মাহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনএ গোটা বিশ্বজগতের স্রষ্টা। এই বিশ্বে বা এর বাইরেও যা কিছু রয়েছে, সেসব কিছুরই একমাত্র মালিক তিনি। আখিরাতের ময়দানেরও মহান মালিক তিনিই। পরকালে কার ব্যাপারে তিনি কি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন-সে ক্ষমতা শুধু তারই। আল্লাহ বলেন-
الْمُلْكُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ - يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ
সেদিন (কিয়ামতের দিন) একচ্ছত্র ক্ষমতা শুধু মহান আল্লাহর। তিনিই মানুষের ভবিষ্যত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। (সূরা হজ্ব-৫৬)
অর্থাৎ হাশরের ময়দানে শতশত কোটি মানুষের বিচার কার্য পরিচালনার জন্যে, সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্যে, কারো কোন সাহায্য বা কারো কোন পরামর্শের প্রয়োজন আল্লাহর নেই। তিনি নিজেই স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং সর্বজ্ঞ। প্রতিটি মানুষের প্রকাশ্য ও গোপন কর্মকান্ড সম্পর্কে তিনি অবগত আছেন তদুপরি ন্যায় ও ইনছাফ প্রদর্শনের জন্য মানুষের প্রতিটি প্রকাশ্য ও গোপন কর্ম পুংখানুপুংখরূপে তাঁর নিষ্পাপ ফেরেশতাগণ সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ করে আমলনামায় রেকর্ড বানিয়ে রেখেছেন।
এ আমলনামা ফেরেস্তাগণ লেখেন। তাদের কোন ভুল হয় না। ভুল-ভ্রান্তি ও পাপ করার প্রবণতা তাদের মধ্যে নেই। কিন্তু তাই বলে মহান আল্লাহ ফেরেশতা কর্তৃক লিখিত আমলনামার উপরে নির্ভরশীল নন।
কারণ ফেরেশতাগণ অদৃশ্যে কি ঘটছে, মানুষ কি চিন্তা করে, ইশারা ইঙ্গিতে পরস্পরে কি বলে, এসব তারা জানতে পারেন না। মানুষ ভবিষ্যতে কি করবে, সে সম্পর্কে ফেরেশতাদের জ্ঞান নেই। কিন্তু আল্লাহর নিকট বর্তমান, ভবিষ্যত ও অতীত বলে কিছু নেই। মানুষ ভবিষ্যতে কি করবে তার বর্তমানরূপ তার সামনে উপস্থিত থাকে।
সুতরাং, ফেরেস্তাদের লিখিত আমলনামা ছাড়াই তিনি তার সঠিক জ্ঞান দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে সক্ষম। কিন্তু ন্যায় ও ইনছাফের দৃষ্টিতে এবং মানুষের বিশ্বাসের জন্যে আমলনামা লেখার ব্যবস্থা তিনি করেছেন। অন্য আল্লাহর উপর প্রভাব বিস্তার করবে, সুপারিশ করে আল্লাহর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারবে এ ধরনের বিশ্বাস যারা মনে স্থান দেবে তারা আর যা-ই হোক অবশ্যই মুসলমান নয়। সুতরাং বিচারের দিনে কোন পীর, ওলী, মাওলানার পরামর্শ বা সুপারিশ গ্রহণ করার কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। মহান আল্লাহ বলেন-
مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لا بَيْعٌ فِيْهِ وَلَا خُلَّةٌ وَ لأَشَفَاعَةٌ
সেদিন (হাশরের দিন) আসার পূর্বে-যেদিন না লেন-দেন হবে, না বন্ধুত্ব উপকারে আসবে, আর না চলবে কোন সুপারিশ। (সূরা বাক্কারাহ্-২৫৪)
সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
কে এমন আছে যে তাঁর (আল্লাহর) অনুমতি ব্যতিত তাঁর দরবারে সুপারিশ করতে পারে?
