বিচার দিবসে কারো প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হবে না

        আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যা করছে এবং বলছে, তার সবকিছুই তিনি দেখছেন এবং শুনছেন। তিনি কোন কিছুই ভুলে যাবেন না। হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে শুরু করে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত শেষ যে মানুষটি জন্ম নেবে, অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্ত মানুষের বলা কথা ও কর্ম সম্পর্কে তিনি অবগত থাকবেন। তাঁর জানার ভিত্তিতে তিনি সমস্ত মানুষের বিচার করতে সম্পূর্ণ সক্ষম। কিন্তু তিনি তা করবেন না-মানুষ যেন নিজের কর্মের রেকর্ড ও চলমান ছবি দেখতে পায়, এ জন্য আল্লাহ তা'য়ালা যখনই কোন মানুষকে পৃথিবীতে প্রেরণ করেন, তখন তার সাথে দু'জন ফেরেস্তা নিয়োগ করেন। তাঁরা সেই মানুষের কথা ও কর্মসমূহ রেকর্ড করেন। আল্লাহর প্রতি কোন মানুষ যেন এই অভিযোগ আরোপ না করে যে, তিনি আমার প্রতি জুলুম করেছেন। কারণ মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ-এরা নিজেদের অপকর্মের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয় আর দোষ চাপিয়ে দেয় আল্লাহর ওপরে। বিপদ দেখলে আল্লাহকে ডাকতে থাকে আর বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করেই তাঁকে ভুলে যায়। এ জন্য মানুষ পৃথিবীর জীবনে যা কিছু করছে তার চলমান ছবি রাখা হচ্ছে, রেকর্ড রাখা হচ্ছে এবং কন্ঠ শব্দও রেকর্ড করা হচ্ছে। বিচার দিবসে চলমান ছবিতে যে যখন দেখতে পাবে, কোথায় কোন অবস্থায় নির্জনে একাকী সে কি ঘটিয়ে ছিল, কবে কোনদিন কাকে কি কথা বলেছিল-তখন তার পক্ষে কোন কিছুই অস্বীকার করা সম্ভব হবে না। সেদিন কি অবস্থার সৃষ্টি হবে মহান আল্লাহ তা শোনাচ্ছেন-

وَيَوْمَ نُسَيِّرُ الجِبَالَ وَتَرَى الْأَرْضَ بَارِزَةٌ وَحَشَرْنَا هُمْ فَلَمْ نُغَادِرُ مِنْهُمْ أَحَدًا - وَعُرِضُوا عَلَى رَبِّكَ صَفًّا لَقَدْ جِئْتُمُونَا كَمَا خَلَقْنَاكُمْ أَوَّلَ مَرَّةً بَلْ زَعَمْتُمْ الَّنْ نَجْعَلَ لَكُمْ مُوْعِداً - وَوُضِعَ الْكِتَابُ فَتَرَى الْمُجْرِمِينَ مُشْفِقِينَ مِمَّا فِيهِ وَيَقُولُونَ يوَيْلَتَنَا مَالِهذَا الْكِتَابُ لاَ يُغَادِرُ صَغِيرَةً وَلا كَبِيرَةً إِلا أَحْصَاهَا وَوَجَدُوا مَا عَمِلُوا حَاضِرًا - وَلَا يَظْلِمُ رَبُّكَ أَحَدًا -

        সেদিনের কথা চিন্তা করা প্রয়োজন যেদিন আমি পাহাড়গুলোকে চালিত করবো এবং তুমি পৃথিবীকে দেখবে সম্পূর্ণ অনাবৃত আর আমি সমগ্র মানবগোষ্ঠীকে এমনভাবে ঘিরে এনে একত্র করবো যে, (পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের মধ্য থেকে) একজনও অবশিষ্ট থাকবে না। এবং সবাইকে তোমার রব্ব-এর সামনে কাতারবন্দী করে পেশ করা হবে। (তখন বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাসীদেরকে বলা হবে) নাও দেখে নাও, তোমরা এসে গেছো তো আমার সামনে ঠিক তেমনিভাবে যেমনটি আমি তোমাদের প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলাম! তোমরা তো মনে করেছিলে আমি তোমাদের জন্য কোন প্রতিশ্রুত ক্ষণ নির্ধারিতই করিনি। আর সেদিন আমলনামা সামনে রেখে দেয়া হবে। সে সময় তোমরা দেখবে অপরাধীরা নিজেদের জীবন খাতায় যা লেখা আছে সে জন্য ভীত হচ্ছে এবং তারা বলছে, হায়! আমাদের দুর্ভাগ্য, এটা কেমন খাতা, আমাদের ছোট বড় এমন কোন কিছুই এখানে লেখা থেকে বাদ পড়েনি। তাদের যে যা কিছু করেছিল সবই নিজের সামনে উপস্থিত পাবে এবং তোমার রব্ব কারো প্রতি জুলুম করবেন না। (সূরা আল কাহ্ফ্ফ-৪৭-৪৯)

