রোযার তাৎপর্য কি ?

        প্রকাশ থাকে যে, রোযা ঈমানের এক-চতুর্থাংশ। কারণ, এক হাদীসে রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন : الصوم نصف الصبر )রোযা সবরের অর্ধেক) এবং অন্য এক হাদীসে বলেন: الصبر نصف الایمان )সবর ঈমানের অর্ধেক)। এ থেকে জানা গেল, রোযা ঈমানের অর্ধেকের অর্ধেক অর্থাৎ এক-চতুর্থাংশ। রোযা আল্লাহ্ তাআলার সাথে সম্পর্কযুক্ত বিধায় ইসলামের সকল রোকনের মধ্যে এটা সেরা রোকন। সেমতে আল্লাহ তাআলার উক্তি রসূলে করীম (সাঃ) এক হাদীসে কুদসীতে বর্ণনা করেছেন। উক্তিটি এই সকল সৎ কাজের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ' গুণ পর্যন্ত হবে; কিন্তু রোযা একান্তভাবে আমার জন্যে বিধায় আমিই এর প্রতিদান দেব। আল্লাহ বলেন:

إِنَّمَا يُوفَّى الصيرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ . 

        অর্থাৎ, সবরকারীদেরকে বেহিসাব সওয়াব দান করা হবে।

        রোযা সবরের অর্ধেক। তাই এর সওয়াব হিসাব-কিতাবের আওতা বহির্ভূত হবে। শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্যে রসূলে করীম (সাঃ)-এর এ উক্তিই যথেষ্ট, তিনি এরশাদ করেন:

والذي نفسي بيده لخلوف فم الصائم اطيب عند الله من ريح المسك يقول الله عز وجل بذر شهوته وطعامه وشرابه لاجلى فالصوم لي وانا اجزى به .

        আল্লাহর কসম, যার হাতে আমার প্রাণ- নিশ্চয় রোযাদারের মুখের গন্ধ আল্লাহ তাআলার কাছে মেশকের চেয়েও উত্তম। আল্লাহ বলেন, রোযাদার তার কামনা-বাসনা ও পানাহার একমাত্র আমার জন্যে পরিত্যাগ করে। অতএব রোযা আমার জন্যে এবং আমিই এর প্রতিদান দেব। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আরও বলেন:

للجنة باب يقال له الريان لا يدخله الا الصائمون وهو موعود بلقاء الله تعالى هي جزاء صومه .

        জান্নাতের একটি দ্বারকে বলা হয় 'বাবুর রাইয়ান'। এতে রোযাদারগণ ছাড়া অন্য কেউ প্রবেশ করবে না। রোযাদারকে তার রোযার বিনিময়ে আল্লাহর দীদারের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে: 

للصائم فرحتان فرحة عند الافطار وفرحة عند لقاء ربه .

        রোযাদারের দুটি আনন্দ। এক আনন্দ ইফতারের সময় এবং এক আনন্দ তার পালনকর্তার দীদার লাভ করার সময়।

        এক হাদীসে আছে- প্রত্যেক বস্তুর একটি দরজা আছে। এবাদতের দরজা হল রোযা। আরও বলা হয়েছে: রোযাদারের নিদ্রা এবাদত। হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ)-এর রেওয়ায়েতে রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেনঃ যখন রমযান মাস শুরু হয়, তখন জান্নাতের দরজা উন্মুক্ত হয় এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। শয়তানকে শিকল পরানো হয়। জনৈক ঘোষণাকারী ঘোষণা করে- যারা কল্যাণ কামনা কর, তারা এগিয়ে আস এবং যারা অনিষ্ট কামনা কর তারা সরে যাও। কোরআনের এক আয়াতে বলা হয়েছে- তোমরা অতীত দিনগুলোতে যা পাঠিয়েছ, তার বিনিময়ে আজ জান্নাতে স্বচ্ছন্দে পানাহার কর। এর তফসীর প্রসঙ্গে ওকী বলেন, এখানে অতীত দিন বলে রোযার দিন বুঝানো হয়েছে। কেননা, রোযার দিনে তারা পানাহার ত্যাগ করেছিল। রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সংসার ত্যাগ ও রোযাকে গর্বের বিষয়সমূহের মধ্যে এক কাতারে রেখেছেন। সংসার ত্যাগ সম্পর্কে তিনি বলেন: আল্লাহ তাআলা যুবক এবাদতকারীকে নিয়ে ফেরেশতাদের কাছে গর্ব করেন এবং বলেন, হে আমার জন্যে আপন বাসনা বর্জনকারী যুবক, হে আমার সন্তুষ্টিতে যৌবন অতিবাহিতকারী যুবক! তুমি আমার কাছে ফেরেশতার মতই। পক্ষান্তরে রসূলুল্লাহ (সাঃ) রোযাদার সম্পর্কে বলেন: আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের উদ্দেশে বলেন,. ফেরেশতাগণ! আমার বান্দাকে দেখ, সে আমার কারণে তার কামনা-বাসনা ও পানাহার ত্যাগ করেছে।

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَا أُخْفِى لَهُمْ مِّنْ قَرَةِ أَعْيُنِ جَزَاء بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ .

        অর্থাৎ, কেউ জানে না তাদের আমলের প্রতিদানস্বরূপ তাদের জন্যে কি লুক্কায়িত রয়েছে, যা তাদের চক্ষুকে শীতল করবে।

        কোরআনের এ আয়াতের তফসীর প্রসঙ্গে কোন কোন তফসীরকার বলেন, এখানে আমল বলে রোযা বুঝানো হয়েছে। কেননা, সবরকরীদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:

إِنَّمَا يُوفَّى الصيرُونَ أَجْرَهُمْ بِغَيْرِ حِسَابٍ .

        অর্থাৎ, সবরকারীকে বেহিসাব পুরস্কার দেয়া হবে।

        এ থেকে জানা যায়, সবরকারীর জন্যে অগণিত সওয়াবের স্তূপ সাজানো হবে, যা অনুমানও করা যায় না। এরূপ হওয়াই সমীচীন। কেননা, রোযা আল্লাহ তাআলার জন্যে এবং তাঁর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার কারণে গৌরবোজ্জ্বল। সকল এবাদতই আল্লাহর জন্যে। তবুও রোযা কাবা গৃহের ন্যায় প্রাধান্য রাখে, যদিও সমস্ত ভূপৃষ্ঠই আল্লাহর। রোযার এই প্রাধান্য দুটি কারণে- (১) রোযা রাখার অর্থ কয়েকটি বিষয় থেকে বিরত থাকা এবং কয়েকটি বিষয় বর্জন করা। এটি আভ্যন্তরীণ কাজ। এতে এমন কোন আমল নেই, যা চোখে দেখা যায়। অন্যান্য এবাদত মানুষের দৃষ্টিতে থাকে। কিন্তু রোযা আল্লাহ ব্যতীত কেউ দেখে না। (২) রোযা আল্লাহ তাআলার শত্রুর উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং প্রবল হয়। কেননা, কামনা-বাসনা হচ্ছে শয়তানের ওসিলা বা হাতিয়ার, যা পানাহারের মাধ্যমে শক্তিশালী হয়। এ কারণেই রসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন: শয়তান মানুষের ধমনী (রক্ত চলার পথে) বিচরণ করে। সুতরাং ক্ষুধা তৃষ্ণা দ্বারা তার পথসমূহ সংকীর্ণ করে দাও। এদিকে লক্ষ্য করে রসূলে পাক (সাঃ) হযরত আয়েশা (রাঃ)-কে বলেছিলেন: সর্বদা জন্নাতের দরজা খটখটাও আরজ করা হল: কিসের মাধ্যমে? তিনি বললেন: ক্ষুধার মাধ্যমে। যেহেতু রোযা বিশেষভাবে শয়তানের মূলোৎপাটন করে, তার চলার পথ রুদ্ধ এবং সংকীর্ণ করে, তাই রোযা বিশেষভাবে আল্লাহর সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়ার যোগ্য হয়েছে। কেননা, শয়তানের মূলোৎপাটনে আল্লাহ সাহায্য করেন। বান্দাকে সাহায্য করা নির্ভর করে বান্দার পক্ষ থেকে আল্লাহকে সাহায্য করার উপর। সে মতে আল্লাহ বলেন:

إِنْ تَنْصُرُوا اللهَ يَنْصُرْكُمْ وَيُثَبِّتْ أَقْدَامَكُمْ .

        অর্থাৎ, যদি তোমরা আল্লাহকে সাহায্য কর, তবে আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পদযুগল সুদৃঢ় রাখবেন।

        মোট কথা, চেষ্টা শুরু করা বান্দার পক্ষ থেকে এবং বিনিময়ে হেদায়েত তথা সৎপথ প্রদর্শন আল্লাহর পক্ষ থেকে হবে। যেমন- আল্লাহ  বলেন وَالَّذِينَ جَاهَدُوا فِينَا لَنَهْدِيَنَّهُمْ سُبُلَنَا :  আমার পথে অধ্যবসায় করে, আমি অবশ্যই তাদেরকে আমার পথ প্রদর্শন করি। আরও বলেন : م حَتَّى يُغيروا إِنَّ اللَّهَ لَا يُغَيِّرُ مَا بِقَوم : مَا بِأَنْفُسِهِمْ অর্থাৎ, আল্লাহ কোন জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ তারা নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন না করে। পরিবর্তনের জন্যে কামনা-বাসনাকে চূর্ণ বিচূর্ণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। কেননা, কামনা বাসনা শয়তানের বিচরণ ক্ষেত্র। যে পর্যন্ত এই বিচরণ ক্ষেত্র সবুজ শ্যামল থাকবে, শয়তানের বিচরণ বন্ধ হবে না। বিচরণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর প্রতাপ বান্দার কাছে প্রকাশ পাবে না এবং দীদারের পথে পর্দা পড়ে থাকবে। রসূলে আকরাম (সাঃ) বলেন: যদি মানুষের অন্তরে শয়তানের যাতায়াত না থাকত, তবে মানুষ ঊর্ধ্বজগত নিরীক্ষণ করতে সক্ষম হত। এদিক দিয়ে রোযা এবাদতসমূহর দরজা ও ঢাল।

Post a Comment

0 Comments