কিন্তু পৃথিবীতে কিছু সংখ্যক মানুষের ধারণা এবং বিশ্বাস যে, এমন কিছু পীর, মাওলানা, ওলী আছেন যাঁরা হাশরের ময়াদানে তাদের জন্যে আল্লাহর দরবারে সুপারিশ করবে। আল্লাহ তায়ালা তাদের সুপারিশ অনুযায়ী তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতে পাঠাবেন। যারা বিশ্বাস করে অমুক 'বাবা' অমুক 'পীর' অমুক 'ওলী' কিয়ামতের ময়দানে আমাদের জন্য সুপারিশ করবে, তারা আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করার চেয়ে তথাকথিত 'সুপারিশ কারীদের' কাছে বেশী ধর্না দেয়। কারণ তারা মনে করে ওই ব্যক্তি আল্লাহর খুব কাছের, আল্লাহর অত্যন্ত প্রিয় ব্যক্তি, আল্লাহর উপর ওই ব্যক্তির সাংঘাতিক প্রভাব। এই ধরণের বিশ্বাসে বিশ্বাসী হয়ে এক শ্রেণীর মানুষ নিজের কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে পৃথিবীর ভোগ-বিলাস থেকে দূরে সরে আল্লাহর আইন মেনে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার পরিবর্তে-ওই সমস্ত মানুষকে সন্তুষ্ট করার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে, যাদেরকে তারা সুপারিশকারী হিসেবে বিশ্বাস করে। তাদের সন্তুষ্টির জন্যে নযর নিয়াষ দান করা, তাদের নামে গরু, খাসী, মুরগী, নগদ টাকা মানত করা, তাদের কবরে ফুল, মিষ্টি, গোলাপ পানি, মোমবাতি, আগরবাতি, কবরে শায়িত ব্যক্তির নামে ওরশ করা-নিজেরা এগুলো অতি উৎসাহের সাথে করে এবং অপরকেও করতে উঃসাহ দান করে। তাদের বিশ্বাস এসব করলে তিনি হাশরের মাঠে তার জন্য সুপারিশ করবেন।
আল্লাহর দেয়া বিধান ইসলাম সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান ও দৃঢ় বিশ্বাসের অভাবেই এক শ্রেণীর মানুষ ওই ধরণের ভুল করে থাকে। কিছু মানুষের ধারণা মৃত্যুর পরে যদি সত্যই কোন জীবন থেকেই থাকে, তাহলে সে জীবনে সহজে মুক্তি পাবার উপায় কি? এ প্রশ্ন যখন তাদের মনে জাগে তখন শয়তান এসে কুমন্ত্রণা দেয়, 'অমুক মাজারে গিয়ে সেজদা দিয়ে তাকে সন্তুষ্ট করো। তিনি পরকালে তোমার জন্যে সুপারিশ বা শাফায়াত করবেন।'
শয়তানের কুমন্ত্রণা অনুযায়ী তারা দল বেঁধে আল্লাহর ওলীদের মাজারে গিয়ে এমন ভক্তি শ্রদ্ধা ও আবেদন নিবেদন জানায়, যে আবেদন নিবেদন জানানো উচিত ছিল মহান আল্লাহর দরবারে। ওই হতভাগা মানুষগুলো একথা বুঝতে চায় না, তাদের আবেদন-নিবেদন কবরের ওই মানুষটি শুনতে পারছে না। শুধু তাই নয় কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহ যখন তার ওলীদের জানিয়ে দেবেন, 'তোমাদের মাযারকে কেন্দ্র করে ওই মানুষগুলো এই এই কাজ করেছে।' তখন ওলীগণ ওই হতভাগাদের আচরণের কারণে চরম অসন্তুষ্ট হবেন। আল্লাহকে বাদ দিয়ে যারা জীবিত অথবা মৃত মানুষকে নিজের প্রভু বানিয়ে নেয় অথবা তাদেরকে আল্লাহর শরীক বানায় তাদের জন্যে অভিশাপ ছাড়া কোন বুজুর্গ-ওলীর পক্ষ থেকে দোয়া বা সুপারিশের আশা করা সম্পূর্ণ অসম্ভব।