        হযরত আদম আলাইহিস্ সালাম থেকে নিয়ে কিয়ামতের পূর্বে শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত যেসব মানুষ পৃথিবীতে আগমন করবে, তারা মাতৃগর্ভ থেকে ভূমিষ্ঠ হয়ে পৃথিবীর আলো-বাতাসে মুহূর্তের জন্য নিঃশ্বাস গ্রহণ করলেও তাদের প্রত্যেককে পুনরায় সৃষ্টি করা হবে এবং সবাইকে একই সাথে একত্রিত করা হবে। কোথাও কেউ বাদ পড়বে না। পৃথিবীতে পঞ্চাশ বা একশজন মানুষকে একত্রে আসামী করে মামলা দায়ের করা হলে কোর্টে যখন তারা হাজিরা দেয়, তখন ... অনেক আসামীই উপস্থিত না থেকে অন্য কাউকে আদালতে পাঠিয়ে দেয়। মূল আসামীর পক্ষে আরেকজন হাজিরা দিয়ে আসে। বিচারক প্রত্যেক আসামীর চেহারা চিনে রাখতে পারেন না। এ জন্য আসামীগণ এ ধরনের কৌশল করে থাকে। আসামীদের নাম ধরে ডাকার সময় মূল আসামীর পরিবর্তে অন্য লোক তার উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। মাত্র দশজন বিশজন পঞ্চাশ জন আসামীর হাজিরার ক্ষেত্রে পৃথিবীর মানুষ বিচারককে এভাবে ধোকা দেয়া যায়, কিন্তু বিচার দিবসে আল্লাহর আদালতে এভাবে ধোকা দেয়া যাবে না। সেদিন কত শতকোটি মানুষ যে আল্লাহর আদালতে একত্রে দাঁড়াবে, তা কল্পনাও করা যায় না। কোন একজন মানুষও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে সমর্থ হবে না।

        সবাইকে আপন রব্ব আল্লাহ তা'য়ালার সামনে কাতারবন্দী হয়ে দাঁড়াতে হবে। পৃথিবীতে যারা বিচার দিবসের প্রতি অবিশ্বাস পোষণ করে সেদিন সম্পর্কে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতো, মৃত্যুর পরে পুনরায় সৃষ্টি করা অসম্ভব বলে ধারণা করতো, তাদেরকে বলা হবে, 'তোমরা যে বিষয়টির প্রতি অবিশ্বাস করতে, এখন তো দেখলে কিভাবে তা বাস্তবায়িত হলো! যে বিচার দিবস সম্পর্কে তোমরা তামাশা করতে, তোমাদের সেই তামাশাই আজ রূঢ় বাস্তবে পরিণত হয়েছে সেটা নিজের চোখে দেখে নাও।'

        এরপর ঐসব অবিশ্বাসীদের সামনে সেই কিতাব রাখা হবে, যে কিতাবে তাদের পৃথিবীর জীবনের যাবতীয় ঘটনা লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। কোথায় কোনদিন চার দেয়ালের মধ্যে নিভৃত কক্ষে নিজ দলীয় বা বিরোধী দলীয় প্রতিপক্ষকে হত্যা করার জন্য ষড়যন্ত্র করেছিল, কোনদিন কোন মুহূর্তে কোন নারীকে ধর্ষন করেছিল, কি অবস্থায় কোন ব্রান্ডের মদ পান করেছিল, কোন ফাইলে কলমের এক খোঁচা দিয়ে জাতিয় অর্থ আত্মসাৎ করেছিল, নির্দোষ প্রতিপক্ষকে আসামী বানানোর জন্য কোথায় কিভাবে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল, কোন টেবিলে বসে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মিথ্যা রিপোর্ট তৈরী করে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল, এ ধরনের অসংখ্য অপরাধের কোনকিছুই বাদ পড়েনি।

