কিয়ামতের ময়দানে ঐলোকগুলোর মুখমন্ডল ধূলিমলিন হবে, পৃথিবীতে যারা ইসলামী আন্দোলনের সাথে বিরোধিতা করেছিল এবং আল্লাহর বিধান অনুসরণে অবহেলার পরিচয় দিয়েছে। এই পৃথিবীতে শত কোটি মানুষ। কেউ কালো কেউ ফর্সা। কেউ মোটা কেউ পাতলা। কেউ সুন্দর কেউ অসুন্দর কুৎসিত। কারো চেহারা এতই সৌন্দর্য মন্ডিত যে, একবার দেখে সাধ মিটে না, বার বার দেখতে ইচ্ছে করে। আবার কারো চেহারা এতই কুৎসিত যে, প্রথম দৃষ্টিতেই মনে বিতৃষ্ণা চলে আসে।
কিন্তু কতক কুৎসিত মানুষের মন, আমল-আখলাক এতই সুন্দর যে, মহান আল্লাহ তাদের উপর রাজী-খুশী থাকেন। আবার কতক সুন্দর চেহারার মানুষ আছে, যাদের মন-মানসিকতা, স্বভাব-চরিত্র এতই জঘন্য যে, খোদ শয়তানও তাদের ক্রিয়াকর্ম দেখলে দূরে সরে যায়। এই পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে কঠিন মানুষকে চেনা। সুন্দর মিষ্টি ভদ্র চেহারার আড়ালে জঘন্য মন লুকিয়ে থাকে। ভদ্রতার মুখোশ পরে ভদ্র-সৎ মানুষদের সাথে এই পাপীরা মেশে। পৃথিবীতে এদের চেহারা দেখে অনুমান করা যায় না এরা কত জঘন্য অপরাধী। কিন্তু কিয়ামতের দিন! সেদিন ওই পাপীদের চেহারা এমন হবে যে, ওদের চেহারার দিকে তাকালেই স্পষ্ট চেনা যাবে এরা পাপী। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীনবলেন-
وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُسْفَرَةٌ ضَاحِكَةٌ مُسْتَبْشِرَةٌ وَجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ أُولَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ :
এবং সেদিন কতিপয় মুখমন্ডল ধূলিমলিন হবে। কালিমা লিপ্ত অন্ধকার লিপ্ত অন্ধকার সমাচ্ছন্ন হবে। এরাই হলো অবিশ্বাসী ও পাপী লোক। (সূরা আবাসা-৪০-৪২)
যারা আসামী-অপরাধী তাদের চেহারা-ই বলে দেবে সেদিন তারা পাপী। কোরআন বলছে-
يُعْرَفُ الْمُجْرِمُونَ بِسِيْمَهُمْ فَيُؤْخَذُ بِالنَّوَاصِي وَالْأَقْدَامِ
অপরাধীগণ সেখানে নিজ নিজ চেহারা দিয়েই পরিচিত হবে এবং তাদেরকে কপালের চুল ও পা ধরে চ্যাংদোলা করে (জাহান্নামের দিকে) নিয়ে যাওয়া হবে। (সূরা আর-রহমান-৪১)
সূরা ইবরাহীমে বলা হয়েছে-
وَتَرَى الْمُجْرِمِينَ يَوْمَئِذٍ مُقَرَّنِينَ فِي الْأَصْفَادِ سَرَابِيلُهُمْ مِّنْ قطرانِ وَتَغْشَى وُجُوهَهُمُ النَّارُ
সেদিন তুমি অপরাধীদেরকে দেখবে, শিকল দ্বারা শক্ত করে হাত-পা বাঁধা রয়েছে এবং গায়ে গন্ধকের পোষাক পরানো হয়েছে। আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ তাদের মুখমন্ডল আচ্ছন্ন করে রেখেছে। (সূরা ইবরাহীম-৪৯-৫০)