বর্তমান পৃথিবীতে কিছু মানুষ তাদের দরবারে যাতায়াত করে তাদের মধ্যে ওই শ্রেণীর মানুষের সংখ্যাই বেশী-সমাজে যারা অসৎ হিসেবে চিহ্নিত। এই অসৎ দুষ্কৃতিকারী মানুষগুলো প্রকৃত ইসলামের অনুসারী না হয়ে ছুটে যায় এক শ্রেণীর পীরদের দরবারে বা মাজারে। তাদের বিশ্বাস পরকালে তার পীর সাহেব আল্লাহর দরবারে তাদের জন্যে সুপারিশ করে তাদের নাজাতের ব্যবস্থা করে দেবেন। এ আশায় তারা তাদের পীর সাহেবকে নানা ধরণের মূল্যবান উপহার দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করে। একথা অবশ্যই সত্য যে, কিয়ামতের ময়দানে মহান আল্লাহ অনুগ্রহ করে যে সমস্ত ব্যক্তিগণকে শাফায়াত বা সুপারিশ করার অনুমতি দিবেন-তারা অবশ্যই ও সমস্ত মানুষ, পৃথিবীতে জীবিত থাকতে যারা নবী এবং তার সাহাবাগণের ন্যায় জীবন-যাপন করেছেন-এরা আল্লাহর ওয়াদা অনুসারে জান্নাতি হবেন। পক্ষান্তরে কিয়ামতের দিন যে ব্যক্তির নিজেরই মুক্তির কোন আশা নেই, সেই ব্যক্তি আরেকজনের জন্যে সুপরিশ করার সৌভাগ্য লাভ করবে কি করে? সত্যিকারের যারা পীর, যারা ওলী তাদের জীবন-যাপনের ধরণ আল্লাহর রাসূল এবং তাঁর সাহাবাগণের ন্যায়। তারা সর্বদা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ইসলাম বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন। সত্যিকারের পীর-ওলী জেল-জুলুম পরোয়া করেন না। কোন দৃষ্কৃতিকারী, সূদখোর, ঘুষখোর, কালোবাজারি, জ্বেনাকার মদ্যপ পীর-ওলীদের বন্ধু হতে পারে না। কিয়ামতের দিন দুষ্কৃতিকারী অসৎ লোকদের কোন বন্ধুও থাকবে না, কোন সুপারিশকারীও থাকবে না। মহান আল্লাহ বলেন-
مَا لِلظَّلِمِينَ مِنْ حَمِيمٍ وَلَا شَفِيعٍ يُطَاعُ
অন্যায় আচরণকারীদের জন্যে (হাশরের দিন) কোন অন্তরঙ্গ বন্ধুও থাকবে না এবং থাকবেনা কোন সুপারিশকারী যার কথা শুনা যাবে। (সূরা মুমিন-১৮)
বর্তমানে কিছু সংখ্যক নামধারী তথাকথিত পীর-ওলীদের দরবারে ওই সমস্ত দুষ্কৃতিকারীদের দেখা যায়-যারা প্রচুর কালোটাকার মালিক। এই তথাকথিত পীরগণ ওই দুষ্কৃতিকারীগণের চরিত্র সংশোধনের চেষ্টা না করে তাদের কাছ থেকে শুধু নয়রানাই গ্রহণ করে। এদের নিজেদের নাজাত তো মিলবেইনা বরং দুষ্কৃতিকারীদের প্রশ্রয় দেয়ার কারণে পরকালে শাস্তিরযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। এই ধরণের ভন্ড অর্থলোভী পীর, মাওলানাদের সম্পর্কে সূরা বাকারার ১৬৬-১৬৭ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
إِذْ تَبَرَّأَ الَّذِينَ اتَّبِعُوا مِنَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا وَرَأَوُا الْعَذَابَ وَتَقَطَّعَتْ بِهِمُ الْأَسْبَابُ - وَقَالَ الَّذِينَ اتَّبَعُوا لَوْ أَنَّ لَنَا كَرَّةً فَنَتَبَرَّ أَمِنْهُمْ كَمَا تَبَرَّءُوا مِنَّا - كَذَالِكَ يُرِيهِمُ اللَّهُ أَعْمَالَهُمْ حَسَرَاتٍ عَلَيْهِمْ وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ -
(কিয়ামতের দিন) ওই সব ব্যক্তি পৃথিবীতে যাদেরকে অনুসরণ করা হতো, (তারা) তাদের অনুসারীদের সাথে কোন সম্পর্ক নেই বলে ঘোষণা করবে কিন্তু তারা অবশ্যই শাস্তি পাবে এবং তাদের মধ্যকার সব ধরণের সম্পর্ক ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। পৃথিবীতে যারা এসব ব্যক্তিদের অনুসরণ করেছিল তারা বলবে হায়রে, যদি পৃথিবীতে আমাদেরকে একটিবার সুযোগ দেয়া হতো, তাহলে আজ যেভাবে এরা আমাদের প্রতি তাদের অসন্তোষ ও বিরক্তি প্রকাশ করছে, আমরাও তাদের প্রতি আমাদের বিরক্তি দেখিয়ে দিতাম। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে তাদের কৃত কর্মকান্ড এভাবে উপস্থিত করবেন যে, তারা দুঃখ ও অনুশোচনায় কাতর হয়ে পড়বে। কিন্তু জাহান্নামের আগুন থেকে তারা বের হবার পথ পাবে না।
পূর্ববর্তী উম্মতের ধর্মীয় নেতাগণ অর্থ উপার্জনের লোভে মানুষকে ধর্মের নামে আল্লাহ-রাসূলের পথ থেকে বহু দূরে নিয়ে যেত। তারা নিজেদের মুরীদদেরকে সত্যিকারের মুক্তির পথ না দেখিয়ে মুরীদদের কাছ থেকে নয়র-নেয়াজ গ্রহণ করে নিজেদের মনগড়া পথে পরিচালিত করতো। সূরা তওবায় এ ধরনের পীর, দরবেশ আলেমদের সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
إِنَّ كَثِيرًا مِّنَ الْأَحْبَارِ وَالرُّهْبَانِ لَيَأْكُلُونَ أَمْوَالَ النَّاسِ بِالْبَاطِلِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللَّهِ -
(আহলে কিতাবদের) অধিকাংশ আলেম, পীর, দরবেশ-অবৈধ উপায়ে মানুষের অর্থ-সম্পদ ভক্ষণ করে এবং তাদেরকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখে। (সূরা তওবা-৩৪)
এসব অর্থলোভী পথভ্রষ্ট পীর, আলেম নামধারী যালেমগণ তাদের ধর্মীয় সিংহাসনে বসে ফতোয়া বিক্রি করে। তারা সত্যিকারের দ্বিনদার, পহেজগার আলেম, ওলামা, পীর, মাশায়েখদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দেয়। এদেরই কারণে সত্যিকারের পীরগণ সমাজে মর্যাদা পায় না। কিয়ামতের ময়দানে সুপারিশ বা শাফায়াত সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দূর করে কোরআন ও হাদীস প্রকৃত ঘটনা মানুষের সামনে পেশ করেছে। সেদিন সবচেয়ে বড় সুপারিশকারী হবেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব, মানুষের মুক্তির দিশারী, নবী সম্রাট, আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি জনাবে মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকেও কিছু নেক মানুষ অন্যের জন্য সুপারিশ করার অনুমতি লাভ করবে। এই সুপারিশ হবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। যারা সুপারিশ করার অনুমতি লাভ করবে-তারা হলো ওই সমস্ত ব্যক্তি, যারা পৃথিবীতে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টির জন্যে চরম কষ্ট, দুঃখ, যন্ত্রণা, সহ্য করেও ইসলামের আদেশ-নিষেধ পালনে সদাসর্বদা তৎপর ছিলেন। তারা আল্লাহর নিকট কোন অন্যায় আবদার করবেন না। কোন দুষ্কৃতিকারীর জন্যে তারা সুপরিশ করবেন না। সুপারিশ তাদের জন্যেই করবেন-পৃথিবীতে যারা ইসলামের আদেশ-নিষেধ পালন করে চলেছে বটে কিন্তু সামান্য ভুল ভ্রান্তিও করেছেন। তবুও শাফায়াতের পুরো ব্যাপারটা মহান আল্লাহর মর্জি মোতাবেক হবে। আল্লাহ বলেন-