        অসংখ্য ক্রাইম রিপোর্ট সম্বলিত নিজের জীবনলিপি দেখে অপরাধীরা আযাব থেকে বাঁচার জন্য সমস্ত কিছু অস্বীকার করে বলবে, এসব কাজ আমরা একটিও করিনি। অপরাধীরা আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলবে। তারা তাদের অপরাধ মেনে নিতে অস্বীকার করবে। সাক্ষীদেরকে মিথ্যা বলবে এবং ক্রাইম রিপোর্ট সম্বলিত নিজের জীবনলিপির নির্ভুলতাও মেনে নেবে না। ফেরেস্তাদেরকে দোষারোপ করে বলবে, তারা মনগড়া রিপোর্ট রচিত করেছে, এসবের কোন কিছুই আমাদের দ্বারা ঘটেনি। তারপর সেই চলমান ছবি তাদের সামনে উত্থাপন করা হবে। অপরাধীরা দেখতে থাকবে পৃথিবীতে কোথায় তারা কি করেছিল এবং নিজের কন্ঠ শুনতে থাকবে, কবে কোনদিন কি বলেছিল। এরপর আল্লাহ আদেশ দেবেন, তোমাদের এসব মিথ্যা কথা বন্ধ করো এবং এখন দেখো তোমাদের নিজেদের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তোমাদের কৃতকর্মের কি বর্ণনা দেয়। আল্লাহ বলেন-

الْيَوْمَ نَخْتِمُ عَلَى أَفْوَاهِمْ وَتُكَلِّمُنَا أَيْدِيهِمْ وَتَشْهَدُ أَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ

        আজ আমি এদের মুখ বন্ধ করে দিচ্ছি, এদের হাত আমার সাথে কথা বলবে এবং এদের পা সাক্ষ্য দেবে এরা পৃথিবীতে কি উপার্জন করে এসেছে। (সূরা ইয়াছিন-৬৫)

        শুধু যে হাত ও পা-ই সাক্ষ্য দেবে তাই নয়-যে কন্ঠ দিয়ে আল্লাহর বিরুদ্ধে, আল্লাহর দেয়া বিধানের বিরুদ্ধে উচ্চস্বরে কথা বলেছে, শ্লোগান দিয়েছে, সেই কণ্ঠও তারই বিরুদ্ধে আল্লাহর আদেশে বিচারের দিনে সাক্ষ্য দিবে। আল্লাহ বলেন-

يَوْمَ تَشْهَدُ عَلَيْهِمْ الْسِنَتُهُمْ وَأَيْدِيهِمْ وَأَرْجُلُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْلَمُوْنَ - يَوْمَئِذٍ يُوَقِيهِمُ اللَّهُ دِينَهُمُ الْحَقِّ وَيَعْلَمُونَ أَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ الْمُبِينُ

        তারা যেন সেদিনের কথা ভুলে না যায় যেদিন তাদের নিজেদের কন্ঠ এবং তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ্য দেবে। সেদিন তারা যে প্রতিদানের যোগ্য হবে, তা আল্লাহ তাদেরকে পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে, আল্লাহই সত্য এবং সত্যকে সত্য হিসাবে প্রকাশকারী। (সূরা নূর-২৪-২৫)

        এ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি হাদীসে বলা হয়েছে, যেসব অপরাধী আল্লাহর সামনে দাঁড়িয়েও নিজের অপরাধের স্বীকৃতি দিবে না, তখন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ একে একে সাক্ষ্য দেবে যে, ঐগুলোর সাহায্যে কোথায় কি অবস্থায় কোন কাজের আঞ্জাম দেয়া হয়েছে। আখিরাতের জগত কোন আত্মিক জগৎ হবে না। বরং মানুষকে সেখানে দেহ ও আত্মার সমন্বয়ে পুনরায় ঠিক তেমনি জীবিত করা হবে যেমনটি বর্তমানে তারা এই পৃথিবীতে জীবিত রয়েছে। যেসব উপাদান, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং অণু-পরমাণুর সমন্বয়ে এই পৃথিবীতে তাদের দেহ গঠিত, কিয়ামতের দিন সেগুলোই একত্রিত করে দেয়া হবে এবং যে দেহে অবস্থান করে সে পৃথিবীতে কাজ করেছিল পূর্বের সেই দেহ দিয়েই তাকে উঠানো হবে। আল্লাহ বলেন-

حَتَّى إِذَا مَا جَاءُوهَا شَهِدَ عَلَيْهِمْ سَمْعَهُمْ وَأَبْصَارُ هُمْ وَجُلُودُهُمْ بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ - وَقَالُوا لِجُلُودهمْ لِمَ شَهِدْ تُمْ عَلَيْنَا - قَالُوا انْطَقَنَا اللهُ الَّذِي أَنْطَقَ كُلُّ شَيْءٍ وَهُوَ خَلَقَكُمْ أَوَّلَ مَرَّةٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ

        পরে যখন সবাই সেখানে পৌঁছে যাবে তখন তাদের কান, তাদের চোখ এবং তাদের দেহের চামড়া তারা পৃথিবীতে কি করতো সে সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে। তারা তাদের শরীরের চামড়াসমূহকে বলবে, তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিলে কেন? (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও চামড়া) জবাব দেবে, সেই আল্লাহই আমাদের বাকশক্তি দান করেছেন যিনি প্রতিটি বস্তুকে বাকশক্তি দান করেছেন। তিনিই তোমাদেরকে প্রথমবার সৃষ্টি করেছিলেন। আর এখন তোমাদেরকে তাঁর কাছেই ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। (সূরা হামীম সাজদাহ্-২০-২১)

        পৃথিবীতে আল্লাহর বিধানের মোকাবিলায় যারা বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করেছে, এরা বিচার দিবসেও নিজেদের অপরাধ ঢাকা দেয়ার জন্য মিথ্যা কথা বলবে। অনিবার্য শাস্তি ও তার ভয়াবহতা দেখে তা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য যখন তারা মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করবে, তখন তাদের পক্ষে আল্লাহর বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্ব ও অবিচার করার অভিযোগও তোলা মোটেও অসম্ভব নয়। এ জন্য পৃথিবীতে মানুষের জীবনলিপি-কণ্ঠস্বর রেকর্ড ও চলমান ছবি সংরক্ষণের ব্যবস্থাই শুধু করা হয়নি, পক্ষপাতহীন বিচারের লক্ষ্যে এমন এক ব্যবস্থা করা হয়েছে যে, মানুষ অপরাধ সংঘটনের সময় তার দেহের যেসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করেছিল, সেসব কিছুই যেন তার কৃতকর্মের ব্যাপারে সাক্ষ্য প্রদান করে। মহান আল্লাহ এমনিতেই মানুষের অসংখ্য অপরাধ ক্ষমা করে দেন। তারপরেও বান্দা যেন শাস্তিভোগ না করে, এ জন্য তিনি অত্যন্ত সুক্ষ্ম বিচার করবেন। সেদিন কারো প্রতি সামান্যতম জুলুম করা হবে না। যারা পৃথিবীতে সৎকাজ করেছে, তাদের সৎকাজের প্রতিদান দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে। আর যারা অসৎ কাজ করেছে, সেই অসৎ কাজের পরিমাণ অনুযায়ীই শাস্তি প্রদান করা হবে, এর জন্য কোন বর্ধিত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে না। আল্লাহ বলেন-

مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا وَمَنْ جَاءَ بِالسَّيِّئَةِ فَلَا يُجزى الا مِثْلَهَا وَهُمْ لَا يُظْلَمُونَ

        প্রকৃতপক্ষে যে ব্যক্তি (আল্লাহর দরবারে) সৎকাজ নিয়ে উপস্থিত হবে, তার জন্য দশগুণ বেশী পুরস্কার রয়েছে। যে পাপের কাজ নিয়ে আসবে তাকে ততটুকুই প্রতিফল দেয়া হবে, যতটুকু সে অপরাধ করেছে। আর কারো ওপরে জুলুম করা হবে না। (সূরা আন'আম-১৬০)

        'মিযান' আরবী শব্দ। যার অর্থ নিক্তি, দাঁড়িপাল্লা, পরিমাপক যন্ত্র, ওজনের মাধ্যম। কিন্তু ইসলামী শরীয়তের ভাষায় মিযান বলা হয় সেই 'পরিমাপক যন্ত্রকে যা দ্বারা পরকালে বিচার দিবসে মানুষের ভালো-মন্দ তথা নেকী ও গোনাহ ওজন করা হবে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, কোন বস্তুর আকার, আয়তন নেই, তা দাঁড়িপাল্লায় ওজন করা হবে কিভাবে ? মানুষের মনে এ ধরনের প্রশ্ন জাগা অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি হলো অজানাকে জানা। এই প্রশ্নের উত্তর দু'ধরনের হতে পারে। যথা (১) হাশরের ময়দানে নেকী ও গোনাহকে ওজন দেয়ার জন্যে মহাশক্তিশালী আল্লাহ রব্বুল আলামীন নেকী ও গোনাহের আকার, আয়তন প্রদান করতে পারেন। এ কথার সমর্থন হাদিসে পাওয়া যায়, 'বিচারে দিন মানুষ বড় বড় পাহাড়ের আকৃতিতে তাদের নেকসমূহ দেখতে পাবে।' (২) মানুষ পৃথিবীতে এক এক বস্তু ওজন করার জন্যে এক এক ধরনের পরিমাপক যন্ত্র আবিষ্কার করেছে।