গন্ধক আগুনের স্পর্শ পেলে যে কিভাবে জ্বলে ওঠে তা সবাই জানে। সেদিন পাপীদের শরীরে গন্ধকের পোষাক পরিয়ে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। জাহান্নামের ভয়ঙ্কর আগুন তাদের হাড় পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু কখনো মৃত্যু হবে না। আযাবের পরে কঠিন আযাবই শুধু ভোগ করবে। মানুষ পৃথিবীতে সামান্য দু'দিনের জীবন সুন্দর করার জন্য কত রকমের সাধনা-চেষ্টা করে। সন্তান যখন দু'আড়াই বছর বয়সে কথা বলতে শেখে তখন থেকেই তাকে লেখা-পড়া শিক্ষা দেয়। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ডিগ্রী অর্জন করার পরেও তাকে আরো উচ্চ শিক্ষা অর্জনের জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে বিদেশে পাঠায়।
এ সবই করা হয় পৃথিবীতে সুন্দরভাবে জীবন-যাপনের জন্য। কিন্তু এই দুনিয়ার জীবন অত্যন্ত স্বল্প সময়ের। স্বল্প সময়ের এই জীবনকে সুন্দর করার জন্য এত চেষ্টা-সাধনা। অথচ পরকালের অনন্তকালের জীবন সুন্দর করার জন্য কোন প্রচেষ্টা নেই। বড় বড় ডিগ্রী অর্জন করে শিক্ষিত হিসেবে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু নিজের ঘরে কোরআন শরীফ, সেটা একবার খুলেও দেখছে না এর ভেতর কি আছে। ইসলাম সম্পর্কে যারা জ্ঞান অর্জন না করে শুধু অন্যান্য বিষয়েই বিরাট বিরাট পন্ডিত, বুদ্ধিজীবী সেজেছে, তাদেরকে আল্লাহ অন্ধ বলেছেন। কারণ এদের চোখ থাকতেও এরা কোরআন হাদিস, ইসলামী সাহিত্য অধ্যয়নের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করে সেই অনুযায়ী কাজ করেনি। সত্য পথ এই সব জ্ঞানপাপী, পন্ডিত, বুদ্ধিজীবীগণ দেখার চেষ্টা করেনি। আল্লাহ বলেন-
وَمَنْ كَانَ فِي هَذِهِ أَعْمَى فَهُوَ فِي الْآخِرَةِ أَعْمَى وَأَضَلُّ سَبِيلاً -
আর যারা পৃথিবীতে (সত্য দেখার ব্যাপারে) অন্ধ হয়ে থাকবে, তারা আখেরাতেও অন্ধ হয়েই থাকবে। বরং পথ লাভ করার ব্যাপারে তারা অন্ধদের চেয়েও ব্যর্থকাম। (বনী-ইসরাইল-৭২) পৃথিবীতে কত দৃষ্টিবান মানুষ এই চোখ দিয়ে নানা ধরনের পুস্তক পড়ে, গবেষণা করে, পর্যবেক্ষণ করে বিরাট বিরাট পন্ডিত হচ্ছে। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে অন্ধই থেকে যাচ্ছে। আবার কত দৃষ্টিহীন অন্ধ মানুষ, যারা অপরের সাহায্যে ইসলামী জ্ঞান অর্জন করে ইসলামের বিধান মেনে চলছেন। জ্ঞানপাপীদের লক্ষ্য করেই আল্লাহ বলেছেন এরা প্রকৃত অন্ধদের চেয়েও অন্ধ ব্যর্থকাম। মহান আল্লাহ বলেন-
ونَحْشُرُهُمْ يَوْمَ القِيمَةِ عَلَى وُجُوهِهِمْ عُمْيًا وَبُكْمًا وَصُمَّا مَاؤُهُمْ جَهَنَّمُ
আমি তাদেরকে কিয়ামতের দিন অন্ধ, বোবা ও কালা (বধির) করে উল্টো করে টেনে নিয়ে আসবো। এদের শেষ পরিণতি জাহান্নাম। (সূরা বনী-ইসরাইল-৯৭)
