হাশরের ময়দানে সবেচেয়ে নিঃস্ব ব্যক্তি কারা হবে ?

        পৃথিবীতে একজন মানুষ তার নিজস্ব জ্ঞানবুদ্ধি ও কর্মশক্তি নিয়ে জীবন পথে চলা শুরু করে। পৃথিবীতে একটু স্বচ্ছলতা, একটু শান্তি, সুন্দরভাবে বসবাসের জন্যে তার চেষ্টা সাধনার অন্ত থাকে না। প্রতিটি মানুষই জীবনের পথে সফলতা অর্জন করতে চায়। মানুষের প্রতিদিনের এই যে চেষ্টা সাধনা, এত শ্রমদান এর পরিণামেই হয় জয়-পরাজয়ের নির্ধারণ-অর্থাৎ এত কিছু করে কে সফল হলো আর কে হলো ব্যর্থ। পৃথিবীতে সফলতা ও ব্যর্থতার সংজ্ঞা সমস্ত মানুষের কাছে এক রকম নয়। এর কারণ হলো সমন্ত মানুষের আদর্শ এক রকম না। মানুষ বিভিন্ন আদর্শে বিশ্বাসী, সেহেতু তাদের কাছে সফলতা ও ব্যর্থতার ধরণও আলাদা। কোন মানুষ হয়তঃ চরম অন্যায় পথ অবলম্বন করে অসৎভাবে তার উদ্দেশ্য হাছিল করলো, অনেকে তার সম্পর্কে মন্তব্য করলো মানুষটি তার সাধনায় সফল হয়েছে।

        এই সফলতা অর্জন করতে গিয়ে যদি অন্যায় অবিচার, চরম দুর্নীতি, অসত্য, হীন ও জঘণ্য পন্থা অনুসরণ করতে হয়, তবুও তাকে মনে করা হয় সাফল্য। জোর করে শক্তি দিয়ে অন্যায়ভাবে অপরের ধন-সম্পদ হস্তগত করে, মিথ্যা মামলায় জড়িত করে এবং মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমানাদীর দ্বারা কাউকে সর্বশান্ত করে কেউ হচ্ছে বিজয়ী, কোটি কোটি টাকার মালিক, হরেক রকমের গাড়ি-বাড়ির মালিক হয়ে স্ত্রী-সান্তনাদিসহ পরম সুখে বিলাস বহুল জীবন-যাপন করে, অনেকের দৃষ্টিতে এটা সফলতা। মানুষ বলে লোকটা সফল।

        অসৎ পথ ধরে অগাধ ধন-সম্পদের মালিক হয়ে কেউ বা সমাজে তার আধিপত্য বিস্তার কতে সক্ষম হয়। সে চায় সবাই তার কাছে নত হয়ে থাক। তার বিরুদ্ধে সামান্য টু-শব্দও সে সহ্য করতে পারে না, স্বার্থবাদী চাটুকারের দল দিনরাত তার জয় গান গেয়ে বেড়ায়। তার দাপটে কেউ সত্য কথা বলতে পারে না। যারা সত্য পথে চলে সত্য কথা বলে তারা ওই ব্যক্তি কর্তৃক নির্যাতিত হয়। ক্ষমতার দাপটে দিশেহারা হয়ে সে সবার উপরে খোদায়ী করতে চায়। অনেকের মতে এটাও সফলতা।

        অপরদিকে কোন ব্যক্তি সত্যকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে সৎভাবে জীবন-যাপন করে। দুর্নীতি, সুদ, ঘুষ, কালোবজারী, মিথ্যা প্রতারণা, প্রবঞ্চনা সে করে না, ফলে সমাজে সে ক্ষমতাবান অর্থশালীও হতে পারে না। অন্যয়ের বিরুদ্ধে সে কথা বলে, সমাজ থেকে দেশ থেকে সে সবধরনের অন্যায় উৎখাত করে সত্য প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ফলে সমাজ বা দেশের ক্ষমতাবান অসৎ মানুষগুলো তার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। পরিণামে সে অত্যাচারিত হয়। তার সকল আত্মীয়-স্বজন তাকে ত্যাগ করে। সমাজ তাকে অবহেলা করে। অনেকে ওই সৎমানুষটি সম্পর্কে মন্তব্য করে, মানুষটা দারুণ বোকা, তা না হলে এভাবে সত্য কথা বলতে গিয় এমন অত্যাচার সহ্য করে নাকি? অযথা নিজের জীবনটা ব্যর্থ করে দিল! এই ধরণের সফলতা ও ব্যর্থতা বর্তমান পৃথিবীতে চারদিকেই দেখা যাচ্ছে।

        কিন্তু সত্যিকারের সফলতা ও ব্যর্থতা, জয়-পরাজয় নির্ধারণ হবে কিয়ামতের পরে হাশরের ময়দানে আল্লাহর আদালতে। বোখারী শরীফে হযরত আবু হোরায়রা রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু কর্তৃক বর্ণনাকৃত একটি হাদীসে পাওয়া যায়। যারা বেহেশতে যাবে তাদের সবাইকে জাহান্নামের একটি অংশ দেখিয়ে জানানো হবে-ওই অংশটা তোমার ভাগে পড়তো, যদি তুমি পাপী হতে। ফলে বেহেশতবাসীগন আল্লাহর প্রতি আরো বেশী কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবে। আবার জাহান্নামবাসীদের জান্নাতের একটি অংশ দেখিয়ে জানানো হবে-জান্নাতের ওই অংশটা তোমার নছিবে জুটতো, যদি তুমি পৃথিবীতে ইসলামী বিধান মেনে চলতে। ফলে জাহান্নামবাসীদের অনুতাপ-অনুশোচনা আরো বেশী বৃদ্ধি পাবে।