        দাঁড়িপাল্লা দিয়ে নানা ধরনের ফসল, গোস্ত, মাছ ইত্যাদি ওজন করে। আবার পানি, তৈল, মধু, তথা তরল জিনিষ ওজন করার জন্য ভিন্ন ধরনের পরিমাপক ব্যবহার করা হয়। তরল পদার্থের ঘনত্ব পরিমাপ করা হয় ল্যাক্টোমিটার দিয়ে। তামপাত্রা ও হিমাংঙ্ক পরিমাপক করা হয় থার্মোমিটার দ্বারা। বায়ু বা বাতাসের চাপ পরিমাপ করা হয় বেরোমিটার দিয়ে।

        সুতরাং, হাশরের ময়দানে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ রব্বুল আলামীন তার বান্দাদের সওয়াব ও গোনাহ পরিমাপ করার জন্য এমন ধরনের পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার করবেন-যা পৃথিবীর মানুষ কোনদিনই কল্পনা করতে পারবেনা। প্রকৃত ব্যাপার এই যে, মানুষের সওয়াব ও গোনাহ অবশ্যই ওজন করা হবে। এখন কি দিয়ে কেমন করে ওজন দেয়া হবে সেটা আল্লাহই ভালো জানেন।

        পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই এবং প্রত্যেক মানুষের কাছে পরিমাপকযন্ত্র হলো ইনসাফ ও ন্যায়ের প্রতীক। আবহমান কাল থেকেই পৃথিবীতে নানা পদ্ধতির পরিমাপকযন্ত্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কম্পিউটার আবিষ্কার হবার পরে তার ভেতরেও পরিমাপের পদ্ধতি সংযোজন করা হয়েছে। পৃথিবীতে মানুষ কোন বস্তুর ওজন জানার জন্য এবং নানা ধরনের বস্তুর ক্রয়-বিক্রয়ের সময় এই পরিমাপক যন্ত্র ব্যবহার এ জন্য করে যে, তারা যেন না ঠকে। বিচার দিবসেও আল্লাহ তা'য়ালা মানুষের যাবতীয় সৎ ও অসৎ কর্মসমূহ ওজন করবেন।

        যে মিযান বা দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে, তা কোন ধরনের দাঁড়িপাল্লা বা পরিমাপকযন্ত্র হবে, সে সম্পর্কে মানুষের পক্ষে অনুমান করা কষ্টকর। আধুনিক বিজ্ঞান অত্যন্ত দ্রুত শত শত কোটি টন জিনিস ওজন করার জন্য অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির পরিমাপকযন্ত্র আবিষ্কার করেছে। যে মহাবিজ্ঞানী আল্লাহ তা'য়ালা তাঁর বান্দাকে বাতাস, গ্যাস ও তাপ ওজন করার মতো জ্ঞান দান করেছেন, তিনি মানুষের সৎ ও অসৎ গুণাবলীর সঠিকভাবে পরিমাপ করার জন্য এমন বিশেষ ধরনের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করবেন, যা সম্পর্কে মানুষ কল্পনাও করতে সক্ষম নয়। এই পরিমাপক যন্ত্রের নাম পবিত্র কোরআনে দাঁড়িপাল্লা হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মানুষের কাছে সহজবোধ্য করার জন্যই দাঁড়িপাল্লা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন-

وَنَضَعُ الْمَوَازِينَ الْقِسْطَ لِيَوْمِ الْقِيمَةِ فَلَا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَإِنْ كَانَ مِثْقَالَ حَبَّةٍ مِّنْ خَرْدَلٍ أَتَيْنَا بِهَا وَكَفَى بِنَا حَاسِبِيْنَ

        কিয়ামতের দিন আমি যথাযথ ওজন করার দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করবো। ফলে কোন ব্যক্তির প্রতি সামান্যতম জুলুম হবে না। যার তিল পরিমাণও কোন কর্ম থাকবে তাও আমি সামনে আনবো এবং হিসাব করার জন্য আমি যথেষ্ট। (সূরা আল আম্বিয়া-৪৭)