قُلْ لِلَّهِ الشَّفَاعَةُ جَمِيعًا -
(হে রাসূল) বলে দিন, শাফায়াতের সমগ্র ব্যাপারটি আল্লাহর নিয়ন্ত্রণে। (সূরা যুমার-৪৪) মহান আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কেউ কারো জন্য শাফায়াত করতে পারবে না। আল্লাহ বলেন-
مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ
তাঁর অনুমতি ব্যতিত কে তাঁর নিকট শাফায়াত করবে? (সূরা বাক্কারাহ-২৫৫)
যে ব্যক্তির প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে আল্লাহ অন্য কাউকে শাফায়াত করার অনুমতি প্রদান করবেন, সে ছাড়া অন্য কোন ব্যক্তি নিজ ইচ্ছে মতো শাফায়াত করা দূরে থাক-আল্লাহর সামনে মুখ খুলতেই পারবে না। সূরা আম্বিয়ার ২৮ নং আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন-
وَلَا يَشْفَعُونَ الأَ لِمَنِ ارْتَضى
যাদের উপর আল্লাহ খুশী হয়েছেন তারা ব্যতিত আর কারো জন্যে শাফায়াত করা যাবে না। সুপারিশকারী যা সুপারিশ করবে তা হবে সকল বিচারে সত্য ও ন্যায় সঙ্গত। কোরআন বলছে-
لا يَتَكَلَّمُونَ إِلا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا -
করুণাময় আল্লাহ রব্বুল আলামীন যাদেরকে অনুমতি দিবেন তারা ব্যতিত আর কেউ কোন কথা বলতে পারবেনা এবং তারা যা কিছু বলবে তা ঠিক ঠিক বলবে। (সূরা নাবা-৩৮)
যারা সুপারিশ করার অনুমতি লাভ করবে তারা নির্দিষ্ট শর্ত অর্থাৎ সত্য ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটা সীমারেখার ভেতরে সুপারিশ করবে। আর এই সুপারিশের ধরণ সাধারণ কোন সুপারিশের মতো হবে না। আল্লাহর নিকট সুপারিশের ধরনও হবে ইবাদত ও বন্দেগীর ন্যায়। মানুষ আল্লাহর কাছে যে পদ্ধতিতে নিজের পাপের ক্ষমা চায় অর্থাৎ কান্নাকাটি, অনুনয়-বিনয় এবং অত্যন্ত দীনহীন ভঙ্গিতে-তেমনি ভঙ্গিতে শাফায়াতকারী শাফায়াত করবে। তবে শাফায়াতের এই ধরণ আল্লাহর রাসূলের জন্য প্রজোয্য নয়। কারণ তার মর্যাদা আল্লাহর নিকট সবেচেয়ে বেশী। তিনি কি ভঙ্গীতে আল্লাহর দরবারে উম্মতের জন্য শাফায়াত করবেন সেটা আল্লাহ ও তাঁর প্রিয় বন্ধু বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মধ্যেকার ব্যাপার। যিনি সুপারিশ করবেন তার মনে কখনো এ ধারণা জন্মাবেনা যে, তাঁর সুপারিশের কারণে আল্লাহ তার নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। পরম মেহেরবান আল্লাহর অনুগ্রহসূচক অনুমতি পাবার পরে সুপারিশকারী অত্যন্ত দীনতা, হীনতা ও বিনয় সহকারে অনুনয় করে বলবে, 'হে দুনিয়া ও আখিয়াতের মহান মালিক আল্লাহ! তুমি তোমার অমুক বান্দাহর গুনাহ ও ভুল ত্রুটি-বিচুতি ক্ষমা করে দাও। তাকে তোমার অনুগ্রহ ও রহমত দান করে ধন্য করো।'
