছিল, তারা তা চরম ঘৃণায় পদাঘাত করে ফেলে দিল। বিচার দিবসে প্রতিটি কাজের জবাবদিহি করতে হবে, এই বিশ্বাস-ই মানুষের চরিত্রে এভাবে সার্বিক পরিবর্তন সাধিত করেছিল।

        রাতের অন্ধকারে দুধের সাথে পানি মিশ্রিত করে বিক্রি করলে কেউ দেখতে পাবে না-কিন্তু সর্বদর্শী আল্লাহ দেখবেন, বিচার দিবসে জবাবদিহি করতে হবে, এই অনুভূতি এতটাই প্রবল ছিল যে, অবরোধপুরের অধিবাসিনী যুবতী নারীও দুধে পানি মিশিয়ে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জনের পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করতো। বিক্রেতা ক্রেতাকে জানিয়ে দিতো, তার পণ্যে কোথায় কি ত্রুটি রয়েছে। বস্ত্র বিক্রেতা যদি ভুল ক্রমে কারো কাছে ত্রুটি যুক্ত বস্ত্র বিক্রি করতো, বিষয়টি স্মরণে আসার সাথে সাথে সে বিচার দিবসে জবাবদিহির ভয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান শূন্যের মতই অনুসন্ধান করতে থাকতো, কোথায় গেল সেই বস্ত্রের ক্রেতা। তাকে খুঁজে বের করে অর্থ ফেরৎ দেয়া হতো। পথ চলতে গিয়ে অলঙ্কারে সুসজ্জিতা তন্বী তরুণী অনিন্দ সুন্দরী ষোড়ষী যুবতী দেখেছে তার দিকে এগিয়ে আসছে সুন্দুর সুঠাম দেহের অধিকারী যুবক। লুষ্ঠিতা আর ধর্ষিতা হবার ভয়ে আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে সে পথের ধূলায় বসে পড়েছে।

        যুবক ধীর গতিতে এগিয়ে এসে সামনে স্থির দাঁড়িয়ে ভয়াবহ্বলা যুবতীর চোখের ওপরে চোখ রেখে মমতাভরা কন্ঠে আবেদন করেছে, 'মা, কোন ভয় নেই। আপনি কোথায় যাবেন বলুন আমি প্রহয়া দিয়ে নিরাপত্তার সাথে আপনাকে গন্তব্যস্থলে পৌঁছে দেবো, আমার পরিচয় শুনুন, আমি মুসলমান।' বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি মানুষের হৃদয়ে প্রবেশ করিয়ে আল্লাহর রাসূল এই ধরনের চরিত্রবান মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন।

        বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি সক্রিয় না থাকলে কোনক্রমেই মানুষের চরিত্র ভালো হবে না, মানুষের ভেতর থেকে অপরাধ প্রবণতা দূর হবে না, এ জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পরকাল সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে সবচেয়ে বেশী আলোচনা করেছেন। মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের আলোচনা এতটাই অধিক যে, তা একত্রিত করলে ত্রিশপারা কোরআনের প্রায় দশপারার সমান হবে। একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে কোরআনে যে আলোচনা করা হয়েছে, তার সারমর্ম হলো, মানুষের ব্যক্তিগত আচার আচরণ এবং মানব গোষ্ঠীসমূহের সামাজিক ও সামগ্রিক আচরণ কোনক্রমেই নির্ভুল ও সঠিক হতে পারে না, যতক্ষণ না মানুষের যাবতীয় কাজকর্মের চূড়ান্ত হিসাব আল্লাহর কাছে পেশ করতে হবে-এই চেতনা ও দৃঢ় বিশ্বাস মানবীয় চরিত্রের গভীর বুনিয়াদে সম্পৃক্ত ও সংযোজিত হবে।

        অনেকে প্রশ্ন করে থাকেন যে, আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস এবং বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি না থাকার পরেও অনেক মানুষ এমন রয়েছে যে, তারা অত্যন্ত সৎ এবং নীতিবান। পরকালে অবিশ্বাসী অনেক লোকের নীতিদর্শন ও কর্মবিধি সম্পূর্ণরূপে বস্তুবাদ ও নাস্তিকতা ভিত্তিক হওয়ার পরেও তারা বহুলাংশে পবিত্র চরিত্রের অধিকারী হয়ে থাকে। জুলুম, বিপর্যয়, অন্যায়, পাপ ইত্যাদি ধরনের কাজ থেকে তারা দূরে অবস্থান করে। তাদের পারস্পরিক লেন-দেন অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন হয় এবং তারা প্রকৃত দেশ প্রেমিক হিসাবে জাতির একনিষ্ঠ সেবক হয়ে থাকে। এটা কিভাবে সম্ভব হয়?

        এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, গোটা বস্তুবাদী ও ধর্মহীন নীতি দর্শন ও চিন্তা চেতনা-পদ্ধতি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলে দেখা যাবে যে, এসব সৎ স্বভাব সম্পন্ন নাস্তিক লোকদের যেসব নৈতিক সৌন্দর্য ও সৎকাজের জন্য তাদেরকে চরিত্রবান বলা হয়, প্রকৃত পক্ষে তার ভিত্তি নির্মিত হয় দেশ-জাতি ও বস্তুবাদী আদর্শকে কেন্দ্র করে। এসব ধর্মহীন দার্শনিক চিন্তা-বিশ্বাসে ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, বিশ্বাসপরায়ণতা, অঙ্গীকারপূরণ,ইনসাফ-সুবিচার, দয়া-অনুগ্রহ, বদান্যতা, উদারতা, ত্যাগ-তীতিক্ষা, সহানুভূতি, আত্মসংযম, পবিত্রতা, সত্যকে জানা, অধিকার আদায় ইত্যাদি সৎ কাজের মূলেও সংকীর্ণ জাতিয়তাবাদ আর নাস্তিক্যবাদী আদর্শ ক্রিয়াশীল। জাতিয়তাবাদ আর দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে উল্লেখিত সৎ গুণাবলী আংশিকভাবে অর্জন করা যেতে পারে শুধুমাত্র দেশ ও জাতির স্বার্থে। আবার দেশ ও জাতির স্বার্থেই তা যে কোন মুহূর্তে পরিহারও করা যেতে পারে। এদের কাছে চিরন্তন মূল্যবোধ বলে কিছুই নেই। এ ধরনের লোকগুলোর খোদা হয় চারটি। নিজের নক্স, দেশ, জাতি এবং নিজেদের তৈরী করা বিধান। এই চার খোদায় বিশ্বাসী লোকগুলো ক্ষেত্র বিশেষে আংশিকভাবে সৎ গুণাবলী অর্জন করলেও তা যেমন ঐ চার খোদার প্রয়োজনে করে, আবার পরিহার করলেও তা ঐ চার খোদার প্রয়োজনেই পরিহার করে।

        এক নম্বর খোদা নক্স-এর নির্দেশে এরা যে কোন মুহূর্তে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বা কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য নীতি আদর্শ বিবর্জিত গর্হিত কর্মে জড়িয়ে পড়তে পারে। দুই নম্বর খোদা দেশ-এই দেশের স্বার্থে এরা যে কোন নিন্দনীয় নীতি গ্রহণ করতে পারে। তিন নম্বর খোদা জাতি-জাতির স্বার্থে এরা অন্য জাতি বা দেশের ক্ষতি করতে সামান্য দ্বিধাবোধ করে না। চার নম্বর খোদা হলো দেশের প্রচলিত আইন-কানুন-যা তাদের নিজেদেরই রচনা করা। যখনই এই আইন তাদের মন-মর্জির বিপরীত নির্দেশ দান করবে, তখনই তারা তা সংশোধন করে নিজেদের স্বার্থের অনকূল করে নেবে।

        মানুষ কামনা-বাসনা, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে নয়। কারো কাছে জবাবদিহির অনুভূতি যখন হৃদয়ে থাকে না, তখন সে অবৈধ কামনা-বাসনা ও লোভ-লালসা চরিতার্থ করার জন্য অন্য মানুষের অলক্ষ্যে এগিয়ে যাবে। নিজ দেশের ও জাতির স্বার্থে সে যে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দ্বিধা বা লজ্জাবোধ করবে না। দেশ ও জাতির স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যদি অন্য দেশ দখল করতে হয়, অন্য জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার প্রয়োজন হয়, বিশ্ব বিবেকের শত প্রতিবাদ উপেক্ষা করে তারা তা করবেই।

        এরবড় প্রমাণ ভারত, রাশিয়া, ইসরাঈল, ইউরোপ, আমেরিকা ও বৃটেন। কাশ্মিরে ভারত পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন করেছে। প্রতিদিন তারা সেখানে মুসলমানদের রক্ত নিয়ে হোলি খেলছে। কাশ্মিরীদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তারা বুলেট আর বুটের নিচে পিষ্ট করছে। রাশিয়া আফগানিস্থানে আগ্রাসন চালিয়ে অগণিত আবাল বৃদ্ধ বণিতাদের নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। আমেরিকা ভিয়েতনামে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে। বিশ্বমোড়ল আমেরিকার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোড়া ইসরাঈল ফিলিস্তীনের আবাল বৃদ্ধ বণিতাদেরকে পাখির মতোই গুলী করে হত্যা করছে।

        বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় ইউরোপীয় হায়েনা আর আমেরিকা-বৃটেনের প্রত্যক্ষ সগযোগিতায় লোমহর্ষক গণহত্যা চালানো হয়েছে। ইরাকের সাথে বর্বর আচরণ করা হচ্ছে। আলজিরিয়া আর আলবেনিয়ায় গণহত্যা চালানো হচ্ছে। এসব অমানবিক কর্মকান্ডের সাথে যারা জড়িত এবং প্রত্যক্ষভাবে যারা সহযোগিতা করছে, তারা সবাই মানবাধিকারের প্রবক্তা। ব্যক্তি হিসাবে এদের সবার চরিত্রে কিছু না কিছু সৎ গুণাবলী অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু দেশ ও জাতির স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে এরা লজ্জা, ঘৃণা, নিয়ম-নীতি, মানবতা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, বিশ্বাসপরায়ণতা, অঙ্গীকারপূরণ, ইনসাফ-সুবিচার, দয়া-অনুগ্রহ, বদান্যতা, উদারতা, ত্যাগ-তীতিক্ষা, সহানুভূতি, আত্মসংযম, পবিত্রতা ইত্যাদি সৎগুণাবলীর পোষাক দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। বিশ্ব বিবেক এদের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে বার বার প্রতিবাদ করছে, কোন প্রতিবাদই তারা গ্রাহ্য করছে না। বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতিহীন মানবগোষ্ঠীর কাছ থেকে এরচেয়ে ভিন্ন কোন আচরণ আশা করা যায় না।

        বিচার দিবসে জবাবদিহির অনুভূতি সম্পন্ন মুসলিম সৈন্যবাহিনী কোন অমুসলিম দেশ জয় করলে সে দেশের অমুসলিম জনগণের সাথে তাঁরা এমন আচরণ করেছেন যে, বিজিত দেশের জনগণ তাঁদের স্বজাতীয় শাসকের কাছ থেকে এতটা ভালো আচরণ লাভ করেনি। একমাত্র মুসলমানরা ব্যতিত অন্য সমস্ত জাতি যে সাম্প্রদায়িক দুষ্টক্ষতে আক্রান্ত তার প্রমাণ অতীতেও যেমন তারা দিয়েছে-বর্তমানেও তারা সাম্প্রদায়িক কাপালিকদের মতো আচরণ করছে। আসমুদ্র হিমাচল রাম রাজত্ব প্রতিষ্ঠার স্বপ্নাভিলাষী ভারতের বর্ণহিন্দুরা ভিন্ন জাতি ও তাদের ধর্মীয় স্থানসমূহ সহ্য করতে পারে না।

        পাশ্চাত্যের সামাজ্যবাদী অশুভ খৃষ্টশক্তি ইউরোপের বুকে মুসলিম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব কল্পনাও করতে নারাজ। হার্জেগোভিনা-বসনিয়া-চেচনিয়া থেকে মুসলমানদের শেষ চিহ্ন মুছে দেয়ার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। মসজিদগুলো অস্ত্রের আঘাতে ধূলোর সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। ইসলাম বিদ্বেষী অমুসলিম শক্তিসমূহ বর্তমান পৃথিবীতে নিজেদেরকে সবচেয়ে সভ্য বলে দাবী করে থাকে। গোটা বিশ্বব্যাপী মানবাধিকারের শ্লোগানে তারা উচ্চকণ্ঠ। পক্ষান্তরে অতীত ইতিহাস এবং তাদের বর্তমান কর্মকান্ড এ কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে, ইহুদী-খৃষ্ট অপশক্তি ও তাদের দোসর জড়বাদী বর্ণহিন্দুরা পৃথিবীতে মানবাধিকার সবচেয়ে বেশী লংঘন করেছে এবং করছে।

        ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের সাথে বর্ণ হিন্দুদের আচরণ, মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদীদের নির্মম অত্যাচার ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ নীতি, হর্জেগোভিনা-বসনিয়া-চেচনিয়া-কাশ্মির ও ইরাকে খৃষ্টশক্তি কর্তৃক পোড়ামাটি নীতি অবলম্বন, এ সমস্ত ঘটনাই প্রমাণ করে যে, অমুসলিমরাই সাম্প্রদায়িক কাপালিকের ভূমিকায় শাণিত কৃপাণ হস্তে বিশ্বব্যাপী মুসলিম নিধনযজ্ঞে অবতীর্ণ হয়েছে।