        সেদিন আল্লাহর সুবিচারের মানদন্ডে ওজন ও সত্য উভয়ই সমার্থবোধক হবে। সত্য ব্যতিত সেদিন অন্য কোন জিনিসেই ওজন পরিপূর্ণ হবে না এবং ওজন ছাড়া কোন জিনিসই সত্য বলে বিবেচিত হবে না। যার কাছে যত সত্য থাকবে, সে ততটা ওজনদার হবে এবং সিদ্ধান্ত যা-ই হবে তা ওজন হিসাবে ও ওজনের দৃষ্টিতেই হবে। অপর কোন জিনিসের বিন্দুমাত্র মূল্য স্বীকার। করা হবে না। ইসলাম বিরোধিদের জীবন পৃথিবীতে যত দীর্ঘ হোক না কেন, যত শানশওকতপূর্ণ ও বাহ্যিক কীর্তিপকলাপে পরিপূর্ণ হোক না কেন, আল্লাহর পরিমাপকযন্ত্রে তার কোন ওজনই হবে না। মৃত্যুর পরে তার জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে মহাআড়ম্বরে শোক প্রকাশ-প্রচার মাধ্যমে তার কীর্তিগাঁথা প্রচার, জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত করে রাখা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন, তোপধ্বনীর মাধ্যমে কবরে অবতরণ, এসবের কোন মূল্যই আল্লাহ দিবেন না।

        যে ব্যক্তি পৃথিবীতে কুলি-মজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেছে, বাঘের বা সাপের কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছে, তারপর তার লাশ বাঘের পেটে হজম হয়ে গিয়েছে, সে যদি আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে থাকে, আল্লাহর কাছে তার ওজন হবে অপরিসীম এবং তার মর্যাদা হবে বিরাট। পৃথিবীতে জাঁকজমকের সাথে চলাফেরা করেছে অথচ আল্লাহর বিধান অনুসরণ করেনি, বিচার দিবসে সে ওজনদার হবে না। সেদিন শুধু তারাই ওজনদার হবে, পৃথিবীতে যারা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করেছে। আল্লাহ বলেন-

وَمَنْ خَفَّتْ مَوَازِينُهُ فَالْئِكَ الَّذِينَ خَسِرُوا أَنْفُسَهُمْ بِمَا كَانُوا بِأَيْتِنَا يَظْلِمُونَ

        আর ওজন ও পরিমাপ সেদিন নিশ্চিতই সত্য-সঠিক হবে। যাদের পাল্লা ভারী হবে, তারাই কল্যাণ লাভ করবে আর যাদের পাল্লা হাল্কা হবে, তারা নিজেদেরকে মহাক্ষতির সম্মুখীন করবে। কারণ তারা আমার আয়াতের সাথে জালিমের ন্যায় আচরণ করছিল। (আ'রাফ-৯) আল্লাহর বিধান অনুসরণ করে না, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধাবোধও অন্তরে নেই, নামাজ-রোজা আদায় করার কোন প্রয়োজন অনুভব করে না। কেউ কেউ হজ্জ আদায় করে এ জন্য যে, নির্বাচন এলে নামের পূর্বে 'আল হাজ্জ' শব্দটি ব্যবহার করে ধর্মভীরু মানুষদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবার জন্য। এদের মধ্যে অনেকে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছে। অর্থ, প্রভাব-প্রতিপত্তির জোরে এরা দেশের বিশিষ্ট নাগরিকে পরিণত হয়েছে। সাধারণ লোকজন এদেরকে মূল্য দিয়ে থাকে, সম্মান-মর্যাদা দেয়। মহান আল্লাহর আদালতে বিচার দিবসে এদের কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ বলেন-

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُمْ بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالاً - الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الحيوة الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا - أُولَئِكَ الَّذِينَ كَفَرُوا بِأَيْتِ رَبِّهِمْ وَلِقَائِهِ فَحَبِطَتْ أَعْمَا لَهُمْ فَلَا نُقِيمُ لَهُمْ يَوْمَ الْقِيمَةِ وَزْنًا -

        হে রাসূল! এদেরকে বলো, আমি কি তোমাদের বলবো নিজেদের কর্মের ব্যাপারে বেশী ব্যর্থ ও ক্ষতিগ্রস্থ কারা? সে লোকগুলো তারা, যারা পৃথিবীর জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সংগ্রাম সব সময় সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত থাকতো এবং যারা মনে করতো যে, তারা সব কিছু সঠিক করে যাচ্ছে। এরা এমন সব লোক যারা নিজেদের রব্ব-এর নিদর্শনাবলী মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাঁর সামনে উপস্থিত হবার ব্যাপারটি বিশ্বাস করেনি। তাই তাদের সমস্ত কর্ম নষ্ট হয়ে গিয়েছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোন গুরুত্ব দেয়া হবে না। (কাহ্ফ-১০৩-১০৫)