সুতরাং সুপারিশ করার অনুমতিদানকারী যেমন আল্লাহ তেমনি তা কবুলকারীও আল্লাহ। মহান আল্লাহ বলেন-
لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيُّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
তিনি (আল্লাহ) ব্যতিত তাদের জন্যে না আর কেউ ওলী বা অভিভাবক আছে, আর না কেউ শাফায়াতকারী। (সূরা আনয়াম-৫১)
শাফায়াতকারী তারাই হবেন যারা আল্লাহর অতি প্রিয়। আর যাদের জন্যে শাফায়াত করা হবে তাদের পাপের অবস্থা এই যে, পাপ ও নেকীর ক্ষেত্রে তাদের পাপ সামান্য বেশী। অর্থাৎ ক্ষমা পেয়েও যেন ক্ষমা না পাওয়ার অবস্থা, ক্ষমার যোগ্যতা লাভে সামান্য অভাব। এই অভাবটুকু পুরণের জন্যেই মহান মালিক আল্লাহর রাব্বুল আলামীন অনুগ্রহ করে তাদের জন্যে শাফায়াত করার অনুমতি দান করবেন। সুতরাং একথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, কারো ইচ্ছে অনুযায়ী কেউ কারো পক্ষে সুপারিশ করতে পারবে না। যাদের জন্য সুপারিশ করা হবে তাদের প্রতি আল্লাহ সন্তুষ্ট হয়ে ক্ষমা করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই কাউকে সুপারিশ করার অনুমতি প্রদান করবেন। এখানে একটা প্রশ্ন জাগে, সুপারিশ করার অনুমতিদান করবেন আল্লাহ, আবার তা কবুলও করবেন তিনি। তাহলে সুপারিশকারী নিয়োগ করার যুক্তিটা কী? এর জবাব অত্যন্ত স্পষ্ট। কিয়ামতের ময়দানে সেই মুসিবতের দিনে, যে মুসবিতের মহাবিভিষীকা দেখে সাধারণ মানুষের অবস্থা যে কি হবে তা কল্পনারও বাইরে-স্বয়ং কোন কোন নবীগণও ভয়ে কাঁপতে থাকবেন এবং আল্লাহর সামনে কোন কথা বলার সাহস পাবেন না। সেই অবস্থায় আল্লাহ তার কিছু প্রিয় বান্দাহদেরকে শাফায়াত করার অনুমতি প্রদান করে তাদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করবেন। এই মর্যাদার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ স্থান পাবার অধিকারী হবেন বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
তবে এ কথাও সত্য-মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে চললেই যে, সে কিয়ামতের ময়দানে জান্নাত পাবে এ ধারণা করা উচিত নয়। বরং মনের আকাংখা এটাই হওয়া উচিত, 'জান্নাতের লোভনেই জাহান্নামেরও ভয় নেই-চাই শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি।' সুতরাং, আল্লাহর রহমত ছাড়া মুক্তি পাওয়া যাবে না। সূরা নাবা-এর ৩৮ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
يَوْمَ يَقُومُ الرُّوحُ وَالْمَلْئِكَةُ صَفًّا - لا يَتَكَلَّمُونَ إِلَّا مَنْ أَذِنَ لَهُ الرَّحْمَنُ وَقَالَ صَوَابًا -
সেদিন সকল আত্মা ও ফেরেশতাগণ কাতার বন্দী হয়ে দাঁড়াবে কেউ কোন কথা বলবেনা সে ব্যতীত, যাকে পরম করুণাময় অনুমতি দিবেন। এবং যথাযথ ও সঠিক কথা সে বলবে।
0 Comments