        পৃথিবীতে যারা ক্ষমতাবান জালিম ব্যক্তির দ্বারা যতটুকু অত্যাচারীত হবে, কিয়ামতের ময়দানে ওই জালিমের যদি নেক কাজ থেকে থাকে, তা দিয়ে দেয়া হবে তাদেরকে, যাদের সাথে সে অন্যায় করেছে। যদি নেক কাজ না থাকে তাহলে যে ব্যক্তির সাথে সে অন্যায় করেছে। যদি নেক কাজ না থাকে তাহলে যে ব্যক্তির সাথে সে অন্যায় করেছে, ওই ব্যক্তির গোনাহ্ থাকলে তা চাপানো হবে জালিমের ঘাড়ে। যে পরিমাণ জুলুম করবে, সেই পরিমান নেক কাজ দিয়ে দিতে হবে বা গোনাহ্ নিজের কাঁধে নিতে হবে। কারণ সেদিন তো মানুষের কাছে কোন ধন-সম্পদ থাকবে না। সুতরাং তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে সে যার যার সাথে জুলুম করেছে, তাকে তাকে নেক দিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।

        এভাবে নেক কাজ দিতে দিতে যখন আর দেয়ার মতো নেক কাজ থাকবে না, তখন ওই সমস্ত মানুষের গোনাহ তাকে নিতে হবে যাদের উপরে সে জুলুম করেছে। অবশ্য যার সাথে যে পরিমান অন্যায় করা হবে, ঠিক সেই পরিমানই সে প্রতিপক্ষের নেকি লাভ করবে। অথবা জালিমের আমল নামায় কোন নেকি না থাকলে মজলুমের ততো পরিমাণ গোনাহ্ জালিমের ঘাড়ে চাপানো হবে। বোখারী শরীফে অন্য একটি হাদীসে আছে হযরত আবু হোরায়রাহ্ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেন, কোন মানুষ যদি অন্য মানুষের সাথে অন্যায় করে থাকে তাহলে তার উচিত এই পৃথিবীতেই তা মিটিয়ে ফেলা। কারণ আখেরাতে কারো কাছে কোন দেয়ার মতো সম্পদ থাকবে না। নেকী ও গোনাহ ছাড়া। অতএব সেদিন তার নেকীর কিছু অংশ সেই ব্যক্তিকে দিয়ে দিতে হবে। অথবা তার কাছে যথেষ্ট নেকী না থাকলে মজলুমের ততো পরিমান গোনাহের অংশ তাকে দেয়া হবে।

        মুসনাদে আহমদে জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন উনায়েস রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বলেছেন  বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কোন জান্নাতী জান্নাতে জাহান্নামী জাহান্নমে প্রবেশ করতে পারবে না-যতক্ষণ সে যার যার সাথে অন্যায় করেছে তাদের দাবী না মিটানো পর্যন্ত। এমনকি সে যদি কাউকে অন্যায়ভাবে একটি চড় দিয়ে থাকে, তার বিনিময় তাকে অবশ্যই মিটিয়ে দিতে হবে। সাহাবাগণ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে জানতে চাইলেন, 'ইয়া রাসূলুল্লাহ, সেদিন তো আমরা কপর্দকহীন থাকবো, বিনিময় দেবো কি দিয়ে?' আল্লাহর রাসুল বললেন, 'নেকী-গোনাহের দ্বারা বিনিময় দিতে হবে।' মুসলিম শরীফে এবং মুসনাদে আহমদে হযরত আবু হোরায়রাহ্ রাদিয়াল্লাহু তা'য়ালা আনহু বর্ণনা করেন, একদিন আল্লাহর রাসুল সমবেত সাহাবাদেরকে প্রশ্ন করলেন, 'তোমরা কি জানো, সব চেয়ে নিঃস্ব কোন ব্যক্তি? সাহাবাগণ বললেন, 'যে কপর্দকহীন এবং যার কোন সম্পদ নেই, সেই তো সবচেয়ে নিঃস্ব।'

        তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, "আমার উম্মতের মধ্যে ওই ব্যক্তি সব চেয়ে নিঃস্ব যে ব্যক্তি নামজ, রোজা, হজ্জ্ব, যাকাত ও অন্যান্য নেকির পাহাড় সাথে নিয়ে কিয়ামতের ময়দানে হাজির হবে। সে ব্যক্তি তার চারদিকে শুধু নেকীই দেখতে পাবে। ব্যক্তিটির চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল থাকবে। তারপর একের পর এক লোক এসে দাবী জানাবে, সে অন্যায়ভাবে আমাকে মেরেছিল, কেউ দাবী করবে সে আমার সম্পদ কেড়ে নিয়েছিল, কেউ দাবী করবে ওই ব্যক্তি ষড়যন্ত্র করে আমাকে হত্যা করিয়েছিল, কেউ বলবে সে আমাকে গালি দিয়েছিল, কেউ দাবী করবে সে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যে অপবাদ দিত, কেউ দাবী করবে আমার পাওনা টাকা সে দেয়নি।

        তখন সমস্ত পাওনাদারের দাবী মিটানো হবে ওই ব্যক্তির নেকী দ্বারা। লোকটির নেকী শেষ হয়ে যাবে কিন্তু পাওনাদার শেষ হবে না। তখন অবশিষ্ট পাওনাদারের গোনাহ তার উপরে চাপানো হবে। নেকীর পাহাড় সাথে নিয়ে কিয়ামতে উঠেও গোনাহের পাহাড় কাঁধে নিয়ে তাকে জাহান্নামে যেতে হবে। এই ব্যক্তিই সবেচেয়ে নিঃস্ব ব্যক্তি।

Post a Comment

0 Comments