        অর্থাৎ যাদের সমস্ত প্রচেষ্টা ও সাধনা পৃথিবীর জীবনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তারা যা কিছুই করেছে আল্লাহর প্রতি সম্পর্কহীন হয়ে ও আখিরাতের চিন্তা বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীতে অর্থ-বিত্ত, ঐশ্বর্য, সম্মান, মর্যাদা, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের জন্যই করেছে। পৃথিবীর জীবনকেই তারা একমাত্র জীবন মনে করেছে। পৃথিবীর জীবনে সফলতাকেই তারা নিজেদের জীবনের উদ্দেশ্যে পরিণত করেছিল। এরা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিলেও তাঁর সন্তুষ্টি কোন কর্মের মধ্যে নিহিত এবং তাঁর সামনে বিচার দিবসে দাঁড়াতে হবে, সমস্ত কাজের হিসাব দিতে হবে, এ কথা তারা মনে স্থান দেয়নি। তারা নিজেদেরকে সবচেয়ে বড় জ্ঞানী, সম্মান ও মর্যাদা লাভের যোগ্য একজন মনে করতো। এরা পৃথিবীর চারণ ভূমি থেকে একমাত্র নিজেদের স্বার্থোদ্ধার ব্যতিত অন্য কোন কাজ করতো না।

        বিচার দিবসের দিন প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিগত গুণাবলীর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। যে ব্যক্তি কোন জুলুমের বোঝা বহন করে নিয়ে যাবে, সে আল্লাহর অধিকারের বিরুদ্ধে জুলুম করুক বা আল্লাহর বান্দাদের অধিকারের বিরুদ্ধে অথবা নিজের নক্সের বিরুদ্ধে জুলুম করুক না কেন, যে কোন অবস্থায়ই সেসব কর্ম তাকে নিকৃষ্ট পরিণতি থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। বিচার দিবসের দিনে সমস্ত মানুষ যখন মহান আল্লাহর মহাপ্রতাপ দেখবে, তখন তাদের মাথা আপনা আপনিই ঝুঁকে পড়বে। আল্লাহ বলেন-

وَعَنَتِ الْوُجُوهُ لِلْحَيِّ الْقَيُّوْمِ وَقَدْ خَابَ مَنْ حَمَلَ ظُلْمًا وَمَنْ يَعْمَلْ مَنَ الصَّلِحْتِ وَهُوَ مُؤْ مِنْ فَلَا يَخْفُ ظُلْمًا وَلَا هَضْمًا -

        লোকদের মাথা চিরঞ্জীব ও চির প্রতিষ্ঠিত সত্তার সামনে ঝুঁকে পড়বে, সে সময় যে জুলুমের গোনাহের ভার বহন করবে সে ব্যর্থ হবে। আর যে ব্যক্তি সৎকাজ করবে এবং সেই সাথে সে মুমিনও হবে তার প্রতি কোন জুলুম বা অধিকার হরণের আশঙ্কা নেই। (ত্বা-হা-১১১-১১২)

        অনেক মানুষ প্রশ্ন তোলে, পৃথিবীতে অমুসলিমগণ যে সৎকর্মসমূহ করে অর্থাৎ তাদের অনেকে অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কর্ম করে, দান করে, তাদের দ্বারা অসংখ্য মানুষ উপকৃত হয় এদেরকে বিচার দিবসের দিনে কি ধরনের প্রতিফল দেয়া হবে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা যেতে পারে যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অবশ্যই তাদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকেন। তিনি রাহমান ও রাহীম। তিনি কারো সৎকর্ম বৃথা যেতে দেন না। সৃষ্টিজগৎ ব্যাপী এবং এই পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার জন্য প্রতি মুহূর্তে তিনি রাহমত বর্ষণ করছেন, এগুলো তো শুধুমাত্র ঈমানদারগণই ভোগ করছে না, তারাও এগুলো ভোগ করছে। শুধু তাই নয়, এই পৃথিবীতে তাদের কর্মের বিনিময়ে আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে এমন অসংখ্য দুর্লভ নিয়ামত ভোগ করার সুযোগ করে দিয়েছেন, যা তিনি ঈমানদারকে দেননি। আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে না, স্বীকার করলেও শিক্কক করে, তাদের সৎকাজের বিনিময়ে এই পৃথিবীতে আল্লাহ তা'য়ালা তাদেরকে বাড়ি, গাড়ি, অঢেল সম্পদ, সম্মান-মর্যাদা, যশ-খ্যাতি দান করেছেন, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিয়ামতসমূহ ভোগ করার সুযোগ প্রদান করেছেন, তাদের মৃত্যুর পরেও তাদের কাউকে কাউকে পরম শ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করেছেন, এসব তো তারা তাদের সৎকাজের বিনিময় হিসাবে লাভ করেছে। একটি বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে যে, যে কোন সৎকাজ কবুলের ও আখিরাতে তার বিনিময় লাভের পূর্ব শর্ত হলো, ঈমানদার হতে হবে। ঈমানহীন কোন সৎকাজের বিনিময় বিচার দিবসে পাওয়া যাবে না-এই পৃথিবীতেই তার বিনিময় দিয়ে দেয়া হবে।