এই সমস্ত জ্ঞান পাপী মুর্খ পন্ডিতগণ যারা ইসলামী জ্ঞান অর্জনও করেনি মেনেও চলেনি বা বিশ্বাসও করেনি। এরা যখন কিয়ামতের ময়দানে অন্ধ হয়ে উঠবে তখন এরা কি বলবে সে সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন-
وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيمَةِ أَعْمَى - قَالَ رَبِّ لِمَ حَشَرْ تَنِي أَعْمَى وَقَدْ كُنْتُ بَصِيرًا -
কিয়ামতের দিন আমি তাকে অন্ধ করে উঠাবো তখন সে বলবে, হে রব! পৃথিবীতে তো আমি দৃষ্টিমান ছিলাম কিন্তু এখানে কেন আমাকে অন্ধ করে উঠালে? (সূরা ত্বা-হা-১২৪-১২৫)
পৃথিবীতে যারা জীবিত থাকতে নিজের খেয়াল খুশী মতো চলেছে, তারা কিয়ামতের ময়দানে ভয়াবহ অবস্থা স্বচোক্ষে দেখে অনুশোচনা-অনুতাপ করবে। আফসোছ করে বলবে কেন আমি এই পরকালের জীবনের জন্যে কিছু অর্জন করে পাঠাইনি! কিন্তু মৃত্যুর পরে তো কোন অনুতাপ আফসোছ কাজে আসবে না। কোরআন শরীফে আল্লাহ জানিয়ে দিয়েছেন ওই পাপীদেরকে আফসোছ করতে দেখে তিনি বলবেন, 'কেন, পৃথিবীতে তো আমি তোমাদেরকে যথেষ্ট হায়াত দিয়েছিলাম, তখন তো আজকের এই অবস্থাকে তোমরা অবিশ্বাস করেছো।' সূরা ফজর-এর ২৩-২৪ নং আয়াতে বলা হয়েছে-
وَجَائَ يَوْمَئِذٍ بِجَهَنَّمَ - يَوْمَئِذٍ يُتَذَكَّرُ الْإِنْسَانُ وَأَنَّى لَهُ الذكرى - يَقُولُ يُلَيْتَنِي قَدَّمْتُ لِحَيَانِي
আর জাহান্নামকে সেদিন সবার সামনে হাজির করা হবে। তখন মানুষের বিশ্বাস জন্মাবে। কিন্তু তখন তার বিশ্বাস অবিশ্বাসের তো কোন মূল্য থাকবে না। আফসোস করে তখন সে বলতে থাকবে, হায়! আমি যদি এই জীবনের জন্যে অগ্রিম কিছু পাঠাতাম!
পৃথিবীতে মানুষ যা করছে, তা সবই কিয়ামতের দিন সে নিজ চোখে দেখতে পাবে। আল্লাহর সৃষ্টি এই মানুষ আল্লাহর দেয়া জ্ঞান দিয়েই কত কিছু আবিষ্কার করেছেন এবং করছে। মানুষে কণ্ঠস্বর, ছবি, ক্রিয়াকান্ড, হাসি, কান্না শত শত বছর ফিতার মাধ্যমে ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছে। তেমনিভাবে মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন মানুষের সকল কর্মকান্ড, কথা ধরে রাখার ব্যবস্থা করেছেন। মানুষের নিজের আমলসমূহ কিয়ামতের দিন পেশ করা হবে। সূরা নাবা-এর ৪০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন-
يَوْمَ يَنْظُرُ الْمَرْءُ مَا قَدَّمَتْ يَدُهُ وَيَقُولُ الْكُفْرُ بِلَيْتَنِي كُنْتُ بُرَابًا -
সেদিন মানুষ সবকিছু প্রত্যক্ষ করবে যা তাদের হস্তসমূহ অগ্রিম পাঠিয়েছে। তখন প্রতিটি অবিশ্বাসী কাফের চিৎকার করে বলবে, "হায়! আমি যদি (আজ) মাটি হয়ে যেতাম।
0 Comments