বিচার দিবসে মানুষকে এককভাবে জবাবদিহি করবে

        বিচার দিবসে প্রত্যেক ব্যক্তিকে আল্লাহর আদালতে জবাবদিহি করতে হবে। পৃথিবীতে মানুষের কত আপনজন থাকে, শুভাকাংখী থাকে, অসংখ্য পরিচিতজন ও বন্ধু থাকে। একজন বিপদাপন্ন হলে আরেকজন তাকে সাহায্য করতে দৌড়ে আসে। আদালতে তার বিরুদ্ধে মামলা হলে যামিন নিতে গেলে বা হাজিরা দিতে গেলে তার সাথে কেউ না কেউ যায়। কিন্তু আল্লাহর আদালতে সে কাউকে সঙ্গী হিসাবে পাবে না। প্রত্যেক ব্যক্তিকে একাকী জবাবদিহি করতে হবে। তার কৃতকর্মের সাফাই আরেকজন গাইবে, এমনটি সেখানে হবে না। আল্লাহ বলেন-

وَلَقَدْ جِئْتُمُونَا فُرَادَى كَمَا خَلَقْتُكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَتَرَكْتُمْ مَّا خولنكُمْ وَرَاءَ ظُهُورِكُمْ وَمَا نَرَى مَعَكُمْ شُفَعَاءَ كُمُ الَّذِينَزَعَمْتُمْ أَنَّهُمْ فِيكُمْ شُرَكوا - لَقَدْ تَقَطَّعَ بَيْنَكُمْ وَضَلَّ عَنْكُمْ مَا كُنْتُمْ تَزْعُمُونَ

        (বিচার দিবসের দিন আদালতে আল্লাহ বলবেন) নাও, এখন তোমরা ঠিক তেমনিভাবে একাকীই আমার সামনে উপস্থিত হয়েছো, যেমন আমি তোমাদেরকে প্রথমবার একাকী সৃষ্টি করেছিলাম। তোমাদেরকে আমি পৃথিবীতে যা কিছু দান করেছিলাম, তা সবই তোমরা পিছনে রেখে এসেছো। এখন আমি তোমাদের সাথে সেসব পরামর্শ দাতাগণকেও তো দেখি না, যাদের সম্পর্কে তোমরা ধারণা করেছিলে যে, তোমাদের কার্যোদ্ধারের ব্যাপারে তাদেরও অংশ রয়েছে। তোমাদের পারস্পরিক সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছে এবং তোমরা যা কিছু ধারণা করতে, তা সবই আজ তোমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। (সূরা আল আন'আম-৯৪)

        পৃথিবীতে মানুষ অসংখ্য সঙ্গী-সাথী জুটিয়ে নেয়। বৈধ-অবৈধ পথে সে সম্পদের পাহাড় রচিত করে তবুও সম্পদ আহরোণের নেশা যায় না। এসব ত্যাগ করে যেতে হবে, সেদিন এসব কোনই কাজে আসবে না। যারা সৎকাজ করেছে অর্থাৎ আল্লাহর বিধান অনুসারে পৃথিবীতে জীবন পরিচালনা করেছে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে একমাত্র আল্লাহকেই রব্ব হিসাবে অনুসরণ করেছে, কেবলমাত্র তাদেরই সঙ্গী হবে তাদের কৃত সৎকাজসমূহ। কোন বিপদ দেখা দিলে বা কোন কামনা-বাসনা পূরণের আশায় মানুষ পীর-দরবেশ-মাজার-ফকিরের কাছে ধর্ণা দিয়ে মনে করতো, এরা তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারে, তার মনের কামনা পূরণ করতে পারে, তাকে ধনবান বানিয়ে দিতে সক্ষম, বিচার দিবসে সুপারিশ করতে সক্ষম, সেদিন তারা কেউ কোন সাহায্য করতে পারবে না।

        আল্লাহর বিধান থেকে দূরে সরিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে যেসব নেতা-নেত্রীরা মানুষকে ভাতের অধিকার, ভোটের অধিকার, অর্থনৈতিক মুক্তির অধিকারের লোভ দেখিয়ে পরামর্শ দিতো যে, তাদেরকে সহযোগিতা করা হোক, যারা এসব প্রতারণামূলক কথাবার্তায় আকৃষ্ট হয়ে ঐসব নেতা-নেত্রীদের পেছনে ছুটেছে, তাদেরকে যখন আল্লাহর আদালতে উপস্থিত করা হবে, তখন আল্লাহ প্রশ্ন করবেন-তোমাদেরকে যারা পরামর্শ দিতো, তাদেরকে তো আজ দেখা যাচ্ছে না। তারা সবাই আজ সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।