        ১০৯৯ সনে খৃষ্টশক্তি জেরুজালেম দখল করে ৭০ হাজার মুসলিম নারী-পুরুষ-শিশুদের একটি প্রাণীকেও জীবিত রাখেনি। মুসলমানদের দেহ থেকে মস্তক বিচ্ছিন্ন করে বর্শার অগ্রভাগে গেঁথে উল্লাস প্রকাশ করেছে। ঘোড়ার পিঠে আরোহণ করে তারা যখন শহরে প্রবেশ করেছে, তখন তাদের ঘোড়ার পা মুসলমানদের রক্তে ডুবে গিয়েছে। কবরস্থান থেকে মুসলমানদের হাড়গোড় তুলে অপমানিত করেছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে গোটা জেরুজালেম নগরী খৃষ্টানদের পৈশাচিকতায় মুসলিম শূন্য হয়ে যায়।

        পক্ষান্তরে পুনরায় ১১৭৮ সনে-মাত্র ৮৮ বছর পরে মুসলমানেরা যখন জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করে, তখন একজন অমুসলিমেরও কোন ক্ষতি মুসলমানরা করেনি। মুসলিম হত্যাযজ্ঞের মহানায়ক নরঘাতক রিচার্ড-যে রিচার্ড হাজার হাজার মুসলিম নারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুষক-তরুণকে লোমহর্ষক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছিল, যার সম্পর্কে তারই জ্ঞাতি ভাই ঐতিহাসিক "লেনপুল" তার বর্বর হত্যাকান্ড সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, "নিষ্ঠুর কাপুরুষোচিত" বলে। এই খৃষ্টান নরপশু রিচার্ডকে ঐতিহাসিক "গিবন" চিহ্নিত করেছেন, "শোণিত পিপাসু" হিসেবে। আর ঐতিহাসিক কক্সবার্টের ভাষায় রিচার্ড হলো, "মানব জাতির নির্মম চাবুক"। যুদ্ধের ময়দানে এই নরঘাতকের অস্ত্র যখন ভেঙ্গে গিয়েছিল, মানবতার বন্ধু সালাহ্ উদ্দিন আইয়ুবী তখন তাকে হত্যা না করে অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছিলেন।

        নরপশু রিচার্ড অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, তার খৃষ্টান সাথীরা তাকে ত্যাগ করে চলে যাচ্ছিল। তখন মুসলিম বীর সালাহ্ উদ্দিন গোপনে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন। ইতিহাসের প্রতিটি বাঁকে এবং বর্তমানে মুসলমানরা এভাবে মানবতা প্রদর্শন করেছে-করছে, আর সেই নির্মল নিষ্কলুষ মানবতাকে নিষ্ঠুর পায়ে বার বার পদদলিত করেছে অমুসলিম শক্তি। পরকালে জবাবদিহির অনুভূতি যাদের ভেতরে নেই তাদের চরিত্র আর ঐ অনুভূতি যাদের ভেতরে রয়েছে, তাদের চরিত্রে শতযোজন পার্থক্য বিরাজিত, পৃথিবীর জাতিসমূহের ইতিহাসই তা প্রমাণ করে দিয়েছে। আল্লাহ এবং পরকালের ব্যাপারে যারা কোন গুরুত্ব দেয় না, তাদের অবস্থা সম্পর্কে সূরা ইউনুসের ৭-৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-

إِنَّ الَّذِينَ لَا يَرْجُونَ لِقَاءَ نَا وَرَضُوا بِالْحَيْةِ الدُّنْيَا وَاطْمَانُوا بِهَا وَ الَّذِينَ هُمْ أَيْتِنَا غَافِلُونَ - أُولَئِكَ مَأوَا هُمُ النَّارُ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

        প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, যারা আমার সাথে (বিচার দিবসে) মিলিত হবার কোন আশা পোষণ করে না এবং পৃথিবীর জীবন নিয়েই সন্তুষ্ট ও নিশ্চিন্ত থাকে, আমার নিদর্শনগুলোর প্রতি উদাসীন থাকে, তাদের শেষ আবাসস্থল হবে জাহান্নাম, ঐসব কৃতকার্যের বিনিময়ে যা তারা (তাদের ভ্রান্ত মতবাদ ও ভ্রান্ত কর্ম পদ্ধতি অনুসরণ করতে গিয়ে) করেছে।

        বিচার দিবসের অনুভূতি মানুষের চরিত্রকে কলুষিত হওয়া থেকে বর্মের মতোই পরিবেষ্টন করে রাখে। পৃথিবীর ইতিহাসে যতগুলো ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে, যত দেশে গণহত্যা চলেছে-এক কথায় যত অপরাধ সংঘটিত হয়েছে এবং হচ্ছে, তা সবই বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহির অনুভূতি না থাকার কারণেই সংঘটিত হয়েছে, এ কথা অভিজ্ঞতা বার বার প্রমাণ করে দিয়েছে।

Post a Comment

0 Comments