        এদের বিপরীতে অধিকাংশ ঈমানদারদের জীবনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে দেখা যায়, মানুষকে আল্লাহর পথের দিকে আহ্বান জানাতে গিয়ে এদেরকে অবর্ণনীয় অত্যাচার সহ্য করতে হয়, জেলের অন্ধকার কুঠুরিতে আবদ্ধ থাকতে হয়, সহায়-সম্পদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়। অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটাতে হয়, জীবন-যাপনের তেমন কোন উপকরণ থাকে না, মনের একান্ত বাসনা আল্লাহর ঘরে গিয়ে আল্লাহকে সেজদা দিবে, অর্থাভাবে সে অদম্য কামনা বুকে নিয়েই কবরে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির জন্য উত্তম পোষাক, উৎকৃষ্ট খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারে না, নিজের মেধাবী পুত্র বা কন্যাকে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষা দিতে পারে না। মাথা গোঁজার জন্য এক টুকরো যমীন কিনতে পারে না, রোগাক্রান্ত হলে তেমন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারে না।

        এরপরেও তারা সমস্ত পরিস্থিতি হাসিমুখে মোকাবেলা করে আল্লাহর দরবারে শোকর আদায় করে। নিজেকে অপরাধী মনে করে সেজদায় পড়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে। পৃথিবীতে ধন-সম্পদ না চেয়ে আল্লাহর দরবারে পরকালের কল্যাণ কামনা করে। আল্লাহ তা'য়ালা ঈমানদারকে কিয়ামতের ময়দানে তাদের কর্মের সর্বোত্তম বিনিময় দান করবেন, সেদিন কারো প্রতি সামান্য অবিচার করা হবে না। সবাই যার যার অধিকার বুঝে পাবে।

        প্রতিদান ও সুবিচারের বেশ কয়েকটি রূপ হতে পারে। প্রতিদান লাভের অধিকারী ব্যক্তিকে প্রতিদান না দেয়াও অবিচার এবং জুলুম। প্রতিদান লাভকারী যতটা প্রতিদান লাভের উপযুক্ত তার থেকে কম দেয়াও অবিচার ও জুলুম। যে ব্যক্তি শাস্তি লাভের যোগ্য নয়, তাকে শাস্তি দেয়াও অবিচার এবং জুলুম। আবার যে শাস্তি লাভের যোগ্য তাকে শাস্তি না দেয়া এবং যে কম শাস্তি লাভের যোগ্য, তাকে অধিক শাস্তি দেয়াও জুলুম ও অবিচার।

        জালিম শাস্তি পাচ্ছে না, নির্দোষ অবস্থায় খালাস পাচ্ছে আর মজলুম তা অসহায়ের মতো নীরবে চেয়ে চেয়ে দেখছে, এটাও অবিচার ও জুলুম। একজনের অপরাধের কারণে অন্যজন শাস্তি লাভ করছে, একের অপরাধ অন্যের ওপর চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, এসবই জুলুম আর অবিচারের কারণে হয়ে থাকে। বিচার দিবসে এসবের কোনকিছুই ঘটবে না। মহান আল্লাহ কারো প্রতি কোন ধরনের জুলুম করবেন না। বিচার দিবসের দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে ভাষণে বলা হবে-

فَالْيَوْمَ لا تُظْلَمُ نَفْسٌ شَيْئًا وَلَا تَجْزَوْنَ إِلَّا مَا كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

        আজ কারো প্রতি তিলমাত্র জুলুম করা হবে না এবং যেমন কাজ তোমরা করে এসেছো ঠিক তারই প্রতিদান তোমাদের দেয়া হবে। (সূরা ইয়াছিন-৫৪)

Post a Comment

0 Comments