        মানুষ হিসাবে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত পর্যায়ে আল্লাহর সামনে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। এ ব্যক্তিগত দায়িত্বের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি তার সাথে অংশীদার নেই। পৃথিবীতে যতই অধিক সংখ্যক ব্যক্তিবর্গ, বিপুল সংখ্যক জাতি, দল ও গোষ্ঠী বা বিপুল সংখ্যক সংগঠন একটি কাজে বা একটি কর্মপদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করুক না কেন, বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে তাদের এ সমন্বিত কার্যক্রম বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত দায়িত্ব পৃথকভাবে চিহ্নিত করা হবে এবং তার যা কিছু শাস্তি বা পুরস্কার সে লাভ করবে তা হবে তার সেই কর্মের প্রতিদান-যা করার জন্য সে নিজে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দায়ী বলে প্রমাণিত হবে। এ ইনসাফের মানদন্ডে অপরের গর্হিত কর্মের বোঝা একজনের ওপর এবং তার গোনাহের বোঝা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কোনই সম্ভাবনা থাকবে না। সুতরাং মানুষের জন্য জ্ঞান-বিবেক ও বুদ্ধির পরিচয় হলো এটাই যে, আরেকজন কি করছে সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে নিজের কর্ম কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তার দিকে দৃষ্টি দেয়া। যদি তার মধ্যে নিজের ব্যক্তিগত দায়িত্বের সঠিক অনুভূতি থাকে, তাহলে অন্যেরা যাই করুকনা কেন, সে নিজের সাফল্যের সাথে আল্লাহর সামনে যে কর্মধারার জবাবদিহি করতে পারবে তার ওপরই অটলভাবে দন্ডায়মান থাকা। মহান আল্লাহ বলেন-

مَنِ اهْتَدَى فَإِنَّمَا يَهْتَدِى لِنَفْسِهِ وَمَنْ ضَلَّ فَإِنَّمَا يَضِلُّ عَلَيْهَا وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُخْرَى

        যে ব্যক্তি সৎপথ অবলম্বন করে, তার সৎপথ অবলম্বন তার নিজের জন্যই কল্যাণকর হয়। আর যে ব্যক্তি পথভ্রষ্ট হয়, তার পথভ্রষ্টতার ধ্বংসকারিতা তার ওপরেই বর্তায়। কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না। (সূরা বনী ইসরাঈল-১৫)

        ময়দানে ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এমন কিছু সংখ্যক লোক রয়েছে, যারা মনে করে-'আমরা ইসলামী আন্দোলনের দাওয়াত কবুল করে ইসলামের দল ভারী করলাম। কারণ সমাজে আমাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি রয়েছে, লোকজন আমাদেরকে গুরুত্ব দেয়, সম্মান করে, মর্যাদা দেয়।' এদের মনোভাব এ ধরনের যে, তারা ইসলামী আন্দোলনে শামিল হয়ে যেন ইসলামের প্রতি করুণা করেছে। এরা আন্দোলনে শামিল না হলে, ইসলাম কোনদিনই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে না। এ ধরনের চিন্তা-চেতনা নিয়ে যারা ইসলামী আন্দোলনে শামিল হয়, তাদের অনুধাবন করা উচিত-কেউ আল্লাহর রবুবিয়াত কবুল করে ইসলামী আন্দোলনে শামিল হলে, এতে তার নিজেরই কল্যাণ হবে। অন্য কেউ তার কল্যাণে অংশ নিতে পারবে না। সে সৎপথ লাভ করলো, এ জন্য আল্লাহর দরবারে বার বার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কেননা আদালতে আখিরাতে তার ব্যাপারে তাকে একাই জবাবদিহি করতে হবে, অন্য কেউ তার অবস্থা পরিবর্তন করে দিতে পারবে না। আল্লাহ বলেন-

مَا لَكُمْ مِّنْ مَلْجَا يَوْمَئِذٍ وَمَا لَكُمْ مِّنْ نَّكِيْرٍ

        সেদিন তোমাদের জন্য কোন আশ্রয়স্থল থাকবে না এবং তোমাদের অবস্থা পরিবর্তনের জন্য চেষ্টাকারীও কেউ থাকবে না। (সূরা আশ শূরা-৪৭)

Post a Comment

0 Comments